প্রচ্ছদ / আদব ও আখলাক / মুসলিমদের ইতিহাসে সমাজসেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

মুসলিমদের ইতিহাসে সমাজসেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

মুহাম্মাদ শাহাদাত সাকিব

অসহায় ও বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমেই প্রকাশ পায় মানবতা। যে মানুষ অন্যের চোখের পানি মুছে দেয়, যে মানুষ অসহায়ের পাশে দাঁড়ায়, তাদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে, সেই প্রকৃত মানুষ। মানুষ সামাজিক জীব। সে একা চলতে পারে না। পরস্পর সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। একের বিপদে অন্যে সাহায্যের হাত বাড়াবে, এগিয়ে আসবে সহমর্মিতা নিয়ে; সাহায্য ও সহমর্মিতার এই বোধ আমাদের মাঝে জাগিয়ে তুলেছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

নবীজী উম্মতকে শিখিয়েছেন, সমগ্র মুসলিম জাতি মিলে একটি সত্তা, একটি দেহ। যার কোথাও আঘাত লাগলে প্রতিটি অঙ্গেই সেই ব্যথা অনুভূত হবে। জেগে উঠবে সমস্ত দেহ। তাই মুসলিম সমাজে কোনো পীড়িত কিংবা অসহায় ব্যক্তি সংকটগ্রস্ত হলে একাকিত্ব বোধ করে না। কারণ পাশেই আছে তার ভাই। ভ্রাতৃত্বের টানে যে এগিয়ে আসবে সাহায্যের জন্য। ইসলাম সকল মুসলমানকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

اِنّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ.

নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই। -সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১০

তাই অপর ভাইয়ের সাহায্যে এগিয়ে আসা, দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নেয়াই ইসলামের শিক্ষা। এ শিক্ষার সর্বপ্রথম প্রায়োগিক রূপ দিয়েছেন সাহাবায়ে কেরাম রা.। মক্কায় নির্যাতিত হয়ে সাহাবায়ে কেরাম যখন মদীনায় হিজরত করেছিলেন, তখন মদীনার আনসারগণ গভীর ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলেন আপন মুহাজির ভাইদের।

মুহাজিরদের মনে ছিল মাতৃভূমি, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে আসার দুঃখ, বাড়ী-ঘর, ধন-সম্পদ ছেড়ে আসার কষ্ট। তবে আনসারগণ চেয়েছেন, মুহাজির ভাইদের সব দুঃখ মুছে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে। তাই তো প্রত্যেকে সাধ্যের সবটুকু দিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন মুহাজির ভাইদের সাহায্যে।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় পৌঁছে প্রত্যেক মুহাজিরকে একএকজন আনসারীর সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দেন। তার সার্বিক খোঁজ-খবর নেয়ার দায়িত্ব থাকে সেই আনসারীর উপর। যেমন, আবু তালহা রা. ও আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ রা. ছিলেন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। হযরত আনাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ রা. ও আবু তালহার মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে দেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫২৮

এমনিভাবে আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. ও সা‘দ ইবনুর রাবী এবং সালমান রা. ও আবুদ দারদা রা. ছিলেন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ (সহীহ বুখারী, কিতাবু মানাকিবিল আনসার)

ইবনে হিশাম রাহ. তার বিখ্যাত গ্রন্থ আসসীরাতুন নাবাবিয়্যাহ-এর মধ্যে কোন্ সাহাবীকে কোন্ আনসারীর সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। (দ্র. আস সীরাতুন নাবাবিয়্যাহ ২/১৪৬)

ভ্রাতৃত্বের এই পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর আনসারগণ এটাকে বোঝা কিংবা করুণা মনে করেননি; বরং একে মনে করেছিলেন জীবনের পরম সৌভাগ্য। তাই তো নিজেদের সবকিছু অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে দিতে চেয়েছেন মুহাজির ভাইদের।

হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন- নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুর রহমান ইবনে আউফ ও সা‘দ ইবনুর রাবী-এর মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে দেন। সা‘দ রা. ছিলেন সম্পদশালী।

তিনি আবদুর রহমান ইবনে আউফকে বললেন, আনসারগণ জানেন, আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী, তবে এ সম্পদ এখন আমার আর তোমার মাঝে অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে নিতে চাই। আমার দুজন স্ত্রী আছে। তাদের যাকে তোমার পছন্দ হয় তাকে আমি তালাক দিয়ে দেব। তুমি তাকে বিয়ে করে নিবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৭৮১

