লেখক– মুনাজিরে ইসলাম মাওলানা মুহাম্মদ আমীন সফদর ওকাড়বী রহঃ
অনুবাদঃ লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
কুরআনের মর্যাদা
নবুয়তী সময়কালের সাথে দূরত্ব যত বাড়ছে মানুষের মাঝে মুক্ত চিন্তা আর দ্বীন বিমুখিতাও বাড়ছে দেদার। নিজেই ইজতিহাদ করার খাহেশে খাইরুল কুরুন তথা শ্রেষ্ঠ যুগের মুজতাহিদগণের সাথে বিদ্রোহ ও শত্র“তাকে দ্বীনের বড় খিদমাত ও সময়ের গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ বানানোর হীন চেষ্টা বেড়েই চলছে।
সুযোগ পেলেই তাকলীদকে গালি দেয়া আজ ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।
একদিন এক সাহেব আসল। না সালাম দিল, না পড়ল দুআ। চেহারাও মুসলমানের নয়, নয় পোশাকও।
এসেই হঠাৎ বলতে শুরু করে দিল-“এ তাকলীদ। যেটা এত মতভেদ উগরে দিল। আ মানুষদের কুরআন হাদীস থেকে হঠিয়ে দিল। এটাই হল চতুর্থ শতাব্দির বেদআত”।
আমি অপারগ হয়ে তার কথা বন্ধ করার জন্য বাধ্য হয়ে বললাম-“জনাব! মিথ্যা কথা বলার জন্য কিছুটা থেমে নিন। অর্ধেক শ্বাসে তিন মিথ্যা বলে দেয়া একটা নতুন রেকর্ড! যার কোন নজীর সম্ভবত আর পাওয়া যাবে না”।
লোকটি বলতে লাগল-“আপনি মিয়া! নজী হুসাইন মুহাদ্দেসে দেহলবী সাহেবের ‘মেয়ারুল হক’কিতাবটি পড়েছেন? সেখানে কিভাবে তিনি তাকলীদের বারটা বাজিয়ে ছেড়েছেন!”
আমি বললাম-“আপনিতো কথা খুব সহজ করে দিলেন। আসুন! মিয়া সাহেব থেকেই শুনে নিন, তাকলীদ কি জন্য করা হয়? তিনি মুকাল্লিদের বর্ণনা এই নকল করেছেন যে, ‘হাদীস ও কুরআন একটি সমুদ্র। যার কোন কূল কিনারা নেই। এসব বুঝা এবং সঠিক পদ্ধতিতে আমল করা এটা মুজতাহিদে মুতলাকের কাজ। আর আমাদের মত ব্যক্তিদের এতটা যোগ্যতা নেই যে, আমরা কুরআন ও হাদীসকে এভাবে বুঝবো [যে প্রতিটি মাসআলা উদ্ভাবন করে]।যদিও কিছু বাহ্যিক অনুবাদ বুঝতেও পারি, তারপরও আমাদের এটা জানা হয় না যে, এ হাদীসটি রহিত কী না? এর অর্থটি কি বাহ্যিক অর্থেই প্রযোজ্য? এর বিপরীত আরো কোন হাদীস আছে? নাকি নাই? এজন্য আমাদের তাকলীদ করা প্রয়োজন। মুজতাহিদের পথ প্রদর্শনে কুরআন ও সুন্নাহের উপর সঠিকভাবে আমল করে আল্লাহ এবং তার রাসূল সাঃ কে সন্তুষ্ট করতে পারি।
ঐক্যমত্ব
মিঞা সাহেবই শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী এর কাছে তাকলীদ আবশ্যক হওয়ার বিষয়ে লিখেছেন যে, দালালত হিসেবে বর্ণনার অনুসরণ করার নাম। এর ব্যাখ্যা হল-যে ব্যক্তি কুরআন ও হাদীস এর উপর পূর্ণ জ্ঞান না রাখে, নিজেই মাসআলা উদ্ভাবন করার ক্ষমতাও রাখে না, তাহলে তার কর্তব্য এটাই যে, কোন ফক্বীহ এর কাছে তা জিজ্ঞেস করে নিবে। আর সে ফক্বীহের অনুসরণ করবে। চাই তিনি স্পষ্ট নস থেকে বিধান নিয়েছেন, বা উদ্ভাবন করেছেন, বা মানসুস বিষয়ের উপর কিয়াস করেছেন।
এ সকল সূরতই রাসূল সাঃ থেকে বর্ণিত বিষয় দ্বারাই প্রমাণিত। যদিও দালালত হিসেব হোক না কেন।
আর এমন তাকলীদ সহীহ হওয়ার উপর গোটা মুসলিম উম্মাহ সকল স্তরের সবার মাঝে ঐক্যমত্ব রয়েছে। শুধু তাই নয়, অন্য উম্মতীরাও স্বীয় শরীয়তের ক্ষেত্রে এমন বিষয়ে একমত। {মেয়ারে হক-৪৬}
এর দ্বারা একতো এটা জানা গেল যে, মুজতাহিদের তাকলীদ মানে হল রাসূল সাঃ এর অনুসরণ। আর ফিক্বহের উপর আমল করা মানেই হল হুবহু কুরআন সুন্নাহের উপর আমল করা। আর এমন তাকলীদ আবশ্যক হওয়ার উপর শুধুমাত্র এ উম্মতের প্রতিটি স্তর [সাহাবা, তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী, উলামায়ে উম্মত] একমত। শুধু তাই না, প্রথম সকল উম্মতীদের মাঝেও এমন তাকলীদ আবশ্যক হওয়ার উপর সবার ঐক্যমত্ব আছে।
দেখুন! মিঞা সাহেব এবং শাহ ওয়ালী রহঃ সাহেবও এক শ্বাসে আপনার তিন মিথ্যার গোমর ফাঁক করে দিয়েছেন”।
ফিক্বহের উপর আমল
লোকটি বলতে লাগল-“আপনি কি ফিক্বহের প্রতিটি মাসআলার উপর আমল করেন? আমরাতো শুধুমাত্র সহীহ হাদীসের উপর আমল করি। জয়ীফ, শাজ, এবং মাওজু হাদীসের উপর আমল করি না। তাইতো মিঞা সাহেব লিখেছেন যে, সনদ সহীহ, মুত্তাসিল, মুসালসাল হলে গ্রহণযোগ্য হবে। {মেয়ারে হক-১৯}।আর আমাদের আলেমরাও নিজেদের ঘোষণাতে লিখে থাকেন যে, হাদীস সহীহ, সরীহ, মারফু, ও গায়রে মাজরুহ মানেন। এ কারণে আমরা সব হাদীসের উপর আমল করি না”।
আমি বললাম-“আপনাদের কাছে শরয়ী দলিলতো শুধু আল্লাহ ও রাসূল সাঃ এর নির্দেশ তাই না? আর আল্লাহ ও রাসূল সাঃ কোন হাদীসকে না সহীহ বলেছেন, না জয়ীফ, এ কারণেতো আপনাদের এ অধিকার নেই যে, কোন হাদীসকে সহীহ বা জয়ীফ বলার”।
– আপনার কথা অবশ্য ঠিক আছে। কিন্তু আমরা এখানে মুহাদ্দিসীনদের তাকলীদ করতে বাধ্য।
– তাহলেতো আপনারা আহলে হাদীস নন। আপনার ব্যাপার স্যাপার খুবই আজব! ফুক্বাহাদো কাছে যাওয়া ও তাদের তাকলীদ করার হুকুম কুরআন হাদীসে স্পষ্ট থাকা সত্বেও তাদের তাকলীদতো করেন না, মুহাদ্দিসীনদের তাকলীদও করেন না, বরং আপনারা স্বীয় খাহেশাতে নফসানীর তাকলীদ করে থাকেন। কেননা, কুরআন ও হাদীসের কোথাও একথা নেই যে, দলিল শুধু সনদ সহীহ, মুত্তাসিল, এবং মুসলসাল, বা হাদীস সহীহ, সরীহ, মারফু, গায়রে মাজরুহ এর মাঝে সীমাবদ্ধ।
এমনিভাবে মুহাদ্দিসীনরাও এ শর্ত আরোপ করেন নি যে, শরয়ী দলিল কেবলমাত্র সনদ সহীহ, মুত্তাসিল, এবং মুসলসাল, বা হাদীস সহীহ, সরীহ, মারফু ও গায়রে মাজরুহ হওয়ার উপর নির্ভরশীল।
আপনাদের সহীহ শর্তের দ্বারা সকল হাসান হাদীস অস্বিকার করা হল। অথচ হাসান হাদীস দলিল হওয়ার উপর সকল মুহাদ্দিসীনগণ একমত।
এমনিভাবে মুত্তাসিল শর্তের দ্বারা সমস্ত মুরসাল হাদীস অস্বিকার করা হল। অথচ মুরসালে মুজাররাদা [যা অন্য কিছু শক্তিশালী হয়েছে] তিন ইমাম তথা ইমাম আবু হানীফা রহঃ, ইমাম মালিক রহঃ ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহঃ এর কাছে দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
এ শর্তের দ্বারা মুয়াত্তার অলংকারত্ব যেমন অস্বিকৃত হল, তেমনি বুখারীর তা’লীকাতও হল পরিত্যাজ্য। আর মিঞা সাহেবতো শর্ত লাগিয়ে ৯৯% হাদীসকে অগ্রহণযোগ্য সাব্যস্ত করেছেন। কেননা, মুসালসাল এমন হাদীসকে বলা হয়, যার اخبرناথেকে শুরু হয়েছে, আবার শেষও হয়েছে اخبرناদিয়ে। অর্থাৎ পূর্ণ সনদ اخبرناদিয়ে হয়। অথবা حدثناদিয়ে শুরু হয়ে শেষ পর্যন্ত حدثناই থাকে, আর এমন হাদীস কয়টি আছে?
আমার ধারণায় এত হাদীস অস্বিকার, তাও এমন ঢংয়ে কোন মুনকিরীনে হাদীস তথা হাদীস অস্বিকারকারী করেছে কি না? আমার সন্দেহ হয়। আপনারাতো এমন হাদীসের প্রকারকেও অস্বিকার করেন যা দলিল হওয়ার উপর ফুক্বাহায়ে কেরাম ও মুহাদ্দিসীনদের ঐক্যমত্ব রয়েছে। তারপর আপনাদের আহলে হাদীস হওয়ার মাঝে কোন ব্যবধান হয় না। অথচ আমরা যদি ফিক্বহের এমন কোন মাসআলার উপর আমল না করি, যার উপর ফুক্বাহারা ফাতওয়া দেন নি, এবং হানাফীদের কাছে যা একদম আমল হিসেবে অগ্রহণীয়, তাহলে আপনারা শোরগোল শুরু করে দেন যে, আমরা ফিক্বহ অস্বিকার করে দিয়েছি। যেমন মুতাওয়াতির কুরআনের বিপরীত শাজ তথা দুর্লভ ও মাতরুক তথা পরিত্যাজ্য কিরাতকে না কুরআন বলি, না কেউ এর তিলাওয়াত করে। এমনি মুতাওয়াতির সুন্নাতের বিপরীত শাজ ও মাতরুক বর্ণনাকে না সুন্নাত বলি, না কোন সুন্নীর এর উপর আমল হয়। এমনিভাবে ফিক্বহের ঐ সকল মাসায়েল যা মুফতা বিহী তথা যার উপর ফাতওয়া দেয় হয়েছে এমন হয়, সেই সাথে এর উপর সকল স্থানে আমল প্রচলিত হয়, সেটাকে বলা হয় হানাফী মাযহাব। এর বিপরীত যেসব শাজ ও মাতরুক বর্ণনা আছে তা না মাযহাবে হানাফী, না এর উপর আমল করা জায়েজ”।
লোকটি দ্রুততার সাথে বলতে লাগল-“হানাফী মাযহাবে রক্ত দিয়ে বরং প্রস্রাব দিয়ে কুরআনে পাক লিখা জায়েজ লিখা আছে। কি এটাই মাযহাবে হানাফী? যার উপর আপনাদের এত গর্ব!?”
কুরআন ও মাযহাবে হানাফী
আমি বললাম-“আরে কেউ যদি বলে যে, কুরআনে মৃত, রক্ত এবং শুকরের গোস্তকে হালাল লেখা হয়েছে। এটা যেমন কুরআনের উপর মিথ্যাচার, এর চেয়েও বড় মিথ্যাচার এটাকে মাযহাবে হানাফী সাব্যস্ত করা। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন বড় কাফের পর্যন্ত এর আগে এত বড় মিথ্যা কথা বলেনি।
এ বিষয়ে আমাদের মাযহাব, যার উপর প্রতিটি স্থানে আমল, তা হল- কুরআনে পাক এক অতি পবিত্র কিতাব। এটাকে নাপাক ব্যক্তি স্পর্শ করতে পারবে না। এমনকি লিখা আছে যে, অযু ছাড়া কুরআনে পাক এবং তার পৃষ্ঠায় পূর্ণ পৃষ্ঠা স্পর্শ করাও মাকরূহে তাহরীমি। চাই সেই স্থান স্পর্শ করুক, যাতে আয়াত লিখা আছে, চাই যে স্থান লেখাহীন। {আল বাহরুর রায়েক-১/২০১, বেহেশতী গাওহার-১৪}
অথচ গায়রে মুকাল্লিদদের শাইখুল ইসলাম মাওলানা সানাউল্লাহ উমরতাসরী এর ফাতওয়া হল-অযু ছাড়া কুরআনে কারীমে হাত লাগানো যায়। {ফাতওয়ায়ে সানায়িয়্যাহ-১/৫১৯}
যে মহিলা ও পুরুষের উপর গোসল ফরজ সেও কুরআনে কারীম মৌখিকভাবে তিলাওয়াত করতে পারবে না, এর উপর হানাফীদের সকল স্থানের ফাতওয়া। এবং আমলও এর উপরই। অথচ গায়রে মুকাল্লিদদের নিকট গোসল ফরয হওয়া ব্যক্তি এবং হায়েজা মহিলাও কুরআনে কারীমে তেলাওয়াত করতে পারে। {ফাতওয়া সানাবিয়্যাহ-১/৫৩৫}
কুরআনে কারীম ও সিপারা যখন এতই অস্পষ্ট হয়ে যায়, যখন এটাকে আর পড়া যায় না, বা এত ভুল লিখা হয় যে, যাকে শুদ্ধ করে পড়া কষ্টকর, তাহলে এটাকে কোন কাপড়ে ঢেকে এমন স্থানে দাফন করতে হবে যা কখনো পায়ের নিচে না আসে, এবং এমনভাবে দাফন করতে হবে যেন এর উপর মাটি না পরে, অর্থাৎ হয়তো বগলী কবরের মত খনন করে ভিতরে দাফন করে দিবে, বা অথবা এর উপর কোন কাঠ রেখে এর উপর মাটি চাপা দিবে। {বেহেশতী জেওর-১/৫৮}
এই হল হানাফী মাযহাব। যার উপর সকলের আমল। আর শুনে রাখুন! হানাফী মাযহাবে নাপাকী দিয়ে কুরআনে পাক লিখার কথাতো দূরে থাক, কুরআনে কারীমকে কোন ময়লা স্থানে মারাত্মক অপরাধ এবং এমন কুফরী যে, যেমন মুর্তিকে সেজদা করা, বা কোন নবীকে [আল্লাহ হিফাযত করুন] শহীদ করে দেওয়ার মত গোনাহের কাজ। এমন কুফরী যে, এ কর্ম করার পর তার ঈমানের স্বীকারোক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। যেমনটি ফাতওয়ায়ে শামী, মুরতাদ অধ্যায়-৩/২৮৪ তে স্পষ্ট লিখা।
তো যেমন কুরআনে কারীমে মৃত, রক্ত এবং শুকরের গোস্ত ও মদকে হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে, এবং এর হুরমত তথা নিষিদ্ধতা এতটাই অকাট্য যে, এর হালাল হওয়ার প্রবক্তা কাফের, তেমনি কুরআনে পাককে নাপাক স্থানে রাখা অকাট্য হারাম, এবং এর এই অপমানজনক অকাট্য কুফরী”।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম-“আমিতো আমার মাযহাব বলে দিলাম। এবার আপনি আপনার মাযহাব কোন গ্রহণযোগ্য কিতাব থেকে দেখান যে, কুরআনে কারীমের অস্পষ্ট লেখা কপি কী করবে? আর কুরআন কারীমকে অপমানকারীকে আপনারা ফাসেক বলেন না কাফের?”
এবার লোকটি স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করে বলল-“আপনিতো জানেন যে, আমাদের মাসায়েলের কোন পূর্ণাঙ্গ কিতাব নেই। এজন্য আমরাও মাসায়েলের ক্ষেত্রে ফুক্বাহায়ে কেরামে এ সুন্দর উদ্ভাবন গ্রহণ করে থাকি”।
অপরাগ অবস্থার বর্ণনা
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম-“কুরআনে কারীমে মৃত, রক্ত এবং শুকরের গোস্তকে হারাম বলেছে, এর পরই فمن اضطر غير باغ ولا عاد فلا اثم عليه، ان الله غفور الرحيم (১৬/১১৫) তথা অতঃপর কেউ সীমালঙ্ঘনকারী না হয়ে নিরূপায় হয়ে পড়লে, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। {সূরা নহল-১১৫}
আল্লামা উসমানী রহঃ বলেন-উল্লেখিত বস্তুগুলো হারাম। কিন্তু যখন কোন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি মৃত পদযাত্রী হয়ে যায়, তাহলে তার এ নিরূপায় অবস্থায় এসব খাওয়ার অনুমতি আছে। তবে শর্ত হল নাফরমানী ও অতিরঞ্জন করতে পারবে না।
নাফরমানী হল-যেমন নিরূপায় অবস্থায় পৌঁছেনি, তারপরও খেতে শুরু করে দেয়া, আর অতিরঞ্জন এর অর্থ হল-প্রয়োজনের অতিরিক্ত খুব পেট ভরে খাওয়া। শুধু এতটুকু খাবে, যতটুকু না খেলে মারা যাবে।
এখন যদি কোন ব্যক্তি ক্ষুধায় মরতে বসে, আর তার সামনে মৃত প্রাণী ছাড়া কিছু না থাকে, যেটা অকাট্য হারাম, যাকে হালাল মনে করা কুফরী, আর সেখানে প্রাণ বাঁচানোর মত কিছুও নেই, তাহলে কি এ প্রয়োজনের সময় প্রয়োজন মাফিক মৃত প্রাণী থেকে কিছু খেয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে নেয়, তাহলে কি এটা জায়েজ হবে?”
লোকটি বলল-“অবশ্যই জায়েজ”।
আমি বললাম-“তাহলে কি এটা বলা যাবে যে, কুরআন মৃত খাওয়া জায়েজ সাব্যস্ত করেছে? নাকি এটা বলা হবে যে, সকল মুসলমান মৃত প্রাণী হালাল একথা বিশ্বাস করে?”
লোকটি বলল-“এটাতো একেবারে মিথ্যা কথা!”।
আমি বললাম-“এক ব্যক্তি পিপাসায় মরতেছে, তার কাছে মদ ছাড়া আর কিছু নেই, যা পান করে প্রাণ বাঁচাতে পারে, তাহলে কি এ প্রয়োজনের সময় প্রয়োজন মাফিক মদ পান করে প্রাণ বাঁচানো কি জায়েজ আছে?”
লোকটি বলল-“অবশ্যই জায়েজ”।
আমি বললাম-“এ বেচারার এ কাজের কারণে কি এটা বলা যাবে যে, কুরআনে কারীম মদ খাওয়ার খুল্লামখুলা অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে? অথবা সকল মুসলমান মদ পান করাকে হালাল মনে করে?”
লোকটি বলল-“আরে! এটাতো বিলকুল মিথ্যা কথা হবে”।
আমি বললাম-“এ মিথ্যা বক্তব্যপ্রদানকারী যদি কোন শিখ বলে, যে সর্বদা মৃত প্রাণী খায়, মদ পান করে, আর সে অপরগতার মাসআলার ব্যাপারে এ শোরগোল করে যে, কুরআনে মৃত, শুকর ও মদকে হালাল লিখেছে। তাহলে এটা কি তার চূড়ান্ত নির্লজ্জতা আর জঘন্যতা নয় যে, নিজেতো এসবকে স্বাভাবিক অবস্থায় হালাল বলে, আবার কুরআনের উপর মিথ্যাচারও করে?
এখানে একথাও স্বরণ রাখুন যে, যে প্রাণী বন্দুক দিয়ে মারা হয়, আমাদের কাছে এ মৃত হারাম। আর গায়রে মুকাল্লিদদের নিকট হালাল। {বুদুরুল আহিল্লাহ-৩৩৫, ফাতওয়া সানাবিয়য়্যাহ-১/১৫০}
এমনিভাবে গায়রে কিতাবী কাফের, অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, কাদিয়ানীদের জবাইকৃত পশু আমাদের কাছে মৃত। হারাম।
অথচ গায়রে মুকাল্লিদদের কাছে হালাল। {উরফুল জাদী-১০}
এমনিভাবে কেঁচু, কাঁকড়া এবং গুইসাপ তাদের কাছে হালাল। {ফাতওয়া সানাবিয়্যাহ-২/৭০, ২/১০৯, উরফুল জাদী-২৩৬}
গায়রে মুকাল্লিদরা এসব নিরূপায় অবস্থা ছাড়াই এসব খায়, পান করে। অথচ যদি কোন হানাফী নিরূপায় অবস্থায়, প্রাণ বাঁচাতে প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনমাফিক এসব খায়, তখন ওরা মিথ্যা শোরগোল শুরু করে দেয় যে, হানাফীরা এসবকে হালাল বলে”।
ওষুধ এবং নিরূপায় হালাত
উপরে খাদ্য সম্পর্কিত নিরূপায় হালাতের উদাহরণ গেল, যাতে মৃত, মদ নিরূপায় অবস্থায় প্রয়োজন মাফিক অনুমোদন আছে। কিন্তু একথা বলা যে, কুরআন মৃত ও মদকে হালাল বলে, এটি মিথ্যাচার।
এখন এটি স্পষ্ট যে, ক্ষুধা পেটে কোন খাদ্য গেলে এর দ্বারা প্রাণ বেঁচে যায়। পিপাসার্তে কোন পানীয় পেলে তাহলে এটা নিশ্চিত যে, পিপাসা মিটে যাবে। কিন্তু অষুধের সাথে সুস্থ্যতা এতটা সুনিশ্চিত নয়, যতটুকু পানির সাথে পিপাসা মিটে যাওয়ার রয়েছে। বরং অষুধের দ্বারা আরোগ্যতাটি হল ধারণাসূচক।
এখন যদি কোন রোগী এমন হয় যে, কোন হালাল অষুধ তার কাজে আসছে না। এমতাবস্থায় কোন দ্বীনদার বিজ্ঞ ডাক্তার যদি এটা বলে যে, ওমুক হারাম অষুধ দিয়ে তার সুস্থ্য হওয়ার প্রবল ধারণা হয়। তাহলে তার প্রাণ বাচানোর জন্য প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনমাফিক অষুধ ব্যবহার জায়েজ আছে কি নেই?
আদ দুররুল মুখতারের লেখক বলেন-‘আমাদের জাহেরী মাযহাব হল-হারাম অষুধ ব্যবহার নিরূপায় অবস্থায় ব্যবহার করাও নিষিদ্ধ। অথচ গায়রে মুকাল্লিদদের বক্তব্য হল-প্রতিটি হালাল প্রাণী [তাদের নিকট ঘোড়া, এবং বক্তব্য অনুযায়ী হাতীও হালাল, কানযুল হাকায়েক] এর পায়খানা এবং প্রস্রাব পাক। যে কাপড়ে লাগে তাতে নামায পড়া জায়েজ। এমনকি অষুধ হিসেবে ব্যবহার করাও জায়েজ আছে। {ফাতওয়া সাতারিয়া-১/৫৩}
আল হাদী কুদসীতে অষুধ হিসেবে নিরূপায় অবস্থায় ব্যবহার জায়েজের ফাতওয়া দেয়া হয়েছে। তবে তাক্বওয়াতো এটাই যে, হারাম অষুধ ব্যবহার না করবে, তবে নিরূপায় অবস্থায় ফাতওয়া দ্বারা সুযোগ আছে বলে প্রতীয়মান হয়। যাতে নিশ্চিত ও ধারণার মাঝে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
কিন্তু এটা বলা যে, মাযহাবে হারাম অষুধ হালাল হয়ে গেছে, এটা কুরআনে কারীম মৃতকে হালাল বলেছে বলার চেয়েও বড় মিথ্যাচার। কেননা, নিরূপায় ব্যক্তির জন্য মৃত খাওয়াতো সর্বসম্মতিক্রমে জায়েজ। কিন্তু নিরূপায় ব্যক্তির জন্য হারাম অষুধ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে মতভেদ আছে।
ঝাড়ফুঁক ও আমলসমূহ
পানি পান করলে পিপাসা মিটে যায়। খানা খেলে ক্ষুধা নিবারিত হওয়া স্বাভাবিকভাবে নিশ্চিত। কিন্তু অষুধ গ্রহণের পর সুস্থ্যতা মাজনূন তথা ধারণাসূচক। আর ঝাড়ফুক, তাবীজ ও আমল দ্বারা আরোগ্যতা মাওহুম তথা অনুমিত। এবার প্রশ্ন হল-মাওহুমকে মাজনূনের উপর কিয়াস করা হবে কী না?
