মাওলানা মুহসিনুদ্দীন খান
হাফেজ আবু বকর আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুহাম্মাদ বিন আবী শাইবা (১৫৯-২৩৫ হি.) হলেন ইমাম আযমের প্রশিষ্য। তিনি আলমুসান্নাফ নামে সুবিশাল এক হাদীস গ্রন্থ সংকলন করেছেন। মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ হাদীস বিশারদ, প্রাচীন পাণ্ডুলিপি-বিশারদ শায়েখ মুহাম্মাদ আওয়ামা (দা. বা.)-এর বলিষ্ঠ সম্পাদনায় একুশ ভলিয়মে (ইনডেক্স বাদে) এটি মুদ্রিত হয়েছে। যার হাদীস সংখ্যা ঊনচল্লিশ হাজার আটানব্বই (৩৯০৯৮) টি।
সুবিশাল এ আলমুসান্নাফ গ্রন্থটি ফিকহে হানাফীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য দলীলের প্রাচুর্যতার এক অনুপম বিশ্বকোষ বললে অতিশয়োক্তি হবে না নিশ্চয়। বিগত শতকের ঈগলদৃষ্টি গবেষক, বিদগ্ধ হাদীসবিশারদ আল্লামা যাহেদ আলকাওসারী রহ. আলমুসান্নাফকে এভাবে মূল্যায়ন করেছেন—
والمصنف احوج ما يكون الفقيه اليه من الكتب الجامعة للمسانيد والمراسيل وفتاوى الصحابة والتابعين، رتبه على الأبواب ليقف المطالع على مواطن الاتفاق والاختلاف بسهولة. وهو من اجمع الكتب لأدلة الفقهاء خاصة اهل العراق.
‘মুসনাদ ও মুরসাল বর্ণনাসমূহ এবং সাহাবী ও তাবেয়ীনের ফতওয়ার যে পূর্ণাঙ্গ কিতাব রয়েছে তন্মধ্যে একজন ফকীহের জন্য সবচেয়ে বেশী যে কিতাবের প্রয়োজন তা হল ‘আলমুসান্নাফ।’ যে কিতাবকে তিনি (ইবনে আবী শাইবা) অনুচ্ছেদভিত্তিক বিন্যস্ত করেছেন; যেন এ কিতাব অধ্যয়নকারী ঐকমত্যপূর্ণ ও মতবিরোধপূর্ণ বিষয়সমূহের ব্যাপারে সহজেই অবগত হতে পারে। কিতাবটি ফকীহ্দের বিষেশত ইরাকবাসীদের (হানাফী মাযহাবের) দলীলসমূহের পূর্ণাঙ্গ কিতাব।’ [কাওসারী রহঃ কৃত যুয়ুলু তাযকীরাতিল হুফফাজ এর হাশিয়া-১৮৫, দিমাশক]
শায়েখ মুহাম্মাদ আওয়ামা (দা.বা.) ও আলমুসান্নাফ গ্রন্থের মূল্যায়নে সুন্দর অভিমত পেশ করেছেন।
وأما “المصنف” : فهو كتاب الكتب، وديوان الدواوين، وجامع الجوامع، وهو مكنز الآثار في فقه السلف عامة، وفي فقه أهل الكوفة خاصة، مرويا بالأسانيد إلى أربابها، وهذا أمر لا يضاهيه فيه كتاب من الكتب المطبوعة، ولا من الكتب المخطوطة المحفوظة فيما أعلم، (مقدمة المصنف ۱: ۰ ٢)
এককথায়, হাফেজ আবু বকর আব্দুল্লাহ্ ইবনে মুহাম্মাদ বিন আবী শাইবা রহ.-এর ‘আলমুসান্নাফ’ গ্রন্থটি হানাফী মাযহাবের দলীলের অন্যতম উৎস ভা-ার বা বিশ্বকোষ। কিতাবটি এত সব বৈশিষ্ট্যের ধারক-বাহক হওয়া সত্ত্বেও ইমাম ইবনে আবী শাইবা রহ. তাঁর এ কিতাবে ইমাম আযমের খিলাফ একটি অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন— كتاب الرد على أبي حنيفة.।
আবার এই অধ্যায়ের সূচনা করেছেন নিম্নোক্ত বাক্য দিয়ে— هذا ما خالف به أبو حنيفة الأثر الذي جاء عن رسول الله صلى الله عليه وسلم । এ অধ্যায়ে তিনি একশ পঁচিশটি মাসআলার ব্যাপারে দাবি করেছেন যে, এসব মাসআলার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার মতামত হাদীস ও আছারের পরিপন্থী।
ইলমী তানকীদ (পর্যালোচনা) ও আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য
মূল ব্যাপারটি হল, সালফে সালেহীনদের যামানায় অধিকাংশ ইমাম-ই একজন আরেকজনের উপর সঠিক পন্থায় ইলমী তানকীদ করতেন। তবে এ ধরনের ইলমী পর্যালোচনা ও সমালোচনা কোন সংকীর্ণ মনোবৃত্তি দ্বারা নয় বরং মহৎ লক্ষ্য দ্বারা তাড়িত ছিল। ইমাম লাইস বিন সাদের বর্ণনা,
‘আমি ইমাম মালেকের সত্তরটি মাসআলা এরূপ পেয়েছি যার সবটাই সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের পরিপন্থী। সুতরাং এ বিষয়ে আমি তাঁকে তা লিখেও পাঠিয়েছি।’ [জামিউল বায়ানিল ইলম-২/১৪৮, মুনীরিয়ার মুদ্রণ, মিশর]
অন্যদের কথা আর কী বলব! খোদ ইমাম শাফেয়ী রহ. ইমাম মালেকের খণ্ডনে একটি কিতাব লিখেছেন। যাতে তিনি প্রমাণিত করেছেন যে, তাঁর অজস্র মাসআলা-মাসায়েল হাদীস পরিপন্থী। ইমাম রাযী রহ. তাঁর মানাকিবুশ শাফেয়ী গ্রন্থে এ কিতাবের ভূমিকা অংশ উল্লেখ করে দিয়েছেন। যাহেরীদের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হাফেজ ইবনে হযম উন্দুলুসী তাঁর মারাতিবুত দিয়ানা নামক কিতাবে লিখেছেন,
‘মুয়াত্তা গ্রন্থে সত্তর ঊর্ধ্ব এরূপ হাদীস রয়েছে যার উপর খোদ ইমাম মালেক নিজেই আমল করেননি।’ [তাদরীবুর রাবী-২৩]
কোন কোন মাগরিবী আলেম সেইসব মাসআলা-মাসায়েলকে একত্রে গ্রন্থনাবদ্ধ করেছেন, যাতে মালেকী মাযহাবের অনুসারীদের আমল মুয়াত্তার হাদীসের সরাসরি খিলাফ। [তাযীলুল মানফাআ-৪/, দায়িরাতুল মাআরিফ, হায়দ্রাবাদ, দাকান]
মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ্ বিন আব্দুল হাকাম মালেকী—যিনি মিশরের প্রশিদ্ধ ফকীহ ও মুহাদ্দিস ছিলেন আবার ইমাম শাফেয়ীরও শাগরিদ ছিলেন—তিনিও ইমাম শাফেয়ীর খণ্ডনে একটি স্বতন্ত্র পুস্তক লিখেছেন। পুস্তকটির নাম الرد على الشافعى فيما خالف فيه الكتاب والسنة. অর্থাৎ ঐ সকল মাসআলা-মাসায়েলে ইমাম শাফেয়ীর খণ্ডন যাতে তিনি কুরআন ও সুন্নাহের খিলাফ করেছেন। [তাবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা-১/২২৪]
আমাদের এ আলোচনা থেকে পাঠকবৃন্দ যেন এটা না বুঝেন যে, নাউযুবিল্লাহ! এসব শীর্ষ ইমামগণ হাদীসের বিরোধিতা করতেন। ঘূর্ণাক্ষরেও বিষয়টি এরূপ নয়। যদি তাঁরা এভাবে নবীজীর হাদীসের বিরোধিতা করতেন, তাঁদের ইমামের মত সম্মানজনক আসনে সমাসীন হওয়া তো দূরের কথা তাদের মুসলমান হওয়ার উপরই আপত্তি এসে যেত। বাস্তবতা হল এই যে, এগুলো মূলত ইজতিহাদী মাসআলা-মাসায়েল। আর ইজতিহাদী বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে এটা জরুরী নয় যে, যে রিওয়ায়েত একজনের কাছে সহীহ বা গ্রহণযোগ্য তা আরেক জনের কাছেও সহীহ বা গ্রহণযোগ্যরূপে বিবেচিত হবে। হতে পারে, উক্ত মুজতাহিদের জানা মতে হাদীসটির সনদে কোন সূক্ষ্ম দোষ নিহিত আছে কিংবা তাঁর গবেষণায় হাদীসটি মানসুখ বা হাদীসটির মর্ম নিরূপণে তাঁর কাছে ভিন্ন কোন গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা রয়েছে। [ইমাম ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস-৪৭]
সমালোচনার অন্তরালে গ্রহণযোগ্যতা ও পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি!
এই ভূমিকামূলক কিছু জবাব জেনে নেওয়ার পর এবার আমরা ফিরে আসি মূল উত্তরের দিকে।
বিস্তারিত ও পরিচ্ছন্ন জবাব
এক
ইমাম আযমের দিকে যে সকল বক্তব্য নিসবাত করা হয়েছে প্রথম কথা হল—এসব বক্তব্যের তিনি একটারও সনদ বর্ণনা করেননি। আবার এগুলোর অনেকটাই এরকম যে, ইমাম আযমের দিকে যার নিসবত সহীহ্ নয়। ভুল তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এরূপ নিসবাত করা হয়েছে।
দুই
যে সকল হাদীস এনে আপত্তি করা হয়েছে সেইসব হাদীসের স্তর ও মানের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়নি। এর মধ্যে মুনকাতি বা সূত্রবিচ্ছিন্ন বর্ণনাও যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে মুতাকাল্লাম ফীহ (আপত্তিকর) রাবীর বর্ণনা।
তিন
একশ’ পঁচিশটি মাসআলার মধ্যে অর্ধেক হল এমন যে, যেখানে উভয় পক্ষের মুজতাহিদের কাছে হাদীস রয়েছে। ইমাম আবু হানীফা রহ. তাঁর কাছে গ্রহণীয় অগ্রগণ্যতার কারণের ভিত্তিতে একটিকে গ্রহণ করেছেন। আর অন্য ইমাম তাঁর কাছে অগ্রগণ্যতার কারণের ভিত্তিতে আরেকটিকে গ্রহণ করেছেন। এরূপ ক্ষেত্রে একজন মুজতাহিদের উপর এ আপত্তি করা যায় না যে, তিনি সহীহ্ হাদীসের খিলাফ করেছেন।
চার
একশ পঁচিশটি মাসআলার মধ্যে বাকী অর্ধেক হাদীসকে যদি পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়, তার এক ভাগ হল এমন যে, যেখানে তিনি খবরে ওয়াহেদকে গ্রহণ না করে বরং কিতাবুল্লাহর উপর আমল করেছেন। দ্বিতীয় ভাগ হল এরকম, যেখানে খবরে মাশহুর পর্যায়ের হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আবার খবরে মাশহুরের চেয়ে একটু কম স্তরের হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। এরূপ ক্ষেত্রে তিনি দলীলের শক্তিমত্তার দিকে বিবেচনা করে খবরে মাশহুরকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তৃতীয় ভাগ হল এমন, যেখানে হাদীসের মর্ম নিরূপণে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। (হাদীসটি অন্য ইমামগণ যে অর্থ গ্রহণ করেছেন, ইমাম আবু হানীফা রহ. আরো গভীরে প্রবেশ করে অন্যান্য হাদীসের আলোকে অন্য অর্থ গ্রহণ করেছেন।)
আর অন্যের তুলনায় ইমাম আযমের মর্ম মূলে প্রবেশের ক্ষমতা সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়েছে। চতুর্থ ভাগ (বার/তেরটি হাদীস) এমন, যেখানে কম-সে কম ইমাম আযমের প্রমাদ মেনে নেওয়া যেতে পারে। (এরূপ ক্ষেত্রে তিনি দুই সওয়াবের স্থলে এক সওয়াবের অধিকারী হবেন।) সর্বশেষ পঞ্চম ভাগ এমন, যেখানে ইবনে আবী শাইবা ইমাম আযমের বক্তব্য ও মতামত সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে ভুলের শিকার হয়েছেন। [আননুকাতুত তরীফা এর ভূমিকায় ইমাম যাহেদ আলকাউসারী রহঃ এর আলোচনা থেকে গৃহীত]
ইমাম আযম থেকে বর্ণিত মাসআলা-মাসায়েলের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন রকম বক্তব্য রয়েছে। খতীব খুওয়ারায্মী রহ.-এর ভাষ্যমতে ইমাম আবু হানীফা রহ. তিরাশি হাজার মাসআলা-মাসায়েল ইস্তেম্বাত (গবেষণালবদ্ধ উদ্ভাবন) করেছেন। ইশারাতুল মারাম গ্রন্থকারের ভাষ্যমতে এর সংখ্যা পাঁচ লক্ষ। ঈনায়া গ্রন্থকারের মতানুযায়ী এর সংখ্যা বাহাত্তর হাজারের ঊর্ধ্বে।
গণনার মূলনীতিগত পার্থক্যের কারণে যদিও এই মতভেদ তৈরী হয়েছে; কিন্তু আমরা সর্বনিম্ম সংখ্যার হিসাব ধরে যদি এবার একটি পরিসংখ্যান বের করি, তাহলে দেখা যাবে ইবনে আবী শাইবার উক্ত অভিযোগের অন্তরালে ইমাম আযমের ফযীলত ও স্বীকৃতির মহা সনদ লুকায়িত আছে। কারণ তাঁর দৃষ্টিতে এত হাজার হাজার মাসআলার মধ্যে তিনি কেবল এই যৎসামান্য মাসআলা-ই খুঁজে পেয়েছেন যা তাঁর দৃষ্টিতে হাদীসের পরিপন্থী।
ইবনে আবী শাইবার আরোপিত দলীলের ভিতর থেকে কেবল বার/তেরটি জায়গায় তাঁর বক্তব্য ও দাবি সঠিক হয়ে থাকলে এটা ইজতিহাদের সুবিশাল অঙ্গনে বিচরণকারী ও মহা কর্মযজ্ঞের আঞ্জামদানকারী আবু হানীফা রহ.-এর শানে ইমামতের পরিপন্থী নয়। কারণ ঝুঁকি বহুল এ ময়দান যে কত কঠিন সে সম্পর্কে আমরা ইতঃপূর্বে ধারণা লাভ করে এসেছি। অতএব একজন মুজতাহিদ হিসেবে তিনি যদি তাঁর ইজতিহাদে অতি নগণ্য কিছু জায়গায় ভুলের শিকারও হন, তাহলে হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি দুই সওয়াবের স্থলে এক সওয়াবের অধিকারী অবশ্যই হবেন।
ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর প্রতি ইবনে আবী শাইবার আকীদাত ও প্রসন্ন মনোভাব!
ইবনে আবী শাইবা রহ. যে সকল মাসআলার ব্যাপারে হাদীসপরিপন্থী হওয়ার দাবি করেছেন তা মূলত শাখাগত ইজতিহাদী মাসআলা-মাসায়েল। আকীদা সংশ্লিষ্ট বিষয়ক নয়; আবার ইজমায়ী মাসআলা-মাসায়েলও নয়। [শায়েখ মুহাম্মদ আওয়ামা কৃত, কিতাবুর রদ্দি আলা আবী হানীফা এর প্রাক কথন, আলমুসান্নাফ-২০/৮]
আবার ইমাম ইবনে আবী শাইবা রহ. কিতাবুল ঈমানে ইমাম আযমের উপর কোন নকদ বা আপত্তি না করা এ কথা দৃঢ়তার সাথে প্রমাণ করে যে, ইমাম আযমের প্রতি তাঁর আকীদাত সহীহ্ ছিল। ইমাম আযমের শাখাগত মাসআলার খ-নে—যেগুলোর সিংহভাগের সাথে শীর্ষ ইমামগণ একমত পোষণ করেছেন—তিনি যে বাব নিয়ে এসেছেন, তাতে ইমাম আযমের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাবাপন্ন হওয়ার বিন্দুমাত্র দালালত ও আভাস-ইঙ্গিত নেই। [প্রাগুক্ত]
ইবনে আবী শাইবা যে ১২৫ টি মাসআলার ব্যাপারে আপত্তি করেছেন তার সিংহভাগই এমন যে, ইমাম আযমের সাথে সহমতব্যক্তকারী হিসেবে রয়েছেন তাঁর পূর্ববর্তী বা সমসাময়িক যুগের কুফা, বসরা ও হারামাইন শরীফাইনের একঝাঁক ইমাম। ইমামদের এ বিরাট সংখ্যার উপর এ অভিযোগ আরোপ করা যে, তাঁরা নবীর সুন্নাতের বিরোধিতা করেছেন! ইসলামের উপর অভিযোগ করার নামান্তর। অতএব ইবনে আবী শাইবার এ অভিযোগের অন্তরালে ইমাম আবু হানীফা বা হানাফী মাযহাবের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো রুগ্ন দিলের (ইমামদের প্রতি সুপ্ত মনোশত্রুতার) পরিচয়। [প্রাগুক্ত]
স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতার আরেকটি দিক
তৎকালীন সময়ে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর জনপ্রিয়তা ও তাঁর মাযহাবের অনুসারীর সংখ্যা ছিল অবাক করা। রাষ্ট্রীয় কর্ণধারদেরও হৃদয়ের মণিকোঠায় তাঁর এ মাযহাব আসন গেড়ে বসেছিল। তাই ইবনে আবী শাইবা রহ. মূলত সহীহ নিয়্যতে এই গুটি কতেক মাসআলার ব্যাপারে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর নাম উল্লেখপূর্বক স্বতন্ত্র আলোচনা এনেছেন। উদ্দেশ্য, যাতে (ইবনে শাইবা রহ.-এর দৃষ্টিতে) এ সব ভুলের অনুসরণ করা না হয়। এর দ্বারা প্রকারান্তরে ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর সুমহান মর্যাদা ও আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাই ফুটে ওঠে। [দেখুন, শায়েখ মুহাম্মদ দামাত বারাকাতুহুম লিখিত কিতাবুর রদ্দি আলা আবী হানীফা এর প্রাক কথন, আলমুসান্নাফ-২০/৮]
ইবনে আবী শাইবার জবাবে শীর্ষ ইমামগণ
এতো গেল মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার আলোচিত অধ্যায় সম্পর্কে সামগ্রিক পর্যালোচনা। কিন্তু অনেক ইমাম-ই প্রত্যেকটি হাদীসের উপর স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করে কিতাব লিখেছেন।
১। হাফেজ আব্দুল কাদের কুরাশী রহ. الدرر المنيفة في الرد على ابن أبي شيبة فيما اورده على أبي حنيفة. নামে গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
২। হাফেজ কাসেম ইবনে কুতলুবুগা রহ. (ওফাত : ৮৭৯ হি.) الأجوبة المنيفة عن اعتراضات ابن أبي شيبة على أبي حنيفة. নামে কিতাব লিখেছেন।
৩। শাফেয়ী মাযহাবের বিখ্যাত আলেম উকুদুল জুমান প্রণেতা আল্লামা ইউসুফ সালেহী আশ-শামী রহ. ও এ কিতাবের খ-নে কিতাব লিখা শুরু করেন। কেবল দশটি হাদীসের জবাবেই তা দুই খ-ে গিয়ে দাড়ায়। তিনি সে সময় তাঁর বিখ্যাত সীরাত গ্রন্থ সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ লিখার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। যে কারণে এ কাজকে তিনি আর সামনে এগিয়ে নিতে পারেন নি। তবে উকুদুল জুমান কিতাবে হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে ইমাম আযমের মূলনীতিসমূহ তুলে ধরে তিনি ইবনে আবী শাইবার মৌলিক ও দালীলিক জবাব প্রদান করেছেন। [উকদুল জুমান-৩৬৪]
৪। বিদগ্ধ হাদীসবিশারদ আল্লামা যাহেদ আলকাওসারী রহ. النكت الطريفة في التحدث عن ردود ابن أبي شيبة على أبي حنيفة. নামে কিতাব লিখেন। এটি তাঁর জীবদ্দশাতেই ১৩৬৫ হিজরীতে মিশর থেকে মুদ্রিত হয়ে জনসমক্ষে এসেছে।
৫। ড. মুহাম্মাদ কাসেম আবদুহু আলহারেসী তাঁর মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা বাইনাল মুহাদ্দিসীন (৩১৮-৫০৬ পৃ.) কিতাবে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন।
ইমাম আযমের গৌরবের মানসসন্তানদের কার্যকর ভূমিকা
ইমাম আযমের উপর যারাই যে যুগে সমালোচনার তীর নিক্ষেপ করেছেন, ইমাম আযমের গৌরবের মানস-সন্তানেরা সেইসব সমালোচনা ও আপত্তির দালীলিক জবাব প্রদান করেছেন, যা তাঁদের প্রখর ঐতিহাসিক স্বাতন্ত্র্যবোধের পরিচয় বহন করে। প্রাচীন কাল থেকে অধুনা যুগ পর্যন্ত ইমাম আযমের মানাকিবের উপর লেখা গ্রন্থাবলীর দিকে দৃষ্টি বুলালে এ সত্যই প্রস্ফুটিত হবে।
ইমাম আযমের উপর আরোপিত অভিযোগের খণ্ডনে মৌলিক কিছু কাজ
যে সকল ইমাম ও মনীষীগণ ইমাম আযমের জীবনী সংকলন করেছেন তাঁরা তাঁদের এসব জীবনী গ্রন্থের মধ্যে প্রাসঙ্গিকভাবে ইমাম আযমের উপর আরোপিত অভিযোগের খ-নেও কিছু আলোচনা তুলে ধরেছেন। পক্ষান্তরে স্বতন্ত্রভাবে যারা এ বিষয়ে কাজ করেছেন আমরা তাদের বিষয়েই এখন আলোকপাত করছি। তাই এ সংশ্লিষ্ট কিছু তথ্য নিম্নে পরিবেশন করা হল।
১
ইমাম আযমের খণ্ডনে যে সব গ্রন্থ লেখা হয়েছে তন্মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হল খতীব বাগদাদীকৃত তারীখে বাগদাদের ইমাম আযমের জীবনীর মাছালীব অংশটি। তাই সর্বপ্রথম আমরা ভূমিকামূলক কিছু কথা আলোকপাত করে মূল আলোচনায় ফিরে আসছি।
খতীব বাগদাদী ইমাম আযমের সমসাময়িকও ছিলেন না। আবার আবু হানীফার যুগের কাছের মানুষও ছিলেন না। বরং তার মাঝে ও ইমাম আযমের মাঝে ব্যবধান তিন’শ দশ বছর। খতীব বাগদাদীকৃত তারীখে বাগদাদে ইমাম আযমের পক্ষে-বিপক্ষে সব ধরনের রিওয়ায়েত-ই জমা করা হয়েছে। তাঁর জীবনীর এ অংশে স্তুতি-প্রশংসার বর্ণনাও যেমন এসেছে তেমনি নিন্দাবাদের বর্ণনাও এসেছে। তবে সব কিছুই বর্ণিত হয়েছে সনদসহ। যে কারণে এসব জরাহ্ ও নিন্দাবাদ সম্বলিত বর্ণনা অন্যদের জন্য তাহ্কীক করার সুযোগ রয়ে গেছে পূর্ণ মাত্রায়। তাই পরবর্তী ইমামগণ তাঁদের ইতিহাসগত দায়িত্বশীলতার আলোকে এসব রিওয়ায়েতের তাহকীকে স্বতন্ত্র পুস্তক রচনার দিকে মনোনিবেশ করেছেন। তাঁরা ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর জরাহ সংক্রান্ত খতীব বাগদাদীর বর্ণনার কোনটা মাওযু, আবার কোনটা মাযরূহ ও অগ্রহণযোগ্য স্বপ্রমাণিত করে পূর্ণশক্তিতে ইমাম আবু হানীফার বিরুদ্ধে সমালোচনা ও অপপ্রচারের জ্ঞানবৃত্তিক জবাব প্রদান করেছেন।
এ কাজের জন্য সর্বপ্রথম আলমালিকুল মুআযযাম আবুল মুযাফফার ঈসা বিন আলমালিকুল আদেল সাইফুদ্দীন আবী বকর বিন আইয়ুব আলহানাফী রহ. (৫৭৮- ৬২৪ হি.) এগিয়ে আসেন। তিনি السهم المصيب في كبد الخطيب নামে খতীব বাগদাদীর খণ্ডনে কিতাব লিখেন। [কিতাবটির নাম আমরা যিরিকলী লিখিত আল-আলাম (৫/১০৮) কিতাবে এভাবে পেয়েছি। السهم المصيب في الرد على الخطيب]
খতীব বাগদাদীর ইন্তেকাল হয়েছে ৪৬৩ হিজরীতে। আর আলমালিকুল মুআযযাম ইন্তেকাল করেন ৬২৪ হিজরীতে। পাঠকের মনে প্রশ্ন উদয় হতে পারে এত দীর্ঘ সময় খতীব বাগদাদীর খণ্ডনে কোন কিতাব লিখা হল না কেন?
আসলে ব্যাপারটি হল তারীখে বাগদাদের ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর উপর আরোপিত অসমীচীন ও জঘন্য অপবাদ সম্বলিত অংশটি জনসমক্ষে এসেছে বা মুদ্রিত হয়েছে আলমালিকুল মুআযযাম হানাফী মাযহাব অবলম্বন করার পর। আর তিনিই সর্বপ্রথম এর খ-নে কিতাব লিখেন।
যদি ইমাম আলমালিকুল মুআযযামের যামানার পূর্বে তারীখে বাগদাদের এ আপত্তিযুক্ত অংশটি প্রকাশিত হত, তাহলে আলেমগণ তার খণ্ডনে কিতাব লিখতে কাল বিলম্ব করতেন না। যেমনটি তাঁরা আব্দুল কাহের আলবাগদাদী (ওফাত : ৪২৯ হি.), ইবনুল জুওয়াইনী ও আবু হামেদ তূসী এবং অন্যদের ক্ষেত্রে বিলম্ব করেননি। [তানীবুল খতীব-৫৫]
আলমালিকুল মুআযযাম ছাড়াও অনেক আলেমই খতীব বাগদাদীর খণ্ডনে স্বতন্ত্র কিতাব লিখেছেন। তন্মধ্যে রয়েছেন :
২
(আবুল ফারাজ) ইবনুল জাওযী রহ. (৫১০ হি.-৫৯৭ হি.)। তিনি السهم المصيب في الرد على الخطيب নামে কিতাব লিখেছেন।
৩
ছিবতু ইবনুল জাওযী (৫৮১হি.-৬৫৪ হি.) বিরাটায়তনে দুই খণ্ডে কিতাব লিখেছেন। তিনি তাঁর এ কিতাবের নামকরণ করেছেন الانتصار لإمام أئمة الأمصار। [আবুল মুআয়্যাদ আলখুওয়ারাযমী তাঁর ‘জামিউ মাসানীদিল ইমাম আযম’ কিতাবের ভূমিকায় খতীব বাগদাদীর খণ্ডনী আলোচনা এনেছেন।]
৪
শাফেয়ী মাযহাবের ইমাম সুয়ূতী রহ.ও السهم المصيب في نحر الخطيب নামে খতীব বাগদাদীর খণ্ডনে গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন।
৫
ইমাম মুহাম্মাদ যাহেদ আলকাওসারী রহ.ও এ বিষয়ে ‘তা’নীবুল খতীব আলা মা সা-কাহু ফী তরজামাতি আবী হানীফা মিনাল আকাযীব’ নামে কিতাব লিখেছেন। ১৩৬১ হিজরীতে তা মিশর থেকে প্রকাশিত হয়। [শায়েখ আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ রহঃ, আর রফউ ওয়াত তাকমীল এর টীকা-৭৭]
৬
ড. মাহমুদ আত-তহ্হানের একটি কিতাবের নাম الخطيب البغدادى وأثره في علم الحديث । এ কিতাবে (৩০৬-৩৪৫ পৃ.) তিনি অত্যন্ত সাজানো গোছানো দালীলিক আলোচনা করেছেন।
নোট : খতীব বাগদাদীর ইন্তেকালের পর এ কিতাবের মাঝে আহমদ বিন আলহাসান—যিনি ইবনে খায়রূন নামে প্রসিদ্ধ—নামক জনৈক ব্যক্তির হস্তক্ষেপ ও বর্ধিত সংযোজন রয়েছে বলে অনেক ইমাম-ই মতামত দিয়েছেন। তারীখে বাগদাদের এ অধ্যায় সম্পর্কে ড. মাহমুদ আত-তহ্হান আলোচনাটি খুব তথ্য-বহুলরূপে পেশ করেছেন। সেখান থেকে কিছু মূল্যবান তথ্য পাঠকের খেদমতে তুলে ধরছি।
এক
তারীখে বাগদাদের মাখতূতা বা পাণ্ডুলিপি কপিসমূহের মাঝে ইমাম আযমের জরাহ্ সংক্রান্ত স্পর্শকাতর পর্বটির মাঝে জরাহ্ এর পরিমাণগত ও সংখ্যাগত বিরাট ব্যবধান রয়েছে। কোন নুসখায় জরাহস্ফীতি! আবার কোন নুসখায় অতিশয় স্বল্প পরিমান জরাহ। এর অন্তরালে রহস্য কী? নুসখার ব্যবধানের ক্ষেত্রে অল্প-স্বল্প পরিবর্তন ও ব্যবধান আপত্তিকর নয়। কিন্তু এই ব্যবধান যদি দুস্তর পারাপারের আকার ধারণ করে!
দুই
খতীব বাগদাদী নিজেই তাঁর তারীখে বাগদাদে যে সব রাবীদের ব্যাপারে জরাহ ও আপত্তি করেছেন এরূপ আপত্তিকর বর্ণনাকারীদের সূত্রে বর্ণিত ইমাম আযম সম্পর্কিত জরাহকে তিনি মাহফুয বা সঠিক ও সংরক্ষণশীল বর্ণনা বলে মন্তব্য করেন কীভাবে? [দেখুন আল-খতীব আল-বাগদাদী ওয়া আছারুহু ফী ইলমিল হাদীস-৩০৬-৩৪৫]
তারীখে বাগদাদের ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর উপর আরোপিত অসমীচীন ও জঘন্য অপবাদ সম্বলিত অংশটি নিয়ে তীক্ষèভাবে চিন্তাভাবনা করলে সচেতন পাঠক বারবার শক্তরকম ধাক্কা খাবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই মাছালীব বা ইমাম আযমের উপর আরোপিত জরাহ ও মিথ্যা অপবাদ সম্বলিত অংশটি খতীব বাগদাদীর নয় বরং কোন নাসেখ বা কপিকারকের খতীব বাগদাদীর নামে চালিয়ে দেয়া বর্ধিত সংযোজন বা ‘প্রক্ষেপন’ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। কোন কোন গবেষকের ভিন্নমত থাকলেও সার্বিক তথ্যের বিচারে আমাদের কাছে এ সম্ভাবনাই অধিক প্রবল বলে মনে হয়।
৭
সপ্তম শতাব্দীর মনীষী আল্লামা মাসঊদ বিন শাইবা সিন্ধী-এর ফিকহ বিষয়ক একটি রচনা হল কিতাবুত তালীম। গ্রন্থটি এখন মাফকূদ (পাওয়া যায় না এমন)। এই কিতাবুত তালীম এর ভূমিকা অংশের নাম হল مقدمة كتاب التعليم। তিনি কিতাবটিতে ইমাম আযমের মানাকিবের পাশাপাশি ইবনুল জুওয়াইনীকৃত ‘মুগীছুল খলক’ এবং গাযালী এর দিকে নিসবতকৃত ‘মানখূল’-এর খ-নও করেছেন। যাতে উক্ত লেখকদ্বয় ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর মাযাহাব রদ করেছেন এবং প্রান্তিকতার শিকার হয়েছেন। [মুকাদ্দামাতু কিতাবিত তালীম-২-৩]
পাক-ভারত উপমহাদেশের বিদগ্ধ হাদীসবিশারদ আল্লামা মুহাম্মাদ আব্দুর রশীদ নুমানী রহ. مقدمة كتاب التعليم التعليق القويم على (আততা‘লীকুল কাবীম আলা মুকাদ্দিমাতি কিতাবিত তা‘লীম) নামে এ কিতাবের উপর মূল্যবান তা‘লীক (ইলমী টীকা-টীপ্পনী) সংযোজন করেছেন এবং কিতাবের শুরুতে ৮৪ পৃষ্ঠাব্যাপী এক বিস্তৃত ও শানদার ভূমিকাও লিখেছেন। এই তা‘লীকটি কলেবরের দিক দিয়ে মূল কিতাবের চেয়ে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিতাবটি সিন্ধী আদবী বোর্ড থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
৮
যফর আহমদ উসমানী রহ. (১৩১০ হি.-১৩৯৪ হি.) কর্র্তৃক লিখিত আবু হানীফা ওয়া আসহাবুহুল মুহাদ্দিসুন এর শুরু অংশ যা ইলাউস সুনানের মুকাদ্দিমা অংশের সাথে মুদ্রিত।
৯. বঙ্গদেশের বিখ্যাত আলেমে দ্বীন, মুবাহিছ ও বহু গ্রন্থপ্রণেতা আল্লামা রুহুল আমীন বশিরহাটী রহ. (ওফাত : ১৩৬৪ হি.=১৯৪৫ ঈ.) ইমাম আযমের উপর আরোপিত বিভিন্ন অভিযোগের খ-নে একটি কিতাব লিখেছেন। কিতাবটির নাম দাফিউল মুফসিদীন। এটি তৎকালীন সময়ে বাংলা ভাষায় লেখা এক অমূল্য গ্রন্থ।