সুবহানাল্লাহ! কত বড় ত্যাগ! কত বড় কুরবানী! পৃথিবীতে কি খুঁজে পাওয়া যাবে এর নজীর! নিজের অর্ধেক সম্পদ দিতে চাচ্ছেন। প্রিয়তমা স্ত্রীকেও ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন; না নিজের রক্ত সম্পর্কের কোনো আত্মীয়ের জন্য নয়; বরং পরদেশী এক মানুষের জন্য, যার সাথে সম্পর্কের ও পরিচয়ের সূচনা হয়েছে অল্প ক’দিন আগে। তবে ঈমানের বন্ধন তাদের মাঝে হৃদয়ের গভীর বন্ধন গড়ে তুলেছিল।

আনসারদের এই হৃদ্যতা মুহাজিরদের মুগ্ধ করেছিল। হৃদয় থেকে যে রক্ত ঝরছিল তা যেন বন্ধ হয়ে গেছে তাদের উষ্ণ আন্তরিকতা পেয়ে। তাই তো দরবারে নববীতে একদিন মুহাজিরগণ বলেছিলেন-

يَا رَسُولَ اللهِ، مَا رَأَيْنَا قَوْمًا أَبْذَلَ مِنْ كَثِيرٍ وَلَا أَحْسَنَ مُوَاسَاةً مِنْ قَلِيلٍ مِنْ قَوْمٍ نَزَلْنَا بَيْنَ أَظْهُرِهِمْ، لَقَدْ كَفَوْنَا المُؤْنَةَ، وَأَشْرَكُونَا فِي المَهْنَإِ، حَتّى لَقَدْ خِفْنَا أَنْ يَذْهَبُوا بِالأَجْرِ كُلِّهِ.

ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা যাদের কাছে এসেছি, প্রাচুর্য-অপ্রাচুর্য সকল অবস্থায় তাদের মত এত ব্যয় করতে এবং এত উত্তম সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে আমরা আর কাউকে দেখিনি। তারা আমাদের সকল প্রয়োজনে যথেষ্ট হয়েছেন এবং তাদের শ্রমলব্ধ সম্পদে আমাদের অংশীদার বানিয়েছেন। এমনকি আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে যে, সব সওয়াব তাঁরাই নিয়ে যাবেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৮৭

সাহাবায়ে কেরাম রা. ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিলেন, বিপদগ্রস্ত ভাইদের সাহায্যে এগিয়ে আসার যে নজীর স্থাপন করেছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে তা আজও ভাস্বর হয়ে আছে।

সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকে ত্যাগ, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্বের এই শিক্ষা লাভ করেছেন যুগে যুগে আল্লাহপ্রেমী মুমিনগণ। তাই তো বিপন্ন মানবতার আর্তনাদে সাড়া দিয়ে তারা ছুটে যান। তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেন। মলিন মুখে খুশির হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেন।

ইসলামের ইতিহাসে প্রতিটি যুগে প্রতিটি জনপদে ভ্রাতৃসেবার এমন দৃষ্টান্ত অসংখ্য। সমাজে যে যখন সমস্যায় পড়েছে অন্যেরা তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। এজন্য মুসলিম সমাজে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য সেবা প্রতিষ্ঠান ও দাতব্য সংস্থা। স্বাস্থ্যসেবা, দারিদ্র্য বিমোচন, রাস্তা-ঘাট উন্নয়ন, সংকটগ্রস্তদের আশ্রয়দান ইত্যাদি কোনো কিছুই এর বাইরে ছিল না। মুসলিম সমাজের বহুমুখী সেবার সামান্য কিছু দিক নিম্নে তুলে ধরা হল।

মুসলিম সমাজে স্বাস্থ্যসেবা

সুস্থতা আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত। একজন সুন্দর বলেছেন- ‘সুস্থতা সুস্থ ব্যক্তির মাথার তাজ, যা কেবল অসুস্থরাই দেখতে পায়।’ অসুস্থ ব্যক্তিই শুধু অনুভব করতে পারে- রোগের যন্ত্রণা কত কষ্টদায়ক।

রোগ-যন্ত্রণার মুহূর্তে সেবার জন্য একজন মানুষ পাশে থাকা রোগীর অনেক প্রয়োজন। মুসলমানদের সোনালীযুগে তাই রোগীর সেবা করার জন্য ছিল অনেক সুন্দর ব্যবস্থা। কোনো অসুস্থ রোগী যেন চিকিৎসাহীন না থাকে, এদিকে বিশেষ লক্ষ রাখা হত। কারাগারে থাকা অপরাধী ব্যক্তীরাও এ আওতার বাইরে ছিল না; বরং তাদেরও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হত নিয়মিত।

ওযীর আলী ইবনে ঈসা বাগদাদের প্রধান চিকিৎসক সিনান ইবনে সাবেতকে লিখেছিলেন- আমি বন্দীদের ব্যাপারে ভেবে দেখেছি। সংখ্যাধিক্য এবং প্রতিকূল আবহাওয়া ও অবস্থানের কারণে অনেক সময় তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই তাদের জন্য আলাদা চিকিৎসক নির্ধারণ করা আমাদের দায়িত্ব। চিকিৎসক প্রতিদিন কারাগারে যাবে। পুরো কারাগার ঘুরে অসুস্থদের চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবারহ করবে। -তারীখুল হুকামা, পৃষ্ঠা ১৪৮

বিভিন্ন বড় বড় মসজিদ ও জনবহুল স্থানে বসানো হত ভ্রাম্যমান চিকিৎসাকেন্দ্র। মাকরিযী রাহ. বলেন, ইবনে তুলূন যখন মিসরের বিখ্যাত জামে মসজিদ নির্মাণ করেন তখন মসজিদের পিছনে একটি ফার্মেসীও প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রয়োজনীয় সব ধরনের ঔষধ সেখানে ছিল। প্রতি জুমার দিন একজন ডাক্তার অসুস্থদের সেখানে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেন। -আলমাওয়াইযু ওয়াল ই‘তিবার ৪/২৬৭

এ ধরনের ভ্রাম্যমান হাসপাতালের পাশাপাশি নির্মিত ছিল বড় বড় হাসপাতাল। সেখান থেকে রোগীদেরকে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করা হত। সমাজের নেতৃস্থানীয় লোক ও ধনীব্যক্তিরা অসহায় মানুষদের সেবার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য এগুলো প্রতিষ্ঠা করতেন।

সুলতান নূরুদ্দীন রাহ. ৫৪৯ হিজরীতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলমুসতাশফান নূরী আলকাবীর’। দামেশকে নির্মিত এ হাসপাতালটি ছিল তৎকালীন দেশের সবচেয়ে সুন্দর হাসপাতাল।

হাসপাতালটিকে কেবলমাত্র গরীব ও অসহায় ব্যক্তিদের জন্য তিনি ওয়াকফ করেছিলেন। তবে হাঁ, প্রয়োজনে ধনীরাও সেখানে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারত। রোগীদের সব ধরনের ঔষধ-পত্র হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে প্রদান করা হত।

ঐতিহাসিকগণ লেখেন, ৮৩১ হিজরীতে একজন রুচিশীল পর্যটক আলমুসতাশফান নূরীতে যান এবং হাসপাতালের সেবার মান, শৃংখলা, খাবার-দাবার ও রোগীদের প্রতি চিকিৎসকদের যত্ন দেখে অভিভূত হন। তবে চিকিৎসা শাস্ত্রে তাদের কতটুকু অভিজ্ঞতা আছে তা পরীক্ষা করার জন্য অসুস্থতার ভান করে হাসপাতালে ভর্তি হন।

প্রধান চিকিৎসক এসে তার নাড়ি ধরে বুঝতে পারেন। আসলে তার কোনো রোগ নেই। চিকিৎসকদের পরীক্ষা করাই উদ্দেশ্য। তিন দিন পর্যন্ত তাকে হাসপাতালে আপ্যায়ন করা হল। মুরগী, বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি ও ফল দিয়ে যত্ন করা হল অনেক।

তিন দিন পর প্রধান চিকিৎসক তাকে একটি কাগজ দিলেন, সেখানে লেখা ছিল- আমাদের এখানে তিন দিন মেহমানদারী করা হয়। তখন সে বুঝে গেল, চিকিৎসক আগেই তার রোগ ধরে ফেলেছেন। -তারীখুনা আলমুফতারা আলাইহি, ১৬৩

৬৮৩ হিজরীতে আলমালিকুল মানসূর সাইফুদ্দীন নির্মাণ করেন ‘আলমুসতাশফাল মানসূরী আলকাবীর’ শৃংখলা ও পরিপাটির দিক থেকে এটি ছিল তৎকালীন যুগের পৃথিবীর সুন্দরতম একটি হাসপাতাল।

এর চিকিৎসা সেবাও ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত ও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। প্রত্যেক রোগীর সেবায় দুজন ব্যক্তি নিযুক্ত থাকত। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, কেবলমাত্র হাসপাতালে অবস্থানরত ব্যক্তিদেরই চিকিৎসা সেবা প্রদান করত না; বরং যেসকল রোগী হাসপাতালে আসতে অক্ষম তাদের বাড়ী গিয়ে সেবা প্রদান করা হত এবং প্রয়োজনীয় ঔষধ ও খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হত।

প্রতিদিন প্রায় চার হাজার মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হত এ হাসপাতাল থেকে। যারা সেবা পেয়ে সুস্থ হয়ে উঠত, যাওয়ার সময় পরিধান করার জন্য তাদের একটি করে নতুন কাপড় দেয়া হত এবং ঘরে ফিরে অতিরিক্ত পরিশ্রমসাধ্য কাজ করে স্বাস্থ্যের যেন অবনতি না ঘটে এজন্য প্রয়োজন পরিমাণ অর্থও দিয়ে দেয়া হত। -মিন রাওয়াইয়ি হাযারাতিনা, পৃ. ২১২

দারুয যিয়াফাহ

বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থায় উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। মাটির মানুষ উটের বাহন ছেড়ে আকাশে উড়ছে বিমানের কল্যাণে। মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। স্বপ্ন দেখছে মহাকাশ জয়ের। রকেটে চড়ে এগিয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন জয়ের প্রত্যাশায়।

কিন্তু আজ থেকে হাজার বছর আগে ছিল না যোগাযোগ ব্যবস্থার এই উৎকর্ষ। এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে ভাবতে হত অনেক। মরুভূমির ধুলো মাড়িয়ে, কষ্টের দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে তবেই পৌঁছতে হত কাক্সিক্ষত দেশে। এর মাঝে কেটে যেত মাসের পর মাস। পথে পথে ডাকাতের ভয়। খাবার ফুরিয়ে যাবার আশংকা।

ঘুমানোর জন্য সুন্দর আরামদায়ক একটু জায়গা মেলাও ভার ছিল সে যুগে। পথিকের এই কষ্টের কথা বিবেচনা করেই বিশাল মুসলিম ভূখ-ে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য ‘দারুয যিয়াফাহ’। রাস্তার মাঝে মাঝে অসংখ্য ঘর। গরীব-অসহায় ও মুসাফিরদের সেখানে বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা করা হত।

এসকল ‘দারুয যিয়াফাহ’গুলোতে মানুষ খুঁজে পেত বাসগৃহের প্রশান্তি। কষ্টের মুহূর্তে ভরপেট খাবার এবং মাথা গোঁজার ঠাঁই। মুসলিম রাষ্ট্রের খলীফা ও সমাজসেবী মানুষেরা মুসাফিরদের জন্য এ পথগৃহগুলো তৈরি করত। শীতকালের হাড় কাঁপানো ঠান্ডা ও গ্রীষ্মের প্রচ- গরম থেকে বাঁচার জন্য পথচারীরা এই ঘরগুলোতেই আশ্রয় নিত।

হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর বিশিষ্ট আলেম সা‘দ বিন ইয়াযিদ বলেন, তিনি একবার প্রচ- বৃষ্টির সময় এমন এক গৃহে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি দেখেন, প্রতিটি কামরা-ই লোকজনে ভর্তি হয়ে আছে। -আল মুনতাযাম ৫/৩৯

খলীফা মুসতানসির বিল্লাহ এ ব্যাপারে ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ। তিনি বাগদাদের প্রতিটি মহল্লায় অসহায় গরীবদের জন্য ‘দারুয যিয়াফাহ’-এর ব্যবস্থা করেছিলেন। বিশেষ করে রমযান মাসে এখান থেকে তাদের খাবার বিতরণ করা হত। সেইসাথে বয়স চল্লিশ হয়েছে এমন বাদীদের ক্রয় করে তিনি আযাদ করে দিতেন এবং তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতেন। -আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১৭/২৬০

আমীর নূরুদ্দীন মাহমুদ রাহ.-ও এক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ ছিলেন। আল্লামা আবু শামাহ ইবনুল আসীর রাহ.-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, নূরুদ্দীন মাহমুদ বিভিন্ন পথের মাঝে মাঝে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার জন্য অসংখ্য ‘খান’ (বর্তমান যুগের আবাসিক হোটেল) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর ফলে মানুষের যাতায়াত নিরাপদ হয় এবং মালামাল সংরক্ষিত থাকে। প্রচ- শীত বা বৃষ্টিতে পথিকের জন্য সেখানেই থাকার ব্যবস্থা ছিল। -আররাওযাতাইন, ১২

মুসলিম ইতিহাসে দাতব্য সংস্থা

ব্যক্তি উদ্যোগে সেবা প্রদানের পাশাপাশি মুসলমানরা গড়ে তুলেছিল বিভিন্ন সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। মুসলিম সমাজে গড়ে উঠেছিল বহুমুখী দাতব্য সংস্থা।

বিশিষ্ট দায়ী আল্লামা মুস্তফা আসসিবায়ী এ ধরনের দাতব্য সংস্থার বহুমুখী সেবার বিবরণ উল্লেখ করেছেন। যেমন :

১. মুসাফির ও পথচারীদের জন্য বাসগৃহের ব্যবস্থা।

২. খানকা প্রতিষ্ঠা।

৩. যে সকল গরীব ও অসহায় মানুষের থাকার কোনো ঘর নেই এবং গৃহ নির্মাণ কিংবা ভাড়া নেয়ার আর্থিক সামর্থ্যও নেই তাদের বসবাসের জন্য গৃহ নির্মাণ।

৪. পথচারীদের পানি পানের ব্যবস্থা।

৫. উন্মুক্ত হোটেল প্রতিষ্ঠা। যেখান থেকে বিনামূল্যে গরীব ও অসহায়দের খাবারের ব্যবস্থা করা হবে।

৬. মক্কায় আগত হাজ্বীদের থাকার জন্য বিনামূল্যে বাসগৃহের ব্যবস্থা।

৭. পথচারী, গবাদী পশু ও ক্ষেত-খামারে পানি সরবরাহ করার জন্য কূপ খনন।

৮. কবরস্থানের ব্যবস্থা করা।

৯. গরীব ও অসহায় মৃতব্যক্তির কাফন-দাফনের ব্যবস্থা।

১০. ইয়াতীম, পঙ্গু, অন্ধ, বৃদ্ধের থাকা-খাওয়া ও যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা।

১১. কারাগারস্থ ব্যক্তিদের আত্মিক  উন্নয়ন ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ব্যবস্থা।

১২. অসচ্ছল পরিবারের উপযুক্ত ছেলে-মেয়েদের বিয়ের যাবতীয় খরচের ব্যবস্থা।

১৩. মায়েদের জন্য দুধ-চিনির ব্যবস্থা। সুলতান সালাহুদ্দীন রাহ. তার কেল্লার একটি ফটকের পাশ দিয়ে দুটি নালা তৈরি করেছিলেন। সপ্তাহে দুই দিন একটি নালা দিয়ে দুধ অপর নালা দিয়ে চিনিমিশ্রিত পানি প্রবাহিত করা হত। মহিলারা সে দুই দিন এসে শিশু ও সন্তানদের জন্য প্রয়োজনীয় দুধ ও চিনিমিশ্রিত পানি নিয়ে যেত।

১৪. হাসপাতাল ও ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা।

১৫. পাত্র ইত্যাদি ভেঙ্গে গেলে নতুন পাত্র কেনার জন্য অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা।

১৬. অসুস্থ পশুর চিকিৎসা ও খাদ্যের ব্যবস্থা এবং যেসকল পশু বয়সের কারণে নিজে চরে বেড়িয়ে কাজ করে খেতে অক্ষম মৃত্যু পর্যন্ত সেগুলোর লালন-পালনের ব্যবস্থা। -মিন রাওয়াইয়ি হাযারাতিনা, পৃ. ১৭৮-১৮২

ইসলামের স্বর্ণযুগে এ ধরনের বহুমুখী সেবা প্রদানের জন্য গড়ে উঠেছিল অসংখ্য দাতব্য প্রতিষ্ঠান। একেক প্রতিষ্ঠান একেক ধরনের সেবা প্রদান করত। জনগণ বিনামূল্যে এ সেবাগুলো পেয়ে থাকত। ফলে অসহায় ও বিপন্ন মানুষেরাও লাভ করত সামাজিক মর্যাদা। কারো কাছে হাত পাতা কিংবা অন্যের উপর বোঝা হয়ে থাকতে হত না তাদের।

‘ওয়াকফ’ সমাজ সেবার একটি স্থায়ী মাধ্যম

মুসলমানদের মধ্যে সমাজ সেবার জন্য যে দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছিল সেগুলোর অর্থ যোগান দেয়া হত মূলত ওয়াকফকৃত সম্পদ থেকে। তৎকালীন সমাজের অর্থবান ও বিত্তশালী লোকের প্রচুর জমি বা এ ধরনের অন্য কিছু ওয়াকফ করত। সে ওয়াকফকৃত সম্পদের লাভ কোন্ ধরনের সমাজসেবায় ব্যয় হবে তা নির্দিষ্ট করে দিত ওয়াকফকারী। সেই অর্থ দ্বারাই পরিচালিত হত সংশ্লিষ্ট সমাজসেবার কার্যক্রম।

বর্তমান যুগে অনেক ক্ষেত্রেই শুধু মসজিদ-মাদরাসার জন্য জমি ইত্যাদি দান করার মধ্যেই ওয়াকফের পবিত্র ধারাটি সংকুচিত হয়ে এসেছে। তবে ইসলামের সোনালী যুগে ওয়াকফ ছিল অনেক ব্যাপক ও সমাজের বিভিন্ন ধরনের সেবামুখী। আল্লামা ইউসুফ কারজাভী তার ‘তারীখুনাল মুফতারা আলাইহি’ গ্রন্থে ওয়াকফের সেবামুখী বিভিন্ন খাত উল্লেখ করেছেন। নি¤েœ সংক্ষেপে কয়েকটি তুলে ধরা হল।

অসুস্থদের সান্ত্বনা প্রদান সংক্রান্ত ওয়াকফ

এ ধরনের ওয়াকফকৃত সম্পদের লাভ দ্বারা অসুসস্থদের সান্ত্বনা প্রদানের ব্যবস্থা করা হত।

দুজন ব্যক্তি অসুস্থ ব্যক্তির কাছে গিয়ে এমন স্থানে দাঁড়াবে যেখানে অসুস্থ ব্যক্তি তাদের দেখবে না। তবে তাদের কথা শুনবে। তখন একজন অপরজনকে জিজ্ঞেস করবে, ডাক্তার এ রোগী সম্পর্কে কী বলেছেন? অপরজন বলবে, ডাক্তার বলেছে তার অবস্থা ভালোই আছে। খুব দ্রুত সে ভালো হয়ে উঠবে। তেমন কোনো রোগ তার নেই।

রোগীকে মানসিকভাবে সুস্থ ও শক্তিশালী করার জন্য সেবার এ অভিনব পন্থা উদ্ভাবন করা হয়েছিল। কারণ মানসিক শক্তি শারীরিক সুস্থতাকে তরান্বিত করে।

পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত ওয়াকফ

আগের যুগে গোসল ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জনের জন্য ‘হাম্মামের’ ব্যবস্থা ছিল। টাকা দিয়ে সেখানে যেতে হত। তবে যেসকল অসহায় ব্যক্তির হাম্মামে যাওয়ার অর্থ নেই এ ধরনের ওয়াকফকৃত সম্পদের লভ্যাংশ এদের কল্যাণে ব্যয় করা হত।

ভেঙ্গে যাওয়া পাত্র সংক্রান্ত ওয়াকফ

এ ধরনের ওয়াকফকৃত সম্পদের লাভ থেকে যে সকল দাস মনিবের পাত্র ভেঙ্গে ফেলত নতুন পাত্র কেনার জন্য তাদেরকে অর্থ সরবরাহ করা হত।

উল্লেখিত সেবাখাতগুলো দেখে সহজেই অনুমান করা যায় ইসলামের ইতিহাসে ওয়াকফ কত ব্যাপক ও বহুমুখী ছিল এবং তা সমাজসেবায় কত বড় অবদান রেখেছিল।

কোনো কোনো দেশে ওয়াকফের প্রচলন এমন বহুমুখী ও সেবাধর্মী ছিল যে, শুধু অমুসলিমরাই নয়, মুসলিম পর্যটকরা পর্যন্ত সেখানে গিয়ে অভিভূত হয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম পরিব্রাজক ইবনে বতুতা মুগ্ধ হওয়ার এমন এক চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন। তার সফরনামা ‘রিহলাতু ইবনে বতুতার’ মধ্যে তিনি লেখেন-

‘দামেশকে আমি ওয়াকফের বিভিন্ন ধরন দেখে আশ্চর্য হয়েছি। কেউ নিজ সম্পত্তি হজে¦ অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ওয়াকফ করছে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল হজে¦ গমনেচ্ছু ব্যক্তিদের সেখান থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করা হয়ে থাকে।

কেউ কেউ দরিদ্র  পরিবারের বিবাহিত রমনীদের স্বামীগৃহে যাওয়ার যাবতীয় খরচাদীর জন্য নিজ সম্পদ ওয়াকফ করছে। কেউ মুসাফিরদের জন্য ওয়াকফ করছে। যেখান থেকে তাদের পানাহার, পোশাক-পরিচ্ছদ ও দেশে ফেরার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করা হয়। কেউবা আবার রাস্তা-ঘাট উন্নয়নের জন্য সম্পদ দান করে যাচ্ছে। এ ছাড়াও সেবামূলক বিভিন্ন কাজের জন্য ওয়াকফের বহুমুখী ধরন আমি সেখানে দেখেছি।’

ইবনে বতুতার দেখা ওয়াকফের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক খাত হল, পাত্র মেরামতের জন্য সম্পদ ওয়াকফ করার ধরনটি। ইবনে বতুতা নিজের দেখা একটি ঘটনা এভাবে বর্ণনা করেন- ‘আমি একবার দামেশকের এক পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম এক গোলামের হাত থেকে একটি চিনা বরতন পড়ে ভেঙ্গে গেল। তখন একজন এসে গোলামটিকে বলল, তুমি ভাঙ্গা অংশগুলো একত্র করে ভেঙ্গে যাওয়া পাত্র সংক্রান্ত ওয়াকফের তত্ত্বাবধায়কের কাছে নিয়ে যাও।

গোলামটি তখন ভাঙ্গা অংশগুলো একত্র করলে লোকটি তাকে তত্ত্বাবধায়কের কাছে নিয়ে গেল। সবকিছু দেখার পর ভাঙ্গা পাত্র সংক্রান্ত ওয়াকফের তত্ত্বাবধায়ক নতুন পাত্র কেনা পরিমাণ অর্থ গোলামটিকে  দিয়ে দিলেন।’

ইবনে বতুতা বলেন- এটা খুব চমৎকার একটি সেবাধর্মী কাজ। কারণ পাত্র ভেঙ্গে ফেলার দরুন সে সমস্যায় পড়তে পারে তাই এ ধরনের ওয়াকফের পদ্ধতি সেখানে চালু করা হয়েছে। যে ব্যক্তি এ অনুপম সেবামূলক কাজের হিম্মত করেছে আল্লাহ তাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। (রিহলাতু ইবনে বতুতা, ৮০-৮৮)

সমাজের এই বহুমুখী সেবা ইসলামী ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়, যা মুসলমানদেরকে তৎকালীন সময়ের সকল জাতি ও ধর্মাবলম্বীদের থেকে দিয়েছিল বিশেষ স্বাতন্ত্র্য। এ ইতিহাস শুধুই গর্বের। তবে গর্ব পর্যন্তই যেন এর ধারা সীমিত না থাকে। এ ধারা প্রবহমান থাকুক চিরকাল। আবার শুরু হোক এ ধারা। মুসলমানদের সুন্দর সমাজ-ব্যবস্থা আদর্শ ও অনুকরণীয় হয়ে উঠুক সবার জন্য- আমীন।

0Shares

আরও জানুন

লিখিত ছাড়া শুধু মৌখিক ওয়াকফ কি গ্রহণযোগ্য নয়?

প্রশ্ন আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।     আমার জানার বিষয় হল এক ব্যক্তি …