প্রশ্ন
Sujata Joynob Sugandhi নামের এক মহিলা নিকধারী বহুল প্রচলিত একটি হাদীসের ক্ষেত্রে যা বলছে তা হুবহু নিম্নে দেয়া হল। এ ব্যাপারে আপনাদের সুচিন্তিত মত জানতে চাই।
প্রশ্নকর্তা-নাম ও ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক।
উক্ত মেয়ে নামধারীর হুবহু বক্তব্য
“আল্লাহ যদি উনার পরে কাউকে সিজদাহ করতে বলত তাহলে হয়ত স্ত্রীদেরকে তাদের স্বামিকে সিজদাহ করার অনুমতি দিত।”
এইটা তো সহিহ হাদিসেও মনে হয় রেফারেন্স এসেছে। আপু ১টু ক্লিয়ার করেন প্লিজ। জাযাকিল্লাহ
উপরের প্রশ্নটা আমাকে করা হয়েছে।
প্রশ্নের জন্য তাকেও আল্লাহ্ উত্তম প্রতিদান দিন ও হেদায়েতের উপর জ্ঞান চক্ষু খুলে দিন।
আমার উত্তর নীচে — তাদের জন্য যারা এই প্রশ্নটার উত্তর চান।
কোরআনে সুরা তাওবার ৭১ নং আআয়াতে বলা আছে মুমিন নারী ও পুরুষ পরস্পরের আউলিয়া মানে ফ্রেন্ড ফিলসফার এন্ড গাইড — এর মধ্যে কে কাকে সিজদা করবে?
সুরা নিসার ২১ নং আয়াতে বলা আছে স্বামি স্ত্রীর কাছে কঠিন শর্তে আবদ্ধ — স্ত্রী আবদ্ধ নয় আবদ্ধ হোল স্বামী , তাহলে কার কাকে সিজদার প্রসঙ্গ আসে?
সুরা লুকমান আয়াত ১৪– আল্লাহ্ বলেন আমাকে ভয় কর আর পিতামাতার শোকরগুজার হও এখানে আরবী পড়ে যদি বোঝেন তাহলে স্পষ্ট বুঝবেন সিজদা করার অনুমোদন থাকলে তা পিতা মাতার উদ্দেশ্যে হোত।
ইসলামে কোন অযৌক্তিক নির্দেশ নাই।
স্বামীর কাছে স্ত্রীর কোন গ্রেটফুলনেস বা কৃতজ্ঞতার কারনে এমন কথা বলা হবে? সাড়ে চৌদ্দ হাজার হাদীস জাল করা হয়েছে যেখানে হালালকে হারাম আর হারামকে হালাল বলে উল্লেখ করা আছে
কোরআনের আয়াত বিশ্বাস করতে হবে শুনলাম ও মানলাম বলে আর হাদীস ভেরিফাই না করে বিশ্বাস করা যাবেনা ।
যা সত্য তা সত্য।
কোরআনের কোন সহী আছে কি?
হাদীসের সহী কেন ? কোরআনের সাথে হাদীসের বক্তব্য সমার্থক না হলে তা কি ভাবে সহি হবে?
আরেকটা কথা বলি আল্লাহ্ সব মানুষকেই একই ভাবে সৃষ্টি করেছেন–
আপনি নিজেকে যখন হীন মনে করেন তখন কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি পরোক্ষ সন্দেহ করা হয়। আল্বানী শওকানী রা যদি পারেন আপনি কেন পারবেন না ?
