লুৎফূর রহমান ফরায়েজী
আমি আবার বলতে লাগলাম, “দেখুন, ইমাম আবূ হানীফা রহঃ এবং মুহাদ্দিসীনদের মাঝের সময়ের পার্থক্য।
ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর জন্ম ৮০ হিজরী। মৃত্যু-১৫০ হিজরী।
মুহাদ্দিসীনদের জন্ম ও মৃত্যু
মুহাম্মদ বিন ইসমাঈল বুখারী রহঃ এর জন্ম-১৯৪ হিজরী এবং মৃত্যু ২৫৬ হিজরী।
মুসলিম বিন হাজ্জাজ ইমাম মুসলিম রহঃ এর জন্ম ২০৪ হিজরী এবং মৃত্যু ২৬১ হিজরী।
মুহাম্মদ বিন ঈসা বিন সাওরা ইমাম তিরমিজী জন্ম-২১০ হিজরী এবং মৃত্যু ২৭৯ হিজরী।
মুহাম্মদ বিন ইয়াজিদ ইমাম ইবনে মাজাহ এর জন্ম-২০৯ হিজরী এবং মৃত্যু-২৭৩ হিজরী।
সুলাইমান বিন আসআস ইমাম আবু দাউদ রহঃ এর জন্ম- ২০২ হিজরী এবং মৃত্যু-২৭৫ হিজরী।
আবু আব্দুর রহমান আহমদ ইমাম নাসায়ী রহঃ এর জন্ম ২১৫ হিজরী এবং মৃত্যু ৩০৩ হিজরী।
এই হল সিহাহ সিত্তার জন্ম ও মৃত্যুর সন। লক্ষ্য করুনঃ
ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর মৃত্যুর ৪৪ বছর পর জন্ম লাভ করেছে ইমাম বুখারী রহঃ।
ইমাম মুসলিম রহঃ এর জন্ম গ্রহণ করেছেন ৫৪ বছর পর।
ইমাম তিরমিজী রহঃ জন্ম গ্রহণ করেছেন ৬০ বছর পর।
ইমাম আবু দাউদ রহঃ জন্ম লাভ করেছেন ৫২ বছর পর।
ইমাম ইবনে মাজাহ রহঃ জন্ম গ্রহণ করেছেন ৫৯ বছর পর।
ইমাম নাসায়ী রহঃ জন্ম গ্রহণ করেছেন ৬৫ বছর পর।
ইলমে হাদীসের সাথে সম্পর্ক রাখেন এমন একজন সাধারণ শিক্ষার্থীও জানেন যে, হাদীস সহীহ বা জঈফ হয় মৌলিকভাবে সনদের দুর্বলতার কারণে। আরো অনেক কারণেও হয়, তবে মূল কারণ সনদের দুর্বলতা। অর্থাৎ সনদের মাঝে দুর্বল রাবী থাকার কারণে সহীহ হাদীসও জঈফ হয়ে যায়, এমনকি মুনকারও হয়ে যায়। আর সনদের মাঝে রাবীগণ শক্তিশালী থাকার কারণে হাদীস সহীহ হয়ে থাকে।
আমরা যদি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করি যে, ইমাম আবু হানীফা রহঃ যখন হাদীসের আলোকে মাযহাব সংকলিত করেন, তখন যে হাদীস সনদের শক্তিশালীত্বের কারণে সহীহ ছিল, উক্ত হাদীসটি ৪০/৫০ বছর পরেও সহীহ থাকা শর্ত কি না? অবশ্যই নয়। কারণ, একটি হাদীস যখন ইমাম আবু হানীফা রহঃ দেখলেন, সে হাদীসটি তার কাছে সহীহ, কারণ তার মাঝে এবং সাহাবীর মাঝে একজন বা সর্বোচ্চ দুইজনের মাধ্যম বিদ্যমান। সেই একজন বা দুইজনও শ্রেষ্ঠ যুগের লোক। তাদের মাঝে হাদীস জঈফ হওয়ার কোন কারণ বিদ্যমান হওয়া প্রায় অসম্ভব। যেখানে ইমাম আবু হানীফা রহঃ নিজেই একজন জাঁদরেল মুহাদ্দিস এবং জারাহ তাদীলের ইমাম। সেখানে তিনি কোন সহীহ হাদীস ছাড়া গ্রহণ করতেই পারেন না। যেমনটি আমাদের গায়রে মুকাল্লিদরাও অকপটে স্বীকার করে প্রচার করে বেড়ায় যে, ইমাম আবু হানীফা রহঃ বলেছেন“যখন হাদীস সহীহ হবে, তখন সেটাই আমার মাযহাব”।
