প্রশ্ন
From: আবদুল্লাহ আল মামুন
বিষয়ঃ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নবীজি (সাঃ) নুরের তৈরি কিনা?
প্রশ্নঃ
হযরত, আসসালামু আলাইকুম,
প্রথমেই আমি আমার পরিচয় দিয়ে নিচ্ছি, আমি আবদুল্লাহ আল মামুন, বাড়ি বরিশাল, আমি বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বর্তমানে চট্টগ্রামে চাকুরীরত রয়েছি।
আমার প্রশ্ন পুরাতন হলেও অনেকদিন ধরে আমার মাথায় দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করছে। আল্লাহ আমাকে যতটুকু দ্বীনের জ্ঞান দান করছেন (যা খুবি সামান্য আপনার তুলনায়), তা দ্বারা আমি কোনও ভাবেই একটা সঠিক সমাধানে আসতে পারছি না। তাই আপনার শরণাপন্ন হচ্ছি। আশা করি এই প্রশ্ন আমার ও আরও অনেকের ভুল ধারনাকে খণ্ডন করতে পারবে।
নবীজি (সাঃ) কি নুরের তৈরি ?
(বোখারী শরীফ এঁর একটা হাদিস যা আমি শুনেছিঃ হযরত আয়শা (রাঃ) এঁর বর্ণনা মতে একদিন উনি কাপড় সেলাই করছিলেন ওনার হাত থেকে সুই পরে গেলে উনি তা তালাশ করছিলেন পাচ্ছিলেন না, সেই মুহূর্তে নবীজি (সাঃ) ওনার ঘরে প্রবেশ করলে উনি নবীজি (সাঃ) এঁর নুরে ওনার সুঁই খুঁজে পেলেন ) এই হাদিস টির ব্যাখ্যা দিয়ে দয়া করে বুঝিয়ে দিবেন। আর আমার কোনও ভুল হলে দয়া করে ঠিক করে দিবেন।
দয়া করে আমার প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দিবেন। কারন আমার কাছে পর্যাপ্ত দলীল নাই।
ধন্যবাদ,
আসসালামু আলাইকুম,
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাটির তৈরী মানুষ ছিলেন। তিনি নূরের তৈরী ছিলেন না। তবে আমাদের মাটি ও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তৈরী করা মাটি এক বা সমান নয়। আকাশ ও পাতালের সম্পর্ক। আমরা সাধারণ মাটির তৈরী আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতী মাটির তৈরী।
নূরের তৈরী বিষয়ক আপনার জানা বিষয়টি সঠিক নয়। বুখারীতে এ মর্মে কোন হাদীস বর্ণিত। হয়নি। যদি কেউ বুখারীর বর্ণনা বলে থাকে, তাহলে সে হয়তো অজ্ঞতাবশত এমনটি বলেছে, কিংবা জেনেশুনে মিথ্যাচার করছে।
এ বর্ণনাটি কতিপয় সীরাত গ্রন্থাকার তাদের রচিত সীরাতের কিতাবে এনেছেন। মুহাদ্দিসগণের বক্তব্য অনুপাতে উক্ত হাদীসটি জাল ও বানোয়াট।
যেমন দালায়েলুন নবুয়্যাহ গ্রন্থে ইসমাঈল বিন মুহাম্মদ ইস্পাহানী রহঃ উক্ত বর্ণনাটি এনেছেন নিম্নোক্ত শব্দ ও সনদেঃ
أَخْبَرَنَا أَبُو مُحَمَّدٍ الْحُسَيْنُ بْنُ أَحْمَدَ السَّمَرْقَنْدِيُّ الْحَافِظُ بِنَيْسَابُورَ أَنَا أَبُو إِبْرَاهِيمَ إِسْمَاعِيلُ بن عِيسَى بن عبد الله التَّاجِرُ السَّمَرْقَنْدِيُّ بِهَا ثَنَا أَبُو الْحَسَنِ عَلِيُّ بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ يحيى بن الْفضل بن عبد الله الْفَارِسِيُّ ثَنَا أَبُو الْحَسَنِ مُحَمَّدُ بْنُ عَلِيِّ بْنِ الْحُسَيْنِ الْجُرْجَانِيُّ الْحَافِظُ بِسَمَرْقَنْدَ ثَنَا مَسْعَدَةُ بْنُ بَكْرٍ الْفَرْغَانِيُّ بِمَرْوٍ وَأَنَا سَأَلْتُهُ فَأَمْلَى عَلَيَّ بَعْدَ جُهْدٍ ثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ أَبِي عَوْنٍ ثَنَا عَمَّارُ بْنُ الْحَسَنِ ثَنَا سَلَمَةُ بْنُ الْفَضْلِ عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِسْحَاقَ بْنِ يَسَارٍ عَنْ يَزِيدَ بْنِ رَوْمَانَ وَصَالِحِ بْنِ كَيْسَانَ عَنْ عُرْوَةَ بْنِ الزُّبَيْرِ عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ اسْتَعَرْتُ مِنْ حَفْصَةَ بِنْتِ رَوَاحَةَ إِبْرَةً كُنْتُ أَخِيطُ بِهَا ثَوْبَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَسَقَطَتْ عَنِّي الْإِبْرَةُ فَطَلَبَتْهَا فَلَمْ أَقْدِرْ عَلَيْهَا فَدَخَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَتَبَيَّنَتِ الْإِبْرَةُ لِشُعَاعِ نور وجهه فَضَحِكْتُ
অর্থঃ হযরত আয়শা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হাফসা বিনতে রাওয়াহা থেকে একটি সুঁই ধার করে আনি। এর দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি কাপড় সেলাই করবো বলে। তখন উক্ত সুঁইটি আমার হাত থেকে পড়ে যায়। তখন আমি অনেক খুঁজেও তা পাচ্ছিলাম না। ইতোমধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবেশ করলেন, তখন নবীজীর চেহারার নূরের আলোতে সুঁইটি দৃশ্যমান হল। তখন আমি মুচকি হেসে দিলাম। [দালায়েলুন নবুয়্যাহ-১/১১৩, বর্ণনা নং-১১৭, আলখাসায়েসুল কুবরা, সুয়ূতীকৃত-১/১০৭, সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ-২/৪০]
উক্ত বর্ণনায় একজন রাবী আছেন, যার নাম হল, মাসআদা বিন বকর ফারগানী। যিনি বর্ণনাটি মুহাম্মদ বিন আহমদ বিন আওন থেকে করেছেন।
এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের মন্তব্য হল,
مسعدة بن بكر الفرغانى. عن محمد بن أحمد ابن عون بخبر كذب
মাসআদা বিন বকর ফারগানী মুহাম্মদ বিন আহমাদ ইবনে আউন থেকে মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করে। [মীযানুল ই’তিদাল-৪/৯৮, রাবী নং-৮৪৬৪, লিসানুল মিযান-৬/২২, রাবী নং-৮১]
এছাড়া এ বর্ণনায় মুহাম্মদ বিন ইসহাক নামে আরেকজন রাবী আছেন। যিনি মুদাল্লিস। সেই সাথে আনআনা বর্ণনা করেছেন। এমন মুদাল্লিস রাবীর আনআনা বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়।
উপরোক্ত কারণে মুহাদ্দিসগণ উক্ত বর্ণনাটিকে জাল ও বানোয়াট বলে আখ্যায়িত করেছেন।
এছাড়া এ সংক্রান্ত আরেকটি বর্ণনা প্রসিদ্ধ। সেটি হল, নবীজীর হাসির ছটায় সুঁই পাওয়া যায়। এ সব হাদীসের হুকুম একই। জাল ও বানোয়াট। সুতরাং এসব হাদীস বর্ণনা করা ও তা দিয়ে দলীল দেয়া কোনটিই জায়েজ নয়।
এ হাদীসকে আব্দুল হাই লাখনোভী রহঃ জাল বলেছেন। দেখুন-আলআসারুল মারফূআ-৪৬।
সাইয়্যিদ সুলাইমান নদভী রহঃ ও জাল বলেছেন। দেখুন-সীরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-৩/৪২৯।
শাইখুল হাদীস সরফরাজ খান সফদর রহঃ ও জাল বলেছেন। দেখুন- নূর ও বাশার-৮৫-৮৭।
এ বিষয়ে বিস্তারিত উত্তর জানতে হলে পড়ুন-
১
নূরের আলোয় সুঁই পাওয়া হাদীসের তাহকীক এবং নূর দাবিদারদের অসাড় বক্তব্য
২
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি নূরের তৈরী?
৪
রাসূল সাঃ কি আল্লাহর নূরের তৈরী?
৫
রাসূল সাঃ এর নূর ও প্রথম সৃষ্টি বিষয়ক হাদীসের তাহকীক
৬
সূরা মায়িদার ১৫ নং আয়াত দ্বারা কি নবীজী নূরের তৈরী প্রমাণ হয়?
৭
নূর বিষয়ে আশরাফ আলী থানবী রহঃ এর উপর মিথ্যা অপবাদের জবাব
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক ও প্রধান মুফতী – মা’হাদুত তালীম ওয়াল বুহুসিল ইসলামী ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম আমীনবাজার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ফারূকিয়া দক্ষিণ বনশ্রী ঢাকা।