প্রচ্ছদ / আকিদা-বিশ্বাস / পূর্বেকার সকল নবীগণ উম্মতে মুহাম্মদী হবার দরখাস্ত আল্লাহর কাছে করেছেন?

পূর্বেকার সকল নবীগণ উম্মতে মুহাম্মদী হবার দরখাস্ত আল্লাহর কাছে করেছেন?

প্রশ্ন

আমাদের দেশের অনেক বক্তা ও দাঈদের উম্মতে মুহাম্মদীর ফযীলত বলতে গিয়ে বলতে শোনা যায় যে, পূর্বেকার সমস্ত নবীরাই উম্মতে মুহাম্মদী হবার জন্য আল্লাহার কাছে দরখাস্ত করেছেন।

কিন্তু শুধুমাত্র হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের দুআ কবুল হয়েছে। আর কোন নবীর দুআ কবুল হয়নি।

বিশেষ করে মুসা আলাইহিস সালামের ক্ষেত্রে বলা হয় যে, তিনি তাওরাতের মাঝে উম্মতে মুহাম্মদীর ফাযায়েল দেখে উম্মত হবার দরখাস্ত আল্লাহর কাছে করেন। তখন আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সালামকে বলেন যে, আপনি আগে চলে আসছেন। আর এ উম্মত সবার শেষে আসবে।

হুজুরের কাছে দরখাস্ত হলো, এ বিষয়ে সঠিক সমাধান জানিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

কোন গ্রহণযোগ্য মারফূ বর্ণনা দ্বারা একথা প্রমাণিত নয় যে, পূর্বেকার নবীগণ উম্মতে মুহাম্মদী হবার আকাঙ্খা করেছেন। কিছু কিতাবে এ ধরণের বর্ণনা পাওয়া যায়, কিন্তু তা চূড়ান্ত পর্যায়ের দুর্বল, কিংবা বানোয়াট অথবা ইজরাইলী বর্ণনা। যার উপর নির্ভর করার সুযোগ নেই।

যেমন শায়েখ আবূ নুয়াইম আলইস্ফাহানী রহঃ এর দালায়েন নুবুয়্যাহ কিতাবের ৬৮ নং পৃষ্ঠার বর্ণনা নং ৩১ এবং হিলয়াতুল আওলিয়া কিতাবের ৩ নং খণ্ডের ৩৭৬ নং পৃষ্ঠায় একটি বর্ণনা এসেছে। যাতে এসেছে যে, হযরত মুসা আলাইহিস সালাম তাওরাত কিতাবে যখন উম্মতে মুহাম্মদীর ফযীলত দেখলেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে দুআ করলেন। যেন এ উম্মত তাকে দেয়া হয়। তখন উত্তরে আল্লাহ তাআলা বললেন যে, تلك امة احمد صلى الله عليه وسلم অর্থাৎ এটি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত। তখন তিনি দুআ করলেন যেন, তাকে উম্মতে মুহাম্মদীর অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

দালায়েলুন নবুয়্যাহ কিতাবে উদ্ধৃত বর্ণনাটির সনদ হলো:

حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْحَسَنِ، قَالَ: ثنا مُحَمَّدُ بْنُ عُثْمَانَ بْنِ أَبِي شَيْبَةَ، قَالَ: ثنا جُبَارَةُ بْنُ الْمُغَلِّسِ، قَالَ: ثنا الرَّبِيعُ بْنُ النُّعْمَانِ، عَنْ سُهَيْلِ بْنِ أَبِي صَالِحٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ

এ বর্ণনায় একজন রাবী আছেন। যার নাম হলো জুবারাহ বিন মুগাল্লিছ। যার ব্যাপারে  মুহাদ্দিসগণের মন্তব্য হলো:

يحيى ابن معين يقول: جبارة كذاب

ইয়াহইয়া বিন মাঈন রহঃ বলেন, জুবারাহ একজন কাজ্জাব তথা চরম মিথ্যুক। [আলজরহু ওয়াত তা’দীল-২/৫৫০, রাবী নং-২২৮৪]

এ বর্ণনা আনার পর লেখক আবূ নুয়াইম রহঃ মন্তব্য করেন:

وَهَذَا الْحَدِيثُ مِنْ غَرَائِبِ حَدِيثِ سُهَيْلٍ، لَا أَعْلَمُ أَحَدًا رَوَاهُ مَرْفُوعًا إِلَّا مِنْ هَذَا الْوَجْهِ

এটি সুহাইল এর গরীব তথা বিরল প্রজাতির বর্ণনার একটি। আমি এমন কাউকে জানি না, যিনি এ সূত্রটি ছাড়া এটিকে মারফূ তথা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সূত্রবদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। [দালায়েলুন নবুয়্যাহ-১/৬৮]

হিলয়াতুল আওলিয়া কিতাবে উদ্ধৃত বর্ণনাটির সনদ হলো:

حدثنا أحمد بن اسحاق وعبدالله بن محمد قالا: ثنا أبو بكر بن أبي عاصم ثنا أيوب الجبابري ثنا سعيد بن موسى ثنا رباح بن زيد عن معمر عن الزهري عن أنس بن مالك قال: قال رسول الله صلى الله عليه و سلم

এ সনদে একজন রাবী আছেন। যার নাম আইয়ুব জাবারী। যার ব্যাপারে আবূ নুয়াইম বর্ণনা আনার পর নিজেই মন্তব্য করেছেন:

وَالْجَبَابِرِيُّ فِي حَدِيثِهِ لِينٌ وَنَكَارَةٌ

আর জাবারীর হাদীসের মাঝে দুর্বলতা এবং মুনকার বিষয় রয়েছে। [হিলয়াতুল আওলিয়া-৩/৩৭৫]

এর সনদে আরেকজন রাবী আছেন। যার নাম হলো: সাঈদ বিন মুসা।

যার ব্যাপারে মুহাদ্দিগণের মন্তব্য হলো:

سعيد بن موسى عن مالك اتهمه ابن حبان بوضع الحديث، وله عن رباح بن زيد موضوعات (المغنی في الضعفاء:1/124،ط:مکتبة مشكاة)

ইমাম যাহাবী রহঃ বলেন, সাঈদ বিন মুসা মালেক থেকে বর্ণনা করেছেন। তাকে ইবনে হিব্বান রহঃ হাদীস জালকারী বলেছেন। আর রাবাহ বিন জায়েদের সূত্রে তার জাল বর্ণনা রয়েছে। [আলমুগনী লিজ জুআফা-১/১২৪]

আলোচিত বর্ণনাটিও সাঈদ বিন মুসা রাবাহ বিন জায়েদ থেকেই বর্ণনা করেছেন।

সুতরাং এ বর্ণনা জাল হওয়ার মাঝে কোন সন্দেহ বাকি থাকে না।

اتهمه ابن حبان بالوضع

ইবনে হিব্বান রহঃ তাকে জাল বর্ণনাকারী বলেছেন। [মীযানুল ই’তিদাল-২/১৫৯, রাবী নং-৩২৮০, লিসানুল মীযান-৩/৪৪, রাবী নং-১৭২]

এমনিভাবে হযরত ইলিয়াস আলাইহিস সালামের ব্যাপারে একই ধরণের দুআ মুস্তাদরাকে হাকেমের ২ খণ্ডের ৬৭৪ পৃষ্ঠায় এবং দালায়েলুন নুবুয়্যাহ লিলবায়হাকীর ৫ নং খণ্ডের ৪২১ নং পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত হয়েছে। যেটিকে ইমাম যাহাবী রহঃ তালখীসে মুস্তাদরাক কিতাবে জাল বর্ণনা বলে অভিহিত করেছেন।

কিছু বর্ণনায় হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের উম্মতে মুহাম্মদী হওয়ার দুআ কবুলের কথা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত বর্ণনাও বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। ফাতহুল বারীতে ইবনে হাজার সূত্রবিহীন তা উল্লেখ করার পর তাকে মারজূহ বলে মন্তব্য করেছেন। [ফাতহুল বারী-৬/৪৯৩]

সুতরাং বুঝা গেল যে, এসব কথা বলে উম্মতে মুহাম্মদীর বানোয়াট ফযীলত বলা থেকে বিরত থাক প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব। কুরআনে কারীমে উম্মতে মুহাম্মদীকে সবচে’ উত্তম উম্মত বলা হয়েছে। [সূরা আলে ইমরান-১১০]

সহীহ হাদীসের মাঝেও এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্বের কথা আসছে। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৭৬৩]

সেসব কথা রেখে জাল ও বানোয়াট কথা বলা কিছুতেই কোন দ্বীনের দাঈর কাজ হতে পারে না। তাই এসব কথা পরিহার করা আবশ্যক।

আরো জানতে দেখুন:

দারুল উলুম দেওবন্দের ফাতাওয়া নং- Fatwa:597-62T/L=07/1440

জামিয়া বিন্নুরিয়া করাচির ফাতাওয়া নং-  144106201170

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।

ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com

0Shares

আরও জানুন

‘সুন্দর সম্পর্ক কেন নষ্ট করে দিলা’ বলার দ্বারা কি স্ত্রী তালাক হয়ে যায়?

প্রশ্ন আস্সালামুআলাইকুম মুফতি সাহেব, এই প্রশ্ন কয়েকটা আগেও করেছিলাম, উত্তর না পেয়ে আবার করছি| ওয়াসওয়াসা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *