প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / তাকলীদের হাকীকতঃ একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা [পর্ব-২]

তাকলীদের হাকীকতঃ একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা [পর্ব-২]

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

১ম পর্ব পড়ে নিন

তাকলীদের আভিধানিক অর্থ

আভিধানিক বলা হয়, যা অভিধানবীদগণ নির্ধারণ করে থাকেন। আর পারিভাষিক অর্থ বলা হয়, যা কোন কোন জাতি বা এলাকা বা বিশেষজ্ঞগণ নির্ধারণ করে থাকেন।

কখনো এমন হতে পারে যে, অভিধানবিদগণ এক অর্থে নির্ধারণ করেছেন, কিন্তু নির্দিষ্ট কউমের কাছে এর অর্থ ভিন্ন হয়ে থাকে। এমনিভাবে বিষয় পরিবর্তন হওয়ার দ্বারাও অর্থ পাল্টে যায়। যেমন সালাত অর্থ নিতম্ব হেলানো। পরিভাষায় বলা হয়, বিশেষ আরকান আদায় করা। আজান অর্থ ঘোষণা করা, পরিভাষায় বিশেষ শব্দ বলা, রোযার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। আর পরিভাষায় খানা-পিনা ও সহবাস থেকে বিরত থাকা সুবহে সাদিক থেকে নিয়ে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত নিয়তের সাথে। হজ্বের আভিধানিক অর্থ ইচেছ করা। আর পারিভাষিক অর্থ বিশেষ দিনে বিশেষ কাজ সম্পন্ন করা। জিহাদের আভিধানিক অর্থ চেষ্টা করা মেহনত করা। পরিভাষায় বলা হয়, আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করার জন্য যুদ্ধ করা।

বিষয় ভিন্ন হয়ে গেলে অর্থ পাল্টে যাচ্ছে, যেমন কালিমা শব্দ। নাহুবীদদের কাছে এক অর্থ। আক্বিদা বিশেষজ্ঞদের কাছে আরেক অর্থ।

গায়রে মুকাল্লিদরা যত স্থানেই আমাদের উপর অভিযোগ উত্থাপন করে থাকে, সকল ক্ষেত্রে এ সকল পরিভাষার পার্থক্য না বুঝার কারণে। এটি বুঝলে আমাদের আকাবীরদের উপর যত অভিযোগ আছে সব ক’টির জবাব দেয়া সহজ হয়ে যাবে।

যেমন হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহঃ তার এক কিতাবে দুআ হিসেবে লিখেছেন যে, “আলী মশকিল কুশা কি ওয়াস্তে তথা বিপদ থেকে উদ্ধারকারী আলীর উসীলায়”।

ব্যাস, গায়রে মুকাল্লিদরা এর পিছনে লেগে গেছে। হযরত আলীকে বিপদ থেকে উদ্ধারকারী বলাতো শিরক। কিন্তু ওরা ফন বুঝতে পারেনি। আক্বিদার ফনে মশকিলকুশার এক অর্থ আর তাসাউফ শাস্ত্রে মাশকিল কুশার ভিন্ন অর্থ। আকাইদ ফনে মশকিল কুশা অর্থ হল বিপদ থেকে উদ্ধার করা। আর তাসাউফ ফনে মাশকিল কুশা অর্থ হল, যিনি গোমরাহী থেকে হেদায়েদের পথে পথ প্রদর্শন করে থাকে। আর তাকে নাপাক পথ থেকে পাক পথে নিয়ে আসে, এবং মনের অবস্থাকে পরিস্কার করে দেয়, তাকে বলা হয় মশকিল কুশা। এটি অনেক মশকিল কাজ। কিন্তু শায়েখ যেহেতু এ কাজ করে দিয়েছেন। তাই শায়েখকে মশকিল কুশা বলা হয়ে থাকে। যেমন আমরা বলে থাকি যে, উস্তাদ আমি ফেঁসে গিয়েছিলাম। তারপর আপনার বুঝানোর কারণে আমি উদ্ধার পেলাম। এখানেও তাই হয়েছে। এ হিসেবে শিরক হল কিভাবে?

