প্রচ্ছদ / ইসলাহী/আত্মশুদ্ধি / লেনদেনে সততা ও হালাল জীবিকা

লেনদেনে সততা ও হালাল জীবিকা

আল্লামা মনজূর নূমানী রহঃ

লেনদেনে সততা, স্বচ্ছতা ও আমানতদারিতা রক্ষা করা ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষার অন্তর্গত। কোরআন ও হাদীস থেকে জানা যায়, পাক্কা মুসলমান সে-ই, যে লেনদেন ও কায়কারবারে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার পরিচয় দেয়। ধোকাবাজি, ওয়াদা-খেলাপি, আমানতের খেয়ানত ইত্যাদি অনৈতিক আচরণ থেকে বিরত থাকে। কারো হক নষ্ট করা, ওজনে কম দেওয়া, অন্যায়ভাবে মামলা দায়ের করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া, সুদ নেয়া, ঘুষ খাওয়া ইত্যাদি অমানবিক হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকে। আর যে ব্যক্তির ভিতর এ দোষগুলি থাকে, সে কাজেকর্মে কিছুতেই ভালো মুসলমান নয়। বরং সে বদজাত মোনাফেক এবং মারাত্মক ধরনের পাপী ও ফাসেক। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে এই দোষগুলি থেকে হেফাজত করুন, আমীন।

হারাম মাল সম্পর্কে কোরআন শরীফে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ

হে ঈমানদারগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে কারো মাল হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করো না। সূরা নিসা ৪/২৯

এই আয়াতে কামাই-রোজগারের সকল চোরা পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। কালোবাজারি, মজুদদারি, সুদ, ঘুষ, লটারী-জুয়া ইত্যাদি সকল ধরনের অন্যায় উপার্জনকে হারাম করা হয়েছে। বিভিন্ন আয়াতে এ সকল হারাম পদ্ধতির পৃথক পৃথক বিবরণও এসেছে। যারা ওজনে কম দিয়ে ক্রেতাকে প্রতারিত করে, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন,

وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِينَ. الَّذِينَ إِذَا اكْتَالُوا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُونَ. وَإِذَا كَالُوهُمْ أَوْ وَزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ. أَلَا يَظُنُّ أُولَئِكَ أَنَّهُمْ مَبْعُوثُونَ. لِيَوْمٍ عَظِيمٍ. يَوْمَ يَقُومُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ
যারা ওজনে কম দেয়, তাদের জন্য চরম দুর্ভোগ! এদের স্বভাব হলো, যখন কারো থেকে মেপে নেয়, তখন কাঁটায়কাঁটায় পুরোপুরি মেপে নেয়। কিন্তু যখন অন্যকে মেপে বা ওজন করে দেয়, তখন কম দিয়ে তাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। তবে কি তাদের স্মরণ নেই যে, তাদেরকে এক মহা দিবসে পুনরুত্থিত করা হবে, যেদিন সকল মানুষ আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সম্মুখে আপন আপন কৃতকর্মের হিসাব দানের জন্য দ-ায়মান হবে? সূরা মুতাফ্ফিফীন ৮৩/১-৬

এক আয়াতে প্রকৃত মুসলমানের আলামত বর্ণনা করে আল্লাহ পাক বলেন,

وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ
(মুসলমান তারা) যারা আমানতের হেফাজত করে, অঙ্গীকারসমূহ রক্ষা করে। সূরা মুমিনূন ২৩/৮

নবীজী তার অধিকাংশ ভাষণে বলতেন,

لَا إِيمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَهُ، وَلَا دِينَ لِمَنْ لَا عَهْدَ لَهُ
শুনে রাখো! যার ভিতর আমানতদারিতার গুণ নেই, তার ভিতর যেন ঈমানও নেই, যার ভিতর ওয়াদা রক্ষার বালাই নেই, তার ভিতর ধর্মের কোনো বৈশিষ্ট্যই নেই! মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১২৩৮৩

অন্য একটি হাদীসে নবীজী এরশাদ করেন,

آيَةُ المُنَافِقِ ثَلاَثٌ: إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ
মোনাফেকের আলামত তিনটি, মিথ্যা বলা, আমানতের খেয়ানত করা ও ওয়াদা করে খেলাপ করা। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৩

ধোঁকাবাজ ব্যবসায়ী সম্পর্কে নবীজী বলেন,

مَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا
ধোঁকাবাজ ও প্রতারক আমাদের দলভূক্ত নয়। (কারণ ধোকা ও প্রতারণা তো জাহান্নামী হওয়ার মাধ্যম।) সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬৪

মদীনার বাজারে এক ব্যক্তি গমের স্তুপ দিলো। কিন্তু স্তুপের উপরিভাগের গম ছিলো একটু শুকনা, আর ভিতরের গম ভিজা। নবীজী বিষয়টি লক্ষ্য করে বললেন,

مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّي
এভাবে যারা ধোকার আশ্রয় নেয়, তারা আমার দলভূক্ত নয়। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০২

সুতরাং যে দোকানদার ভালোটা দেখিয়ে মন্দটা গছিয়ে দেয়, পণ্যের ত্রুটি লুকাতে চেষ্টা করে, নির্ঘাত সে শাস্তিযোগ্য অপরাধে লিপ্ত। আল্লাহ না করুন, এ জন্য তাকে জাহান্নামের আযাবও ভোগ করতে হবে।

এক হাদীসে এসেছে,

مَنْ بَاعَ عَيْبًا لَمْ يُبَيِّنْهُ ، لَمْ يَزَلْ فِي مَقْتِ اللهِ، وَلَمْ تَزَلِ الْمَلاَئِكَةُ تَلْعَنُهُ. قال البوصري في مصباح الزجاجة: هذا إسناد ضعيف وكذا في التنقيح لابن عبد الهادي
যে ব্যক্তি ক্রটিযুক্ত পণ্য বিক্রি করে অথচ গ্রাহককে তা অবহিত করে না, সে ব্যক্তি সর্বদা আল্লাহ তাআলার ক্রোধে নিপতিত থাকে এবং ফেরেশতাগণ সর্বদা তার উপর অভিশাপ ও লানত দিতে থাকে। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ২২৪৭

মোটকথা, ইসলামী শিক্ষার আলোকে ব্যবসা-বাণিজ্যে সব ধরনের অস্বচ্ছতা-চালবাজি নিষিদ্ধ ও অভিশপ্ত। নবীজী এই সমস্ত অপকর্মে যুক্ত ব্যক্তিদের থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে দায়মুক্ত বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এমনিভাবে সুদঘুষও হারাম এবং নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। প্রসিদ্ধ হাদীসে এসেছে,

أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ لَعَنَ آكِلَ الرِّبَا، وَمُوكِلَهُ، وَشَاهِدِيهِ، وَكَاتِبَهُ.
যে ব্যক্তি সুদ নেয় কিংবা দেয়, অথবা সুদী কারবারের কাগজপত্র তৈরি করে বা সাক্ষী হয়, তার উপর আল্লাহ তাআলার গজব! সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪০৯৯

ঘুষ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে,

لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّاشِي وَالْمُرْتَشِي
নবীজী ঘুষের লেনদেনকারীর উপর অভিশম্পাত করেছেন। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৫৮০

এক হাদীসে তো নবীজী এতদূর বলেছেন যে,

مَنْ شَفَعَ لِأَخِيهِ بِشَفَاعَةٍ، فَأَهْدَى لَهُ هَدِيَّةً عَلَيْهَا فَقَبِلَهَا، فَقَدْ أَتَى بَابًا عَظِيمًا مِنْ أَبْوَابِ الرِّبَا
কোনো বৈধ বিষয়ে কেউ যদি কারো জন্য সুপারিশ করে, এরপর যদি সুপারিশকারীকে দ্বিতীয় ব্যক্তি কোনো উপহার দেয় এবং সুপারিশকারী তা গ্রহণ করে, তবে সে যেন ঘুষের বড় দরজায় পা রাখলো। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ১২২৮

উল্লিখিত সকল অন্যায় থেকে জঘণ্যতর অন্যায় হলো মিথ্যা মামলা দিয়ে কারো ক্ষতি সাধন করা। হাদীসে পাকে নবীজী এরশাদ করেন,

مَنِ اقْتَطَعَ شِبْرًا مِنَ الْأَرْضِ ظُلْمًا، طَوَّقَهُ اللهُ إِيَّاهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ سَبْعِ أَرَضِينَ
যে ব্যক্তি কারো এক বিঘত জমি জবরদখল করবে, কেয়ামতের দিন দখল করা ভূমি পরিমাণ সাত তবক জমিন তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬১০

আরেকটি হাদীসে এসেছে,

مَنِ اقْتَطَعَ حَقَّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ بِيَمِينِهِ، فَقَدْ أَوْجَبَ اللهُ لَهُ النَّارَ، وَحَرَّمَ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ. فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ: وَإِنْ كَانَ شَيْئًا يَسِيرًا يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: وَإِنْ قَضِيبًا مِنْ أَرَاكٍ
বিচারকের সামনে মিথ্যা কসম করে যে ব্যক্তি কারো কোন কিছু আত্মসাৎ করে নেবে, আল্লাহ তাআলা তার কপালে জান্নাত হারাম করে জাহান্নাম ওয়াজিব করে দিবেন। নবীজীর এরশাদ শুনে জনৈক ব্যক্তি বললো, যদি সেটা মামুলি কিছু হয়, তবু কি এত বড় সর্বনাশ হবে? নবীজী বললেন, হ্যাঁ, যদিও তা বুনোগাছের একটি ডালই হয় না কেন। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২১৮

একটি হাদীসে নবীজী মামলাবাজ লোকদেরকে সতর্ক করে বলেন,

لَا يَقْتَطِعُ أَحَدٌ مَالًا بِيَمِينٍ، إِلَّا لَقِيَ اللَّهَ وَهُوَ أَجْذَمُ
শুনে রাখো! যারা মিথ্যা কসম করে অন্যায়ভাবে অপরের মাল গ্রাস করে ফেলে, কেয়ামতের দিন তাদেরকে কুষ্ঠরোগী অবস্থায় আল্লাহ তাআলার দরবারে হাজির করা হবে। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৩২৪৪

অন্য এক হাদীসে নবীজী এরশাদ করেন,

مَنِ ادَّعَى مَا ليْسَ لَهُ فَلَيْسَ مِنَّا، وَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ
যে ব্যক্তি কোনো জিনিস তার বলে দাবি করে বসে, অথচ জিনিসটি তার নয়, তবে সে ব্যক্তি আমাদের দলভূক্ত নয়, সে বরং আগ থেকেই নরকে নিজের স্থান ঠিক করে নিক! সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২৯

মিথ্যা সাক্ষ্য দানের ব্যাপারে এক হাদীসে এসেছে,

عُدِلَتْ شَهَادَةُ الزُّورِ بِالْإِشْرَاكِ بِاللَّهِ. قال الهيثمي: إِسْنَادُ الطبراني حَسَنٌ.
একদিন ফজরের নামায শেষে নবীজী মুসল্লিদের সমানে দাঁড়িয়ে গুরুগম্ভীর ভাষায় তিনবার বললেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া শিরক করার মতোই মহাপাপ! মুজামে কাবীর তাবারানী, হাদীস নং ৮৫৬৯

হারাম মাল অশুভ এবং অপবিত্র

হারাম পন্থায় উপার্জিত সম্পদ অপবিত্র এবং অমঙ্গলকর। যে ব্যক্তি খোরপোশে তা ব্যবহার করবে, তার দুআ-নামায কিছুই কবুল হবে না। এমনকি যদি সেই সম্পদ থেকে দান-সদকা করে তাও কবুল হবে না। আল্লাহ পাকের বিশেষ রহমত থেকেও সে বঞ্চিত থাকবে। এক হাদীসে এসেছে,

لَا يَكْسِبُ عَبْدٌ مَالًا مِنْ حَرَامٍ، فَيُنْفِقَ مِنْهُ فَيُبَارَكَ لَهُ فِيهِ، وَلَا يَتَصَدَّقُ بِهِ فَيُقْبَلَ مِنْهُ، وَلَا يَتْرُكُ خَلْفَ ظَهْرِهِ إِلَّا كَانَ زَادَهُ إِلَى النَّارِ، إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَمْحُو السَّيِّئَ بِالسَّيِّئِ، وَلَكِنْ يَمْحُو السَّيِّئَ بِالْحَسَنِ، إِنَّ الْخَبِيثَ لَا يَمْحُو الْخَبِيثَ. إسناده ضعيف
যে ব্যক্তি অন্যায় পথে মাল কামাই করে এবং সেই মাল থেকে সদকা করে, তার সেই সদকা কবুল হয় না, সেই মাল থেকে নিজের প্রয়োজনে খরচ করলে তাতে বরকত হয় না, যদি সেই সম্পদ রেখে সে মারা যায়, তবে তার জন্য তা জাহান্নামের পরোয়ানা হয়ে যায়। তোমরা নিশ্চিতভাবে জেনে নাও, আল্লাহ তাআলা অন্যায়কে অন্যায় দ্বারা (অর্থাৎ হারাম মালের সাদাকা দ্বারা গুনাহ) মাফ করেন না, যেমন একটি অশুচি অপর অশুচিকে পবিত্র করতে পারে না। বরং আল্লাহ তাআলা নেকআমলের বদলে বদআমল মিটিয়ে থাকেন। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৩৬৭২

একটি দীর্ঘ হাদীসে নবীজী ইরশাদ করেন,

أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا … ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ، يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ، يَا رَبِّ، يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ، فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ؟
হে লোক সকল! আল্লাহ তাআলা নিজে পাক ও পবিত্র, তাই পবিত্র এবং হালাল মালই শুধু তিনি কবুল করে থাকেন। …লোকটি বহুদূর পথ সফর করে (কোন বরকতময় স্থানে দুআর জন্য) এলো, তার চুল উশকো-খুশকো, শরীর ধুলোমলিন, আকাশের দিকে দুহাত তুলে ফরিয়াদ করতে লাগলো, আয় আল্লাহ আয় মালিক! কিন্তু তার অন্ন-বস্ত্র সবই হারাম মাল থেকে আসে। হারাম মাল দ্বারাই সে প্রতিপালিত। এই ব্যক্তির দুআ কেমন করে কবুল হবে! সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০১৫

অর্থাৎ যার খানাপিনা হারাম মাল থেকে হয়, তার দুআ কবুল হওয়ার সম্ভাবনা রাখে না। এক হাদীসে এসেছে,

مَنِ اشْتَرَى ثَوْبًا بِعَشَرَةِ دَرَاهِمَ، وَفِيهِ دِرْهَمٌ حَرَامٌ، لَمْ يَقْبَلِ اللهُ لَهُ صَلَاةً مَادَامَ عَلَيْهِ. إسناده ضعيف.
যদি কেউ দশ দিরহামে একটি কাপড় ক্রয় করে, আর যদি দশ দিরহামের একটি দিরহামও হারাম হয়ে থাকে, তবে ঐ কাপড় যতদিন তার গায়ে থাকবে ততদিন তার কোনো নামায কবুল হবে না। মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৫৭৩২

আরেক হাদীসে এসেছে,

لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّيَ بِحَرَامٍ. إسناده ضعيف
হারাম মালে প্রতিপালিত দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আল মুজামুল আউসাত, হাদীস নং ৫৯৬১

দ্বীনী ভাই ও বোন!

আমাদের অন্তরে যদি বিন্দু পরিমাণও ঈমান থাকে, তবে নবীজীর এই সকল বাণী শোনার পর মরণপণ করা উচিৎ যে, যত কঠিন দারিদ্র্য আসুক আর যত কষ্টেই দিন গুযার হোক, হারাম ও অন্যায় পথে জীবিকা অর্জনের চিন্তাও আমরা করবো না। যত কিছুুই হোক, হালাল রুজির উপর তুষ্ট থাকবো। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে তাওফীক দান কররুন। আমীন।

হালাল কামায়ের ফজীলত

ইসলাম যেমনিভাবে রুটিরুজির অন্যায় পদ্ধতিসমূহকে হারাম সাব্যস্ত করেছে, তার বিপরীতে হালাল পথে আয়-রোজগারেরও অনেক সওয়াব ও ফযিলত নির্ধারণ করেছে। এক হাদীসে নবীজী বলেন,

طَلَبُ الْحَلَالِ وَاجِبٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ. قال الهيثمي: إِسْنَادُهُ حَسَنٌ.
দ্বীনের ফরয বিষয়সমূহ পালনের সঙ্গে সঙ্গে হালাল জীবিকা অন্বেষণও একটি ফরজ। আল মুজামুল আউসাত, হাদীস নং ৮৬১০

অন্য এক হাদীসে নবীজী কায়িক শ্রমের বিষয়ে বলেন,

مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ، خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ، وَإِنَّ نَبِيَّ اللَّهِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ، كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ
নিজের হাতের উপার্জনের চে উত্তম উপার্জন আর নেই। আল্লাহর নবী দাউদ নিজ হাতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০৭২

আমানতদার ব্যবসায়ী সম্পর্কে নবীজী বলেন,

التَّاجِرُ الصَّدُوقُ الأَمِينُ مَعَ النَّبِيِّينَ، وَالصِّدِّيقِينَ، وَالشُّهَدَاءِ. هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ
সততার সঙ্গে কারবার পরিচালনাকারী ব্যবসায়ী কেয়ামতের দিন নবী, সিদ্দীক ও শহীদগণের সঙ্গে অবস্থান করবে। সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ১২০৯

লেনদেনে নম্রতা ও দয়াদ্রতা

যেমনিভাবে আর্থিক লেনদেনে সততা ও আমানতদারিতার উপর ইসলামে জোর দেওয়া হয়েছে এবং একে অতি উত্তম নেক কাজ ও আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভের মাধ্যম সাব্যস্ত করা হয়েছে, তেমনিভাবে লেনদেনে নম্রতা, ভদ্রতা ও দয়াদ্রতার প্রতিও ইসলামে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং এর অনেক ফযিলত বর্ণনা করা হয়েছে। নবীজী এরশাদ করেন,

رَحِمَ اللهُ رَجُلاً سَمْحًا، إِذَا بَاعَ، وَإِذَا اشْتَرَى، وَإِذَا اقْتَضَى.
ঐ বান্দার প্রতি আল্লাহর রহমত, যে ক্রয়-বিক্রয়কালে এবং নিজের হক উসুল করার সময় কোমলতা অবলম্বন করে। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০৭৬

একটি হাদীসে এসেছে,

مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُنْجِيَهُ اللهُ مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، فَلْيُنَفِّسْ عَنْ مُعْسِرٍ، أَوْ يَضَعْ عَنْهُ/ مَنْ أَنْظَرَ مُعْسِرًا أَوْ وَضَعَ عَنْهُ، أَظَلَّهُ اللهُ فِي ظِلِّهِ
যে ব্যক্তি চায়, আল্লাহ তাআলা তাকে কেয়ামতের দিবসের পেরেশানি থেকে নাজাত দান করুন, তবে সে যেন গরীব বান্দার ঋণ পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দেয়, পুরো বা আংশিক ঋণ মওকুফ করে দেয়। অন্য বর্ণনায় এসেছে, যে ব্যক্তি গরীব বান্দার ঋণ পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দেয়, পুরো বা আংশিক ঋণ মওকুফ করে দেয় আল্লাহ পাক কেয়ামতের দিন তাকে রহমতের ছায়াতলে স্থান দেবেন। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩০০৬, ১৫৬৩

একদিকে নবীজী ধনবান করজদাতাদেরকে এই নসীহত করেছেন, অন্যদিকে ঋণগ্রহীতাকে জোর তাগিদ দিয়েছেন যে, সে যেন যত দ্রুত সম্ভব ঋণ পরিশোধ করে দেয়। ঋণ বাকি থাকা অবস্থায় যেন তার মৃত্যু না হয়। এক হাদীসে নবীজী বড় কঠিন কথা বলেছেন,

يُغْفَرُ لِلشَّهِيدِ كُلُّ ذَنْبٍ إِلَّا الدَّيْنَ
আল্লাহ পাকের রাস্তায় শাহাদাত বরণের উসিলায় সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়, কিন্তু তার উপর কারো ঋণ থাকলে তা মাফ হয় না। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮৮৬

এমনিভাবে অপর একটি হাদীসে এসেছে,

وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَوْ قُتِلَ رَجُلٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، ثُمَّ عَاشَ وَعَلَيْهِ دَيْنٌ، مَا دَخَلَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَقْضِيَ دَيْنَهُ. صحيح كما في التلخيص للذهبي
ঐ সত্ত্বার কসম! যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, কেউ যদি আল্লাহর পথে শহীদ হয়, এরপর পুনরায় জীবন লাভ করে এবং শহীদ হয়, আবার জীবন লাভ করে শহীদ হয়ে যায়, কিন্তু তার উপর কারো কিছু পাওনা থেকে যায়, তবে এমন শহীদও ঐ ঋণের কোনো বিহিত হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নং ২২১২

মানুষের হক-অধিকার এবং আর্থিক লেনদেনের জটিলতা ও নাযুকতা অনুধাবনের জন্য এ কয়টি হাদীসই যথেষ্ট। আল্লাহ পাক আমাদেরকে এর গুরুত্ব বোঝার তাওফীক দান করুন। আমাদের ঘাড়ে কারো সামান্য হকও যেন থেকে না যায়, সেভাবে চলার শক্তি নসীব করুন। আমীন।

0Shares

আরও জানুন

ঘোড়ার গোস্ত খাওয়ার হুকুম কী?

প্রশ্ন বর্তমান সময়ে ঘোড়ার গোস্ত খাওয়ার হুকুম কি? প্রশ্নকর্তা: মুহাঃ ইসমাইল হোসাইন উত্তর بسم الله …