প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / হাদীসের হাফেজগণও ফকীহগণের মুখাপেক্ষী ছিলেন :

হাদীসের হাফেজগণও ফকীহগণের মুখাপেক্ষী ছিলেন :

আল্লামা আব্দুল মতীন দামাত বারাকাতুহু

পড়ে নিন- মুহাদ্দিসগণও ফকীহগণের কদর বুঝতেন

শুধু হাদীস জানা ফকীহগণের প্রয়োজন ও মুখাপেক্ষিতা মেটাতে ও দূর করতে পারে না। এই কারণে বড় বড় হাফেজে হাদীসগণ শুধু ফকীহগণের কদরই করেন নি, তাদের কাছ থেকে ফিকহের ইলম অর্জন করেছেন, কিংবা তাদের রচিত বইপুস্তক গভীর ভাবে অধ্যয়ন করেছেন। কিংবা তাদের মতানুসারে ফতোয়া দিয়েছেন। এখানে কয়েকজন হাফেজে হাদীসের বিবরণ তুলে ধরা হলো :

১.

ওয়াকী ইবনুল জাররাহ বড় হাফেজে হাদীস ছিলেন। ইমাম বুখারী ও মুসলিমের দাদা-উস্তাদ এবং ইমাম শাফেয়ীর বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন। তার স্মৃতিশক্তি ছিল প্রবাদতুল্য। তাঁর সম্পর্কে খ্যাতনামা মুহাদ্দিস ইয়াহয়া ইবনে মাঈন বলেছেন, يفتي بقول أبي حنيفة তিনি আবু হানীফার মতানুসারে ফতোয়া দিতেন। (কাযী সায়মারী, আখবারু আবী হানীফা ওয়া আসহাবুহু, যাহাবী, তারীখুল ইসলাম, ৪/ ১২২০; যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফাজ, ১/২২৪; ইবনে আসাকির, তারীখু দিমাশক, ৬৩/৭৬)

২.

ইয়াহয়া ইবনে সাঈদ আল কাত্তান বড় জবরদস্ত মুহাদ্দিস ও হাফেজে হাদীস। তিনিও ইমাম বুখারী ও মুসলিমের দাদা-উস্তাদ, আহমাদ, ইবনে মাঈন ও আলী ইবনুল মাদীনীর ন্যায় হাদীসের সমুদ্রতুল্য মুহাদ্দিসগণের উস্তাদ ছিলেন। তিনি নিজে বলেছেন, لا نكذب الله ما سمعنا أحسن من رأي أبي حنيفة وقد أخذنا بأكثر أقواله আমরা আল্লাহর নিকট মিথ্যা বলব না, আমরা আবু হানীফার মতের চেয়ে উত্তম কোন মতের কথা শুনি নি। আমরা তাঁর অধিকাংশ মতই গ্রহন করেছি। (খতীব বাগদাদী, তারীখে বাগদাদ, ১৫/৪৭৩; যাহাবী, তারীখুল ইসলাম, ৯/৩১২; ইবনে কাছীর, আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়া, ১০/১১৪)

এই ইয়াহয়া ইবনে সাঈদ সম্পর্কে তারই শিষ্য ইয়াহয়া ইবনে মাঈন বলেছেন, كان يفتي أيضا بقول أبي حنيفة তিনিও আবু হানীফার মতানুসারে ফতোয়া দিতেন। (যাহাবী, তারীখুল ইসলাম, ৪/১২২০)

৩.

আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী ছিলেন হাদীসের আরেক মহাসাগর। তিনি ইয়াহয়া ইবনে সাঈদের সহপাঠী এরং ইমাম বুখারী ও মুসলিমের দাদা-উস্তাদ ছিলেন। তার সম্পর্কে যাহাবী রহ. সিয়ার গ্রন্থে লিখেছেন, كتب عبد الرحمن بن مهدي إلى الشافعي وهو شاب أن يضع له كتابا فيه معاني القرآن ويجمع قبول الأخبار وحجة الإجماع وبيان الناسخ والمنسوخ فوضع له كتاب الرسالة ইমাম শাফেয়ী যখন যুবক ছিলেন, তখন আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী তার নিকট এই মর্মে পত্র লিখলেন যে, তিনি যেন তার জন্য এমন একটি গ্রন্থ রচনা করে দেন, যে গ্রন্থে থাকবে কুরআনের মর্ম ও বিশ্লেষণ, হাদীসগ্রহণের নিয়মনীতি, ইজমা বা ঐকমত্যের (শরীয়তের দলিল হওয়ার) প্রমাণ ও নাসিখ (রহিতকারী) মানসূখ (রহিত) এর বিবরণ। তার সে আবেদনের প্রেক্ষিতেই তিনি আর রিসালা গ্রন্থখানি রচনা করেছিলেন। (সিয়ার, ইমাম শাফেয়ীর জীবনী, ৮/৩৯৪) আলী ইবনুল মাদীনী বলেছেন, ثم من بعد مالك عبد الرحمن بن مهدي كان يذهب مذهبهم ويقتدي بطريقتهم আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী তাদের (মদীনার ফকীহগণের) মাযহাব অবলম্বন করতেন এবং তাদের পথ অনুসরণ করতেন। (ইলাল, পৃ. ৭২)

৪.

সুফিয়ান ছাওরী ছিলেন প্রখ্যাত হাফেজে হাদীস ও হাদীসের সম্রাট। তাঁর সম্পর্কে ইমাম আবু ইউসুফ কাযী বলেছেন, سفيان الثوري أكثر متابعة لأبي حنيفة مني সুফিয়ান ছাওরী আমার চেয়ে বেশী আবু হানীফার অনুসারী ছিলেন। (ফাযাইলু আবী হানীফা, লি ইবনে আবুল আওয়াম, নং ১৬২; ইবনে আব্দুল বার, আল ইনতিকা, পৃ. ১৯৮)

ওয়াকেদী বলেছেন, كان سفيان الثوري يسألني أن أجيئه بكتب أبي حنيفة لينظر فيها সুফিয়ান ছাওরী আমার নিকট আবেদন করতেন, আমি যেন আবু হানীফার কিতাবগুলো তার কাছে নিয়ে আসি, যাতে তিনি সেগুলো অধ্যয়ন করতে পারেন। (ইবনে আবুল আওয়াম, ফাযাইল, নং ২৫৮)

আলী ইবনুল মাদীনী বলেছেন, سفيان الثوري كان يذهب ويفتي بفتواهم সুফিয়ান ছাওরী কুফার ফকীহগণের মাযহাব অনুসরণ করতেন এবং তাদের মতানুসারে ফতোয়া দিতেন। (ইবনে আবু হাতিম, আল জারহু ওয়াত তাদীল, ১/৫৮)

খ্যাতনামা হাফেজে হাদীস ইয়াযীদ ইবনে হারুন বলেছেন, كان سفيان يأخذ الفقه عن علي بن مسهر من قول أبي حنيفة وأنه استعان به وبمذاكرته على كتابه هذا الذي سماه الجامع সুফিয়ান (ছাওরী) আবু হানীফার মতাশ্রিত ফিকাহ শিখতেন আলী ইবনে মুসহির (আবু হানীফার বিশিষ্ট শিষ্য ও প্রসিদ্ধ হাদীসবিদ) এর কাছ থেকে।

তিনি তার এই গ্রন্থ: যার নাম দিয়েছেন তিনি আল জামে: রচনার সময় আলী ইবনে মুসহিরের ও তার সঙ্গে কৃত মৌখিক আলোচনার সাহায্য নিয়েছেন। (আল্লামা মাসউদ ইবনে শায়বা সিন্ধী, মুকাদ্দিমা কিতাবুত তালীম, তাহাবীকৃত আখবারু আবী হানীফা ওয়া আসহাবুহু এর বরাতে, ইবনে মাজাহ আওর ইলমে হাদীস, পৃ. ১৮৪-১৮৫)

৫.

ইমাম মালেক রহ. ছিলেন মদীনা শরীফের বিখ্যাত হাফেজে হাদীসগণের অন্যতম। ফিকহের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্কও ছিল। মদীনাবাসীর আমলও ছিল তার চোখের সামনে।

তার সম্পর্কে আব্দুল আযীয দারাওয়ার্দী বলেছেন, كان مالك ينظر في كتب أبي حنيفة وينتفع بها মালেক আবু হানীফার কিতাবগুলো দেখতেন এবং সেগুলো থেকে উপকৃত হতেন। (ইবনে আবুল আওয়াম, ফাযাইলে আবী হানীফা, নং ৪৯৫)

৬.

সুফিয়ান ইবনে উয়ায়না কুফার অতঃপর মক্কার শীর্ষ হাফেজে হাদীস ছিলেন। তার সম্পর্কে কাযী বিশর ইবনুল ওয়ালীদ বলেছেন, كنا نكون عند ابن عيينة ، فكان إذا وردت عليه مسألة مشكلة يقول : هاهنا أحد من أصحاب أبي حنيفة؟ فيقال بشر ، فيقول : أجب فيها ، فأجبت فيقول : التسليم للفقهاء سلامة في الدين. অর্থাৎ আমরা ইবনে উয়ায়না’র মজলিসে থাকতাম। কোন জটিল মাসআলা দেখা দিলে তিনি বলতেন, এখানে আবু হানীফার শিষ্য বা শিষ্যের শিষ্য কেউ আছে? বলা হতো বিশর আছে। বলতেন, এর সমাধান দাও। আমি সমাধান দিলে তিনি বলতেন, ফকীহগণের নিকট নিজেকে সমর্পন করাই দ্বীনকে নিরাপদ রাখার নামান্তর। (তারীখে বাগদাদ, ৭/৫৬১)

৭.

ইমাম আহমাদ ছিলেন অন্যতম একজন হাফেজে হাদীস। তিনি ইমাম শাফেয়ী ও তার ফিকহের প্রতি এতটাই অনুরক্ত ছিলেন যে, তিনি শুধু নিজেই নন, হুমায়দী, ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ ও ইবনে ওয়ারাহ প্রমুখ বড় বড় হাফেজে হাদীসকে ইমাম শাফেয়ীর পাগল বানিয়ে ছেড়েছেন। পেছনে এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা গত হয়েছে।

ইমাম আহমাদ বলেছেন, إذا سئلت عن مسألة لا أعرف فيها خبرا قلت فيها بقول الشافعي لأنه إمام قرشي আমাকে যদি এমন কোন মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়, যে বিষয়ে কোন হাদীস আছে বলে আমি জানি না, তবে আমি শাফেয়ীর মতানুসারে ফতোয়া দিই। কেননা তিনি কুরায়শ বংশীয় ইমাম। (সিয়ার, ৮/৪১৪) ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ বলেন, قال لي أحمد بن حنبل : تعال حتى أريك رجلا لم تر عيناك مثله فأقامني على الشافعي আমাকে আহমাদ ইবনে হাম্বল বললেন, চল, তোমাকে এমন এক লোক দেখাব, তোমার দুচোখ তার মতো কাউকে দেখে নি। এরপর তিনি আমাকে শাফেয়ীর নিকট হাজির করলেন। (হিলয়াতুল আওলিয়া, আবু নুয়ায়ম, ৯/৯৭; বায়হাকী, আল মারিফা, নং ৩৭৭)

ইবনে ওয়ারাহ (ইমাম মুসলিমের উস্তাদ) বলেন, قدمت من مصر وأتيت أحمد بن حنبل فقال لي : كتبت كتب الشافعي؟ قلت : لا، قال فرطت ما عرفنا العموم من الخصوص وناسخ الحديث من منسوخه حتى جالسنا الشافعي قال : فحملني ذلك على الرجوع إلى مصر فكتبتها আমি মিসর থেকে আসলাম। আহমাদ ইবনে হাম্বলের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, তুমি কি শাফেয়ীর কিতাবগুলো লিখে এনেছ? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তুমি ত্রুটি করেছ। আমরা তো শাফেয়ীর নিকট বসার আগ পর্যন্ত জানতাম না, খাস কাকে বলে, ‘আম কাকে বলে, হাদীসের নাসিখ কোনটি, মানসুখ কোনটি। ইবনে ওয়ারা বলেন, তার কথায় আমি পুনরায় মিসর গেলাম, এবং সেগুলো লিখে আনলাম। (যাহাবী, সিয়ার, ৮/৪০০)

৮.

ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ ছিলেন ইমাম বুখারী ও মুসলিমের উস্তাদ। তার সম্পর্কে পূর্বে কিছু আলোচনা করা হয়েছে। তিনি ইমাম শাফেয়ীর মজলিসে বসার পরই তার ভক্ত হন এবং তার ওফাতের পর বলা হয়, انكب على كتبه دراسة يستوعبها তার কিতাবসমূহ গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে থাকেন। (মুকাদ্দিমা মাসাইলে আহমাদ ওয়া ইসহাক, ১/১৪২)

তিনি মার্ভের এক বিধবাকে বিবাহ করেছিলেন ইমাম শাফেয়ীর কিতাবগুলোর আকর্ষণেই। তদুপরি ইমাম আহমাদকে অনুরোধ করে তার মাধ্যমে ইমাম শাফেয়ীর আর রিসালা গ্রন্থটিও তিনি সংগ্রহ করেছিলেন।

কুহুস্তানী বলেন,
دخلت يوما على إسحاق فأذن لي وليس عنده أحد فوجدت كتب الشافعي حواليه فقلت : معاذ الله أن نأخذ إلا من وجدنا متاعنا عنده ، فقال لي : والله ما كنت أعلم أن محمد بن إدريس في هذه المحل الذي هو محله ولو علمت لم أفارقه

আমি একবার ইসহাক ইবনে রাহুয়ার নিকট গেলাম। তিনি আমাকে অনুমতি দিলে ভেতরে গিয়ে দেখলাম, সেখানে কেউ নেই। দেখলাম, তার চতুর্দিকে ইমাম শাফেয়ীর কিতাবসমূহ। আমি বললাম, যার কাছে আমাদের মাল পেয়েছি, তার পরিবর্তে অন্য কাউকে গ্রেফতার করব: এর থেকে আল্লাহর পানাহ। (এটি সুরা ইউসুফের ৭৯ নং আয়াত, এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে, আপনি তো এগুলো রাখতে পারেন না। আপনি তো মুহাদ্দিস, আপনার সম্পদ তো হাদীসভান্ডার। অনুবাদক) তখন ইসহাক বললেন, আল্লাহর কসম! আমি জানতাম না মুহাম্মদ ইবনে ইদরীস (শাফেয়ী) এই মানে পৌঁছে গেছেন, যে মানে তিনি রয়েছেন। যদি জানতাম তবে তার থেকে পৃথক হতাম না। (মুকাদ্দিমা মাসাইলে আহমাদ ওয়া ইসহাক, ১/১৪২)

৯.

হুমায়দী ছিলেন মক্কা শরীফের খ্যাতনামা হাফেজে হাদীসগণের অন্যতম। তিনি ইমাম বুখারীর বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন। ইমাম আহমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ইমাম শাফেয়ীর এমনই পাগল হলেন যে, ইমাম শাফেয়ী যখন শেষ জীবনে স্থায়ীভাবে মিসরে চলে যান, তখন তার সঙ্গে হুমায়দীও চলে গিয়েছিলেন। তার আশা ছিল ইমাম শাফেয়ীর ওফাতের পর তিনি তার স্থলাভিষিক্ত হবেন, কিন্তু মিসরে ইমাম শাফেয়ীর বিশিষ্ট শিষ্য ইবনে আব্দুল হাকামের কারণে তা হয়ে ওঠে নি। (আজমী, মুকাদ্দিমা মুসনাদিল হুমায়দী) যাহাবী রহ. সিয়ারে লিখেছেন, وهو معدود في كبار أصحاب الشافعي তিনি ইমাম শাফেয়ীর শীর্ষস্থানীয় শিষ্যদের মধ্যে গণ্য। (তাযকিরাতুল হুফফাজ, ২/৩)

১০.

ইয়াহয়া ইবনে মাঈন ছিলেন প্রখ্যাত হাফেজে হাদীস। ইমাম আহমাদ ও আলী ইবনুল মাদীনীর সঙ্গে ছিল তার গভীর বন্ধুত্ব। তিনি ইমাম বুখারী ও মুসলিমের উস্তাদ ছিলেন। ইমাম আহমাদ সম্পর্কে আবু জাফর বলেছেন, كان يفعل بيحيى بن معين مالم أره يعمل بغيره من التواضع والتكريم والتبجيل ইমাম আহমাদ ইয়াহয়া ইবনে মাঈনের সঙ্গে এমন বিনয় ও সম্মানের আচরণ করতেন, যা অন্য কারো সঙ্গে করতে আমি দেখি নি। (যাহাবী, সিয়ার, ৯/৫২২)

এই ইবনে মাঈন সম্পর্কে হাফেজ যাহাবী বলেছেন, كان أبو زكريا حنفيا في الفروع আবু যাকারিয়া (ইয়াহয়া ইবনে মাঈন) ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফী ছিলেন। (সিয়ার, ৯/৩৫৯) একই মন্তব্য করেছেন তিনি তার তারীখুল ইসলাম গ্রন্থেও। (দ্র. ৫/৯৫৬)

ইবনে মাঈন বলেছেন, القراءة عندي قراءة حمزة والفقه فقه أبي حنيفة وعلى هذا أدركت الناس হামযার (সাত কারীর একজন) কিরাআতই হলো আমার দৃষ্টিতে কিরাআত, আর আবু হানীফার ফিকাহই হলো ফেকাহ। এ কথার উপরই আমি মানুষকে পেয়েছি। (কাযী সায়মারী, আখবারু আবী হানীফা ওয়া আসহাবুহু, ১/৮৭; ইবনে খাল্লিকান, ওয়াফায়াতুল আ’য়ান, ইমাম আবু হানীফার জীবনী)

ইবনে মাঈন যে আবু হানীফার ফিকাহ অনুসরণ করতেন সেটা তার নিম্নোক্ত উক্তি থেকেও বোঝা যায়। তার শিষ্য ইবনে মুহরিয বলেছেন, سمعت يحيى يقول : ما قرأت خلف إمام قط جهر أو لم يجهر আমি ইয়াহয়াকে বলতে শুনেছি যে, আমি কখনো ইমামের পেছনে কোরআন পড়ি নি, চাই তিনি সরবে কিরাআত পড়ুন বা নীরবে। (তারীখে ইবনে মাঈন বি রিওয়ায়াতি ইবনে মুহরিয, ১/১৫৬)

১১.

হাফেজ আবু যুরআ রাযী ছিলেন অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী। হাফেজ আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে উমর রাযী বলেছেন, لم يكن في هذه الأمة أحفظ من أبي زرعة الرازي এই উম্মতের মধ্যে আবু যুরআ রাযীর চেয়ে বড় হাফেজে হাদীস ছিল না। তিনি আরো বলেছেন, وحفظ كتب أبي حنيفة في أربعين يوما فكان يسردها مثل الماء তিনি আবু হানীফার কিতাবগুলো চল্লিশ দিনে মুখস্থ করে ফেলেছেন। তিনি সেগুলো পানির মতো মুখস্থ বলে যেতেন। (মিযযী, তাহযীবুল কামাল)

যাহাবী সিয়ার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, قال أبو زرعة وقيل له اختيار أحمد وإسحاق أحب إليك أم قول الشافعي؟ قال بل اختيار أحمد وإسحاق (৯/৪৫২) আবু যুরআকে জিজ্ঞেস করা হলো, আহমাদ ও ইসহাকের মত আপনার কাছে বেশী পছন্দের নাকি শাফেয়ীর মত? তিনি বললেন, আহমাদ ও ইসহাকের মত। (৯/৪৫২)

১২.

খতীব বাগদাদী স্বীয় সনদে বর্ণনা করেছেন যে, ওয়াকী ইবনুল জাররাহ বলেছেন, كان لنا جار من خيار الناس وكان من الحفاظ للحديث আমাদের একজন উত্তম প্রতিবেশী ছিলেন, তিনি হাদীসের হাফেজও ছিলেন। এই প্রতিবেশী তার স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন। একবার তাদের মধ্যে একটু ঝগড়া হলো। ফলে লোকটি বলে ফেললেন, আজ রাতেই যদি তুমি আমার নিকট তালাক চাও, আর আমি তালাক না-ও দিই, তবুও তুমি তিন তালাক। তার স্ত্রীও বলে ফেললেন, আজ রাতে যদি আমি তালাক না চাই, তবে আমার সব গোলাম আজাদ (মুক্ত) ও আমার সব সম্পদ সদকা। এরপর রাতেই তারা আমার নিকট আসলেন। মহিলাটি বললেন, আমি এই বলে ফেলেছি।

আর প্রতিবেশী বললেন, আমি এই বলে ফেলেছি। আমি বললাম, আমার কাছে এর কোন সমাধান নেই। চলুন এই শায়খের: অর্থাৎ আবু হানীফার: কাছে যাই। আশা করি তার কাছে আমরা এর সমাধান পাব।

লোকটি আবু হানীফার কিছু বিরূপ সমালোচনা করতেন এবং আবু হানীফার সেকথা জানাও ছিল। তিনি বললেন, আমার লজ্জা বোধ করে। আমি বললাম, আপনি তো আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন। তবুও তিনি যেতে চাইলেন না। অবশেষে আমি তাদেরকে নিয়ে ইবনে আবু লায়লা ও সুফিয়ানের নিকট গেলাম। তারা উভয়েই বললেন, এ বিষয়ে আমাদের নিকট কোন সমাধান নেই। পরে আমরা আবু হানীফার কাছেই গেলাম। এবং পুরো ঘটনা খুলে বললাম। আমি তাকে একথাও জানালাম যে, আমরা সুফিয়ান ও ইবনে আবু লায়লার নিকটও গিয়েছিলাম। তারা কোন জবাব দিতে পারেন নি।

তিনি (লোকটিকে) বললেন, আপনার সমস্যার সমাধান দেওয়াই আমার কর্তব্য, যদিও আপনি আমার সঙ্গে দুশমনি করতেন। এরপর তিনি লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কিভাবে বলেছেন? স্ত্রীকেও জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কিভাবে বলেছেন? সবশুনে তিনি বললেন, আপনারা কি আল্লাহর ধরা থেকে নিষ্কৃতি চান এবং বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে বাঁচতে চান? তারা বললেন, হ্যাঁ। তিনি (মহিলাকে) বললেন,
سليه أن يطلقك فقالت طلقني فقال للرجل قل لها أنت طالق ثلاثا إن شئت فقال لها ذلك فقال للمرأة قولي لا أشاء فقال : قد بررتما وخرجتما من طلبة الله لكما

আপনি স্বামীর নিকট তালাক চান। মহিলা বললেন, তুমি আমাকে তালাক দাও। অতঃপর তিনি স্বামীকে বললেন, আপনি বলুন, তুমি যদি চাও তবে তোমাকে তিন তালাক। তিনি স্ত্রীকে তাই বললেন। তিনি (আবু হানীফা) মহিলাকে বললেন, আপনি বলুন, আমি চাই না। এরপর বললেন, আপনারা শপথ ভেঙ্গে যাওয়া থেকে রক্ষা পেলেন এবং আল্লাহর ধরা থেকেও বেঁচে গেলেন।

ওয়াকী রহ. বলেন, فكان الرجل بعد ذلك يدعو لأبي حنيفة في دبر الصلوات وأخبرني أن المرأة تدعو له كلما صلت এরপর থেকে এ ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের পর আবু হানীফার জন্য দুআ করতেন এবং আমাকে একথাও জানিয়েছেন যে, তার স্ত্রীও যখনই নামায পড়েন তাঁর জন্য দুআ করেন। (আল ফাকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ, ২/১৯৪)

লক্ষ করুন, এই ব্যক্তি নিজেও হাদীসের হাফেজ ছিলেন। ওয়াকী ও সুফিয়ান ছাওরীও হাদীসের হাফেজ হওয়ার পাশাপাশি উচ্চ মানের ফকীহও ছিলেন। ইবনে আবু লায়লাও ছিলেন কুফার কাযী ও বিচারক। এতদসত্ত্বেও তারা কেউ উক্ত সমস্যার সমাধান দিতে পারেন নি।

ওয়াকীসহ এই বারজন খ্যাতনামা হাফেজে হাদীসের কেউ কোন ফকীহর শিষ্য হয়েছেন, কেউ তাদের রচিত গ্রন্থ সংগ্রহ করে মুখস্থ বা গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। কেউ বা কোন ফকীহর মতানুসারে ফতোয়া দিয়েছেন। এছাড়া শত শত মুহাদ্দিস ও হাফেজে হাদীস যারা চার ইমামসহ অন্যান্য ফকীহগণের নিকট ফেকাহ শিখেছেন বা তাদের মাযহাব অবলম্বন করেছেন তাদের কথা তো বলাই বাহুল্য।

যদি হাদীস জানা বা মুখস্থ থাকাই যথেষ্ট হতো, তবে এসব হাফেজে হাদীসের জন্য কেন তা যথেষ্ট হলো না? তাদের চেয়ে বড় কোন হাফেজে হাদীসের কথা কি আজ কল্পনা করা যায়?

আরো পড়ুনঃ

ইমাম আবু হানীফা ছিলেন যুগের সবচেয়ে বড় মুজতাহিদ ও ফকীহ

0Shares

আরও জানুন

বিতর নামাযের পর নফল পড়লে কোন সওয়াব হবে না?

প্রশ্ন আস-সালামু আলাইকুম, মুহতারাম, একজন শায়েখ ভক্ত বলতেছেন, বিতরের পর নফল নামাজ আদায় করা যাবে …