লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
গত ৯ই ফেব্রুয়ারী ২০১৩ ঈসাব্দ রোজ রবিবার রাত সাড়ে ৮ এর দিকে জামিয়াতুল আসআদে আসেন আহলে হাদীসদের বিভ্রান্তিকর দাওয়াতে বিভ্রান্ত এক দ্বীনী ভাই। [আমি তখন জামিয়াতুল আস’আদে শিক্ষকতার দায়িত্বে ছিলাম। এখন সেখানে নেই। এখন আছি তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকায়।
কুশল বিনিময়ের পর আমি জিজ্ঞাসা করলাম- আপনি আগে কী করতেন ধর্মীয় বিষয়ে আর এখন কী করেন?
ভাইটি- আগে নামাযে রফয়ে ইয়াদাইন করতাম না এখন করি, আগে আমীন জোরে বলতাম না এখন করি, আগে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়তাম না এখন পড়ি, আগে পা ছড়িয়ে দাঁড়াতাম না এখন দাঁড়াই ইত্যাদি।
আমি- এরকম আগে কেন করতেন? আর এখন কেনইবা ছেড়ে দিলেন?
ভাইটি- মা-বাবা, দাদা-দাদীদের এমনভাবে নামায পড়তে দেখলাম তাই করতাম, কিন্তু একদিন এক এক ভাইয়ের বক্তৃতা শুনে তারপর সালাফী পাবলিকেশন্সের বই পড়ে আমি নামায পাল্টে ফেলি।
আমি- তাহলে আপনার আগের পড়া নামায কি ভুল ছিল?
ভাইটি- সহীহ হাদীসের খেলাফ ছিল।
আমি- আচ্ছা, তাহলে আপনি আমাকে জানান, আপনি কুরআন দেখে পড়তে জানেন?
ভাইটি- নাহ।
আমি- হাদীস আরবী দেখে পড়তে জানেন?
ভাইটি- নাহ।
আমি-তাহলে আপনি এখন যা করছেন তা হাদীসে আছে, একথা বুঝতে পারলেন কি করে?
ভাইটি- অনুবাদ দেখে।
আমি- অনুবাদটি কি সঠিক না বেঠিক সেটি কি জানেন?
ভাইটি- নাহ।
আমি- আপনার বাবা-মা, দাদা-দাদিসহ হাজার বছর ধরে এ উপমহাদেশের লাখো উলামা, মাশায়েখ, বর্তমানে লাখো উলামা মুহাদ্দিস, ফক্বীহদের পড়া নামাযটি আপনি এক মুহুর্তে ছেড়ে দিলেন একজন ব্যক্তির কথায়, আর সালাফী পাবলিকেশন্সের বাংলা পড়ে, আপনার বিবেক কি একবার বাঁধেনি এতগুলো মানুষ কি ভুল করছে? যদি করে থাকে, তাহলে একজন বিজ্ঞ আলেমের কাছে গিয়ে এর ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন কি?
ভাইটি- একজন ইমামের কাছে গিয়েছিলাম কিন্তু বিজ্ঞ কোন আলেমের কাছে যাইনি।
আমি- এটি কি ন্যায় বিচার হল? কোটি মানুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন, তারা সহীহ হাদীস অনুযায়ী নামায পড়ে না বলে, অথচ কোনটি সঠিক, তা জানার জন্য চেষ্টা না করে এক বিভ্রান্ত ব্যক্তির বিভ্রান্তিকর বক্তব্য শুনে তাদেরই প্রকাশিত অনুবাদ পড়ে পূর্ববর্তী মত ছেড়ে দিলেন এটি কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে?
ভাইটি- আসলে ওদের হাদীস দেখে আকৃষ্ট হয়েছি।
আমি- আপনি কি লোকটির কথায় অন্ধ বিশ্বাসী হয়ে গেলেন না? বাংলা অনুবাদটি সঠিক কি না? তা যেহেতু আপনি জানেন না, তাহলেতো আপনি অনুবাদকের কথার অন্ধ তাকলীদ করেই গায়রে মুকাল্লিদ হলেন তাই না?
ভাইটি চুপ হয়ে গেলেন। অনেকটা অসহায়ত্ব ভাব চেহারায় ফুটে উঠল।
এবার আমি ভাইটিকে বললাম, আচ্ছা! আপনাকে আব্দুল আজীজ বিন ইউসুফরা কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী নামায পড়তে বলছে তাইনা? তো নামাযের যেসব মাসআলায় স্পষ্ট নির্দেশনা নেই, অর্থাৎ হুকুমটি স্পষ্টভাবে বলা নেই, সেসব ক্ষেত্রে আপনি কি করবেন? কি বিধান আরোপ করবেন?
ভাইটি- বুঝি নাই। পরিস্কার করে বলুন।
আমি- আচ্ছা, আপনারাতো সহীহ হাদীসের আলোকে সবাইকে একত্রিত হতে বলছেন, এক প্লাটফর্মে আসার কথা বলছেন, তাই না?
ভাইটি- হ্যাঁ।
আমি- স্লোগানটি কিন্তু খুবই চমৎকার। কিন্তু এর আড়ালে প্রত্যেক মুসলমানকে আরেক মুসলমানের সাথে বিবাদ আর ঝগড়ায় লিপ্ত করার হীন মানসিকতা নিহিত। তা কি জানেন?
ভাইটি- কিভাবে?
আমি- আচ্ছা, ধরুন, এখানে উপস্থিত আট জন ব্যক্তির প্রত্যেকেই আহলে হাদীস মতবাদ গ্রহণ করেছে। [তখন সেখানে আসলেই আটজন উপস্থিত ছিল]
এখন আমরা মসজিদে গেলাম জামাতে নামায পড়তে। সবাই বুখারী ও মুসলিমের উপর আমল করে নামায পড়বো। এখন একজন এসে বলল, বুখারীতে এসেছে রাসূল সাঃ রফয়ে ইয়াদাইন করেছেন, সুতরাং তা করা আবশ্যক, রফয়ে ইয়াদাইন না করলে নামায হবে না, তেমনি বুখারী মুসলিমে এসেছে রাসূল সাঃ জুতা পা দিয়ে নামায পড়েছেন, সুতরাং জুতা পা দিয়ে নামায পড়া আবশ্যক। জুতা খুলে নামায পড়লে হবে না।
দ্বিতীয়জন বলল, “আরে না, না, এটি জায়েজ বুঝানোর জন্য করেছেন রাসূল সাঃ। জুতা পরিধান করে নামায পড়া জরুরী নয়।”
প্রথমজন জবাবে বলল, “আরে ভাই, নামাযে রফয়ে ইয়াদাইন করেছেন রাসূল সাঃ, তা যদি জরুরী হয়ে থাকে, তাহলে রাসূল সাঃ জুতা পরিধান করে নামায পড়েছেন, তা কেন জরুরী হবে না?”
তাহলে দুইজন দুই মতে বিভক্ত হল।
তৃতীয়জন বলল, “বুখারীতে রফয়ে ইয়াদাইন করার হাদীস এসেছে, তাই রফয়ে ইয়াদাইন করা জরুরী, তেমনি বুখারীতে নাতি কাঁধে নামায আদায়ের বর্ণনা এসেছে, উভয়টিই রাসূল সাঃ এর নামায পড়াকালীন আমল। কোনটি জরুরী আর কোনটি জরুরী নয়, তা রাসূল সাঃ এর হাদীসে বলা নেই। তাই আমরা রফয়ে ইয়াদাইন করা যেমন জরুরী মনে করি, নাতি কাঁধে নিয়ে নামায পড়াকেও জরুরী মনে করবো। নতুবা রাসূল সাঃ এর নামাযকালীন আমলকে ছেড়ে দেয়া হয়। যা জায়েজ হতে পারে না।”
এবার চতুর্থজন এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, “আরে নাহ! নাতি কাঁধে নিয়ে নামায পড়া জরুরী নয়।”
তৃতীয়জন জবাবে বলবে, “রাসূল সাঃ নামাযে রফয়ে ইয়াদাইন করেছেন বলে তা যদি আমরা জরুরী মনে করে থাকি, তাহলে নামাযে নাতি কাঁধে নিয়েছেন, সেটিকে কেন জরুরী মনে করবো না? কোনটি জরুরী আর কোনটি জরুরী নয়, তাতো হাদীসে বলা হয়নি। সহীহ হাদীসের স্পষ্ট অর্থ রেখে নিজের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা বাড়ানো কি জায়েজ আছে?
আরো একটি ফাটল তৈরী হল।
এবার এগিয়ে এলেন পঞ্চমজন। তিনি বলতে লাগলেন, “আরে ভাই! ইমাম কে হবেন? তিনি কি তার স্ত্রীকে চুম্বন করে এসেছেন?”
ছষ্ঠজন বললেন, “এ উদ্ভট প্রশ্ন কেন হে?”
পঞ্চমজন জবাব দিলেন, “আরে ভাই, নামাযের সময় রাসূল সাঃ রফয়ে ইয়াদাইন করেছেন, বলে আমরা তা জরুরী বলছি, তাহলে নামাযের আগে যে রাসূল সাঃ স্ত্রীকে চুম্বন করে এসে নামায পড়িয়েছেন, যা বুখারীর হাদীসে এসেছে, এটি বাদ দিব কেন? এটিওতো রাসূল সাঃ এর নামায পূর্ব আমল। রফয়ে ইয়াদাইন যেমন আমল চুম্বন করাওতো আমল। তাহলে এক আমল জরুরী হলে আরেকটি কেন জরুরী নয়?”
ছষ্ঠজন বললেন, “আরে ভাই! এটিতো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনামাত্র। এটি জরুরী কেন হবে?”
পঞ্চমজন জবাবে বললেন, “এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা আপনাকে কে বলল? রফয়ে ইয়াদাইনকেও তাহলে অন্যরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মন্তব্য করবে। তখন কি বলবেন?”
সপ্তমজন এবার যদি বলতে থাকেন, “সেজদার সময় রাসূল সাঃ থেকে রফয়ে ইয়াদাইন প্রমাণিত। কিন্তু যে ইমাম সেজদার সময় রফয়ে ইয়াদাইন করবে না, আমি তার পিছনে নামায পড়বো না।”
৮মজন বললেন, “কেন হে?”
সপ্তমজন জবাব দিলেন- “শায়েখ আলবানী লিখেছেনঃ وقد روى هذا الرفع عن عشرة من الصحابة তথা [সেজদার সময়] এ রফয়ে ইয়াদাইন দশ জন সাহাবী বর্ণনা করেছেন। {সিফাতু সালাতিন নাবী-১৪৬} এমনিভাবে গায়রে মুকাল্লিদদের নিকট মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফক্বীহ ও উসূলী আবুল মুহাম্মদ আব্দুল হক আলহাশেমী আসসালাফী [মৃত্যু ১৩৯২ হিজরী] সাহেব স্বীয় কিতাব “ফাতহুল ওদূদ ফী তাহক্বীকি রফয়ে ইয়াদাইন ইনদাস সুজূদ” গ্রন্থে হযরত মালিক বিন আনাস রাঃ, হযরত আনাস বিন মালিক আনসারী রাঃ, হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ, হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ, হযরত উমায়ের বিন হাবীব রাঃ, হযরত হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ, হযরত ওয়াইল বিন হুজুর রাঃ, হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর বিন খাত্তাব রাঃ এবং হযরত আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর রাঃ এ নয়জন সাহাবী থেকে সেজদার সময় রফয়ে ইয়াদাইন করার হাদীস একত্র করেছেন।
এমনিভাবে প্রসিদ্ধ গায়রে মুকাল্লিদ আলেম আবু হাফস বিন উসমান আলউসমানী সাহেব স্বীয় রেসালা “ফজলুল ওদূদ ফী তাহক্বীকে রফয়ে ইয়াদাইন লিস সুজূদ” এ উল্লেখিত নয়জন সাহাবীর হাদীস এনেছেন। আর ফাতাওয়া উলামায়ে হাদীস এর ৪ নং খন্ডের ৩০৬ নং পৃষ্ঠায় লিখা হয়েছে যে, রফয়ে ইয়াদাইন [সেজদার সময়] মানসূখ তথা রহিত হয়নি। বরং রাসূল সাঃ এর শেষ সময়ের আমল এটা ছিল। কেননা, মালিক বিন হুয়াইরিস রাঃ রাসূল সাঃ এর শেষ বয়সে মদীনায় সাক্ষাৎ করেন। এরপর এমন কোন স্পষ্ট হাদীস পাওয়া যায় না, যার দ্বারা এটি রহিত হওয়ার কথা বুঝা যায়। {আব্দুল হক্ব ওয়া ফায়যুল কারীম সিন্ধী}
তাহলে এ রহিত না হওয়া সহীহ হাদীসটি যে মানবে না, তাকে আমরা কি করে ইমাম বানাতে পারি?
এভাবে যদি সবাই কুরআন ও সহীহ হাদীস দেখে, যে যেটা বুঝে সেটাকেই দ্বীন মনে করতে থাকে, তাহলে কি যিন্দিগীতে আহলে হাদীসরা দুই রাকাত নামায জামাতে পড়তে পারবে?
এর নাম একতার দাওয়াত না প্রতিটি ব্যক্তিকে বিবাদে লিপ্ত করার মারাত্মক ষড়যন্ত্রমূলক দাওয়াত?
মুজতাহিদ ইমামের অনুসরণকে বিদআত আর গোমরাহী সাব্যস্ত করে আপনাকে যে, নিজেই মুজতাহিদ সেজে আমল করতে বলা হল, আপনি কিভাবে আমল করবেন এসব হাদীসে? নিজের মন যখন যেটি চায় সেটিকে? সব ক’টিইতো সহীহ হাদীস। তাহলে করবেনটা কি?
আসলে আপনাকে কিছু করতে বলেনি ওরা, বলেছে অন্ধভাবে যেন আপনি তাদের মুকাল্লিদ হয়ে যান। ওদের সালাফী পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত অনুবাদ পড়বেন, ওদের বয়ান শুনবেন, ওদেরকে দলীল ছাড়াই মেনে নিবেন, আর শ্রেষ্ঠযুগের মুজতাহিদকে ছেড়ে দিয়ে ফেতনার যুগের অযোগ্য ব্যক্তির অন্ধ মুকাল্লিদ হয়ে যাবেন এইতো ওদের দাওয়াত?”
পুরোই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন ভাইটি।
কোন উত্তরই ফুটছিল না ভাইটির মুখে। আমার মনে হতে লাগল ভাইটির মনে চিন্তার উদ্রেক হচ্ছে। তিনি খানিক ভড়কে গেলেন। এ সরল কথাগুলো তিনি বুঝতে না পারার কারণে কিভাবে ওদের ফাঁদে পা দিলেন সে জন্য হয়তো মনে মনে শরমিন্দা হলেন।
কিন্তু না। তিনি এবার আচমকা বলে উঠলেন। আচ্ছা, তাহলে ইমাম আবূ হানীফা রহঃ যে বলেছেন, যখন সহীহ হাদীস পাবে জেনে রেখো সেটিই আমার মাযহাব”।
এমনিভাবে ইমাম শাফেয়ী রহঃ, ইমাম মালিক রহঃ, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহঃ থেকেও এমন কথা আছে।
আমি- যেসব রেফারেন্সে এসব বলা হয়, আমি তা আপনার কাছে আরো স্পষ্ট ভাষায় তা উদ্ধৃত করছি-
১-যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাজহাব’। [হাশিয়াহ ইবনে আবেদীন ১/৬৩]
২- আমরা কোথা থেকে গ্রহণ করেছি, তা না জেনে আমাদের কথা গ্রহণ করা কারো জন্য বৈধ নয় হাশিয়াহ ইবনে আবেদীন ৬/২৯৩]
৩- যে ব্যক্তি আমার দলীল জানে না, আমার কথা দ্বারা ফতোয়া প্রদান করা তার জন্য হারাম [ ড. অছিউল্লাহ বিন মুহাম্মাদ
আববাস, আত-তাক্বলীদ ওয়া হুকমুহু ফী যুইল কিতাব ওয়াস-সন্নাহ, পৃঃ ২০]
৪- নিশ্চয়ই আমরা মানুষ। আমরা আজকে যা বলি, আগামীকাল তা থেকে ফিরে আসি [ ড. অছিউল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আববাস, আত-তাক্বলীদ
ওয়া হুকমুহু ফী যুইল কিতাব ওয়াস-সন্নাহ, পৃঃ ২০]
এ প্রশ্নটি আরো অনেক আগেই আমাদের জামিয়ার ওয়েব সাইটের প্রশ্নোত্তর বিভাগে করা হয়েছিল। আমি তার জবাব হুবহু নকল করছি-
ধোঁকাবাজী নং-১
“যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাজহাব’। [হাশিয়াহ ইবনে আবেদীন ১/৬৩]”
এটি মিথ্যাচারমূলক বক্তব্য। ইমাম আবু হানীফা রহঃ একথা এভাবে বলেননি। এটি ধোঁকাবাজ আর মিথ্যুকদের সৃষ্ট ধু¤্রজাল। আর রেফারেন্সও দেয়া হয়েছে ভুল। রেফারেন্সটি হবে- ১/১৬৭, জাকারিয়া লাইব্রেরী। ইমাম আবু হানীফা রহঃ বলেছেন-
اذا صح الحديث فهو مذهبى তথা যখন হাদীস সহীহ হয়, তাহলে সেটিই আমার মাযহাব। {হাশিয়ায়ে ইবনে আবেদীন-১/৬৩}
“পাবে” শব্দ আরবীতে কোথায় আছে? এটি গায়রে মুকাল্লিদদের বানানো শব্দ। একথা ইমাম আবু হানীফা রহঃ বলেননি। পাবে শব্দ থাকলে আরবীতে থাকতো وجد কিন্তু উক্ত ইবারতের কোথাও এ শব্দটি নেই। তাহলে “পাবে” অর্থ কোত্থেকে আমদানী করা হল?
যিনি বলছেন, হাদীস সহীহ হলে, সেটি তার মাযহাব, তিনি কি করে গায়রে সহীহ হাদীসের উপর তার মাযহাব প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন? একথাইতো সুষ্পষ্ট প্রমাণ যে, ইমাম আবু হানীফা রহঃ তার মাযহাবের ভিত্তি রেখেছেন কেবল সহীহ হাদীসের উপর। কোন দুর্বল হাদীসের উপর তিনি তার মাযহাব প্রতিষ্ঠা করেননি।
বাংলায় “পাবে” শব্দ বাড়িয়ে বক্তব্যটিকে বিকৃতকারীর নাম আহলে হাদীস হয় না, হয় আহলে ধোঁকা।
ধোঁকাবাজী নং-২
“আমরা কোথা থেকে গ্রহণ করেছি, তা না জেনে আমাদের কথা গ্রহণ করা কারো জন্য বৈধ নয়। হাশিয়াহ ইবনে আবেদীন ৬/২৯৩]”
এ বক্তব্যটি যেভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। সাধারণ পাঠকগণ বুঝবেন যে, এটি বুঝি ইমাম সাহেবের মুকাল্লিদদের উদ্দেশ্যে ইমাম আবু হানীফা রহঃ বলে গেছেন। অথচ এ বক্তব্যটি তিনি মুকাল্লিদদের উদ্দেশ্যে বলেন নি। বলেছেন মুজতাহিদদের উদ্দেশ্যে। তাই এটিও একটি ধোঁকাবাজিমূলক বক্তব্য।
যদি তিনি এটি মুকাল্লিদদের উদ্দেশ্যেই বলে গিয়ে থাকেন, তাহলে প্রশ্নকারীর কাছে আমাদের আবেদন, উক্ত কিতাবের মূল আরবিটা দিন। তাহলে আপনার মিথ্যার খোলস খুব সহজেই বেরিয়ে আসবে।
ধোঁকাবাজী নং-৩
তোমার জন্য আফসোস হে ইয়াকুব (আবু ইউসুফ)! তুমি আমার থেকে যা শোন তাই লিখে নিও না। কারণ আমি আজ যে মত প্রদান করি, কাল তা প্রত্যাখ্যান করি এবং কাল যে মত প্রদান করি, পরশু তা প্রত্যাখ্যান করি [ ড. অছিউল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আববাস, আত-তাক্বলীদ ওয়া হুকমুহু ফী যুইল কিতাব ওয়াস-সন্নাহ, পৃঃ ২০]
এ বক্তব্যেরও আরবী ইবারত কাম্য হানাফী নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে। গায়রে মুকাল্লিদ দাবিদার ভ্রান্ত কারো কিতাব থেকে নয়। অথচ এখানে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে একজন গায়রে মুকাল্লিদের লেখা বই থেকে। তাই হানাফী নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ থেকে এ বক্তব্যটিকে ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর বক্তব্য প্রমানিত দেখাতে হবে। কেননা, অর্থ বিকৃতি ও মিথ্যা কথা বলা গায়রে মুকাল্লিদদের মাযহাবের মূল ভিত্তি।
যদি উক্ত বক্তব্যটি সঠিক হয়, তাহলেও কোন সমস্যা নেই। কারণ ইমাম সাহেব একথা কাকে বলছেন? গায়রে মুজতাহিদকে না মুজতাহিদকে?
ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর বক্তব্যটি কি মুকাল্লিদকে লক্ষ্য করে না মুজতাহিদকে লক্ষ্য করে?
নিশ্চয় মুজতাহিদকে লক্ষ্য করে। ইমাম আবু ইউসুফ মুজতাহিদ ফিল মাযহাব ছিলেন। মুজতাহিদ ফিল মাযহাব বলা হয়, যিনি ইমামের নির্দিষ্ট করা মূলনীতির আলোকে, দলীলের আলোকে স্বীয় মূলনীতি নির্ধারণের যোগ্যতা রাখেন। যে মূলনীতির আলোকে তিনি নিজেই কুরআন ও হাদীসে অবর্ণিত মাসায়েলকে বের করতে পারেন। তার নাম মুজতাহিদ ফিল মাযহাব।
এমন মুজতাহিদের জন্য শুধু ইমামের দলীলের উপর নির্ভর করে মাসআলা মেনে নেয়া জায়েজ নয়, যতক্ষণ না তিনি উক্ত মাসআলার দলীল নিজে যাচাই বাছাই করে নিশ্চিত হন।
তাহলে যেহেতু ইমাম আবু ইউসুফ রহঃ নিজেই মুজতাহিদ ছিলেন। আর মুজতাহিদের জন্য দলীল ছাড়া ইমামের বক্তব্য মেনে নেয়া বৈধ নয়, তাই তাকে ইমাম আবু হানীফা রহঃ সতর্ক করে বলেছেন যে, “হে ইয়াকুব (আবু ইউসুফ)! তুমি আমার থেকে যা শোন তাই লিখে নিও না।”
যেহেতু কুরআন ও হাদীসে যে সকল মাসআলা বর্ণিত নেই। সেসব ক্ষেত্রে সমাধান মুজতাহিদের স্বীয় ইজতিহাদ। আর ইজতিহাদী সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হতে পারে। তাই ইমাম আবু ইউসুফ রহঃ এর মত মুজতাহিদের জন্য যাচাই বাছাই ছাড়া ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর বক্তব্য মেনে নেয়া বৈধ নয়।
কিন্তু এ বক্তব্যে মুকাল্লিদদের কেন টেনে আনা হল? এ কথাতো মুকাল্লিদের জন্য বলাই হয়নি। তাহলে মুকাল্লিদদের ক্ষেত্রে কেন ধোঁকাবাজির সাথে এ বক্তব্য উদ্ধৃত করা হচ্ছে?
ধোঁকাবাজী নং-৪
যে ব্যক্তি আমার দলীল জানে না, আমার কথা দ্বারা ফতোয়া প্রদান করা তার জন্য হারাম [ ড. অছিউল্লাহ বিন মুহাম্মাদ
আববাস, আত-তাক্বলীদ ওয়া হুকমুহু ফী যুইল কিতাব ওয়াস-সন্নাহ, পৃঃ ২০]
এটিও একটি ধোঁকাবাজিমূলক প্রশ্ন। একেতো এ বক্তব্যটি ইমাম আবু হানীফা রহঃ থেকে প্রমানিত কি না? তাই সন্দেহ আছে। কারণ গায়রে মুকাল্লিদরা প্রচুর পরিমাণ মিথ্যা রেফারেন্স দিয়ে থাকে। আর অনবরত মিথ্যা কথা বলে থাকে। তাই প্রথমে উক্ত বক্তব্যটি যতক্ষণ পর্যন্ত হানাফী কোন নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে আরবী ইবারতসহ না দেখাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এর কোন বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। কারণ মিথ্যুক কত কথাই বলতে পারে।
আর যদি উক্ত বক্তব্যটি প্রমাণিত করতেও পারে, তাহলে দেখা যাবে যে, উক্ত বক্তব্যটি পূর্বের মত ইমাম আবু হানীফা রহঃ মুজতাহিদদের উদ্দেশ্য করেই বলেছেন। মুকাল্লিদদের উদ্দেশ্য করে বলেননি। তাই এ অপরিচিত গায়রে মুকাল্লিদের লেখা বইয়ের রেফারেন্স দেয়া বক্তব্যটি দ্বারা ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর পক্ষ থেকে মুকাল্লিদদের তাকলীদ করা নিষিদ্ধ প্রমানিত হয় না।
ধোঁকাবাজী নং-৫
নিশ্চয়ই আমরা মানুষ। আমরা আজকে যা বলি, আগামীকাল তা থেকে ফিরে আসি [ ড. অছিউল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আববাস, আত-তাক্বলীদ
ওয়া হুকমুহু ফী যুইল কিতাব ওয়াস-সন্নাহ, পৃঃ ২০]
এ ধোঁকাবাজীর ব্যাপারেও আমাদের পূর্বোক্ত বক্তব্যটি প্রযোজ্য। তথা আগে হানাফী নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে উক্ত বক্তব্যটি ইমাম আবু হানীফা রহঃ বলেছেন, তা প্রমাণ করতে হবে মূল আরবী ইবারত দিয়ে। তারপর বিশ্বাস হবে যে, আসলেই ইমাম আবু হানীফা রহঃ এমন বলেছেন। নতুবা ফাসেক মিথ্যুকের কথাকে অন্তত আমরা বিশ্বাস করি না।
তারপরও যদি তা ইমাম আবু হানীফা রহঃ থেকে প্রমাণিত করেও, তবুও মুকাল্লিদের কোন সমস্যা নয়। কারণ আমরা জানি যে, মুজতাহিদের ভুল হলেও একটি সওয়াব। আর সঠিক হলে দুটি সওয়াব। সুতরাং মুজতাহিদের যারা মুকাল্লিদ তাদের ঘাবড়ানোর কোন কারণ নেই। ভুল হলেও সওয়াব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না। তাই চিন্তার কোন কারণ নেই।
ধোঁকাবাজী নং-৬
‘আমি যদি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ওরাসূলুললাহ (ছা:)-এর কথার (হাদীছ) বিরোধী কোন কথা বলে থাকি,তাহ’লে আমার কথাকে ছুঁড়ে ফেলে দিও [ছালেহ ফুল্লানী, ইক্বাযু হিমাম, পৃঃ ৫০]
এখানেও একই কথা প্রযোজ্য। আগে তা হানাফী নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর বক্তব্য প্রমাণ করতে হবে। নতুবা এটি মিথ্যাচার বৈ আর কিছু নয়। যা তাদের মজ্জাগত স্বভাব।
আর যদি প্রমানিত হয়, তাহলে দেখা যাবে, ইমাম সাহেব রহঃ এর বক্তব্যটি মুজতাহিদের জন্য ছিল। গায়রে মুজতাহিদ তথা মুকাল্লিদের জন্য ছিল না। সুতরাং এ বক্তব্যের দ্বারা মুকাল্লিদের ক্ষেত্রে কোন কিছুই প্রমাণিত হচ্ছে না।”
আমি যখন দৃঢ়তার সাথে উপরোক্ত বক্তব্যের সার-নির্যাস উপস্থাপন করলাম। আর বলে দিলাম, “এসব তথ্য কথিত আহলে হাদীসরা আপনাদের মত গায়রে আলেম ব্যক্তিদের সামনে উপস্থাপন করে। আর আপনারা এসবের ব্যাখ্যা এবং সত্যাসত্যি বিজ্ঞ হানাফী আলেমদের কাছে জিজ্ঞাসা না করে তাদেরকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
অন্তত একবারও যদি বিজ্ঞ আলেমদের কাছে গিয়ে ব্যাখ্যা ও সত্যতা যাচাই করে নিতেন ওদের অন্ধ অনুসরণ না করে, তাহলে হয়তো এভাবে বিভ্রান্ত হতেন না।”
এবারো থমকে গেলেন ভাইটি। সত্য উপলব্দি করার দ্যুতি ভাইটির চেহারায় প্রতিভাত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল।
এবার ভাইটি বলতে লাগলেন,“আসলে আমরাতো বুঝি না। যাচাই করে দেখার মত সুযোগ বা আরবীও জানি না। তাই ওদের কথায় সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে যাই। ওরা আমাকে বলেছে যে, ইমাম হানীফা রহঃ নাকি অল্প কিছু হাদীস জানতেন। যার বেশিরভাগই জাল হাদীস।”
আমি বললাম, “আচ্ছা, ভাল কথা। যদি তাই হয়, তাহলে হানাফী মাযহাবের মাসায়েলতো সব জাল হাদীস দিয়ে প্রমাণিত হওয়ার কথা তাই নয়? কিন্তু বাস্তবে কি তা? মুসনাদে আবী হানীফাহ, মুয়াত্তা মুহাম্মদ, আসারুস সুনান,আদিল্লাতুল হানাফিয়্যাহ,নসবুর রায়াহ, কিফায়াহ ও ইলাউস সুনান ইত্যাদি হাদীসগ্রন্থের কিতাবসমূহের হাদীস সবই কি জাল হাদীস? তাহলেতো তিরমিজী শরীফও জাল হাদীসের কিতাব হওয়া আবশ্যক হয়। কারণ তিরমিজীর অসংখ্য স্থানে হাদীস উল্লেখের পর ইমাম তিরমিজী রহঃ মন্তব্য করেছেন এ হাদীস হানাফী মাযহাবের পক্ষের দলীল। তাহলে তিরমিজীর যত স্থানে ইমাম তিরমিজী রহঃ হানাফী মাযহাবের দলীল বলে মন্তব্য করেছেন, তা সবই কি জাল হাদীস?”
চুপ হয়ে রইলেন ভাইটি।