অবশ্যই আল্লাহ্ চাইলে পারবেন।
উনারাও কেউ আল্লাহর প্রকাশ্য সার্টিফিকেটধারী নন আপনি ও নন । তাই নিজেও বোঝার চেষ্টা করুন কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়েই।
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
প্রশ্নে উল্লেখিত মহিলা বা পুরুষটি কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে কতটা অজ্ঞ এবং বিদ্বেষভাবাপন্ন তা তার লেখার ষ্টাইল দ্বারা পরিস্ফুটিত। একটি পরিস্কার সহীহ হাদীসকে জাল ও বানোয়াট প্রমাণের জন্য কুরআন ভক্তির নাটকের মঞ্চায়ন করলেন চাতুরতার সাথে। অথচ হাদীসটি সহীহ কি না? সেদিকে একবারও খেয়াল করার প্রয়োজন অনুভব করেনি লোকটি।
প্রথমে আমরা হাদীসটি দেখে নেই-
عَنْ مُعَاذٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَوْ كُنْتُ آمِرًا أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لِأَحَدٍ لَأَمَرْتُ النِّسَاءَ أَنْ يَسْجُدْنَ لِأَزْوَاجِهِنَّ»
হযরত মুয়াজ রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যদি আমি যদি কোন ব্যক্তিকে অন্য কাউকে সেজদা করার আদেশ দিতাম, তাহলে আমি স্ত্রীদের আদেশ দিতাম তাদের স্বামীকে সেজদা দিতে। [কিন্তু সেজদা আল্লাহ ছাড়া কাউকে দেয়া জায়েজ নয়, তাই এ আদেশ দেয়া হয়নি’।
হাদীসটি যেসব কিতাবে বর্ণিত
মুসন্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-৮৭৮৫,
সুনানে দারেমী, হাদীস নং-১৫০৪,
সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২১৪০,
মুসনাদুল হারেস, হাদীস নং-৪৯৮,
মাশকিলুল্ আসার, হাদীস নং-১৪৮৭,
মুজামে কাবীর, হাদীস নং-৪৮৬,
মুসতাদরাক আলাস সাহিহাইন, হাদীস নং-২৭৬৩,
সুনানে কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং-১৪৭০৫।
হাদীসটির ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসদের বক্তব্য
১
ইমাম আবু দাউদ রহঃ এ হাদীস নকল করে চুপ রয়েছেন। আর তিনি যে হাদীস বর্ণনা করে চুপ থাকেন, সেটি তার কাছে সহীহ।
২
আল্লামা হায়তামী রহঃ বলেন, এর সনদ সহীহ। {আযযাওয়াজের-২/৪১}
৩
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী রহঃ বলেন, এটি সহীহ। {আলজামেউস সাগীর, বর্ণনা নং-৭৪৮২}
৪
আল্লামা বুসিরী রহঃ বলেন, এর সনদ ও এর রাবীগণ সিকা তথা নির্ভরযোগ্য। {ইতহাফুল খায়রাহ-৪/৮৩}
রাসূল সাঃ থেকে প্রমাণিত একটি সহীহ ও গ্রহণযোগ্য হাদীসকে যে ব্যক্তি অহেতুক যুক্তি দাঁড় করিয়ে অস্বিকার করতে পারে, আর যাইহোক খাটি মুসলিম হতে পারে না।
আমাদের পক্ষ থেকে উক্ত ব্যক্তির কাছে হাদীসটির সহীহ হবার প্রমাণ পেশ করার পরও যদি তার ভুল দাবি থেকে সে ফিরে না আসে, তাহলে হাদীস অস্বিকার করার কারণে উক্ত ইসলামের সীমা থেকে বেরিয়ে যাবে। তাই উক্ত ব্যক্তিকে নিজের অজ্ঞতা সত্বেও ইসলাম সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান থেকে বিরত রাখতে সকলের সাধ্যমত চেষ্টা করা উচিত। ইসলাম সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রদানের কারনে প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে চেষ্টা উচিত। হাদীস অস্বিকার করায় ধর্ম অবমাননার মোকাদ্দমা দায়ের করে হলেও এসব বিভ্রান্তিকারীদের অপপ্রচার থেকে সাধারন মুসলমানদের রক্ষা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের এসব অজ্ঞ ও কুরআন ও হাদীস বিদ্বেষী ব্যক্তিদের অপপ্রচার থেকে সরলপ্রাণ মুসলমানদের ঈমান ও আমলকে হিফাযত করুন। আমীন।
সতর্কবাণী
আমাদের তাহকীক মতে অনেক বিধর্মীকে ইহুদী খৃষ্টানরা মুসলিম সাজিয়ে ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যারা মূলত বিধর্মী, কিন্তু নাম ব্যবহার করে মুসলমানের। মূলত কাফির কিন্তু ভাব দেখায় মুসলমানের। তারা কখনো কুরআনকেই খোঁড়া যুক্তি দিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। আবার কুরআনের দোহাই দিয়ে অস্বিকার করে হাদীস। আবার ইসলামের বিভিন্ন বিধানকে মানবতা বিরোধী আখ্যা দিয়ে পেশ করে অহেতুক হাস্যকর যুক্তির।
ইসলাম দরদীর মুখোশ পড়লেও এরা ইসলাম ও মুসলমানদের ঘোরতর শত্রু। তাই যার তার কাছে ইসলামের কথা গ্রহণ করতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন বিজ্ঞ মনীষীগণ।
দ্বীনী বিষয় খুবই উঁচু মার্গের। তাই যার তার কাছ থেকে দ্বীনী বিষয় গ্রহণ কিছুতেই উচিত নয়। ভিডিও মুফতী। টিভি মুফতী ইত্যাদি থেকে দ্বীন শিখতে গেলে তা আর দ্বীন থাকবে না। হয়ে যাবে জগাখিচুরী। এ কারণেই হযরত মুহাম্মদ বিন সীরীন রহঃ বলেছেন-
عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ سِيرِينَ، قَالَ: «إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِينٌ، فَانْظُرُوا عَمَّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ»
হযরত মুহাম্মদ বিন সীরীন রহঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নিশ্চয় এটি দ্বীনী ইলম। তাই তুমি নির্দিষ্ট করে নাও, তোমার দ্বীন কার কাছ থেকে গ্রহণ করবে? {মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস নং-২৭৩, সুনানে দারেমী,হাদীস নং- ৪৩৩, মুসন্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-২৬৬৩৬,কানযুল উম্মাল, হাদীস নং-২৯২৭৪, মুকাদ্দিমায়ে সহীহ মুসলিম}
দ্বীনী বিষয় গ্রহণ করার আগে দেখে নিতে হবে লোকটি কে? কি তার পরিচয়? তার কী পড়াশোনা আছে? সে কি দ্বীনী বিষয় বলার যোগ্যতা রাখে?
আফসোস! আমরা শারীরিক অসুস্থ্যতার জন্য ডাক্তারের কাছে গেলে দেখে নেই, যার কাছে গেলাম সে ডাক্তার কি না? তার ডিগ্রি আছে কি না? সে এমবিবিএস কি না? তিনি এফসিপিএস কি না? তিনি ডাক্তারী বিষয়ে পিএইচডি করেছেন কি না? ডাক্তারী বিষয় শিখার পর তিনি বিজ্ঞ কোন ডাক্তারের কাছে থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কি না? উক্ত ডাক্তারের বিষয়ে মানুষ কি বলে? অন্যান্য ডাক্তাররা উক্ত ডাক্তারকে ডাক্তার হিসেবে স্বীকৃতি দেয় কি না?
এই সব কিছুই আমরা দুনিয়াবী, শারীরিক অসুস্থ্যতার চিকিৎসা-সমাধানের জন্য জেনে নেই। তারপর ঐ ডাক্তারের প্রেশক্রিপশন গ্রহণ করি। কিন্তু বড়ই আফসোসের বিষয় হল, দ্বীনী বিষয়ের মত এত স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা এসব যাচাইয়ের কোন প্রয়োজন অনুভব করি না। যাকে তাকে শায়েখ বানিয়ে দেই। লাল নীল জামা পড়ে, প্যান্ট টাই পড়ে, ভিডিও সামনে বসে, টিভি সেটের সামনে বসে যাচ্ছে তাই বলে যাচ্ছে, আমরা এসবই দ্বীন মনে করে গোগ্রাসে গিলে নিচ্ছি। দ্বীন মনে করে আত্মতৃপ্ত হচ্ছি।
একবারও জানার চেষ্টা করি না। লোকটি আলেম কি না? লোকটিকে বিজ্ঞ আলেম হিসেবে বিজ্ঞ উলামাগণ স্বীকৃতি দেন কি না? লোকটি দ্বীন সম্পর্কে সত্যিই অভিজ্ঞ কি না? এরকম গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা বলার মত যোগ্যতা লোকটি মাঝে আছে কি না?
দুনিয়াবী বিষয়ের ডাক্তারের সব খোঁজ নিলেও দ্বীনী ডাক্তার তথা সমাধানদাতার ব্যাপারে খোঁজ খবর না নিয়েই আমরা লুফে নেই লোকটির জাহালতপূর্ণ গবেষণা।
দ্বীনী বিষয় যার তার কাছ থেকে নেয়া উচিত নয়। অনভিজ্ঞ ও অস্বীকৃত কোন ব্যক্তির দ্বীনী বিষয়ের ফাতওয়ার উপর নির্ভর করা মানে হল নিজের পায়ে নিজেই কুঠারাঘাতের মত অপরিণামদর্শী আচরণ। তাই ধর্মীয় বিষয়ে এসব লেখকদের লেখা পড়াউ উচিত নয়। কার বক্তব্য শুনবেন? এসব বিষয় আপনার নিকটস্থ হক্কানী আলেম উলামা থেকে জেনে শুনুন। নতুবা বিভ্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক।
আল্লাহ তাআলা এসব ফিতনা থেকে মুসলিম জাতিকে হিফাযত করুন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন