প্রচ্ছদ / অপরাধ ও গোনাহ / খেলাই জীবনের মাকসাদ?

খেলাই জীবনের মাকসাদ?

শাইখুল ইসলাম মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তকী উসমানী

গত মাসে পাকিস্তান ও ভারতে যৌথভাবে বিশ্বকাপ ক্রিকেট টুর্ণামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় দেড় মাস যাবৎ এটাই ছিল সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। সর্বত্র আলোচনার বিষয়বস্ত্ত ছিল খেলা এবং যেখানেই কিছু লোক একত্র হয়েছে সেখানেই খেলার কথা অবধারিতভাবে উঠে এসেছে। দেশের মন্ত্রী-এমপি থেকে শুরু করে শ্রমিক-কর্মচারী পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ খেলার সর্বশেষ সংবাদ জানার জন্য, টেলিভিশনের পর্দায় খেলা দেখার জন্য এবং রেডিওতে ধারাবিবরণী ও আলোচনা-পর্যালোচনা শোনার জন্য শুধু ব্যস্তই ছিল না; বরং মগ্ন ও সমাহিত ছিল। যেন এটাই এখন গোটা জাতির একমাত্র কাজ। যেন এই দেশের কোথাও কোনো সমস্যা নেই এবং দেশের চূড়ান্ত উন্নতি নিশ্চিত হয়ে গেছে। সুতরাং জাতির সামনে বিনোদন ও খেলাধুলায় মত্ত হওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।

এখনও মানুষের মস্তিষ্ক হতে বিগত দেড় মাসের খেলার নেশা দূর হয়নি। এরই মধ্যে আজকের খবরের কাগজে বলা হয়েছে-ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল আসন্ন পাকিস্তান সফরে তিনটি টেস্ট সিরিজ ছাড়াও তিনটি এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলবে। (রোযনামায়ে জঙ্গ, ১৪/১১/৮৭)

মোটকথা, আরো দেড় মাস গোটা দেশ, বিশেষত তরুণশ্রেণী পুনরায় ক্রিকেট জ্বরে আক্রান্ত হবে। আরো শোনা যাচ্ছে যে, এই দ্বিপাক্ষিক ম্যাচ শেষ হওয়ার পর পাকিস্তান ক্রিকেট দল বিদেশ সফরে রওনা হবে।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, যেসব খেলাধুলা সুস্থতা ও দৈহিক সক্ষমতার পক্ষে সহায়ক তা মৌলিকভাবে নাজায়েয বা দোষণীয় নয়। কিন্তু প্রত্যেক বিষয়েরই একটা সীমারেখা আছে, যা লঙ্ঘন করা হলে সাধারণ মুবাহ ও বৈধ কাজ তো দুরের কথা, নেক আমলও শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয থাকে না। বরং আপত্তি ও প্রতিবাদের উপযুক্ত হয়ে যায়। বর্তমানে খেলাধুলার অবস্থা এই যে, তা আর খেলাধুলা নয়; বরং জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে। এবং জীবনের বহু প্রয়োজন ও বাস্তব সমস্যার চেয়েও তা বহু গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে খেলার পিছনে গোটা জাতির মূল্যবান সময় যেভাবে বিনষ্ট হচ্ছে তার নিন্দা ও আফসোসের ভাষা আমার জানা নেই।

সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে তো কারো দ্বিমত নেই। শুধু ইসলামই নয়, পৃথিবীর সকল ধর্ম, এমনকি নাস্তিক ও বস্ত্তবাদি দার্শনিকরাও সময়ের গুরুত্ব ও সময়কে কাজে লাগানোর শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু এইসব খেলাধুলার সময়ে আমাদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে, আমাদের কাছে সবচেয়ে মূল্যহীন ও অপ্রয়োজনীয় জিনিসের নাম সময়।  সুতরাং তা ব্যয় করার জন্য খেলা দেখা ও খেলা নিয়ে অহেতুক গালগল্পে লিপ্ত হওয়ার চেয়ে উত্তম ক্ষেত্র আর কিছুই নেই।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন কোনো কোনো জায়গায় পুরোদস্ত্তর সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়। যেখানে ছুটি ঘোষণা করা হয়নি সেখানেও কাজ-কর্মে ছুটির আবহ বিরাজ করে, অফিস-আদালত থেকে শুরু করে কলেক-ভার্সিটি পর্যন্ত সর্বত্র  সবার দৃষ্টি থাকে টিভির মনিটরে এবং মন পড়ে থাকে খেলার মাঠে। এ অবস্থায় অফিসের দায়িত্বপূর্ণ কাজকর্মে এবং শ্রেণীকক্ষের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার মতো কাজে মনই বা কীভাবে বসবে আর কীভাবে একাগ্রতাই সৃষ্টি হবে? অথচ মনোযোগ ও একাগ্রতা ছাড়া এসব কাজ সুসম্পন্ন করা কি কখনো সম্ভব? আমাদের কিশোর ও তরুণশ্রেণী যারা এখনো খেলাধুলা ও জীবনের বাস্তব প্রয়োজনের মাঝে পার্থক্য করার যোগ্যতা অর্জন করেনি তাদের মন-মস্তিক্ষে যদি দিনরাত ব্যাট-বলের শাসন চলতে থাকে তাহলে তারা লেখাপড়ার মতো রসকষহীন বিষয়ে কিভাবে মনোযোগ দেবে? উপরন্তু তারা যখন বয়স্কদেরকেও সব কাজকর্ম ছেড়ে খেলা দেখায় মগ্ন দেখে এবং এটাই তাদের গল্পগুজবের একমাত্র বিষয় হয় তখন তো তাদের কচিমনে আর কোনো দ্বিধা-সংশয় অবশিষ্ট থাকে না এবং এর ক্ষতিকর দিকগুলো তাদের উপলব্ধি থেকে সম্পূর্ণ বিদায় নিয়ে যায়।

এখানেই শেষ নয়, সরকার ও জনসাধারণ উভয় পক্ষের কাছে খেলোয়াড়দের যে মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা এবং মিডিয়া ও গণমাধ্যমে তাদের যে প্রচার ও প্রশংসা ফুটে উঠে তা জাতির শিশু-কিশোরদের চরমভাবে বিভ্রান্ত করে। কারণ এ ধরনের মূল্যায়ন তো দেশের শীর্ষস্থানীয় গবেষক-বিজ্ঞানী এবং মেধাবী কোনো সমাজ-সংস্কারকের ভাগ্যেও কখনো জোটে না। কৃতী খেলোয়াড়ের একেকটি এ্যাকশনের জন্য লাখ লাখ টাকার পুরস্কার দেয়া হয়, ম্যাচ সিরিজে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য থাকে গাড়ি-বাড়ি ও নগদ টাকার পুরস্কার। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ ও পদস্থ কর্মকর্তারা সারা দিন বসে বসে এইসব কর্মকান্ড দেখতে থাকেন এবং নিজেদের হাতে তাদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন। তো শিশুরা যখন দেখে যে, লেখাপড়ার পরিবর্তে যারা খেলাধুলাকে জীবনের লক্ষ্য বানিয়েছে তারাই বর্তমান সময়ের তারকা তখন লেখাপড়া ও ভালো হয়ে চলার উপদেশ তাদের কাছে কপটতা বলে মনে হয়। এক্ষেত্রে তাদেরকে কতটা দোষ দেওয়া যায়?

এ তো হল সময়ের অপচয় এবং মেধা ও প্রতিভা ধ্বংসের দিক। এরপর যদি এইসব টুর্ণামেন্টের আর্থিক ক্ষতি সম্পর্কে চিন্তা করা হয় তবে সেটাও কম দুঃখজনক নয়। একেকটি স্টেডিয়ামের নির্মাণ ও সংস্কারের পিছনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয় এবং খেলার আয়োজন ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য যে বাজেট রাখা হয় তা কি এই দরিদ্র দেশের জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনক নয়?

এখন পৃথিবীর অনেক দেশেই খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে। কিন্তু যে উন্মাদনা ও উন্মত্ততা আমাদের দেশে দেখা যায় তা পৃথিবীতে আর কোনো দেশে দেখা যায় কি না সন্দেহ। এই বিংশ শতাব্দীর শেষেও পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে, যেগুলোর নাম খেলাধুলার সাথে কখনো শোনা যায়নি; বরং পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই সম্ভবত এ বৈশিষ্ট্য নিয়েই চলে। অথচ তারাও তাদের শিশু-কিশোরদের শারীরিক সুস্থতার বিষয়ে সজাগ। খেলাধুলাকে জীবন-মরণের বিষয় না বানিয়েও তারা শুধু বিংশ শতাব্দীতে জীবিতই থাকেনি, উন্নতি ও সমৃদ্ধির দিক থেকে তারা আমাদের চেয়েও অগ্রগামী। পৃথিবীর এক বৃহৎ রাষ্ট্র চীনের কথাই ধরুন, শরীর চর্চা ও দেহ সুরক্ষার কলা-কৌশলের প্রতি যতটা গুরুত্ব এদের মধ্যে পাওয়া যায় অন্তত আমি তা অন্য কোনো দেশের নাগরিকদের মধ্যে দেখতে পাইনি। কিন্তু এটাকেও তারা শুধু ব্যায়াম ও শরীর চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে, একে এমন ব্যাপক উন্মাদনার অনুসঙ্গ হতে দেয়নি। যা আবাল-বৃদ্ধের মন-মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে রাখবে এবং তাদেরকে মৌলিক দায়িত্ব-কর্তব্য হতে উদাসীন বানিয়ে দেবে।

একথাগুলির উদ্দেশ্য-আল্লাহ না করুন-শুধু সমালোচনা ও তিরস্কার করা নয়; বরং পূর্ণ দরদের সাথে দেশের সরকার ও জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করতে চাই যে, ম্যাচপ্রীতি এখন সীমা অতিক্রম করেছে এবং এর সুদূর প্রসারী ক্ষতি এমন যেকোনো ব্যক্তিই উপলব্ধি করতে পারবে, যার মধ্যে সামান্যতম বিবেক-বুদ্ধি অবশিষ্ট আছে। আল্লাহর ওয়াস্তে চিন্তা করুন! এভাবে আমরা আমাদের জাতিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি? আমরা এমন একটি জাতি, যারা অসংখ্য সমস্যার ঘূর্ণিপাকে আটক পড়ে আছি এবং নিজেদের প্রয়োজন পূরণে বাইরের দেশের সাহায্যের মুখাপেক্ষী, যেসব সাহায্য দেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় মর্যাদার মূল্যে কেনা হয়। আমাদের প্রতিটি দিন একেকটি নতুন সমস্যা নিয়ে উপস্থিত হয়। শিশু-কিশোরদের সহীহ তালীম-তরবিয়তের ব্যবস্থা নেই, আদালতে অমীমাংসিত মামলার স্ত্তপ জমে আছে, চারদিকে শত্রুরা হা করে আছে।

আজ এই জাতির প্রয়োজন খেলোয়াড়ের নয়, মেধাবী মানুষ ও দেশ গড়ার সৈনিকের। অথচ আমরা এমন এক রঙ তামাশার পরিবেশ সৃষ্টি করেছি যে, গায়ক-নায়ক ও খেলোয়াড়রাই আজ হয়ে গেছে নতুন প্রজন্মের আদর্শ।

অনুবাদ : মুহাম্মাদ আনসারুল্লাহ হাসান

0Shares

আরও জানুন

বয়স হয়ে গেলে আল্লাহ নামায মাফ করে দেন?

প্রশ্ন আমার দাদা একজন দেওবন্দী আলেম।উনি খুবই নামাজি এবং পরহেজগার। উনার বয়স ১০০। হঠাৎ করে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *