প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / লা-মাযহাবিয়্যাতঃ উম্মতকে বিভক্ত করার এক ভয়ানক ষড়যন্ত্রের নাম!

লা-মাযহাবিয়্যাতঃ উম্মতকে বিভক্ত করার এক ভয়ানক ষড়যন্ত্রের নাম!

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

ইসলাম নামক জান্নাতী ধর্ম এ উপমহাদেশে প্রবেশ করেছে হাজার বছর পেড়িয়ে গেছে। ইসলাম নামক এ শান্তির পায়রা উপমহাদেশের মাটিতে আগমণ হবার পর থেকে সাধিত হয়েছে আশাতীত বিপ্লব। যে দেশে জাতবর্ণের ভেদাভেদ ছিল ধর্ম। মানুষকে বিভাজন করে রেখেছিল ব্রাহ্মণ, ক্ষৈত্রিয়, শুদ্র ইত্যাদি নামে।

সেই বিভাজন তুলে দিয়ে আল্লাহর সৃষ্টিকে এক কাতারে নিয়ে এসেছিল ইসলাম। তুলে দিয়েছিল মতভেদ ও বিভেদের দেয়াল। তৈরী করেছিল সম্প্রীতি, ভালবাসা ও মোহাব্বতের এক অনুপম ভ্রাতৃত্ব। রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি থেকে নিয়ে সমাজের নি¤œ স্তরের মেথর যে ধর্মের ছায়াতলে এসে মসজিদে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যেত। মসজিদ ছিল একতা ও সম্প্রীতিবোধের এক নজরকাড়া প্লাটফর্ম।

পাঁচ ওয়াক্তের সালাত, বিতর, তারাবী, ঈদ তারাবীহ ছিল সকল মুসলিমদের একিভূত থাকার নিদর্শন। এসব ইবাদত নিয়ে ছিল না কোন কোন্দল-বিভেদ। উপমহাদেশের সকল মুসলিমগণ কুরআন ও হাদীসের আলোকে লিপিবদ্ধ করা ফিক্বহে হানাফীর ছিল একনিষ্ট অনুসারী।

সেই একতা, সেই মোহাব্বত, সেই ভ্রাতৃত্বের দেয়াল ভেঙ্গে দিয়ে এ উপমহাদেশের মুসলমানদের মাঝে বিভেদের দেয়াল দাঁড় করাতে এক সময় আগমণ করল ইংরেজ বেনিয়ারা। মোঘল স¤্রাজ্যের সর্বশেষ স¤্রাট আহমাদ শাহ আবদালীর সরলতার সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা আস্তানা গাড়ল এ দেশে। অবশেষে ধীরে ধীরে গ্রাস করে দেশ। কুক্ষিগত করল ক্ষমতার মসনদ। নেমে এল মুসলমানদের দুর্দিন। ইংরেজরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে চালাল নিপিড়ন নির্যাতনের ষ্টিমরোলার। কিন্তু তারা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল এত নিপিড়নের পরও মুসলমানদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ছে না। ইস্পাত কঠিন তাদের হৃদয়। বারবার একতাবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলছে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন। শত নির্যাতন নিপিড়নে রোখা যাচ্ছে না ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহ।

কারণ খুঁজতে লাগল ইংরেজরা। বেরিয়ে এল আসল সত্য। এ দেশের মুসলমানরা তাদের ধর্ম বিশেষজ্ঞ উলামায়ে কেরামকে শ্রদ্ধা করে। তাদের কুরআন ও হাদীস ভিত্তিক সঠিক ব্যাখ্যার আলোকে নিজের জীবন পরিচালিত করতে সদা সচেষ্ট থাকে। আলেমদের দ্বীনী কথায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে দ্বীনের জন্য নিজের জান কুরবান করতে দীপ্ত শপথ নেয়। জুলুম নির্যাতনে ধৈর্য ধারণ করতে উলামায়ে কেরামের কুরআন ও হাদীসের আলোচনায় সান্ত¦না খুঁজে পায়।

দ্বিতীয়ত মুসলমানদের মাঝে অর্থ বিত্ত ও পদ পদবীর দিক থেকে যত পার্থক্যই থাকুক না কেন, সকলে পাঁচ ওয়াক্তের সালাতে, ঈদে, তারাবীহ, জানাজাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায়। একজনের কষ্টে আরেকজন পাশে দাঁড়ানোর প্রেরণা পায় এ সম্মিলনে। পরস্পরের মাঝে তৈরী হয় ভালবাসা ও মোহাব্বত।

ইংরেজ বেনিয়ারা বুঝে যায়, এ উপমহাদেশে তাদের শোষণ সুদৃঢ় করতে হলে মুসলমানদের এ দুই সঞ্জীবনী শক্তিকে বিনষ্ট করে দিতে হবে। আলাদা করে দিতে হবে সাধারণ মুসলিম থেকে আলেমদের। আলেমদের প্রতি সাধারণ মুসলিমদের করে তুলতে হবে বিদ্বেষী। সেই সাথে মুসলমানদের একতার প্লাটফর্ম সম্মিলিত ইবাদতগুলোকে করে তুলতে হবে বিতর্কিত। যাতে একতার প্লাটফর্মগুলো হয়ে পড়ে বিবাদ বিভক্তির প্লাটফর্ম। নামাযের কাতারগুলো হয়ে পড়ে ঝগড়ার আখরা।

কাদিয়ানীকে নবী বানানোর মাধ্যমে মুসলমানদের মাঝে ফাটল সৃষ্টির একটি অপপ্রয়াস চালায় ইংরেজরা। কিন্তু এ থিউরী কাজে লাগিয়ে খুব বেশি ফায়দা করে উঠতে পারেনি। এখানেও উলামায়ে কেরামের কুরআন ও হাদীসের দলীলের যুদ্ধে হেরে যায় কাদিয়ানী। রব উঠে কাদিয়ানী কাফির। কাদিয়ানী কাফির।
নতুন নবীর থিউরীতে কিছু মানুষ বিভ্রান্ত হলেও মুসলমানদের সিংহভাগই থেকে যায় আগের মতই একতায় সংঘবদ্ধ।
এবার ভয়ানক থিউরী নিয়ে হাজির হয় ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা। ধর্মকে পূঁজি করে বিভক্তির আগুণ ছড়িয়ে দেয়। এ এক মোক্ষম অস্ত্র। অর্থ বিত্ত, জমিদারী, পদ ও পদবীর লোভ দেখিয়ে ক্রয় করে নিল মিয়া নজীর হুসাইন, নওয়াব সিদ্দীক হাসান ও মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবীদের।

যাদের মূল কাজই হল দু’টি। এক. আলেমদের কাছে যাবার কোন প্রয়োজন নেই, নিজে নিজে কুরআন ও হাদীস পড়, যা বুঝতে পারো, সেভাবেই আমল কর। আলেমরা তাদের স্বার্থের জন্য দ্বীনকে পাল্টে দেয়। তাই তাদের কাছে যাবার কোন মানে হয় না” প্রভৃতি মুখরোচক কথা বলে সাধারণ মুসলমানদের করে তুলতে শুরু করে আলেম বিদ্বেষী।
দ্বিতীয়ত উপমহাদেশে ইসলাম আসার পর থেকে মুসলমানদের ঐতিহ্যিক একতার ও ভ্রাতৃত্বের প্লাটফর্ম ইবাদত বিষয়ে ছড়াতে শুরু করে সংশয়-সন্দেহ।

এবার সফলতার মুখ দেখতে শুরু করে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা। তাদের কিছুই করার দরকার নেই। মুসলমানরা নিজেরাই নিজেদের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হবে। বিবাদে লিপ্ত হবে। নিজের ধর্মের ইবাদত বিষয়ে থাকবে বিভ্রান্তিতে। সাধারণ মুসলমানদের কাছে এক সময় পুরো দ্বীনে ইসলামকেই মনে হতে থাকবে সন্দেহযুক্ত।

এ ভয়াবহ খেল শুরু করে এ নতুন ফিরক্বাটি। নামকি হবে এ দলের? প্রথমে মুহাম্মদী, আবার মুআহহিদীন ইত্যাদি নামে নিজেদের নাম প্রকাশ করতে থাকে মুসলমানদের বিবাদ বিভক্তির ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নকারী দলটি।