এ ব্যাপারে গুরাবায়ে আহলে হাদীস জামাতের ফাতওয়া দেখুন-
প্রশ্নঃ সাপ, বিচ্ছু বা কুকুর কামড়ালে শিরকী শব্দ দিয়ে ঝাড়ফুক করা জায়েজ আছে কি নেই?
উত্তরঃ ভালতো নয়, তবে কোন মুসলমানের কল্যাণার্থে প্রয়োজনের সময় নিরূপায় হয়ে যদি করে ফেলে তাহলে কোন সমস্যা নেই। {সহীফায়ে আহলে হাদীস, রমযানুল মুবারক ১৯৪৫ ঈসাব্দ}।
এর পর আবু মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার সাহেবের দস্তখত আছে। তারপর তার পিতা মাওলানা আব্দুল ওহাব দেহলবী আরো লিখেন-“সাপ, বিচ্ছু, কুকুর ইত্যাদি কাটলে, তাহলে বিষওয়ালা প্রাণীর কাটা স্থানে শিরকী শব্দ দিয়ে কোন অমুসলিম বা মুসলিম ঝাড়ফুক করলেও কোন সমস্যা নেই। {সহীফায়ে আহলে হাদীস, জমাদিউস সানী, ১৯৪৬ ঈসাব্দ} রেফারেন্স দিয়েছেন যিল্লে মুহাম্মদী ওরফে ইমামতে মুহাম্মদী মুহাম্মদ জুনাগরী এর। এবার প্রশ্নোত্তরের ধরণটি লক্ষ্য করুন-
প্রশ্নঃ
এক ব্যক্তির নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে, আর কোন জায়েজ অষুধ দিয়ে তা বন্ধ করা যাচ্ছে না। লোকটি মৃতপ্রায় হয়ে যাচ্ছে। যদি কারো জানা থাকে যে, এ রক্ত দিয়ে যদি সূরা ফাতিহা কপালে লিখে দেয়া হয় তাহলে রক্ত বন্ধ হয়ে যাবে। আর লোকটির প্রাণও বেঁচে যাবে। তাহলে কি নিরূপায় অবস্থায় একাজ করা জায়েজ আছে?
গায়রে মুকাল্লিদের পক্ষ থেকে জবাবঃ
গায়রে মুকাল্লিদদের নিকট রক্ত পাক। প্রতিটি হালাল প্রাণীর প্রস্রাব পায়খানাও পাক। বীর্যও পাক। আর পাক জিনিস দিয়ে কুরআন লিখা কোন আয়াত বা হাদীস দ্বারা নিষেধাজ্ঞা আসে নি। এজন্য নিরূপায় অবস্থায় হোক, বা স্বাভাবিক অবস্থায় হোক, সর্ববস্থায় তা করা জায়েজ আছে। যেখানে বুখারীতে উটের প্রস্রাব পান করার বিধান আছে। তাহলে কুরআনে পাককে লেখা কি করে না জায়েজ হতে পারে? আর অনেক গায়রে মুকাল্লিদরাতো ফাতিহাকে কুরআনই মনে করে না। তাহলে এর উপর আর কি সমস্যা থাকতে পারে?
হানাফীদের পক্ষ থেকে জবাবঃ
রক্ত, বীর্য, প্রস্রাব নাপাক। আর নাপাক স্থানে কুরআনে কারীম রাখা, মৃত, শুকর মদের মতই অকাট্য হারাম ও কুফরী। আর এর দ্বারা আরোগ্যলাভ সুনিশ্চিত নয়, এবং মাযনুন ও নয়। বরং মাওহুম। তাই মাওহুমকে মাযনূন এবং ইয়াকীনের উপর কিয়াস করে এমন নিরূপায় অবস্থায়ও এ কথা বলা যাবে না যে, এরূপ নিরূপায় অবস্থায় শরীয়ত হারাম কাজ করার অনুমোদন দেয়, বা কুফরী করার অনুমোদন দেয়।
এটাই হল প্রকৃত হানাফী মাযহাব। অবশ্য যদি কেউ মাওহুমকে মাযনূন ও ইয়াকিনের উপর কিয়াস করে এমন নিরূপায় অবস্থায় হারাম কাজ করার অনুমোদন দিয়ে থাকে, তাহলে সেটি তাহলে এটি প্রকৃত হানাফী মাযহাবের বিপরীত।
অবশ্য গায়রে মুকাল্লিদদের নিকট নিরূপায় অবস্থা ছাড়াও স্বাভাবিক অবস্থায় রক্ত এবং হালাল প্রাণীর প্রস্রাব পায়খানা দিয়ে কুরআনে কারীম লেখা কখনোই নিষিদ্ধ নয়।
এ কারণে গায়রে মুকাল্লিদদের হানাফীদের অপপ্রচার করা শিখদের বাতিল দাবির চেয়েও জঘন্য। যে শিখেরা স্বাভাবিক অবস্থায় শুকর খাওয়াকে হালাল মনে করে, অথচ মুসলমানদের উপর অভিযোগ করে বলে যে, “তোমাদের মাযহাব ভুল। তোমাদের কুরআনে শুকর খাওয়াকে হালাল বলেছে”।
মোটকথা, যেভাবে আমরা রক্ত, মৃত, শুকর এবং মদকে অকাট্য হারাম বলে থাকি, তেমনি কুরআনে কারীমকে নাপাক স্থানে ইচ্ছেকৃত রাখাকেও হারাম বিশ্বাস করি। শুধু তাই নয়, এটাকে এমন কুফরী মনে করি যে, যেমন মুর্তীকে সেজদা করা কুফরী। কাবা শরীফকে লাঞ্ছিত করা কুফরী। কোন নবীকে শহীদ কুফরী।
পক্ষান্তরে যারা আহলে সুন্নাতের উপর অপবাদ আরোপ করছে, তারা নিজের মাযহাবকে পরিমার্জিত করে ছাপাচ্ছে না যে, তাদের কাছে রক্ত পবিত্র, মৃতও পবিত্র। প্রতিটি হালাল প্রাণীর প্রস্রাব পবিত্র। বীর্যও পাক। আর বারবার আবেদন করার পরও একটি আয়াত বা হাদীসও উপস্থাপন করতে পারে নি যে, পাক বস্তু দিয়ে কুরআনে কারীম লেখা হারাম ও কুফরী।
সেই সাথে আমাদের ইমাম আবু হানীফার রহঃ, ইমাম আবু ইউসুফ রহঃ, ইমাম মুহাম্মদ ও যুফার রহঃ থেকে কিয়ামত পর্যন্ত কোন মায়ের সন্তান নিরূপায় অবস্থায়ও এ হারাম ও কুফরী করা জায়েজ বলেছেন বলে প্রমাণিত করতে পারবে না।
না উঠবে খঞ্জর না উঠবে তলোয়ার,
নিয়েছি পরীক্ষা এ হাতের বারংবার।
অবশেষে লোকটি এ ওয়াদা করে যায় যে, সে উভয় বক্তব্যটির প্রমাণ নিয়ে আসবে। এক হল-যেহেতু তাদের কাছে রক্ত, বীর্য, মদ, শুকর, মৃত এবং হালাল প্রাণীর প্রস্রাব পবিত্র, তাহলে কোন হাদীস বা আয়াতে আছে কি যে, পবিত্র বস্তু দিয়ে কুরআন পাক লেখা হারাম এবং কুফরী?
দ্বিতীয় হল- তাদের ৫ জন ইমাম থেকে সহীহ সনদসহ এ কথা প্রমাণিত যে, তারা নিরূপায় অবস্থায় এ হারাম ও কুফরী কাজ [প্রস্রাব দিয়ে কুরআন লিখন ইত্যাদি] করার অনুমোদন দান করেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ দু’টি কথার প্রমাণ পেশ করতে পারে নি।
গায়রে মুকাল্লিদদের সাথে আমার সর্বশেষ দরখাস্ত এই যে, আপনারা প্রথমেই মানুষের মাঝে দ্বীন বিমুখিতা এবং পূর্বসূরীদের ব্যাপারে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে ফেলেছেন। আর এমন অপবাদ আরোপ করা দ্বীনের কোন খিদমাত নয়। বর্তমানে এমন বিদ্বেষ মনোভাবান্ন না মুসলিম জাতি। না আমাদের দেশ। তাই এসব থেকে ফিরে আসুন। আল্লাহ তাআলা সবাইকে মিথ্যা থেকে তওবা করার তৌফিক দান করুন।