তাই তিনি হাদীসের ভিত্তিতে যেসব মাসআলা বলেছেন, তার সব ক’টিই ছিল সহীহ হাদীস। যেহেতু তার এবং রাসূল সাঃ এর মাঝে মাধ্যম ছিল দুই বা একজন। তাই সনদের মাঝে দুর্বলতা আসা ছিল খুবই দূরের কথা। কিন্তু উক্ত হাদীসটি, যেটাকে ইমাম আবু হানীফা রহঃ সনদ শক্তিশালী হওয়ার কারণে সহীহ হিসেবে মত দিয়ে তার মাঝে নিহিত মাসআলাকে সহীহ সাব্যস্ত করেছেন, ঠিক সেই হাদীসটিই ৪০/৫০ বছর পর সনদের দুর্বলতার মাধ্যমে পরবর্তীদের কাছে যেতে পারে।
কারণ ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর কাছে যে হাদীস সহীহ হিসেবে এলো সনদ শক্তিশালী হওয়ার দ্বারা, উক্ত হাদীসটি যদি পরবর্তীতে কোন দুর্বল রাবী বর্ণনা করে, তাহলে উক্ত হাদীসটি উক্ত দুর্বল ব্যক্তির বর্ণনার কারণে যার কাছে বর্ণনা করল, তার কাছে হয়ে যাচ্ছে দুর্বল তথা জঈফ। কিন্তু সে হাদীস কিন্তু ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর জমানায় সহীহই ছিল। সেটি জঈফ হয়েছে পরবর্তীতে এসে। তাহলে সহীহ থাকা অবস্থায় উক্ত হাদীসের ভিত্তিতে যেহেতু ইমাম আবু হানীফা রহঃ স্বীয় মাযহাব দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন, তাই ৪০/৫০ বছর পরের কোন মুহাক্কিকের কাছে জঈফ সুত্রে পৌঁছার কারণে জঈফ মনে হলেও আবু হানীফা রহঃ এর মাযহাব কিন্তু জঈফ হাদীস নির্ভর হয়ে যাচ্ছে না।”
এবারো লা-জওয়াব হয়ে গেলেন লা-মাযহাবী হতে দাওয়াত পাওয়া ভাইটি। অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। মনে হচ্ছিল তার মন থেকে দ্বিধা আর সন্দেহের পর্দা বুঝি আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। সত্যালো উঁকি দিচ্ছে তার মন ও মননে।
আমি আবার বললাম, “সময় খুবই কম। রাত হয়ে যাচ্ছে, আপনাদের আবার ফিরে যেতে হবে অনেক দূর।
তাই কথাকে সংক্ষেপ করে ফেলছি। আপনি এতটুকুতো আশা করি বুঝতে পারছেন যে, আপনাকে অনেক বিষয়ে ওরা বিভ্রান্ত করেছে তাইনা?”
ভাইটি বলতে লাগল- “আচ্ছা যদি ওদের কথাও হাদীসে থেকে থাকে, তাহলে মানতে সমস্যা কোথায়?”
আমি বললাম, “আপনি মানবেন কিভাবে? আগেইতো উল্লেখ করেছি, কোন মুজতাহিদ ইমামের ইজতিহাদ ছাড়া আপনি শুধু কুরআন ও সহীহ হাদীস দেখে দ্বীন মানতেই পারবেন না। বরং বিভ্রান্তি আর ঝগড়া শুধু বেড়েই চলবে। তাই বিজ্ঞ একজন মুজতাহিদের অনুসরণ করে দ্বীন পালন সহজ হবে। যা আল্লাহ তাআলারই নির্দেশ। কুরআনের একাধিক আয়াতে জ্ঞানী মুজতাহিদগণের অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই নয়কি?
আচ্ছা, যাইহোক আজ সময় কম। রাত হয়ে যাচ্ছে, চলুন, আমি আপনাকে মতভেদপূর্ণ মাসআলায় একটি মূলনীতি শিক্ষা দিচ্ছি। যে আপনাকে দাওয়াদ দিয়েছে, তার কাছ থেকে এসবের জবাব জানতে চাইবেন। দেখবেন তাদের ধোঁকাবাজী আপনার সামনে কিভাবে পরিস্কার হয়ে যাবে।”
ভাইটি বললেন, “বলেন।”
আমি বললাম, “আচ্ছা, নামায সঠিকভাবে আদায় করার জন্য, নামাযের ফরজ কয়টি? সুন্নত কয়টি? ওয়াজিব কয়টি? নিষিদ্ধ বিষয় কয়টি? মাকরূহাত কয়টি? তাছাড়া এসবের সংজ্ঞা কি? এসবের বিধান কি? কোনটি ছেড়ে দিলে নামায হবে? কোনটি ছেড়ে দিলে নামায নামায হবে না? কোনটি ছেড়ে দিলে নামায অসম্পূর্ণ হবে? কোনটি করা যাবেই না? এসব জানা কি জরুরী নয়?”
ভাইটি বললেন, “হ্যাঁ, তাতো জরুরী।”
আমি বললাম, “তো আপনি তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করবেন, সহীহ হাদীসের দ্বারা এসব প্রমাণ করে দেখাবে। যেসব সহীহ হাদীসে এ বিভাজন এবং সংজ্ঞা ও এসবের হুকুম উল্লেখপূর্বক বলা হয়েছে”।
ভাইটি বলল, “ভাই! এটাতো সম্ভব না।”
আমি বললাম, “তাহলে আপনার নামায হচ্ছে কি না? আপনি কিভাবে বুঝতে পারবেন যদি এসব আপনার জানা না থাকে?”
ভাইটি বলতে লাগলেন, “আসলে ওরা আমাকে বলেছে যে, নামাযে রাসূল সাঃ যা করেছেন, তাই করা আবশ্যক। ফরজ ওয়াজিব বলে কিছুই নাই। তিনি নামাযরত অবস্থায় যা কিছু করেছেন, সবই আমাদের করা জরুরী। যদি তা না করি, তাহলে আমাদের নামায হবে না।”
আমি বললাম, “আচ্ছা, তাই নাকি? তাহলে আপনি তাদেরকে বলবেন, আমি আপনাকে প্রথমেই যেমন বলেছি যে, জুতা পরিধান করে তাহলে নামায পড়া আবশ্যক? স্ত্রীকে চুম্বন করে নামাযে দাঁড়ানো আবশ্যক? নাতিকে কাঁধে নিয়ে নামায পড়া তাহলে আবশ্যক? সেজদায় যেতে ও আসতে রফয়ে ইয়াদাইন তথা হাত উঠানো আবশ্যক?”
ভাইটি বললেন, “নাহ, এসবতো আবশ্যক নয়।”
আমি বললাম, “ইচ্ছে হলেই একটিকে আবশ্যক বলবেন, একটিকে জরুরী বলবেন, অথচ নিজের দাবির পক্ষে কুরআন বা হাদীসের কোন দলীল উপস্থাপন করবেন না, এ কেমন নীতি হে? এর নাম কুরআন ও হাদীসের অনুসরণ না নিজের মনের পূজা?
চেহারাটা উদ্ভাসিত হয়ে গেল ভাইটির। হাসি হাসি চেহারাতেই বলতে লাগলেন- “ আমার মনেও মাঝে মাঝে প্রশ্নের উদয় হয়। আমি ওদেরকে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতাম। কিন্তু ওরা অনেক প্রশ্ন এড়িয়ে যেত। আমি তাদের একদিন বলেছিলাম, ‘কুরআনে এসেছে, যখন কুরআন পড়া হয়, তখন শোন এবং চুপ থাক”।
তাহলে আমরা কেন ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়ি? তখন ওরা আমাকে জবাবে বলে যে, সূরা ফাতিহা কুরআনের অন্তর্ভূক্ত নয়। ওরা আরো কি কি সব দলীল জানি পেশ করেছিল। আমিতো আলেম না, তাই মনে রাখতে পারিনি।”
আমি বললাম, “দেখেছেন কিভাবে তাদের মনগড়া মত সাব্যস্ত করার জন্য কুরআনের সর্বপ্রথম সূরাটিকেই অস্বিকার করে দিল। যদি সূরা ফাতিহা কুরআন না হয়, তাহলে কুরআনের সকল নুসখার শুরুতে এ সূরা কেন আছে? তাহলে যা কুরআন নয়, তাকে কি কুরআন হিসেবে চালানো হচ্ছে কুরআনে লিখে নাউজুবিল্লাহ!
এরকম ভ্রান্ত দল আরো আছে কি না? আমার সন্দেহ জাগে। যারা নিজেদের অন্ধ বিশ্বাস প্রমাণের জন্য কুরআনের সর্বপ্রথম সূরাকেই কুরআন হওয়া থেকে অস্বিকার করে দিচ্ছে।
অথচ কুরআনে এসেছে যে, وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ (২০৪)
যখন কুরআন পড়া হয়, তখন তোমরা তা মনযোগ সহকারে শোন এবং চুপ থাক। {সূরা আরাফ-২০৪}
অথচ এ আয়াতের আদেশ অগ্রাহ্য করে নামাযের মাঝে ইমাম যখন সূরা ফাতিহা পড়ে, তখন তা না শোনে কথিত আহলে হাদীস মুসল্লিরা সবাই সূরা ফাতিহা পড়ছে। কুরআনের আয়াতের নির্দেশ অমান্য করতে আরো একটি মারাত্মক জালিয়াতীর আশ্রয় নিয়ে বলছে, সূরা ফাতিহা নাকি কুরআনের অন্তর্ভূক্তই না। হাদীসের অনুসারী দাবিদার এমন মারাত্মক বেআদব আরো আছে কি না? আমার সন্দেহ হচ্ছে।”
ভাইটি বলতে লাগল, “ওরা বলে যে, সূরা ফাতিহা কিরাতের অন্তর্ভূক্ত না, কুরআনের অন্তর্ভূক্ত।”
আমি বললাম, “এর মানে কি যে সূরা ফাতিহা কুরআনের অন্তর্ভূক্ত? কুরআনের অন্তর্ভূক্ত হয়ে সেটি কিরাত তথা পাঠের অন্তর্ভূক্ত হতে বাদ যাচ্ছে কেন? যদি সূরা ফাতিহা কিরাত তথা পাঠের অন্তর্ভূক্ত না হয়, তাহলে এ সূরা সবাইকে পড়ানোর জন্য এত তোড়জোড় কিসের? কিরাত মানেতো পাঠ তথা তিলাওয়াত করা। যেটি কিরাতের অন্তর্ভূক্তই নয়, সেটিকে সবাই পড়ার জন্য এত লাফালাফি করার মানে কি?”
ভাইটি বলতে লাগল, “বুঝতে পারছি। আরেকদিন আপনার কাছে সময় নিয়ে আসতে হবে। একদিন সকালে আসবো। দীর্ঘ সময় আলোচনা করলে আমার কাছে বিষয়গুলো আরো পরিস্কার হবে আশা করি।”
আমি বললাম, “আমার আগের কথাগুলো যদি আপনার মাথায় ঢুকে থাকে, তাহলে সত্য বুঝতে আশা করি আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে। আর যেসব প্রশ্ন করতে তাদের বলেছিলাম, তা আশা করি আপনি করবেন”।
ভাইটি বলতে লাগল, “আচ্ছা, বুখারীতে নাকি একটি হাদীস আছে, আমিও বাংলায় দেখেছি যে, ‘সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না’।
তাহলে আমরা কেন সূরা ফাতিহা পড়বো না ইমামের পিছনে?”
আমি বললাম, আমাকে জবাব দিন- “খুতবা ছাড়া জুমআ হয় না” কথাটি সঠিক কি না?
ভাইটি- অবশ্যই সঠিক।
আমি- “আজান ছাড়া জামাত সুন্নতের খেলাফ হয়” কথাটি সঠিক কি না?
ভাইটি- হ্যাঁ, ঠিক।
আমি- “ইকামত ছাড়া জামাত সুন্নতের খেলাফ হয়” কথাটি ঠিক না?
ভাইটি- হ্যাঁ, ঠিক।
আমি বললাম, “এবার আমাকে আপনি বলেন, খুতবা ছাড়া যেহেতু জুমআ হয় না, তাই মুসল্লিরা যেহেতু খুতবা পড়ে না, তাই
কারো জুমআ আদায় হয় না?
আজান ও ইকামত ছাড়া যেহেতু জামাত সুন্নতের খেলাফ হয়, তাই মুয়াজ্জিন ছাড়া বাকি সকল মুসল্লি ও ইমামের নামায সুন্নতের খেলাফ হচ্ছে, কারণ তারা কেউ আজান ও ইকামত দেয়নি?”
ভাইটি- হ্যাঁ, তাইতো এমনতো কেউ বলে না। ইমামের খুতবাইতো মুসল্লিদের খুতবা বলে ধর্তব্য হয়। মুয়াজ্জিনের আজান ও ইকামতইতো সবার আজান ও ইকামত বলে সাব্যস্ত হয়। সবার বলাতো জরুরী নয়। একজনের বলা মানেইতো সবার বলা।”
আমি বললাম, “তাহলে সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না” এক্ষেত্রে ইমামের সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত কেন মুসল্লির পক্ষ থেকে হবে না? সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না একথা কে অস্বিকার করছে? কিন্তু কথা হচ্ছে, নামায হয় না বলে কি সবারই পড়তে হবে? না ইমামের পড়ার দ্বারা সবার হয়ে যাবে?
“যেমন খুতবা ছাড়া জুমআ হয় না” কিন্তু কথা হচ্ছে ইমামের খুতবা সবার পক্ষ থেকে হবে কি না? নাকি সবারই জুমআর খুতবা বলতে হবে?
ভাইটি এবার হেসে দিলেন। হাসতে বলতে লাগলেন “এভাবেতো আসলে ভাবিনি, কথাতো ঠিকই। সবারতো খুতবা পড়া লাগে না, ইমামের খুতবাই মুসল্লির খুতবা হিসেবে ধর্তব্য হয়ে যায়।”
আমি বললাম, “এভাবেই সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায হয় না, কিন্তু ইমামের সূরা ফাতিহা পড়ার দ্বারা সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। হাদীসে এসেছে-
مَنْ كَانَ لَهُ إِمَامٌ فَإِنَّ قِرَاءَتَهُ لَهُ قِرَاءَةٌ
রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যার ইমাম আছে, তার ইমামের কিরাত মানেই মুসল্লির কিরাত বলে ধর্তব্য হবে। {মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং-১২৪, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৪৬৪৩, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৮৫০, তাহাবী শরীফ, হাদীস নং-১২৮৭, সুনানে দারাকুতনী, হাদীস নং-১২৩৩, মুসনাদে আবী হানীফা, হাদীস নং-২৫}
যাইহোক, আপনাকে যে দাওয়াত দিচ্ছে, তাকে বলবেন, নামাযের ক্ষেত্রে যেসব নতুন নতুন আমল আপনাকে শিখিয়েছে, সেসব বিষয়ের পূর্ণ আমলের রেফারেন্স যেন আপনাকে দেয়। আংশিক আমলের নয়। যেমন এক ব্যক্তি প্রতিদিন জোহরের ফরজ পড়ে আট রাকাত। এখন লোকটির কাছে যদি এ আট রাকাত পড়ার দলীল চাওয়া হয়, আর লোকটি জোহর নামায পড়া ফরজ একথার দলীল পেশ করে, তাহলে কি তার মতের দলীল হবে?”
ভাইটি বললেন- “নাহ, হবে না। আট রাকাতের দলীল দিতে হবে”।
আমি বললাম, “ঠিক তাই। জোহরের নামায ফরজ একথায়তো কোন মতভেদই নেই। মতভেদ হল আট রাকাত নিয়ে। যেহেতু জোহরের নামায আট রাকাত পড়ছে, তাই দলীল দিবে আট রাকাতের। শুধু জোহর ফরজ একথার দলীল দিলে তার মত প্রমাণিত হয় না।
তেমনি আহলে হাদীসরা নামাযে যেসব আমল করে থাকে, তার পূর্ণাঙ্গ আমলের দলীল দিবে কুরআন ও সহীহ হাদীস দিয়ে, আংশিক দিলে উক্ত ব্যক্তির মতই ধোঁকাবাজ ও প্রতারক সাব্যস্ত হবে তাই নয়কি?”
ভাইটি বললেন, “হ্যাঁ, দলীলতো পূর্ণ আমলেরই দিতে হবে। আংশিক আমলের দিবে কেন?”
আমি বললাম, “আচ্ছা, ঠিক আছে, চলুন, আমি আপনাকে কয়েকটি আমলের পূর্ণ দলীল চাচ্ছি, যা আপনি তাদের কাছে জানতে চাইবেন-
আহলে হাদীসরা বলে- রফয়ে ইয়াদাইন তথা নামাযে তাকবীরে তাহরীমা ছাড়াও হাত তুলতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের পরিপূর্ণ আমল কি?
চার রাকাত নামাযে তারা ১০ স্থানে রফয়ে ইয়াদাইন করে থাকে, যথা প্রথম ও তৃতীয় রাকাতের শুরুতে এবং প্রতি রাকাতের রুকুতে গমণের সময় এবং উঠার সময়। এই হল মোট ১০ স্থান। এই ১০ স্থানে তারা রফয়ে ইয়াদাইন করে থাকে। আর ১৮ স্থানে রফয়ে ইয়াদাইন করে না। যথা দ্বিতীয় রাকাত ও চতুর্থ রাকাতের শুরুতে এবং প্রতি রাকাতের সেজদাতে গমণ ও উঠার সময়। তাহলে প্রতি রাকাতে দুটি করে সেজদা হলে চার রাকাত নামাযে হচ্ছে ১৬টি সেজদা, আর দ্বিতীয় ও চতুর্থ রাকাতের শুরু নিয়ে হল ১৮টি স্থান। যে ১৮ স্থানে আহলে হাদীস দাবিদার ভাইয়েরা রফয়ে ইয়াদাইন করে না।
সেই সাথে তাদের দাবি হল এটি রাসূল সাঃ এর সর্বশেষ আমল।
আর যারা রফয়ে ইয়াদাইন করে না, তাদের নামায হয় না।
তাহলে রফয়ে ইয়াদাইনের ক্ষেত্রে আহলে হাদীসদের পরিপূর্ণ আমল ও দাবি কি?
১- ১৮ স্থানের রফয়ে ইয়াদাইনের নিষেধাজ্ঞা।
২- ১০ স্থানে রফয়ে ইয়াদাইন করতে হবে।
৩- সর্বদা করতে হবে এ শব্দ।
১- যারা এভাবে রফয়ে ইয়াদাইন করবে না, তাদের নামায হবে না।
এ চারটি পয়েন্টসহ দলীল উপস্থাপন করতে হবে। শুধু আংশিক দলীল গ্রহণযোগ্য হবে না। যদি আংশিক দলীল পেশ করে পরিপূর্ণ আমল করে, তাহলে তারা ধোঁকাবাজ প্রমানিত হয়ে যাবে।
ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া
গায়রে মুকাল্লিদরা [জেহরী তথা জোরে কেরাত পড়া নামাযে] নামাযের মাঝে ইমামের পিছনে ১১৩ সূরা কখনোই পড়ে না। এসব পড়াকে তারা নিষিদ্ধ ও হারাম বলে থাকে।
আরো বলে থাকে যে, “যেমন সকল জামাতে পড়া নামাযের জন্য এক আজান, এক ইকামত, এক খুতবা ও একটি সুতরাই যথেষ্ঠ। তেমনি এক সূরা সকলের পক্ষ থেকে যথেষ্ট। কিন্তু সূরা ফাতিহা ইমামের পড়ার দ্বারা মুক্তাদীর জন্য যথেষ্ট হবে না। প্রতিটি মুক্তাদী নিজেই তা পড়া আবশ্যক। নতুবা মুক্তাদীদের নামায বাতিল ও বেকার হয়ে যাবে। আর [সিররী তথা কেরাত আস্তে পড়া নামায] নামাযের মাঝে মুক্তাদীদের জন্য সূরা ফাতিহা পড়া ফরজ। আর সূরা মিলানো মুস্তাহাব”।
এসব মাসআলা গায়রে মুকাল্লিদ বিতার্কিক প্রথমে কুরআন পাক দ্বারা প্রমাণ করবে। যদি না করতে পারে, তাহলে লিখে দিবে যে, “এ মাসআলায় কুরআনে পাক আমাদের মাথায় হাত রাখতে তৈরী নয়”।
দ্বিতীয় নাম্বার, এ পূর্ণাঙ্গ মাসআলাটিই এমন কিতাব দ্বারা প্রমাণিত করবে, যার সংকলক না মুজতাহিদ না মুকাল্লিদ। বরং গায়রে মুকাল্লিদ। সেই সাথে উক্ত হাদীসটি সহীহ হওয়াটিও দলিল দ্বারা প্রমাণ করতে হবে। স্মর্তব্য- গায়রে মুকাল্লিদদের নিকট দলিল শুধুমাত্র কুরআন ও হাদীস। কোন উম্মতীর বক্তব্য উপস্থাপন করার সাথে সাথেই তাকে বিতর্ক থেকে উঠিয়ে দেয়া হবে।
আমীন বিলজেহের তথা আমীন জোরে বলা প্রসঙ্গে
১- সবাই জানে যে, অধিকাংশ নামায যেমন সুন্নাত ও নফল একাকি পড়া হয়। সে সময় গায়রে মুকাল্লিদরা আমীন আস্তে আস্তে বলে।
২-জামাতের সাথে নামাযে ইমাম একজন হয়, আর মুক্তাদী হয় বাকিরা। এখানে একটি বিষয় পরিস্কার থাকা দরকার যে, গায়রে মুকাল্লিদ মুসল্লি প্রতিদিন এগার সিররী [আস্তে কেরাত পড়া নামায] রাকাতের পিছনে আস্তে আস্তে আমীন বলে। আর ছয় [জেহরী নামায তথা যাতে কিরাত জোরে পড়া হয়] রাকাতে পড়ে জোরে জোরে।
এখানে দেখুন ছয় রাকাতের চেয়ে এগার রাকাত বেশি। অর্থাৎ জোরের চেয়ে আস্তে আমীন বলে বেশি। তাই আগে প্রথমে ১১ রাকাতের বিষয়টি পরিস্কার হওয়া দরকার। তারপর ছয় রাকাতের বিষয়।
৩- কোন কোন মুসল্লি এমন সময় শরীক হয় যে, ইমাম সাহেব ফাতিহার অর্ধেক পড়ে ফেলেছে। এমতাবস্থায় মুক্তাদী ফাতিহা শেষ করার পূর্বেই ইমামের ফাতিহা শেষ হয়ে যায়। তাই সে সময়ও তার জোরে সবার সাথে আমীন বলতে হয়। তাহলে কী দাঁড়াল? মুক্তাদী সূরা ফাতিহা শেষ না করেই আমীন বলে দিল।
এভাবে সূরা ফাতিহা শেষ করার আগেই আমীন বলা কোন আয়াত বা হাদীসের দ্বারা প্রমাণিত?
৪- গায়রে মুকাল্লিদদের ইমামরাও ১১ সিররী রাকাতে সর্বদা আস্তে আমীন বলে। একাজটির প্রমাণ সর্বপ্রথম সাব্যস্ত হওয়া উচিত। তারপর যে ৬ রাকাতে জোরে জোরে আমীন বলা হয়, সেটার প্রমাণ সর্বদার শর্তের সাথে ইবারত দ্বিতীয় দফা দেখাতে হবে।
এ মাসআলাটিও গায়রে মুকাল্লিদ বিতার্কিক সর্ব প্রথম কুরআনে কারীমের দ্বারা প্রমাণিত করবে। যদি না করতে পারে, তাহলে লিখে দিবে যে, “কুরআনে কারীম এ মাসআলায় তাদের উপর হাত রাখতে তৈরী নয়”।
তারপর পূর্ণ মাসআলাটি হাদীস দ্বারা প্রমাণ করে দেখাবে। হাদীসও এমন কিতাব থেকে দেখাতে হবে, যার সংকলক না মুজতাহিদ না মুকাল্লিদ। বরং কোন গায়রে মুকাল্লিদ কিতাবটি সংকলন করেছেন। সেই সাথে হাদীসটিকে দলিল দ্বারা সহীহ সাব্যস্ত করতে হবে। আর একথা কিছুতেই ভুলবেন না যে, আহলে হাদীস দাবিদারদের নিকট দলিল শুধুমাত্র কুরআন ও হাদীস। তাই যদি গায়রে মুকল্লিদ বিতার্কিক সাহেব কোথাও কুরআন ও হাদীস ছাড়া কোন উম্মতী বা স্বীয় সিদ্ধান্ত জানায়, তাহলে তাকে সে মুনাজারা থেকে উঠিয়ে দেয়া হবে। কারণ সে তখন আর আহলে হাদীস থাকবে না। আহলে রায় হয়ে যাবে। ”
দীর্ঘ আলোচনা দ্বারা ভাইটির মনের আঁধার মনে হল অনেক কেটে যাচ্ছে। খুশি খুশি মনে বললেন, “ভাই আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম। আজ রাত হয়ে গেছে। চলে যাচ্ছি, তবে আরেকদিন আসবো সময় করে। তখন আরো বিস্তারিত আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।”
আমি বললাম, “দেখেন, ওসব বিভ্রান্তিকারী ব্যক্তিদের কাছে আর যাবেন না। আপনার ভাল চাই বলেই বলছি। আপনাকে যে দুই ভাই নিয়ে এসেছে, তাদের সাথে তাবলীগ জামাতে সময় দেন। দেখবেন ইনশাআল্লাহ এসব ধোঁকাবাজীর পর্দা কিভাবে উধাও হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আপনার মঙ্গল করুন। আমাদের জন্যও দুআ করবেন, আমরাও আপনার জন্য দুআ করি।”