অবশেষে উক্ত ফিরক্বার একজন বিশিষ্ট গুরু মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী সাহেব ইংরেজ সরকারের কাছে আবেদন করে ”আহলে হাদীস” নামে নিজেদের নাম রেজিষ্ট্রার করান।
ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে ৩ ই ডিসেম্বর ১৮৮৬ ঈসাব্দে পাঞ্জাব গভর্ণমেন্টের কাছ থেকে রেজিষ্ট্রশন করে। আর সি.পি গভর্নমেন্টের কাছ থেকে ১৪ই জুলাই ১৮৮৮ ঈসাব্দে, আর ইউপি গভর্ণমেন্টের কাছ থেকে ২০ই জুলাই ১৮৮৮ ঈসাব্দ, বোম্বাই গভর্ণমেন্টের কাছ থেকে ১৪ই আগষ্ট ১৮৮৮ ঈসাব্দ, মাদ্রাজ গভর্ণমেন্টের কাছ থেকে ১৫ ই আগষ্ট ১৮৮৮ ঈসাব্দ ও মাদ্রাজ গভর্ণমেন্টের কাছ থেকে ১৫ ই আগষ্ট ১৮৮৮ ঈসাব্দ, এবং বঙ্গদেশ গভর্ণমেন্টের কাছ থেকে ১৮৯০ ঈসাব্দ তারিখে দরখাস্ত মঞ্জুরী করায়। (রদ্দে গায়রে মুকাল্লিদিয়্যাত-১১/৩২-৩৯}

সরকারী রেজিষ্ট্রার করিয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীসের নাম নিয়ে শুরু হয় এ নতুন ফিরক্বার ফিতনা বিস্তারের কার্যক্রম।

মসজিদ হয়ে পড়ে ঝগড়া বিবাদের মাকাম। নামাযের কাতার, ঈদ, তারাবী, এসব একতার প্লাটফর্মগুলো হয়ে পড়ে বিভক্তির প্লাটফর্ম।
এ জঘন্য কর্মগুলো পরিচালিত করতে আহলে হাদীস নামধারী লা-মাযহাবী বন্ধুরা কুরআন ও হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা, হাদীসের নামে প্রতারণা ও জালিয়াতি করতেও সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করে না।

কিন্তু এক্ষেত্রেও উলামায়ে দেওবন্দের ইলমী সৈনিকেরা কুরআন ও হাদীসের দলীলের মাধ্যমে খুলে দিতে থাকেন এ নতুন ফিরক্বার মুখোশ। শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহঃ এর দালিলীক প্রতিরোধের সামনে টিকতে না পেরে অনেকটায় চুপশে যায় এ বিদআতি ফিরক্বা।

দীর্ঘদিন পর্যন্ত এ ফিরক্বার আস্ফালন থেকে মুক্ত থাকে সাধারণ মুসলমান।
কিন্তু আফসোস! চার পাঁচ বছর ধরে নব উদ্যমে উক্ত ফিরক্বার প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। মিডিয়ার কল্যাণে পূর্বের তুলনায় হাজার গুণ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে তাদের ফিতনার বিজ। শহর থেকে শহরে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। গজিয়ে উঠেছে কতিপয় শায়েখরা। যারা সৌদি রুমালের ঘুমটার আড়ালে চালিয়ে যাচ্ছেন মুসলমানদের বিভক্ত ও উলামা বিদ্বেষী করার হীন কার্যক্রম। এক্ষেত্রে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন “কুরআন ও সহীহ হাদীস মানি” এ সুন্দর মুখরোচক স্লোগানটি। ইসলাম আসার পর থেকে জারি থাকা কুরআন ও হাদীস ভিত্তিক আমলকে করে তুলছেন বিতর্কিত। সন্দেহ সংশয় জাগিয়ে তুলছেন হাজার বছর ধরে আমল করা নবীজী সাঃ পর্যন্ত সূত্রবদ্ধ সুন্নত সম্পর্কে।
বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বারশত শতাব্দী পর্যন্ত সকল মুহাদ্দিস, ফক্বীহ, উলামা, পীর বুযুর্গদের সর্বসম্মতভাবে অভিযোগহীন আমলী পদ্ধতি মাযহাবকে। খুঁতের পর খুঁত বের করার হীন চেষ্টা করা হচ্ছে এ উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত নববী সুন্নাহকে।
লা-মাযহাবী শায়েখরা তাদের মতবাদ ছড়ানোর জন্য জাল হাদীস পেশ, হাদীস নিয়ে জালিয়াতি প্রতারণা করতেও সামান্যতম দ্বিধাবোধ করছে না।

আল্লাহ তাআলা আমাদের ভয়ানক ফিরক্বার ফিতনাহ থেকে হিফাযত করুন। তাদের বিছানো জালে পা দেয়া থেকে উম্মতে মুসলিমাকে রক্ষা করুন। আমীন।

আরও জানুন

আমাদের নবী কি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী নন?

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। কোন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস