আল্লামা আব্দুল মতীন দামাত বারাকাতুহু
পড়ে নিন- ইমাম আবু হানীফা ছিলেন যুগের সবচেয়ে বড় মুজতাহিদ ও ফকীহ
প্রসিদ্ধ চার ইমামসহ সকল মুজতাহিদ ফকীহই নির্ভর করেছেন সহীহ হাদীসের উপর। কারণ তাদের সকলের ঐকান্তিক চেষ্টা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী ও কর্ম সঠিকভাবে ধরতে পারা। ফলে এ ক্ষেত্রে সহীহ হাদীসের বিকল্প ছিল না। ইমাম আবু হানীফা তাঁর মূলনীতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন,
أني آخذ بكتاب الله إذا وجدته ، فما لم أجده فيه آخذ بسنة رسول الله والآثار الصحاح عنه التي فشت في أيدي الثقات عن الثقات فإذا لم أجد في كتاب الله ولا سنة رسول الله أخذت بقبول أصحابه من شئت وأدع قول من شئت ثم لا أخرج عن قولهم إلى قول غيرهم فإذا انتهى الأمر إلى إبراهيم والشعبي والحسن وعطاء وابن سيرين وسعيد بن المسيب وعدّد رجالا فقوم قد احتجوا فلي أن أجتهد كما اجتهدوا.
আমি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) অনুসারে আমল করি, যদি সেখানে পাই। অন্যথায় রাসূলুল্লাহর সুন্নাহ ও তাঁর থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করি, যা বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীদের সূত্রে বিশ্বস্তদের হাতে হাতে ছড়িয়ে আছে। যদি কুরআন ও সুন্নাহর কোথাও না পাই তবে সাহাবীগণের যার মত পছন্দ হয় গ্রহণ করি, যার মত পছন্দ হয় না গ্রহণ করি না। তবে তাঁদের মতের বাইরেও আমি যাই না। আর যখন ইবরাহীম নাখায়ী, শা’বী, হাসান, আতা, ইবনে সীরীন ও সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব: আরো অনেকের নাম বলেছেন: প্রমুখ পর্যন্ত ব্যাপারটা গড়ায়, তো তাঁরাও ইজতেহাদ করেছেন, আমিও তাদের মতো ইজতেহাদ করেছি। (আল ইনতিকা, পৃ. ২৬৪, ২৬৫)
সুফিয়ান ছাওরীও ইমাম আবু হানীফার নীতি সম্পর্কে অনুরূপ বলেছেন। তিনি বলেছেন,
يأخذ بما صح عنده من الأحاديث التي كان يحملها الثقات وبالآخر من فعل رسول الله صلى الله عليه وسلم وبما أدرك عليه علماء الكوفة
বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের বর্ণনাকৃত যেসব হাদীস তাঁর নিকট সহীহ বলে প্রমাণিত হতো, তিনি সে অনুযায়ী আমল করতেন, আমল করতেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ আমল অনুযায়ী এবং কুফর আলেমগণকে যেভাবে আমল করতে দেখেছেন, সে অনুযায়ী। (প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬২)
বিখ্যাত মুহাদ্দিস হাসান ইবনে সালেহও বলেছেন,
كان النعمان بن ثابت فهما بعلمه متثبتا فيه ، إذا صح عنده الخير عن رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يعدُه إلى غيره
নুমান ইবনে ছাবিত (আবু হানীফা) নিজের ইলম সম্পর্কে বোদ্ধা ছিলেন এবং এক্ষেত্রে খুব পাকা ও সুদৃঢ় ছিলেন। তাঁর নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস সহীহ প্রমাণিত হলে তিনি সেটা ছেড়ে অন্য কিছু অবলম্বন করেন না। (ইবনে আবুল আওয়াম, ফাযাইলু আবী হানীফা, নং ১১৯)
হাফেজে হাদীস ঈসা ইবনে ইউনুস বলেছেন, كان النعمان بن ثابت شديد الاتباع لصحيح حديث رسول الله صلى الله عليه وسلم নুমান ইবনে ছাবিত (আবু হানীফা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহীহ হাদীস কঠিনভাবে অনুসরণ করতেন। (প্রাগুক্ত, নং ২৬৭)
একটি ধারণা ও তার খণ্ডন
কেউ কেউ মনে করেন, ইমাম ও ফকীহগণ যদি সকলেই সহীহ হাদীস মেনে চলতেন, তবে তাদের মধ্যে মতভিন্নতা হত না। অথচ বাস্তবতা হলো, তাদের মধ্যে মতভিন্নতা হয়েছে।
কিন্তু এমন মনে করাটা সঠিক নয়। এমন ভাসা ভাসা ধারণা কোন সাধারণ মানুষ করলে করতে পারে। কোন আলেমের জন্য, আসবাবে এখতেলাফ বা মতভিন্নতার কারণ সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তির জন্য এমন ধারণা পোষণ করার সুযোগ নেই। ফকীহ ইমামগণ ও তাদের মতের অনুসারীদের কথা না হয় বাদই দিলাম। যুগে যুগে যারা মাযহাব অনুসরণ না করে সহীহ হাদীস অনুসরণের দাবী করেছেন, তাদের মধ্যেও অসংখ্য মতভিন্নতা দেখা যায়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেক সাহেবের রচিত ‘উম্মাহর ঐক্য পথ ও পন্থা’ পুস্তকটি ৭৪-৭৮ পৃষ্ঠা দেখা যেতে পারে। এখানে মোটা মোটা কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হচ্ছে :
ক.
আলবানী সাহেব বলেছেন, জাহরী নামাযে মুকতাদী সুরা ফাতেহা পাঠ করবে না। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশের লা মাযহাবী ভাইয়েরা বলে থাকেন, জাহরী ও সিররী সব নামাযেই তা পড়তে হবে।
খ.
আলবানী সাহেব বলেছেন, সেজদায় যেতে প্রথমে হাত পরে হাঁটু রাখা ফরজ। আসাদুল্লাহ গালিব বলেছেন, সুন্নত। শায়খ বিন বায ও শায়খ উছায়মীন বলেছেন, এমনটা করবে না, বরং সুন্নত হলো আগে হাঁটু রাখা, পরে হাত।
গ.
ইমাম বুখারী বলেছেন, রুকু পেলে রাকাত পাওয়া ধর্তব্য হবে না। আমাদের অনেক লা মাযহাবী ভাইও অনুরূপ বলে থাকেন। অপরদিকে শায়খ বিন বায, শায়খ উছায়মীন, আলবানী প্রমুখ বলেছেন, রুকু পেলে রাকাত পাওয়া ধর্তব্য হবে।
ঘ.
শাওকানী সাহেব বলেছেন, ইকামত জোড়া জোড়া শব্দে বলা উত্তম। মুবারকপুরী বলেছেন, বেজোড় শব্দে বলা উত্তম।
এ বিষয়গুলো এই গ্রন্থেই বরাত উল্লেখসহ বিস্তারিত লেখা হয়েছে।
ঙ.
শায়খ বিন বায বলেছেন, রুকু থেকে ওঠার পর পুনরায় হাত বাঁধবে। বাকর আবু যায়দ বলেছেন, পুনরায় হাত বাঁধবে না।
সহীহ হাদীস অনুসারে চলার দাবীদার এসব আলেমদের মধ্যে যদি দ্বিমত হতে পারে, তবে মুজতাহিদ ইমাম ও ফকীহগণের মধ্যেও দ্বিমত হওয়া স্বাভাবিক। যদিও তাদের প্রত্যেকেরই নীতি ছিল সহীহ হাদীস অনুসারে চলা।
কেউ কেউ বলে থাকেন, ইমামগণের ঐ নীতি ছিল সেই কথা ঠিক। কিন্তু সব সহীহ হাদীস তো তাদের নিকট নাও পৌঁছতে পারে। এমতাবস্থায় তাদের কোন একজনকে অনুসরণ করলে সহীহ হাদীস অনুসারে চলা নাও হয়ে উঠতে পারে। একথাটি একেবারে অমূলক নয়। তবে কোন হাদীসটি ইমামগণের নিকট পৌঁছেছে আর কোনটি পৌঁছে নি সেই ফয়সালা করবে কে? বিশেষ করে যে প্রসিদ্ধ মতভেদপূর্ণ মাসায়েলের ক্ষেত্রে একথা বলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করা হয় সেসবগুলোতেই দেখা যায়, সহীহ হাদীসগুলো ইমামগণের নিকট পৌঁছেছে। তারা সেগুলো অনুযায়ী আমল করেছেন ও ফতোয়া দিয়েছেন অথবা সেগুলোর ব্যাখ্যা পেশ করে বিপরীত সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করেছেন। ইমাম আবু হানীফার কথাই ধরা যাক, বিরোধপূর্ণ প্রসিদ্ধ সব মাসায়েলের পক্ষে তার নিকট সহীহ হাদীস বিদ্যমান ছিল। আবার অন্যরা যেসব সহীহ হাদীস অনুসারে আমল করেন এবং বলে থাকেন, এই হাদীসগুলো হয়তো তার নিকট পৌঁছে নি, সেগুলোও তার অজানা ছিল না। সেগুলোর অধিকাংশই তিনি রেওয়ায়েত করেছেন। এর জন্য মুরতাযা হাসান যাবীদী কৃত ‘উকুদুল জাওয়াহিরিল মুনীফা’ কিতাবটি দেখা যেতে পারে। আবার এসব মাসায়েলের প্রায় সব কটিতেই তার সঙ্গে সহমত ব্যক্ত করেছেন সুফিয়ান ছাওরী। তিরমিযী শরীফ দেখলেই এ তথ্য পাওয়া যাবে। সুফিয়ান তো ছিলেন আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীস: হাদীসের স¤্রাট ও মহাসাগর। তার ব্যাপারে তো এই সন্দেহ হওয়ার কথা নয় যে, ঐ সব সহীহ হাদীস তার নিকট পৌঁছে নি। সুতরাং দলিলপ্রমাণ ছাড়া এসব কথা বলে লাভ নেই।
হ্যাঁ, সামগ্রিক বিচারে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হানাফী বড় বড় মুহাদ্দিস ও ফকীহ: যাদেরকে আসহাবুত তারজীহ (অগ্রগণ্য আখ্যা দেওয়ার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ) বলা হয়: চিহ্নিত করেছেন যে, সেসব ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার নিকট সহীহ হাদীস পৌঁছে নি। ফলে কোথাও তাঁরা ইমাম আবু হানীফার বিশিষ্ট শিষ্য ইমাম কাযী আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদের মতকে: যা সহীহ হাদীস অনুসারে হওয়া প্রমাণিত: অগ্রগণ্য আখ্যা দিয়েছেন। কোথাও তাঁদের দুজনের কোন একজনের মতকে, কোথাও আবার ইমাম যুফার বা হাসান ইবনে যিয়াদের: এ দুজনও ছিলেন ইমাম আবু হানীফার বিশিষ্ট শিষ্য: মতকে অগ্রগণ্য আখ্যা দিয়েছেন। এভাবে আজকে যাদের মাথায় এমন সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছে, বহু পূর্বেই হানাফী মনীষীগণ তার গোড়া কেটে দিয়েছেন। ফলে এখন আর এমন সন্দেহ পোষণ করার কোন অবকাশ নেই। অন্যান্য মাযহাব সম্পর্কেও এই একই কথা।