তাকলীদের আভিধানিক অর্থ হল,  جعل القلادة فى العنق তথা গর্দানে কালাদা পরিধান করার নাম তাকলীদ। কালাদা অর্থ দু’টি। যথা-১- রশি। ২- হাড়।

উভয় অর্থ হাদীসে বিদ্যমান।

রশি অর্থ নিলে তা বিদ্যমান বুখারীর ১ম খন্ডের ২৩০ নং পৃষ্ঠায় এসেছে যে,

باب من قلد القلائد بيده এ অধ্যায়ে হাদীস এসেছে যে, فقالت عائشة رضي الله عنها ليس كما قال ابن عباس أنا فتلت قلائد هدي رسول الله صلى الله عليه و سلم بيدي ثم قلدها رسول الله صلى الله عليه و سلم بيديه তখন হযরত আয়শা রাঃ বললেনঃ ইবনে আব্বাস যেমন বলেছেন বিষয়টি তেমন নয়, আমি রাসূল সাঃ এর হাদীর রশি আমার নিজ হাতে পাকিয়ে দিতাম। তারপর তা রাসূল সাঃ নিজ হাতে তা পরিয়ে দিতেন। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১৬১৩}

তাহলে এখানে তাকলীদ অর্থ আসল, রশি।

অপরদিকে বুখারীর ২ খন্ডের ৮৭৪ নং পৃষ্ঠায় এসেছে যে, হযরত আয়শা রাঃ এর বোন আসমা রাঃ থেকে হাড় ধার করে নিয়ে গিয়েছিলেন রাসূল সাঃ এর সাথে বনীল মুস্তালিকের যুদ্ধে। ফিরার পথে হাড়টি হারিয়ে যায়। এ ব্যাপারে হযরত আয়শা রাঃ বলেন- هَلَكَتْ قِلَادَةٌ لِأَسْمَاءَ তথা আসমার [কালাদাটি] হাড়টি হারিয়ে গেছে। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫৮৮২, ৪৩০৭}

এখানে হাড়কে কালাদা বলা হয়েছে।

গায়রে মুকাল্লিদরা বলে থাকে যে, আমরা কি পশু নাকি যে, আমরা গলায় রশি দিব কেন?

আসলে তারা কালাদার দুই অর্থ বিষয়ে অজ্ঞ। দুই অর্থ জানলে এমন বোকামীসূলভ মন্তব্য করতো না। যেমন মওত। রাসূল সাঃ মওতকে কবজ বলেছেন।

إِنَّ اللَّهَ قَبَضَ أَرْوَاحَكُمْ حِينَ شَاءَ ، وَرَدَّهَا إِلَيْكُمْ حِينَ شَاءَ

আর কবজের অর্থ দুটি। যথা খুরুজ তথা বেরিয়ে যাওয়া। আরেক অর্থ হল কাবজ তথা আবদ্ধ করা। কাবজ আসে বাসতুন তথা বিস্তৃতির বিপরীতে। হাত ছড়িয়ে দেয়া বাসতুন। আর মুঠ করে ফেলা কাবজুন। কবজুন এর আরেক অর্থ খুরুজ। যেমন এক হাত থেকে বেরিয়ে অন্য হাতে কোন কিছু চলে যাওয়া। কাসেম নানুতবী রহঃ উভয় অর্থ জানতেন। তাই তিনি বলেছেন যে, সাধারণ মুসলমানদের আত্মা খুরুজ হযে যায়, আর নবীদের আত্মা হাবস তথা আবদ্ধ হয়। আর মামাতীরা জানে একটি অর্থ। তাই তারা একটি অর্থই বলে থাকে।

গায়রে মুকাল্লিদ যত বক্তৃতা আপনারা তাকলীদের ব্যাপারে শুনে থাকবেন, ওরা কখনোই তাকলীদের দুই অর্থ বলবে না। কখনোই বলবে না যে, তাকলীদের অর্থ হাড়ও। সর্বদা বলবে একটি তথা রশি। যেমন মামাতীরা মওতের অর্থ কখনোই দুটি করবে না। সব সময় বলবে খুরুজ। কখনোই কবজের আরেক অর্থ হাবস বলবে না।

রঈসুল মুনাজিরীন মুহাম্মদ আমীন সফদর রহঃ বলেন। ইনসানওয়ালা অর্থ নেয়। আর জানোয়ার জানোয়ারওয়ালা অর্থ নেয়।

তাকলীদের পারিভাষিক অর্থ

জামেউল উলুম ফি ইসতিলাহাতিল ফুনুনে বিদ্যমান তাকলীদের পারিভাষিক অর্থ হল,

التقليد : إتباع الإنسان غيره فيما يقول بقول أو بفعل معتقدا للحقيقة فيه من غير  نظر وتأمل في الدليل كان هذا المتتبع جعل قول الغير أو فعله قلادة في عنقه

তথা তাকলীদ বলা হয়, কোন মানুষ আরেকজনের কথা বা কর্মের ইত্তিবা করা এ বিষয়ে লোকটি সঠিক বিশ্বাস করে, দলীলের দিকে দৃষ্টি ও চিন্তা না করেই। যেন এ ইত্তিবাকারী অন্যের কথা বা কাজটিকে নিজের কাঁধে হাড় হিসেবে পরিধান করে নিয়ে নিয়েছে।

হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহঃ তাকলীদের সংজ্ঞা করেছেনঃ কারো কথা এ হিসেবে মেনে নেয়া যে, লোকটি দলীলের ভিত্তিতে বলে দিবে। কিন্তু তার থেকে দলীলের বিষয়ে কোন তাহকীক করা হয় না।

তাহলে উক্ত দুই সংজ্ঞা দ্বারা আমরা বুঝতে পারছি যে, কারো অনুসরণ করা তার কাছে দলীল চাওয়া ছাড়া। যদিও তার কাছে দলীল বিদ্যমান আছে। এক হল দলীল নেই। আরেক হল দলীল না চাওয়া। তাকলীদ হল, দলীল আছে, কিন্তু মুকাল্লিদ সেই দলীল জানতে চায় না।

তাকলীদের একটি পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা

তাকলীদ হল, মাসায়েলে ইজতিহাদিয়্যাতে, গায়রে মুজতাহিদ ব্যক্তির এমন মুজতাহিদের মুফতাবিহা মাসায়েলকে দলীল চাওয়া ছাড়া মেনে নেয়া, যে ব্যক্তির মুজতাহিদ হওয়া শরয়ী দলীল দ্বারা প্রমানিত, এবং তার মাযহাব উসুলান ও ফুরূআন সংকলিত হয়ে মুকাল্লিদের কাছে আমল হিসেবে মুতাওয়াতির সূত্রে পৌঁছেছে।

মাসায়েলে ইজতিহাদিয়্যাহ

মাসায়েলে ইজতিহাদিয়্যাহ বলে তাকলীদের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। মাসায়েল দুই প্রকার হয়ে থাকে। যথা-১- মাসায়েলে ওয়াজেহা তথা সুষ্পষ্ট মাসায়েল। ২- মাসায়েলে গায়রে ওয়াজেহা তথা অস্পষ্ট মাসায়েল।

ওয়াজেহ মাসায়েলের মাঝে তাকলীদ হয় না। চাই তা কুরআনে বর্ণিত হোক। বা হাদীসের মাঝে হোক।

মাসায়েলে গায়রে ওয়াজেহা পাচ প্রকার। যথা-

১-মাসায়েলে গায়রে মানসূসাহ।

তথা মাসআলা বিদ্যমান কিন্তু এর উপর কুরআনের আয়াত বা হাদীস নেই। এর মূলনীতি কুরআনে বা হাদীসে বিদ্যমান। কিন্তু মাসআলাটি কুরআন বা হাদীসে বিদ্যমান নেই।

কুরআন থেকে উদাহরণ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ [٥:٩٠]

হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কার্য বৈ তো নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাক-যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। {সূরা মায়িদা-৯০}

এ আয়াতে মদকে অপবিত্র হওয়া বর্ণনা করা হয়েছে। তাই অটোমেটিক তা হারাম হওয়া এমনিতেই বুঝে এসে গেছে। কারণ, কোন বস্তু নাপাক হলে, তা হারাম হয়ে থাকে, কিন্তু হারাম হলেই উক্ত বস্তু নাপাক হওয়া শর্ত নয়। হারাম ও নাপাকের মাঝে আম খাস মুতলাকের নিসবত। যেমন সুদের টাকা হারাম। কিন্তু হারাম টাকা নাপাক নয়। চুরি কলম হারাম। কিন্তু কলম নাপাক নয়।

হারাম তিন কারণে হতে পারে। যথা-১- নাপাক হওয়ার কারণে। যেমন প্র¯্রাব-পায়খানা, গোবর-মদ ইত্যাদি। ২- ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য। যেমন বিষ। ৩- সম্মানার্থে। যেমন- মানুষ।

সুতরাং আমভাবে হারাম হলেই তাকে নাপাক হওয়ার হুকুমে নেয়া যাবে না। কিন্তু যে বস্তু নাপাক হয়, তা অবশ্যই হারাম হবে।

এ আয়াতের মাঝে মদকে নাপাক বলা হয়েছে। এর দ্বারা মদ হারাম একথা বুঝা গেল। কিন্তু ভাং বা গাঁজার কি হুকুম? এ কথার উল্লেখ আয়াতের মাঝে নেই। কিন্তু উসুল রয়েছে। আয়াতে খমর শব্দ বলা হয়েছে। খমর অর্থ হল মুখামারাতুল আকল তথা যা আকলকে ঢেকে দেয়। সুতরাং প্রত্যেক ঐ বস্তু যা আকলকে ঢেকে দেয়, তাই হারাম হবে।

মুজতাহিদ ইল্লত বের করেছেন আয়াত থেকে। তারপর ভাং জাতীয় বস্তুর হুকুম বলে দিয়েছেন, যা সরাসরি কুরআনে বর্ণিত নয়।

হাদীস থেকে উদাহরণ

أَبَا هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ يَقُولُ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا وَقَعَ الذُّبَابُ فِي شَرَابِ أَحَدِكُمْ فَلْيَغْمِسْهُ ثُمَّ لِيَنْزِعْهُ فَإِنَّ فِي إِحْدَى جَنَاحَيْهِ دَاءً وَالْأُخْرَى شِفَاءً

হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেনঃ যখন কারো পান পাত্রে মাছি পড়ে যায়, সে যেন তাকে আরেক বার ডুবিয়ে নেয়, তারপর তাকে ফেলে দেয়। কেননা, তার এক ডানায় থাকে রোগ আর আরেক ডানায় থাকে অষুধ। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩৩২০}

এখানে লক্ষ্যণীয় দুটি বিষয়। এক হল মাছি পড়লে তাকে ডুবিয়ে নিবে। আর উক্ত খানা খেতে কোন সমস্যা নেই। জায়েজ আছে খাওয়া।

এখন প্রশ্ন হল, মাছি ফেলে দিয়ে খানা খাওয়া জায়েজ কেন? এর কারণ ইমাম আবু হানীফা রহঃ বের করেছেন যে, মাছি এমন প্রাণী যার রগের মাঝে প্রবাহমান রক্ত নেই। তাই এটি পাত্রে পড়লে পাত্রের খাবার নাপাক করে না। তাই প্রত্যেক ঐ বস্তু যার মাঝে প্রবাহমান রক্ত নেই তার হুকুমও মাছির মতই হবে। অর্থাৎ এরকম প্রাণী খাবারে পরে গেলে তা ফেলে দিয়ে উক্ত খানা খাওয়া জায়েজ হবে। যেমন, পিপড়া, মাছ ইত্যাদি।

পার্থক্য হল মাছির কথা হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। আর মাছ ও পিপড়ার কথা স্পষ্ট নেই। যা মুজতাহিদ ইজতাহিদ করে বের করেছেন।

২- মাসায়েলে মানসূসায়ে মুতাআরিজা

তথা মাসআলা কুরআন বা হাদীসে বিদ্যমান। কিন্তু পরস্পর বিরোধী বর্ণনা নসের মাঝে রয়েছে।

কুরআন থেকে উদাহরণ

وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا يَتَرَبَّصْنَ بِأَنفُسِهِنَّ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا ۖ فَإِذَا بَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا فَعَلْنَ فِي أَنفُسِهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ ۗ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ [٢:٢٣٤]

আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে এবং নিজেদের স্ত্রীদেরকে ছেড়ে যাবে, তখন সে স্ত্রীদের কর্তব্য হলো নিজেকে চার মাস দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়ে রাখা। তারপর যখন ইদ্দত পূর্ণ করে নেবে, তখন নিজের ব্যাপারে নীতি সঙ্গত ব্যবস্থা নিলে কোন পাপ নেই। আর তোমাদের যাবতীয় কাজের ব্যাপারেই আল্লাহর অবগতি রয়েছে। {সূরা বাকারা-২৩৪}

এ আয়াত দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, মহিলার স্বামী মারা গেলে সে ইদ্দত পালন করবে চার মাস দশ দিন।

অথচ অন্য আয়াতে এসেছে

وَالَّذِينَ يُتَوَفَّوْنَ مِنكُمْ وَيَذَرُونَ أَزْوَاجًا وَصِيَّةً لِّأَزْوَاجِهِم مَّتَاعًا إِلَى الْحَوْلِ غَيْرَ إِخْرَاجٍ ۚ فَإِنْ خَرَجْنَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِي مَا فَعَلْنَ فِي أَنفُسِهِنَّ مِن مَّعْرُوفٍ ۗ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ [٢:٢٤٠

আর যখন তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে তখন স্ত্রীদের ঘর থেকে বের না করে এক বছর পর্যন্ত তাদের খরচের ব্যাপারে ওসিয়ত করে যাবে। অতঃপর যদি সে স্ত্রীরা নিজে থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে সে নারী যদি নিজের ব্যাপারে কোন উত্তম ব্যবস্থা করে, তবে তাতে তোমাদের উপর কোন পাপ নেই। আর আল্লাহ হচ্ছেন পরাক্রমশালী বিজ্ঞতা সম্পন্ন। {সূরা বাকারা-২৪০}

এ আয়াত প্রমাণ করছে যে, স্বামী মৃত্যুবরণ করলে স্ত্রীর ইদ্দত হল এক বছর।

এখন যদি কেউ হাদীস রেখে শুধু কুরআন দেখে, তাহলে সে বলে বসবে যে, কুরআনের মাঝে বৈপরীত্ব আছে। তাই কুরআন গ্রহণীয় নয় [নাউজুবিল্লাহ]।

এ বিষয়ে মুজতাহিদগণ এসে বলে দিয়েছেন যে, স্বামী মৃত্যুবরণকৃত মহিলার ইদ্দত সম্পর্কিত বাকারা ২৪০ নং আয়াত মানসুখ তথা রহিত। কেননা, তা আগে নাজিল হয়েছিল। আর ২৩৪ নং আয়াত নাসেখ কেননা, তা পরবর্তীতে নাজিল হয়েছে। সুতরাং আর কোন বৈপরীত্ব বাকি নেই। এ বৈপরীত্ব দূর করেছেন মুজতাহিদ।

হাদীস থেকে দলীল

তিরমিজীর সৌন্দর্য হল, উভয় প্রকারের হাদীস তিনি এনেছেন। তারপর একটিকে তারজীহ দিয়েছেন। আর ইমাম বুখারী রহঃ শুধু এক পক্ষের দলীল এনেছেন। তাই বুখারীর তুলনায় তিরমিজী গবেষণার জন্য অধিক উপকারী। আল্লামা তাজুদ্দীন সুবকী রহঃ এর মতে ইমাম বুখারী রহঃ শাফেয়ী। আর ইবনে তাইমিয়া ও ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ এর মতে তিনি হাম্বলী ছিলেন।

তাহাবী শরীফ ও খুব চমৎকার কিতাব। এতে উভয় প্রকারের দলীল এনে আকলী ও নকলী দলীলের ভিত্তিতে একটি প্রাধান্য দিয়েছেন। এ কিতাব ভাল করে পড়ানো উচিত।

তিরমিজীতে এক হাদীসে এসেছে

عن وائل بن حجر قال سمعت النبي صلى الله عليه و سلم قرأ ( غير المغضوب عليهم ولا الضالين ) فقال آمين ومد بها صوته

হযরত ওয়ায়েল বিন হুজুর রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল সাঃ কে বলতে শুনেছি যে, তিনি পড়েছেন গাইরিল মাগদূবি আলাইহিম ওয়ালাদ দুয়াল্লীন, তারপর বললেন আমীন। তিনি তা মাদ্দের সাথে পড়লেন। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৪৮}

মাদ্দা বিহা সাওতাহু এর অর্থ দুটি। একটি অর্থ হল- জাহারা, তথা জোরে বলা।

এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, রাসূল সাঃ আমীন জোরে বলেছেন। ওয়ায়েল বিন হুজুর থেকে আরেক বর্ণনায় এসেছে যে,

عن علقمة بن وائل عن أبيه أن النبي صلى الله عليه و سلم قرأ ( غير المغضوب عليهم ولا الضالين ) فقال آمين وخفض بها صوته

হযরত ওয়ায়েল বিন হুজুর রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল সাঃ কে বলতে শুনেছি যে, তিনি পড়েছেন গাইরিল মাগদূবি আলাইহিম ওয়ালাদ দুয়াল্লীন, তারপর বললেন আমীন। তিনি তা আস্তে সাথে পড়লেন। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৪৮}

এ হাদীস দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, রাসূল সাঃ আমীন আস্তে বলেছেন। তাহলে এক বর্ণনায় এসেছে, আমীন জোরে বলার কথা। আরেক বর্ণনায় এসেছে আস্তে বলার কথা। আর উক্ত হাদীস দু’টিতে কোনটি আগের আমল আর কোনটি পরের আমল তার কোনই উল্লেখ নেই। তাই এখন আমরা কী করবো?

এর সমাধান মুজতাহিদ ছাড়া কেউ করতে পারবে না।

শেষ পর্ব

আরও জানুন

আমাদের নবী কি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী নন?

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। কোন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস