আল্লামা আব্দুল মতীন দামাত বারাকাতুহু
পড়ে নিন- হাদীসের হাফেজগণও ফকীহগণের মুখাপেক্ষী ছিলেন :
এই এগার নম্বর ঘটনা ও নয় নম্বরে উল্লেখিত ইবনে মাঈনের বক্তব্য থেকেও বোঝা যায়, ইমাম আবু হানীফা ছিলেন তাঁর যুগের সবচেয়ে বড় মুজতাহিদ ও ফকীহ। ইমাম শাফেয়ীর একথা তো খুবই প্রসিদ্ধ যে,
الناس في الفقه عيال على أبي حنيفة
ফিকহের ক্ষেত্রে সকল মানুষ ইমাম আবু হানীফার পরিবারতুল্য।
অর্থাৎ পরিবারের লোকজন যেমন কর্তার মুখাপেক্ষী, তেমনি ফিকহের ক্ষেত্রে মানুষ ইমাম আবু হানীফার মুখাপেক্ষী। ইমাম শাফেয়ী একথাও বলেছেন যে, من أراد أن يتبحر في الفقه فهو عيال على أبي حنيفة وكان أبو حنيفة ممن وفق له الفقه ফিকহের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি পা-িত্য অর্জন করতে চাইবে, সেই আবু হানীফার মুখাপেক্ষী হবে। আবু হানীফাকে ফিকহের জ্ঞান বিশেষভাবে দান করা হয়েছিল। (ওয়াফায়াতুল আ’য়ান)
প্রখ্যাত হাফেজে হাদীস ইয়াযীদ ইবনে হারুন বলেছেন,
أدركت ألف رجل من الفقهاء وكتبت عن أكثرهم ما رأيت فيهم أفقه وألا أورع ولا أعلم من خمسة : أولهم أبو حنيفة
আমি এক হাজার ফকীহর দেখা পেয়েছি। এবং তাদের অধিকাংশের ইলম লিপিবদ্ধ করেছি। তাদের মধ্যে পাঁচজনের চেয়ে বড় ফকীহ পরহেযগার ও সহনশীল কাউকে পাই নি। তাদের প্রথম হলেন আবু হানীফা। (ইবনে আবুল আওয়াম, ফাযাইল, নং ৩৮)
অপর এক বর্ণনায় আছে, ইয়াযীদ ইবনে হারুনকে জিজ্ঞেস করা হলো, من أفقه من رأيت؟ قال أبو حنيفة আপনি যাদের পেয়েছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকীহ কে? তিনি বললেন, আবু হানীফা। (প্রাগুক্ত, নং ১০৯)
প্রসিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিস আবু বকর ইবনে আইয়াশ বলেছেন, كان النعمان بن ثابت فهما من أفقه أهل زمانه নুমান ইবনে ছাবিত (আবু হানীফা) অত্যন্ত সমঝদার ও যুগের অন্যতম ফকীহ ছিলেন। (প্রাগুক্ত, নং ১০৩)
আবু আসিম আন নাবীল বলেছেন, أبو حنيفة عندي أفقه من سفيان আমার দৃষ্টিতে আবু হানীফা সুফিয়ানের চেয়ে বড় ফকীহ ছিলেন। (প্রাগুক্ত, নং ১০৯)
আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেছেন, إن كان لأحد من هذه الأمة أن يقول بالرأي فهو لأبي حنيفة এ উম্মতের কারো যদি মতামত দেয়ার অধিকার থাকে তবে তা আবু হানীফার রয়েছে। (প্রাগুক্ত, নং ১১৬)
আহমদ ইবনে হারব বলেছেন, كان أبو حنيفة في العلماء كالخليفة في الأمراء আমীর-উমারাদের মধ্যে খলীফার যে মর্যাদা, আলেমগণের মধ্যে আবু হানীফারও তেমনি মর্যাদা। (প্রাগুক্ত, নং ১১৫)
ইমাম আবু ইউসুফ বলেছেন, ما رأيت أحدا أعلم بتفسير الحديث من أبي حنيفة হাদীসের মর্ম সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফার চেয়ে বড় জ্ঞানী কাউকে আমি দেখি নি। (প্রাগুক্ত, নং ১২১)
আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেছেন, لا تقولوا رأي أبي حنيفة ولكن قولوا تفسير الحديث তোমরা বলো না আবু হানীফার মত, বরং বলো এটা হাদীসের মর্ম ও ব্যাখ্যা। (প্রাগুক্ত, নং ১৫০)
প্রসিদ্ধ হাফেজে হাদীস ঈসা ইবনে ইউনুসও বলেছেন, والله ما رأيت أفضل منه ولا أورع منه ولا أفقه منه আল্লাহর কসম! আবু হানীফার চেয়ে উত্তম, তার চেয়ে বড় পরহেযগার ও তার চেয়ে বড় ফকীহ কাউকে আমি দেখি নি। (ইবনে আব্দুল বার, আল ইনতিকা, পৃ. ২১২)
ইমাম আবু হানীফাও হাফেজে হাদীস ছিলেন
একজন মুজতাহিদ ফকীহর জন্য অপরিহার্য হলো ন্যূনপক্ষে বিধিবিধান সংক্রান্ত হাদীস ও সুন্নাহর হাফেজ হওয়া। অন্যথায় তিনি সঠিক ফতোয়াও দিতে পারবেন না। সঠিক মাসাইল কুরআন-সুন্নাহ থেকে বের করতেও পারবেন না। ইমাম আবু হানীফাকে মুসলিম উম্মাহর শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ সবচেয়ে বড় ফকীহ আখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি অন্তত বিধানসম্বলিত সুন্নাহর হাফেজ ছিলেন। এ কারণেই হাফেজে হাদীসগণের জীবনীমূলক গ্রন্থগুলোতে ইমাম আবু হানীফার জীবনীও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন হাফেজ যাহাবী তার তাযকিরাতুল হুফফাজ গ্রন্থে (১/১৬৮), হাফেজ ইবনে আব্দুল হাদী তার আল মুখতাসার ফী তাবাকাতি উলামাইল হাদীস গ্রন্থে (২/৯৭),
হাফেজ ইবনে নাসেরুদ্দীন আত তিবয়ান গ্রন্থে (দ্র. আব্দুর রশীদ নুমানী, মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা ফিল হাদীস, পৃ. ৬০), ইমাম ও মুহাদ্দিস ইবনুল মিবরাদ হাম্বলী তার তাবাকাতুল হুফফাজ গ্রন্থে (দ্র. প্রাগুক্ত, পৃ. ৬১)
হাফেজ জালালুদ্দীন সুয়ূতী তার তাবাকাতুল হুফফাজ গ্রন্থে (পৃ. ৮০) ও আল্লামা বাদাখশী তার তারাজিমুল হুফফাজ গ্রন্থে। (দ্র. মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা ফিল হাদীস,পৃ. ৬২, ৬৩)
উল্লেখ্য, এসব গ্রন্থকারের কেউই হানাফী ছিলেন না। তাই এমন সন্দেহেরও কোন অবকাশ নেই যে, ভক্তির আতিশয্যে তাঁরা এমনটি করেছেন।
ইমাম আবু হানীফা ছিলেন অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও মেধার অধিকারী। হাফেজ যাহাবী তার আল ইবার গ্রন্থে লিখেছেন, وكان من أذكياء بني آدم তিনি ছিলেন আদমসন্তানের মধ্যে বড় বড় মেধাবীদের একজন। (১/১১২)
এমন তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী মানুষ সম্পর্কে যখন হাফেজ যাহাবী বলেন, طلب الحديث وأكثر منه في سنة ماءة وبعدها একশ হিজরী ও তার পরবর্তী সময়ে তিনি হাদীস শিক্ষা করেছেন এবং অনেক হাদীস শিক্ষা করেছেন। (সিয়ার, ৬/৩৯৬) তখন তিনি কী পরিমাণ হাদীস আয়ত্ব করেছেন, তা সহজেই অনুমেয়। যাহাবী আরো লিখেছেন, وعني بطلب الآثار وارتحل في ذلك তিনি হাদীস শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন এবং এজন্য বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। (সিয়ার, ৬/৩৯২)
ইমাম আবু হানীফার সহপাঠী ছিলেন মিসআর ইবনে কিদাম। তিনি এত বড় হাদীসবিদ ছিলেন যে, শো’বা ও সুফিয়ানের মতো হাদীস সম্রাটের মধ্যে হাদীস বিষয়ে কোন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে দুজনই বলতেন, اذهبا بنا إلى الميزان مسعر আমাদেরকে (হাদীসের) মানদ- মিসআরের নিকট নিয়ে চল। (হাফেজ আবু মুহাম্মাদ রামাহুরমুযী, আল মুহাদ্দিসুল ফাসিল, পৃ. ১৩৯)
এই মিসআরই ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে বলেছেন,
طلبت مع أبي حنيفة الحديث فغَلَبَنا وأخذنا في الزهد فبرع علينا وطلبنا معه الفقه فجاء منه ما ترون
আবু হানীফার সঙ্গে হাদীস শিক্ষা করলাম, সে আমাদের উপর অগ্রণী হয়ে গেল। যুহদ ও দুনিয়াবিমুখতায় লাগলাম, সে আমাদের ছাড়িয়ে গেল। তার সঙ্গে ফেকাহ শিক্ষা করলাম, এতে তোমরা তো দেখতেই পাচ্ছ সে কেমন বুৎপত্তি অর্জন করেছে। (যাহাবী, মানাকিবু আবী হানীফা, পৃ. ৪৩)
এমনিভাবে ওয়াকী সম্পর্কে ইয়াহয়া ইবনে মাঈন বলেছেন, وكان قد سمع من أبي حنيفة حديثا كثيرا তিনি আবু হানীফা থেকে প্রচুর হাদীস শুনেছেন। (ইবনে আব্দুল বার, জামিউ বায়ানিল ইলম, ২/১০৮২)
ইবনে আব্দুল বার আল ইনতিকা গ্রন্থে লিখেছেন, وروى حماد بن زيد عن أبي حنيفة أحاديث كثيرة আবু হানীফা থেকে হাম্মাদ ইবনে যায়দ বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন। (পৃ. ২০১)
যাহাবী বলেছেন, روى عنه من المحدثين والفقهاء عدة لا يحصون তাঁর থেকে অসংখ্য মুহাদ্দিস ও ফকীহ হাদীস বর্ণনা করেছেন। (মানাকিব, পৃ. ২০)
হাফেজ শামসুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ আস সালেহী বলেছেন,
إن الإمام أبا حنيفة من كبار حفاظ الحديث ولولا كثرة اعتنائه بالحديث ما تهيأ له استنباط مسائل الفقه فإنه أول من استنبطه من الأدلة
ইমাম আবু হানীফা একজন শীর্ষ হাফেযে হাদীস। তিনি যদি অধিক হারে হাদীস অর্জন না করতেন, তবে তাঁর পক্ষে ফিকহের মাসাইল আবিস্কার করা সম্ভব হতো না। কুরআন-সুন্নাহ থেকে তিনিই তো প্রথম (মাসাইল) আবিস্কার করেছেন। (উকুদুল জুমান, পৃ. ৩১৯)
মুহাদ্দিস ইসমাঈল আজলূনী লিখেছেন,
فهو رضي الله عنه حافظ حجة فقيه لم يكثر في الرواية لما شدد في شروط الرواية والتحمل وشروط القبول
তিনি ছিলেন হাফেজে হাদীস, প্রামাণ্য ব্যক্তিত্ব ও ফকীহ। তবে হাদীস অর্জন ও বর্ণনার শর্তাবলি ও হাদীস গ্রহণের শর্তাবলির ক্ষেত্রে তিনি কড়াকড়ি করেছেন। ফলে তিনি অধিক হারে হাদীস বর্ণনা করেন নি। (ইকদুল জাওহারিছ ছামীন, পৃ. ৬)
আরো পড়ুনঃ