প্রশ্ন
১
সাইয়্যিদ কুতুব ও তার লিখিত গ্রন্থাবলী সম্পর্কে উলামায়ে দেওবন্দের মূল্যায়ন জানতে চাই। দয়া করে সঠিক ও যথার্থ অভিমত ব্যক্ত করে আমাদের পেরেশানী দূর করবেন।
২
এছাড়া সাইয়্যিদ কুতুব রহঃ এর ইন্তেকালের মৃত্যুর সময় তিনি নাকি তাকে কালিমা পড়াতে আসা ইমামকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন যে, ‘আমাকে কালিমা পড়াতে এসো না, আমি কালিমা ভালোই জানি। তোমার কালিমা তোমাকে রুটি রুজি যোগায়, আর আমার কালিমা আমাকে ফাঁসিতে ঝুলায়’।
এমন কোন কথা কি সাইয়্যিদ কুতুব রহঃ থেকে সত্যিই প্রমাণিত? নাকি এটি তার নামে বানোয়াট প্রচলিত কথা? দয়া করে বিস্তারিত জানাবেন।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
১
সাইয়্যিদ কুতুব রহঃ এর জীবনের বিভিন্ন দিক রয়েছে। তিনি একই সাথে ইখওয়ানুল মুসলিমীনের দায়িত্বশীল, সাহিত্যিক, মুফাসসিরে কুরআনও ছিলেন।
তিনি ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টাকারী ছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেয়া হয়। তিনি একজন মহান ব্যক্তিত্ব, ইসলামের একনিষ্ট খাদেম ছিলেন। এতে কোন সন্দেহ নেই।
তবে একথাও সত্য যে, তিনি তার লিখিত ‘তাফসীর ফী যিলালিল কুরআন’ এর মাঝে জমহুর মুফাসসিরগণের বিপরীত বেশ কিছু আপত্তিকর বিষয়ের অবতারণা করেছেন। যার ফলে তার তাফসীরের মাঝে বেশ কিছু মারাত্মক ভুল পরিলক্ষিত হয়েছে।
এ কারণে তাঁর তাফসীর গ্রন্থটি জনসাধারণ্যের জন্য পড়া ঠিক নয়।
এছাড়া তার অন্যান্য লিখনীতেও ভ্রষ্টতাসূচক এবং ভারসাম্যহীন বক্তব্য এসেছে। বিশেষ করে হযরত উসমান রাঃ এর শানে চরম বেআদবীসূচক বক্তব্য দিয়ে তিনি চরম গর্হিত কাজ করেছেন।
সাইয়্যিদ কুতুব রহঃ এর বিষয়ে মুহাদ্দিসুল আছর মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ বানুরী রহঃ এর মূল্যায়ন হলো:
غير أنه رأيت تقصيراً من جهات، وربما توهم الخروج عن الجادة،………….
وإن بحوثه في كتابه ” العدالة الاجتماعية ” وخصوصاً فيما قال في حق سيدنا عثمان : إنه كان سيقة لمروان يسوقه كيف يشاء ، وأنه كان يعزل أصحاب رسول الله صلی الله علیه و سلم، ويولي أعداء رسول الله صلی الله علیه و سلم، وأن عهده فجوة في الخلافة، وما إلى ذلك من طامات في حق خليفـة راشد ذي النورين مثل سيدنا عثمان مع كثرة مناقبه في كلام الرسول عليه صلوات الله وسلامه ، وهر الذي جرأ الأستاذ المودودي في كتابه ” خلافة وملوكية ” بطاماته ؛ فبحوثه هذه جعلتي عبر مطمئن بأبحاث تفسيره وعدم الثقة بتحقيقاته على الرغم من تهافت الشباب الأدباء العصريين عليه وكونهم مغرمين به ، ولاريب أن تفسير القرآن و القيام بحقه أمر في غاية الصعوبة والدقة ، هذا ما أقوله أداء اداء لوظيفة الدين مع تقديري لجهوده في القيام لإقامة نظام صالح بإخلاص وما كانت عاقبته من مقاساة آلام في ذلك وخيبة وحرمان حتى ضحي بنفسه ، فجزاه الله وأحسن إليه بتلك الجهود وتضحية النفس ، والله الموفق.” (يتيمة البيان فى شيء من علوم القرآن-ص:80-81، ط: مجلس الدعوة و التحقيق الاسلامي، 1416ھ)
‘কিন্তু সাইয়্যিদ কুতুবের ফী যিলালিল কুরআনের বিভিন্ন স্থানে ভুলত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। কোথাও কোথাওতো সঠিক রাস্তা থেকে বিচ্যুতিরও ধারণা প্রবল হয়। ……………..
সাইয়্যিদ কুতুবের কিতাব ‘আল আদালাতুল ইজতিমায়িয়্যাহ’ এর মধ্যকার কয়েকটি আলোচনা সমালোচনাযোগ্য। বিশেষ করে হযরত উসমান গনী রাঃ এর বিষয়ে চরম বেআদবীসূচক মন্তব্য করে বলেন: হযরত উসমান গনী রাঃ মারওয়ানের অধীন ছিলেন। মারওয়ান যেমন চাইতো হযরত উসমান রাঃ কে দিয়ে তা’ই করাতো। তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণকে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পদ থেকে বরখাস্ত করে নবীজীর দুশমনদেরকে দায়িত্বভার অর্পন করতেন। তাঁর শাসনামল খিলাফতের মাঝে একটি ‘ফাটল’ ছিল।
এছাড়াও খলীফায়ে রাশেদ হযরত উসমান গনী রাঃ এর মতো ব্যক্তিত্বের শানে একাধিক বাজে মন্তব্য সাইয়্যিদ কুতুব করেছেন। অথচ উসমান রাঃ এর শানে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রচুর পরিমাণ প্রশংসাসূচক বাণী রয়েছে।
সাইয়্যিদ কুতুবের এসব আলোচনাকেই মাওলানা মওদূদী সাহেব তার ‘খিলাফাত ও মুলুকিয়্যাত’ গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট করার স্পর্ধা দেখায়।
সাইয়্যিদ কুতুবের এসব আলোচনা আমাকে তার তাফসীর বিষয়ে সন্দিগ্ধ করে তুলে। সেই সাথে তার অন্যান্য গবেষণাকর্মের উপরও আস্থা হারিয়ে ফেলে। অথচ সমকালের যুবক সাহিত্যিকরা তার লেখা ও গবেষণার চরম ভক্ত ও অনুরক্ত।
নিঃসন্দেহে কুরআনে কারীম এবং তার হক আদায় করা সুকঠিন ও স্পর্শকাতর বিষয়।
সাইয়্যিদ কুতুবের বিষয়ে উল্লেখিত কথাগুলো শুধুমাত্র দ্বীনী দায়িত্ব হিসেবে লিখা হয়েছে। নতুবা ইসলামী হুকুমত কায়েমের জন্য তার যে ইখলাসপূর্ণ চেষ্টা প্রচেষ্টা, আমিও এঁর কদর করি। যার ফলশ্রুতিতে এ পথে তাকে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। ব্যর্থতা, বঞ্চনা ও নির্যাতন সইতে হয়েছে। অবশেষে জানের কুরবানীও পেশ করতে হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তার খিদমাত ও হকের পথে তার প্রাণোৎস্বর্গ হওয়ার উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমীন।’ [ইয়াতিমাতুল বয়ান ফী শাইয়ি মিন উলূমিল কুরআন-৮০-৮১, আল্লামা ইউসুফ বানুরী রহঃকৃত]
২
একথার কোন ভিত্তি নেই। এটি একটি প্রচলিত বানোয়াট কথা। সাইয়্যিদ কুতুব রহঃ এর জীবনীকারগণ এমন কোন কথা সাইয়্যিদ কুতুব রহঃ এর সূত্রে জীবনীগ্রন্থগুলোতে মৃত্যুর সময়কালীন সময়ের কথা বলে উল্লেখ করেননি।
এটা পরবর্তীতে কেউ তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সাইয়্যিদ কুতুব রহঃ এর নামে চালিয়ে দিয়েছেন। আর কতিপয় ওয়ায়েজ বক্তারা তাহকীক ছাড়াই এটাকে গলদ মশহুর করে দিয়েছে। অথচ এর কোন ভিত্তি নেই।
যদি সাইয়্যিদ কুতুব রহঃ থেকে এমন কথা সঠিক সূত্রসহ উল্লেখ পান, তাহলে আমাদের কাছে প্রমাণ পাঠানোর জন্য অনুরোধ করছি।
সঠিকভাবে প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত একথাকে সাইয়্যিদ কুতুব রহঃ এর নামে চালানো একটি মিথ্যাচারের শামিল। তাই এ থেকে বিরত থাকা উচিত।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।
ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com