প্রচ্ছদ / কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা / জবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ বলা বিষয়ে জনৈক ব্যক্তির ধৃষ্টতাসূচক অপব্যাখ্যার জবাব

জবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ বলা বিষয়ে জনৈক ব্যক্তির ধৃষ্টতাসূচক অপব্যাখ্যার জবাব

প্রশ্ন

আস সালামু আলাইকুম।

মুফতী সাব জামাতের একজন নেতা। যিনি লন্ডনে আছেন নাম মুফাস্সিল ইসলাম। তিনি প্রায়ই তার ফেসবুক একাউন্টে বিভিন্ন ভিডিও আপলোড করেন বেশির ভাগই রাজনৈতিক। মাঝে মাঝে উনার ভিডিও দেখি ইদানিং উনার ভিডিও দেখি নাই কয়েকমাস ধরে। কিন্তু কয়েকদিন আগে উনার এক ভিডিও দেখে আঁতকে উঠলাম। ভিডিওটি হল,

তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন কোরআনের থেকেঃ বিধর্মীদের দ্বারা হত্যা করা বা যেভাবে বিধর্মীরা পশু জবাই করে বা মারে, সেই সব গোস্ত খাওয়া হালাল বলে ফতুয়া দিছেন। আর বলছেন সুরা আল আন- আম ১২১ নাম্বার আয়াতে জবাহ শব্দ নেই। বা কোরআনের কোথায় ও লেখা নেই যে, বিধর্মীদের জবাই করা মাংস খাওয়া যাবে না। শুধু তাই না তিনি এক বইয়ে অনুবাদে তাফসির কিতাব থেকে জবাহ শব্দ লেখছে দেখে সেই কিতাবের লেখাকে তিরস্কার করে বলেছে তাফসির টাফসির বিশ্বাস করেন না। সে আয়াতে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন বিধর্মীদের মাংস বিস্মিল্লাহ বলে খাওয়ার কথা বলছে। বিসমিল্লাহ বলে খেলে হালাল হয়ে যাবে। তিনি বিধর্মীদের দ্বারা পরিচালিত যে কোন রেস্টুরেন্ট,ফাস্ট ফোডো বানানো গরু মুরগী সব খাওয়া হালাল বলে ফতুয়া দিছেন। মানুষকে বুঝাচ্ছেন। কিন্তু আমরা জেনে আসছি আল্লাহর নাম ছাড়া জবাইকৃত পশুর মাংশ খাওয়া হারাম। বিভিন্ন তাফসির কিতাবে ও তা লেখা আছে তবে তিনি তাফসির কিতাব গুলো মানেন না বলেছেন। আর জোর দিচ্ছেন জবাহ কোরআনে নেই তাই খাওয়া যাবে।আরেকটা জিনিস বিধর্মীরা খ্রিষ্টান দেশে জবাহ করে না, বর্তমানে তারা ইলিক্ট্রিক শট দিয়ে পশুহত্যা করে তারপর সেই মাংস বাজারে সাপ্লাই দেয়।এখন আপনি দয়া করে বিষয়টা পরিষ্কার করলে ভাল হয় হাদিস কোরআন দিয়ে।তার কথা কতটুকু যুক্তিযোক্ত।বিধর্মীদের জবাই করা বা জবাই ছাড়া ইলিক্টিক সট দিয়ে হত্যা করা পশুর মাংস কি মুসলমানদের জন্য খাওয়া হালাল কি?

প্রশ্নকর্তা– নাম ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন একদল মানুষ একুরআনের মাধ্যমেই বিভ্রান্ত হবে, আরেক দল ব্যক্তি এ  কুরআন দ্বারা সঠিক পথ পাবে। আর সঠিক পথ পায় কেবল মুত্তাকীগণ। বেআদব ব্যক্তিরা কুরআনে কারীমের মাধ্যমে কখনোই হিদায়াতপ্রাপ্ত হয় না। বরং এসব বেআদব ফাসিক ব্যক্তিরা কুরআনের দ্বারাই হয় পথভ্রষ্ট।

ইরশাদ হচ্ছে-

يُضِلُّ بِهِ كَثِيرًا وَيَهْدِي بِهِ كَثِيرًا ۚ وَمَا يُضِلُّ بِهِ إِلَّا الْفَاسِقِينَ [٢:٢٦

এ দ্বারা আল্লাহ তা’আলা অনেককে বিপথগামী করেন, আবার অনেককে সঠিক পথও প্রদর্শন করেন। তিনি অনুরূপ উপমা দ্বারা অসৎ ব্যক্তিবর্গ ভিন্ন কাকেও বিপথগামী করেন না। {সুরা বাকারা-২৬}

আরো ইরশাদ হচ্ছে-

ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ [٢:٢

এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য। {সূরা বাকারা-১}
উপরোক্ত ভিডিওতে তিনি যেভাবে মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন, আর এ বিষয়ের হাদীসের দিকে ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত করলেন না, তা দেখে রাসূল সাঃ এর বলা হাদীস অস্বিকারকারীদের চিত্রই শুধু পরিস্ফুটিত হয়েছে। অথচ কুরআনের প্রথম তাফসীর খোদ কুরআনের আয়াত। তারপরই হাদীস।

অর্থাৎ কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা দেখতে হয় প্রথমে কুরআনের অন্যান্য আয়াত দ্বারা। তারপর হাদীস দ্বারা। যদি হাদীসের দ্বারা কুরআনের আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যাটি বুঝে এসে যায়, তাহলে ভিন্ন কোন অর্থ নেয়া কিছুতেই জায়েজ নয়।

হাদীস পরিস্কার ভাষায় আছে কিন্তু কুরআনে নেই বলে কোন বিধানকে অস্বিকার করে দেয়া সুষ্পষ্ট কুফরী। আহলে কুরআন নামধারীরা কাফের হবার এটাই কারণ। কারণ তারা মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য বলে থাকে, তারা শুধু কুরআন মানে। যেসব বিধান কুরআনে পরিস্কার নেই, কিন্তু হাদীসে বর্ণিত আছে, সেসব বিধানকে তারা মানে না। অর্থাৎ তারা হাদীসকে শরীয়তের দলীল বিশ্বাস করে না। উম্মতে মুসলিমা ইজমা হল হাদীস অস্বিকারকারী এসব আহলে কুরআন নামধারীরা কাফের।

উপরোক্ত ব্যক্তির বক্তব্যের স্টাইল ও এতদসংশ্লিষ্ট হাদীসে উদ্ধৃত বিধানকে তিনি যেভাবে অস্বিকার করলেন তাতে তার আহলে কুরআন হওয়ার পরিস্কার জানান দিচ্ছে। যেমনটি রাসূল সাঃ ইরশাদ করে গেছেন-

عَنِ الْمِقْدَامِ بْنِ مَعْدِي كَرِبَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ: «أَلَا إِنِّي أُوتِيتُ الْكِتَابَ، وَمِثْلَهُ مَعَهُ أَلَا يُوشِكُ رَجُلٌ شَبْعَانُ عَلَى أَرِيكَتِهِ يَقُولُ عَلَيْكُمْ بِهَذَا الْقُرْآنِ فَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَلَالٍ فَأَحِلُّوهُ، وَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَرَامٍ فَحَرِّمُوهُ،

“জেনে রাখ, আমি কুরআন প্রাপ্ত হয়েছি এবং তার সাথে আরও অনুরূপ আরেকটি জিনিস (তা হল হাদীস)। অচিরেই দেখা যাবে, এক লোক ভরা পেটে তার খাটের উপর থেকে বলবে: তোমরা  এই কুরআনকে আঁকড়ে ধর। এতে যে সকল বস্তু হালাল পাবে সেগুলোকে হালাল মনে কর, আর যে সব বস্তুকে হারাম পাবে সেগুলোকে হারাম মনে কর।“ (আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৬০৪}

উক্ত ব্যক্তির উপরোক্ত ভ্রান্ত ফাতওয়ার মূল কারণ হল কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতা। সেই অজ্ঞতার একটি চিত্র আমরা দেখে নেই-

মুর্খতা

আরবীব্যাকরণসম্পর্কেঅজ্ঞতা

তিনি দাবি করছেন, কুরআনে জবাই শব্দ আসেনি। তাই rপশু জবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ না বললেও শুধু খাওয়ার সময় বিসমিল্লাহ বলে খেলেই জায়েজ হয়ে যাবে।

কিন্তু আফসোস! ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ, মুফতী শফী রহঃ, হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহঃ সহ সকল মুহাক্কিক ও পৃথিবী বিখ্যাত তাফসীরকারদের অবজ্ঞা করে তিনি মনগড়া মতবাদ কুরআন সম্পর্কে দাঁড় করাতে অপচেষ্টা করলেন, তা সত্যিই অবাক করা কান্ড!

অথচ আরবী ব্যকরণের সহজ পাঠটিও তার জানা নেই। অথচ দাঁড়িয়ে গেলেন পৃথিবী বিখ্যাত সব মনীষীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করার জন্য।  এমন অজ্ঞ ব্যক্তি কি করে কুরআন নিয়ে এমন ধৃষ্টতা প্রদর্শন করতে পারে?

তিনি যদি আরবী ব্যকরণ সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞানও রাখতেন, তাহলে সূরা আনআমের ১২১ নং আয়াতেই তিনি বিসমিল্লাহ ছাড়া জবাই না করলে পশুর গোস্ত খাওয়া যাবে না মর্মে কুরআনের মর্মবাণীটি উপলব্ধি করতে পারতেন।

প্রথমে আয়াতটি দেখে নিন-

وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ ۗ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَىٰ أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ ۖ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ [٦:١٢١

যেসব জন্তুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয় নি, সেগুলো থেকে ভক্ষণ করো না; এ ভক্ষণ করা গোনাহ। নিশ্চয় শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে প্রত্যাদেশ করে-যেন তারা তোমাদের সাথে তর্ক করে। যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তোমরাও মুশরেক হয়ে যাবে। {সুরা আনআম-১২১}

উক্ত আয়াতে কারীমায় লক্ষ্য করুন!

আল্লাহ তাআলা আল্লাহর নাম ছাড়া মৃত হওয়া পশুর ক্ষেত্রে যে নির্দেশটি দিয়েছেন। তাতে দু’টি ফেল তথা ক্রিয়া উদ্ধৃত করেছেন। যথা-

নাহী তথা নিষেধসূচক ক্রিয়া

নফী তাকিদ বলাম তথা অতীতকালীন নেতিবাচক অর্থবোধক ক্রিয়া।

প্রথমে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিলেন لَا تَأْكُلُوا নাহী তথা নিষেধসূচক ক্রিয়া। যার অর্থ হল, “তোমরা খেয়ো না”। যা বর্তমান ও ভবিষ্যতকালীন সময়ে উক্ত কাজটি করার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকে।

তারপর বললেন, لَمْ يُذْكَرِ তথা নফী তাকিদ বলাম তথা অতীতকালীন নেতিবাচক অর্থবোধক ক্রিয়া। যার অর্থ হল, “উল্লেখ করা হয়নি”, “নাম নেয়া হয়নি”।

তাহলে কি দাঁড়াল?

আল্লাহ তাআলা যে প্রাণীর উপর আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি ইতোপূর্বে তা খেতে নিষেধ করেছেন।

উক্ত লন্ডনী ব্যক্তির বক্তব্য অনুপাতে যদি কুরআনের আয়াত দ্বারা জবাই করার সময় বিসমিল্লাহ না বললেও খাওয়ার সময় বিসমিল্লাহ বলার দ্বারা প্রাণী হালাল হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে যে প্রাণীর উপর বিসমিল্লাহ বলা হয়নি অতীতকালে, সে প্রাণী বর্তমানে ও ভবিষ্যতে খেতে আল্লাহ তাআলা কেন নিষেধ করলেন? তার বক্তব্য অনুপাতেতো জবাই করার সময় বিসমিল্লাহ না বললেও খাবার সময় বিসমিল্লাহ বললেই উক্ত প্রাণী হালাল হয়ে যায়। তো যে প্রাণী খাওয়ার সময় বিসমিল্লাহ বললেই হালাল হয়, উক্ত প্রাণী আগে বিসমিল্লাহ না বলায় না খাওয়ার আল্লাহ তাআলার নির্দেশের মানে কি থাকে?

তাহলে কি আল্লাহ তাআলা একটি অযথা নির্দেশ দিলেন? নাউজুবিল্লাহ!

আরবী ব্যকরণের এ সহজ রীতিটিও যদি উক্ত পন্ডিত জামাতি নেতা জানতেন, তাহলে এমন আহমকী আর মুর্খতাসূলভ থিউরীটি ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে হাসির পাত্র হতেন না।

মুর্খতা নং-২

আরবী শব্দের অনুবাদ সম্পর্কে অজ্ঞতা

উক্ত কথিত গবেষক সাহেব কুরআন আয়াত সম্পর্কে অজ্ঞতাসূচক বক্তব্য প্রদান করেছেন আরেকটি কারণে। সেটি হল, তিনি কুরআনের শব্দার্থ সম্পর্কে কোন ধারণাই রাখেন না। তিনি ভেবেছেন জবাই শব্দের আরবী শুধু “জবীহা” হয়ে থাকে। আর কোন আরবী শব্দ জবাই অর্থবোধক হতে পারে না। তাই তিনি বাংলা জবাই শব্দের আরবী “উহিল্লা” এলেও তিনি জবিহা শব্দ না পেয়ে অজ্ঞতার কারণে ফাতওয়া দিয়ে দিলেন কুরআনে জবাই শব্দ নেই। তাই আল্লাহর নাম ছাড়া জবাই করলেও তা খাওয়া যাবে।

হায়রে মুর্খতা! একবারও যাচাই করার প্রয়োজন অনুভব করলেন না কুরআনের আয়াতে উদ্ধৃত “উহিল্লা” শব্দটির অর্থ কি?

এরকম জাহিল ব্যক্তিরা সেজে বসেছে মুফাক্কিরে ইসলাম!

আমরা প্রথমে জবাই করার সময় বিসমিল্লাহ না বললে উক্ত প্রাণী খাওয়া নিষেধ সম্বলিত কয়েকটি পরিস্কার অর্থবোধক আয়াত দেখে নেই-

إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ ۖ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ [١٦:١١٥]

অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের জন্যে হারাম করেছেন রক্ত, শুকরের মাংস এবং যা জবাই কালে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম উচ্চারণ করা হয়েছে। অতঃপর কেউ সীমালঙ্ঘন কারী না হয়ে নিরুপায় হয়ে পড়লে তবে, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। {সূরা নাহল-১১৫}

إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنزِيرِ وَمَا أُهِلَّ بِهِ لِغَيْرِ اللَّهِ ۖ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَلَا إِثْمَ عَلَيْهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ [٢:١٧٣

তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন, মৃত জীব, রক্ত, শুকর মাংস এবং সেসব জীব-জন্তু যা আল্লাহ ব্যাতীত অপর কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানী ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয়, তার জন্য কোন পাপ নেই। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মহান ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু। {সূরা বাকারা-১৭৩}

حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَن تَسْتَقْسِمُوا بِالْأَزْلَامِ ۚ ذَٰلِكُمْ فِسْقٌ ۗ الْيَوْمَ يَئِسَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن دِينِكُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ ۚ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ۚ فَمَنِ اضْطُرَّ فِي مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لِّإِثْمٍ ۙ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ [٥:٣

তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে মৃত জীব, রক্ত, শুকরের মাংস, যেসব জন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গকৃত হয়, যা কন্ঠরোধে মারা যায়, যা আঘাত লেগে মারা যায়, যা উচ্চ স্থান থেকে পতনের ফলে মারা যা, যা শিং এর আঘাতে মারা যায় এবং যাকে হিংস্র জন্তু ভক্ষণ করেছে, কিন্তু যাকে তোমরা যবেহ করেছ। যে জন্তু যজ্ঞবেদীতে যবেহ করা হয় এবং যা ভাগ্য নির্ধারক শর দ্বারা বন্টন করা হয়। এসব গোনাহর কাজ। আজ কাফেররা তোমাদের দ্বীন থেকে নিরাশ হয়ে গেছে। অতএব তাদেরকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় কর। আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। অতএব যে ব্যাক্তি তীব্র ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ে; কিন্তু কোন গোনাহর প্রতি প্রবণতা না থাকে, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল। {সূরা মায়িদা-৩}

চলুন এবার দেখে নেই কুরআনের আয়াত সমূহে উদ্ধৃত “উহিল্লা” শব্দটির অনুবাদ ভাষাবিদগণ কি করেছেন তা দেখে নেই-

وأَصل الإِهْلال رفعُ الصوتِ. وَكُلُّ رافِعٍ صوتَه فَهُوَ مُهِلٌّ، وَكَذَلِكَ قَوْلُهُ عَزَّ وَجَلَّ: وَما أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ*؛ هُوَ مَا ذُبِحَ لِلْآلِهَةِ وَذَلِكَ لأَن الذَّابِحَ كَانَ يسمِّيها عِنْدَ الذَّبْحِ، فَذَلِكَ هُوَ الإِهْلال

“ইহলাল” শব্দের মূল অর্থ হল আওয়াজ উঁচু করা। যেই আওয়াজ উঁচু করে সেই “মুহিল্ল”। আর তেমনি আল্লাহ তাআলার বাণী “ওমা উহিল্লা লিগাইরিল্লাহি বিহী”। এটি হল যাকে অনেক ইলাহের জন্য জবাই করা হয়েছে। আর এখানে জবাই এ অর্থে যে, যেহেতু জবাইকারী জবাইয়ের সময় এসবের নাম উচ্চারণ করে থাকে। তাই এ জবাইয়ের নামই “ইহলাল”। {লিসানুল মিযান}

একই বক্তব্য দ্রষ্টব্য- তাহযীবুল লুগাহ, বর্ণনা নং-১৭৬৪}

ইমাম মালিক রহঃ থেকে বর্ণিত উহিল্লা লিগাইরিল্লাহ এর মাঝে উহিল্লা অর্থ হল জবীহা।

দেখুন-

আলমুহকাম ওয়াল মুহীতুল আজম, ف س قঅধ্যায়।

তাজুল আরূস, ف س قঅধ্যায়।

জবাইয়ের সময় যাতে নাম নেয়া হয়, তাকে উহিল্লা বলে। {কিতাবুল আফআল- باب الثنائي المضاعف}

আরবী অভিধান সম্পর্কে সম্মক অবগতি থাকলে উক্ত আয়াতে কারীমার মাঝেই জবাই শব্দটি বিদ্যমান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। যা পরিস্কার প্রমাণ করছে যে, আল্লাহর নাম ছাড়া প্রাণী জবাই করা হলে তা ভক্ষণ করা মুসলমানদের জন্য জায়েজ নয়।

মুর্খতা নং-৩

রাসূল সাঃ থেকে বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞতা

হযরত আবায়া বিন রিফায়া রাঃ থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে একাংশে তার দাদা রাসূল সাঃ কে প্রশ্ন করেন-

أَفَنَذْبَحُ بِالقَصَبِ؟ فَقَالَ: ” مَا أَنْهَرَ الدَّمَ وَذُكِرَ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ فَكُلْ

আমরা কি বাঁশের কঞ্চি দিয়ে প্রাণী জবাই করতে পারি? তখন রাসূল সাঃ জবাবে বলেন, যে প্রাণীর রক্ত প্রবাহিত করা হয়, আর তাতে বিসমিল্লাহ বলা হয়, তা খাও। {বুখারী, হাদীস নং-৩০৭৫,২৯১০, ৫৪৯৮,৫১৭৯}

عَنْ عَدِيِّ بْنِ حَاتِمٍ، قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرَأَيْتَ إِنْ أَحَدُنَا أَصَابَ صَيْدًا وَلَيْسَ مَعَهُ سِكِّينٌأَيَذْبَحُ بِالْمَرْوَةِ وَشِقَّةِ الْعَصَا؟ فَقَالَ: «أَمْرِرِ الدَّمَ بِمَا شِئْتَ، وَاذْكُرِ اسْمَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ»

হযরত আদী বিন হাতিম রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমাদের মাঝে কেউ শিকারের প্রাণী ধরে। তারপর তার কাছে ছুড়ি না থাকে, এমতাবস্থায় সে কি কাঁচ ও লাকড়ির কঞ্চি দিয়ে জবাই করতে পারে? রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন, যেটা দিয়ে চাও রক্ত প্রবাহিত কর। আর রক্ত প্রবাহিত করার সময় আল্লাহর নাম নিয়ে নাও। {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২৮২৪}

আল্লাহর নামে জবাই করা না হলে উক্ত প্রাণী খাওয়া যাবে না মর্মে একটি পরিস্কার হাদীস দেখুন-

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، ” أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقِيَ زَيْدَ بْنَ عَمْرِو بْنِ نُفَيْلٍ بِأَسْفَلِ بَلْدَحٍ، قَبْلَ أَنْ يَنْزِلَ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الوَحْيُ، فَقُدِّمَتْ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سُفْرَةٌ، فَأَبَى أَنْ يَأْكُلَ مِنْهَا، ثُمَّ قَالَ زَيْدٌ: إِنِّي لَسْتُ آكُلُ مِمَّا تَذْبَحُونَ عَلَى أَنْصَابِكُمْ، وَلاَ آكُلُ إِلَّا مَا ذُكِرَ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ،

 

হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ এর কাছে ওহী নাজিল হবার আগে জায়েদ বিন নুফাইল এর সাথে আসফালি বালদাহ নামক স্থানে সাক্ষাৎ হয়। তখন রাসূল সাঃ এর সামনে দস্তরখান বিছানো হয়। [আর কিছু গোস্ত উপস্থিত করা হয়] রাসূল সাঃ তা খেতে অস্বিকৃতি জানালেন। তারপর জায়েদ বলেন, আমি সে প্রাণী খাই না, যা তোমরা মুর্তির নামে জবাই কর। আমি শুধু ঐ প্রাণীই ভক্ষণ করি যার উপর আল্লাহর নাম নেয়া হয়েছে। {বুখারী, হাদীস নং-৩৮২৬, ৩৬১৪}

প্রশ্নোক্ত ব্যক্তির বক্তব্য অনুপাতে জবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম না নিলেও যদি শুধু খাবার সময় বিসমিল্লাহ বললেই প্রাণীর গোস্ত হালাল হয়ে যেতে তাহলে রাসূল সাঃ কেন বিসমিল্লাহ বলে উক্ত গোস্ত খেলেন না?

কেন তিনি জানালেন জবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ না বললে উক্ত গোস্ত খাওয়া যায় না?

আরো পরিস্কার হাদীস দেখুন

عَنْ عَدِيِّ بْنِ حَاتِمٍ، قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، >>> قُلْتُ: إِنِّي أُرْسِلُ كَلْبِي، أَجِدُ مَعَهُ كَلْبًا آخَرَ، لاَ أَدْرِي أَيُّهُمَا أَخَذَهُ؟ فَقَالَ: «لاَ تَأْكُلْ، فَإِنَّمَا سَمَّيْتَ عَلَى كَلْبِكَ وَلَمْ تُسَمِّ عَلَى غَيْرِهِ»

হযরত আদী বিন হাতিম রাঃ বলেন, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার শিকারী কুকুরকে পাঠালাম। কিন্তু আমি আমার কুকুরের সাথে আরো কুকুর দেখতে পেলাম। আর আমার একথা জানা নেই যে, কোন কুকুর প্রাণীটি শিকার করেছে? [তখন করণীয় কি?] রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন, এ প্রাণীকে খেয়ো না! কেননা, তোমার কুকুরের উপরতো বিসমিল্লাহ বলা হয়েছে, কিন্তু অন্য কুকুরের উপরতো বিসমিল্লাহ বলা হয়নি। {বুখারী, হাদীস নং-৫৪৮৬,৫১৬৮}

 

উপরোক্ত ব্যক্তির বক্তব্য অনুপাতে যদি খাওয়ার সময় বিসমিল্লাহ বললেই প্রাণী হালাল হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে রাসূল সাঃ উক্ত শিকারী প্রাণীকে খেতে নিষেধ করলেন কেন?

কেন বিসমিল্লাহ বলে খেয়ে ফেলার ফাতওয়া রাসূল সাঃ দেননি?

আদী বিন হাতিম রাঃ থেকে বর্ণিত আরেক হাদীসে রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন-

وَإِذَا خَالَطَ كِلاَبًا، لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهَا، فَأَمْسَكْنَ وَقَتَلْنَ فَلاَ تَأْكُلْ،

যদি তোমাদের [শিকারী] কুকুরের সাথে শিকার করার মাঝে এমন কুকুরও শামিল হয়, যাকে ছাড়ার সময় আল্লাহর নাম নেয়া হয়নি, আর তারা মিলেমিশে প্রাণীটি ধরে হত্যা করে, তাহলে তোমরা উক্ত প্রাণীকে খাবে না। {বুখারী, হাদীস নং-৫৪৮৪, ৫১৬৭}

যদি খাওয়ার সময় বিসমিল্লাহ বললেই প্রাণী হালাল হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে রাসূল সাঃ উক্ত শিকারী প্রাণীকে খেতে নিষেধ করলেন কেন?

কেন বিসমিল্লাহ বলে খেয়ে ফেলার ফাতওয়া রাসূল সাঃ দেননি?

এখানে মাত্র ৫টি হাদীস উদাহরণ স্বরূপ উদ্ধৃত করা হল। এরকম অসংখ্য হাদীস হাদীসের গ্রন্থগুলোকে বিদ্যমান রয়েছে, যা পরিস্কার প্রমাণ করছে যে, জবাই করার সময় বিসমিল্লাহ না বললে উক্ত প্রাণী খাওয়া হালাল হয় না। এটা রাসূল সাঃ এর নির্দেশ।

কিন্তু সাড়ে চৌদ্দশ পরে এসে কুরআনের মহা পন্ডিত উক্ত মুফাসসিল সাহেব রাসূল সাঃ এর উক্ত নির্দেশকে কুরআনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে অস্বিকার করতে চাচ্ছে। যা চরম ধৃষ্টতা ও কুফরী মানসিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।

এরকম মুর্খ ব্যক্তিদের কোন অধিকার নেই কুরআন ও হাদীস বিষয়ে ব্যাখ্যা পেশ করা।

একজন মুচি যদি ডাক্তারী প্রেশক্রিপশন লিখতে শুরু করে দেয়, তাহলে যেমন চিকিৎসার উপর কেয়ামত নেমে আসবে, তেমনি এসব অজ্ঞ ও জাহিল ব্যক্তিদের কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে সমাধান পেশ করার মাধ্যমেও দ্বীনী বিধানের উপর কেয়ামত নেমে আসার নামান্তর হয়ে যাচ্ছে।

আল্লাহ তাআলা এসব মুর্খ গবেষকদের অজ্ঞতাসূচক গবেষণার ভয়াবহ ছোবল থেকে মুসলিম উম্মাহকে হিফাযত করুন। আমীন।

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল- [email protected]

[email protected]

0Shares

আরও জানুন

সালাতুত তাসবীহ চার রাকাতের নিয়ত করে দুই রাকাত পড়ে সালাম ফিরিয়ে ফেললে করণীয় কী?

প্রশ্ন আসসালামুআলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ । হযরত একটি মাসআলার সমাধান দিয়ে উপকৃত করিবেন। আমি 4 রাকাত …