১০
উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক ছাহেব (দা.বা.) [শিক্ষা সচিব, মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া ঢাকা, বিভাগীয় প্রধান; আত তাখাসসুস ফী উলূমিল হাদীসিশ শরীফ ও তত্ত্বাবধায়ক, মাসিক আলকাউসার] তিনি তিন বছরের অধিক আল্লামা মুহাম্মাদ আব্দুর রশীদ নুমানী রহ.-এর সাহচর্যে থাকেন। নুমানী রহ.-এর তত্ত্বাবধানে তিনি নিম্নোক্ত দু’টি কিতাব রচনা করেন।
এক
আল্লামা যাহেদ আলকাওসারী রহ. (ওফাত : ১৩৭১ হি.)-এর তানীবুল খতীব আলা মা ছা-কাহু ফী তরজমাতি আবী হানীফা মিনাল আকাযিব কিতাবের বড় দুই খণ্ডে রদ লিখেন শায়েখ আব্দুর রহমান বিন ইয়াহইয়া আলমুআল্লিমী আলইয়ামানী (ওফাত : ১৩৮৬ হি.)। তার এ কিতাবের নাম ‘আততানকীল বিমা ফী তানীবিল কাওসারী মিনাল আবাতীল।’ এ কিতাবের খণ্ডনেই উস্তাযে মুহতারাম (দা. বা.) লিখেছেন নযরাতুন আবেরাহ হাওলা তানকীলিল ইয়ামানী। কিতাবটি এখনো পাণ্ডুলিপি আকারে রক্ষিত।
দুই
আবু হানীফা আলমুফতারা আলাইহি। এ কিতাবে বিস্তারিতভাবে আবু হানীফা রহ.-এর উপর উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগ ও অপবাদের দলীলভিত্তিক ইলমী খণ্ডন করা হয়েছে।
প্রিয় পাঠক! অবাক করা একটি বিষয় হল, যাঁরা ইমাম আযমের উপর আরোপিত বিভিন্ন অভিযোগের খণ্ডনে কাজ করেছেন এর মধ্যে বিরাট এক অংশ এমন রয়েছেন যাঁরা হানাফী মাযহাবের ছিলেন না। বরং তাঁরা ছিলেন ভিন্ন মাযহাবের অনুসারী। এটি ইমাম আযমের মাকবুলিয়াত হওয়ার এক ঐশী আলামত।
পরিশেষে বলতে চাই—ইমাম আযম রহ. আজো উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত দ্বেদীপ্যমান। তিনি এমন একটি স্তরে পৌঁছেছিলেন যে, প্রতিপক্ষ বা তাঁর উপর আপত্তিকারীদের সম্মিলিত মধ্যাকর্ষণ শক্তির চাপ তাঁর উঁচু অবস্থান থেকে এক চুলও স্থানচ্যুত করতে পারেনি। সামান্যতমও হানি হয়নি তাঁর সুউচ্চ মাকামের। বরং উল্টা এর দ্বারা তাঁর আকাশপ্রমাণ ভাবমূর্তি আরো প্রজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। যারা জরাহ-তাদীল ও রিজালশাস্ত্র ইত্যাকার ইলমী পরিম-লের বিষয়কে সাধারণ ও শ্রমজীবী মানুষের ভাবনা-চিন্তার বিষয়বস্তুতে পরিণত করেছেন, বিভিন্ন বিষয় না বুঝে ফাঁপিয়ে-ফুলিয়ে প্রচ- করে দেখিয়েছেন তাদের জন্য এ অধ্যায়ের আলোচনাকে একটু দীর্ঘ করতে হল। তাছাড়া এ আলোচনার দ্বারা ইমাম আযমের প্রতি আমাদের অন্তরের আস্থা ও বিশ্বাস ধ্রুব-নক্ষত্রের মত স্থির হবে। আর হানাফী মাযহাবের অনুসারী না হলেও নিদানপক্ষে ইমামদের প্রতি বিশেষত ইমাম আযমের প্রতি একটা শ্রদ্ধেয়, শোভন এবং সম্ভ্রমসূচক মনোভাব গড়ে উঠবে—ইনশাআল্লাহ।