প্রশ্ন
হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ নাকি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ইশার নামায পড়তেন। তারপর নিজের কওমের লোকদের কাছে গিয়ে আবার ইশার নামাযের ইমামতি করতেন।
তাহলে উক্ত হাদীস দ্বারাতো বুঝা যায় যে, নফল আদায়কারীর পেছনে ফরজ আদায়কারীর ইক্তিদা সহীহ আছে।
কিন্তু আমাদের দেশের সকল মুফতীগণ কেন ফাতওয়া দেন যে, নফল আদায়কারীর পেছনে ফরজ আদায়কারীর ইক্তিদা সহীহ নয়? এ বিষয়ে বিস্তারিত জানালে কৃতার্থ হবো।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
একথা সঠিক যে, হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ ইশার নামাযের সময় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে নামায পড়ে তারপর আবার নিজের সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে ইশার নামাযের ইমামতী করতেন।
হাদীসে আসছে যে,
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، أَنَّ مُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ، كَانَ يُصَلِّي مَعَ رَسُولِ اللهِ صلي الله عليه وسلم الْعِشَاءَ ثُمَّ يَأْتِي قَوْمَهُ فَيُصَلِّي بِهِمْ تِلْكَ الصَّلَاةَ
জাবির বিন আবদুল্লাহ রাঃ থেকে বর্ণিত। মু‘আয বিন জাবাল রাঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ‘ইশার নামায আদায়ের পর পুনরায় নিজ কওমের নিকট গিয়ে ঐ নামাযেরই তাদের ইমামতি করতেন। [সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং-৫৯৯, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৪৬৫]
কিন্তু হাদীসে একথা আসেনি যে, তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে ফরজের নিয়তে ইশার নামায পড়তেন।
বরং এটিই সঠিক ব্যাখ্যা যে, তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে নামায পড়তেন নফলের নিয়তে, তারপর নিজ কওমকে ইমামতী করাতেন ফরজের নিয়তে।
তিনি একাজ এজন্য করতেন,
ক) যেন নবীজীর পিছনে নামায পড়ার বরকত নিতে পারেন।
খ) নামাযের মাসনূনাতগুলো ভালোভাবে জানতে পারেন।
গ) জামাআতে নামায না পড়ার নিফাক্বীর সন্দেহ কেউ যেন করতে না পারে।
কারণ, নবীজীর যুগে কেবলমাত্র চরম মুনাফিকরাই সুযোগ থাকার পরও নবীজীর পিছনে নামায পড়া পরিত্যাগ করতো।
وقال أصحابنا: لا يصلى المفترض خلف المتنفل، وبه قال مالك فى رواية، وأحمد فى رواية أى الحارث عنه، وقال ابن قدام: “اختار هذه الرواية أكثر أصحابنا وهو قول الزهرى، والحسن البصرى، وسعيد بن المسيب، والنخعى، وأبى قلابة، ويحيحى بن سعيد الأنصارى” وقال الطاحوى: وبه قال مجاهد وطاووس-
أما حديث الباب فلا حجة للشافعية فيها، قال ابن الملك: إن النية أمر لا يطلع عليه إلا بإخبار الناوى، فجاز أن معاذا كان يصلى مع النبى صلى الله عليه وسلم بنية النفل ليتعلم منه سنة الصلاة، ويتبارك بها، ويدفع عن نفسه تهمة النفاق، ثم يأتى قومه فيصلى بهم الفرض لحيازة الفضيلتين، مع أن تأخير العشاء أفضل على الأصح، والحمل على هذا أولى لأنه المتفق على جوازه، (موسوعة فتح الملهم بشرح صحيح الإمام مسلم، كتاب الصلاة، باب القراءة فى العشاء، مسألة اقتداء المفترض خلف المتنفل، تحت رقم الحديث-465، دار الضياء دولة الكويت-3/430)
নফল আদায়কারীর পেছনে কেন ফরজ আদায়কারীর ইক্তিদা সহীহ নয়?
১
হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: الْإِمَامُ ضَامِنٌ তথা ইমাম যিম্মাদার। [সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং-৫১৭, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৯৮১, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২০৭]
এর মানে ইমাম সাহেবের নামাযটি মুক্তাদীর নামাযের যিম্মাদার। কেননা একথা আমরা নিশ্চিতরূপেই জানি যে, হাদীসের অর্থ এটা নয় যে, ব্যক্তি মুক্তাদীর ইমাম যিম্মাদার।
সুতরাং বুঝা গেল যে, ইমামের নামাযটি মূলত মুক্তাদীর নামাযের যিম্মাদার। এর মানে ইমামের নামাযটি শুদ্ধ হলেই কেবল মুক্তাদীর নামায শুদ্ধ হবে।
সুতরাং মুক্তাদীর নামাযটি যদি ইমামের নামাযের চেয়ে শক্তিশালী হয়, তাহলে সেই নামাযের যিম্মাদারী কিভাবে দুর্বল নামায বহন করতে পারে?
একথাতো আমরা সবাই জানি যে, ফরজ শক্তিশালী আর নফল দুর্বল। শক্তিশালী তার সমমানের বা দুর্বলের যিম্মাদারী গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু তার চেয়ে শক্তিশালীর যিম্মাদারী গ্রহণ করতে পারে না।
এ কারণেই ফরজ আদায়কারীর পেছনে ফরজ আদায়কারী বা নফল আদায়কারীর ইক্তিদা সহীহ। কিন্তু নফল আদায়কারীর পেছনে ফরজ আদায়কারীর ইক্তিদা সহীহ নয়।
وقال الشيخ أكمل الدين فى العناية: الأصل فى جنس هذه المسائل قوله عليه الصلاة والسلام “الإمام ضامن” بمعنى تضمن صلاته صلاة المقتدى، لأنا نعلم بيقين أن معناه ليس الضمان فى الذمة، فإن صلاة المقتدى ليست فى ذمة الإمام، فيكون معناه صلاة الإمام يتضمن صلاة المقتدى، وصلاة المقتدى إذا كانت أقوى حالا من الإمام فوق صلاته، والشيء إنما يتضمن ما هو دونه أو مثله، لا ما هو فوقه، بخلاف المتنفل بالمفترض لأن الحاجة فى حق المتنفل إلى أصل الصلاة، وهو موجود فى حق الإمام، وهذا بناء على أن مطلق النية كاف فى صحة النفل، والفرض يشتمل عليه، فيصح الاقتداء، بخلاف العكس-(موسوعة فتح الملهم بشرح صحيح الإمام مسلم، كتاب الصلاة، باب القراءة فى العشاء، مسألة اقتداء المفترض خلف المتنفل، تحت رقم الحديث-465، دار الضياء دولة الكويت-3/430-431)
২
যদি নফল আদায়কারীর পেছনে ফরজ আদায়কারীর ইক্তিদা সহীহ হতো, তাহলে সালাতুল খাওফ এর অস্তিস্তেরইতো প্রয়োজন পড়ে না।
কারণ ইমাম সাহেব মুজাহিদদের প্রতিটি গ্রুপকে নিয়েই পূর্ণ নামায পড়াতে পারেন।
সুতরাং বুঝা গেল যে, সালাতুল খাওফ নামাযের অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে, ইমাম ফরজ পড়ে ফেললে পরবর্তীতে নফলের নিয়তে নামায পড়ালে তার পিছনে ফরজ আদায়কারীর নামায হবে না।
ولو جاز اقتداء المفترض بالمتنفل لما شرع صلاة الخوف مع المنافى، بل كان الإمام يصلى بكل طائفة صلاة كاملة-(موسوعة فتح الملهم بشرح صحيح الإمام مسلم، كتاب الصلاة، باب القراءة فى العشاء، مسألة اقتداء المفترض خلف المتنفل، تحت رقم الحديث-465، دار الضياء دولة الكويت-3/431)
৩
হাদীসে ইরশাদ হয়েছে:
إِنَّمَا جُعِلَ الإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ
হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: ইমাম বানানো হয় তার অনুসরণ করার জন্য। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩৭৮, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৮৪৬]
এ হাদীস প্রমাণ যে, ইমাম তখনি ইমাম হিসেবে পরিগণিত হবেন, যখন মুক্তাদীদের নামাযের সাথে তার নামাযের সম্পর্ক তৈরী হবে।
আর এ সম্পর্ক তখনি সম্ভব, যখন মুক্তাদী ইমাম যে নামাযের নিয়ত করেছে মুক্তাদী যদি সেই নামাযেরই নিয়ত করে। তখনি কেবল ইমামের নামাযটি মুক্তাদীর নামাযের যিম্মাদার হবে।
যদি ইমামের নিয়ত ভিন্ন, আর মুক্তাদীর নিয়ত ভিন্ন হয়, তাহলে মুক্তাদীদের মাঝে ইমাম এর পরিপূর্ণ অনুসরণ বিদ্যমান থাকে না।
৪
ইমামের ইক্তিদা বিষয়ে হাদীসে আরো ইরশাদ হয়েছে:
وَلَا تَخْتَلِفُوا عَلَيْهِ
ইমামের বিপরীত করবে না। [সহীহ ইবনে খুজাইমা, হাদীস নং-১৫৭৫]
মুক্তাদীগণ ইমামের অনুসরণ করবে বাহ্যিক আমল ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে। ইমামের বিপরীত বা বিরোধীতা করবে না। এটা মুক্তাদীর দায়িত্ব।
এখন বাহ্যিক আমলের অনুসরণের সাথে অভ্যন্তরীণ তথা নিয়তের ক্ষেত্রেও যদি ইমামের আনুগত্য পাওয়া যায়, তাহলে সেটি হয় পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ।
কিন্তু বাহ্যিক আমলে ইমামের অনুসরণ করে অভ্যন্তরীণ তথা নিয়তের মাঝে বিপরীত তথা বিরোধীতা করলে এটাও ইমামের বিপরীত ও বিরোধীতা হিসেবেই সাব্যস্ত হয়।
এসব কারণে নফল আদায়কারীর পেছনে ফরজ আদায়কারীর ইক্তিদা সহীহ হবে না।
إن حديث إنما جعل الإمام ليؤتم به يدل على أن الإمام لا يعد إماما إلا إذا ربط المقتدى صلاته بصلاته، بحيث يمكنه الدخول فى صلاته بنية صلاة الإمام، فتكون صلاة الإمام متضمنة لصلاة المقتدى، ويكون المقتدى تابعا له فعلا ونية، غير مختلف عليه، كما قال عليه الصلاة والسلام: ولا تختلفوا عليه” فإنه يشمل الاختلاف عليه فى الأفعال الباطنة كما يشمل الاختلاف عليه فى الأفعال الظاهرة-(موسوعة فتح الملهم بشرح صحيح الإمام مسلم، كتاب الصلاة، باب القراءة فى العشاء، مسألة اقتداء المفترض خلف المتنفل، تحت رقم الحديث-465، دار الضياء دولة الكويت-3/433)
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ইসলামিয়া দারুল হক লালবাগ ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা: জামিয়াতুস সুন্নাহ কামরাঙ্গিরচর, ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা: কাসিমুল উলুম আলইসলামিয়া, সালেহপুর আমীনবাজার ঢাকা।
পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।
শাইখুল হাদীস: জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, সনমানিয়া, কাপাসিয়া, গাজীপুর।
ইমেইল– [email protected]