প্রচ্ছদ / আহলে হাদীস / ওরা আহলে হাদীস না আহলে তাকলীদ? [শেষ পর্ব]

ওরা আহলে হাদীস না আহলে তাকলীদ? [শেষ পর্ব]

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

৩য় পর্বটি পড়ে নিন

গায়রে মুকাল্লিদদের তাকলীদের আরো কিছু নমুনা

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহঃ এর তাকলীদ

মাওলানা ওহীদুজ্জামান সাহেব লিখেছেনঃ

“ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রঃ এর বক্তব্য হল, জুমআর নামাযের সময় সূর্য মধ্যাকাশ থেকে হেলে পড়ার আগেও জায়েজ আছে।” {তাইসীরুল বারী-২/১৬}

আহলে হাদীস ভাইয়েরা ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহঃ এর তাকলীদ করে নিজেদের মাযহাব এটাকেই বানিয়ে নিয়েছে। তাদের মতেও জুমআর নামায সূর্য ঢলে যাওয়ার আগেই জায়েজ আছে। {ফাতাওয়া আহলে হাদীস-২/২২, আননাহজুল মাকবূল-২৮, আররাওজাতুন নাদিয়্যাহ-১/১৩৭, নুজুলুল আবরার-১/১৫২}

অথচ কোন সহীহ হাদীসে সূর্য হেলে পড়ার আগে জুমআর নামায শুদ্ধ হওয়ার কোন দলীল নেই। বরং এর বিপরীত সহীহ বুখারীর কিতাবুল জুমআতে এসেছে

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: «أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُصَلِّي الجُمُعَةَ حِينَ تَمِيلُ الشَّمْسُ»

হযরত আনাস বিন মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত। নিশ্চয় রাসূল সাঃ জুমআর নামায পড়তেন সূর্য যখন সূর্য ঢলে পড়ে। {সহীহ বুখারী, -১/৩০৭, হাদীস নং-৯০৪}

সরাসরি সহীহ হাদীসের বিপরীত হওয়ার পরও কথিত আহলে হাদীসরা যারা ইংরেজদের রাজত্বকে আল্লাহর রহমত মনে করে [আলহায়াত বাদাল মামাত-১৬২] তারা শুধুমাত্র হানাফীদের বিরোধিতা করে এ উপমহাদেশের মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে মুসলমানদের শক্তিকে খর্ব করতে চায়। আর ইংরেজদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে চায়। এছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য এতে বাহ্যিকভাবে নেই।

ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর তাকলীদ

শহীদের জানাযার নামায পড়া একাধিক হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। গায়রে মুকাল্লিদ আলেম মাওলানা একথা স্বীকার করে বলেন-

“আসল কথা হল, শহীদদের জানাযার নামায পড়া সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।” {আহকাম ও মাসায়েল-৩৮০}

কিন্তু কথিত আহলে হাদীস ভাইয়েরা শুধুমাত্র হানাফীদের বিরোধীতা করার জন্য ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর তাকলীদ করে লিখে দিয়েছে যে, শহীদের জানাযার নামায পড়া উচিত নয়। {দস্তুরুল মুত্তাকী-১৭৮, কানযুল হাকায়েক-৪৩, সালাতুর রাসূল-৪৪১, তাইসীরুল বারী-২/৩০০}

ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর তাকলীদ

গায়রে মুকাল্লিদদের ইমামদের একজন মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী সাহেব লিখেছেনঃ আর যেখানে আমরা কুরআন ও হাদীসের কোন ইবারত পাই না, সেখানে সাহাবায়ে কেরাম এবং মুজতাহিদ ইমামগণের তাকলীদ করি। বিশেষ করে হানাফী মাযহাবের ইমামদের। যাদের উসূল এবং ফুরূয়ের কিতাব আমাদের পড়াশোনায় বিদ্যমান থাকে। {ইশাআতুস সুন্নাহ-২৩/২৯০}

বাটালবী সাহেব আরো স্পষ্ট ভাষায় অনুসারীদের নসিহত করে লিখেছেনঃ

“অধমের ২০ নং খন্ডের ছয় নং রিসালার ১২০ তম পৃষ্ঠায় আমার কিছু ভাই এবং আহলে হাদীস বন্ধুদের পরামর্শ দিয়েছি যে, যদি তাদের ইজতিহাদে মুতলাকের দাবি না থাকে, তাহলে যেখানে কুরআন এবং হাদীসের স্পষ্ট ইবারত না পাওয়া যায়, তাহলে সেখানে মুজতাহিদীনদের তাকলীদ করাতো কোন সমস্যা নেই। সেক্ষেত্রে হানাফী মাযহাব বা শাফেয়ী মাযহাবের দিকে নিজেদের সম্পর্কিত করবে। {ইশাআতুস সুন্নাহ-২৩/২৯১}

অবাক কান্ড। গায়রে মানসূস মাসআলা তথা কুরআন ও হাদীসে নেই, এমন মাসআলা এবং কুরআন ও হাদীসে বিপরীতমুখী বর্ণনা এমন মাসআলায় আমরা মুজতাহিদের তাকলীদ করলে হাদীস বিরোধী, আর নামধারী আহলে হাদীসরা করলে হাদীসের নামের বরকতে তারা থেকে জান আহলে হাদীস রূপেই।

আরো মজার ঘটনা দেখুন-

মাওলানা বাটালবী সাহেব আরো এক কদম বেড়ে লিখেনঃ

“যে মাসআলায় আমি কোন সহীহ হাদীস না পাই, সে মাসআলায় মাযহাবের ইমামদের বক্তব্যের মধ্য থেকে কোন একটি বক্তব্যকে এ ভাল ধারণা করে নেই যে, এ মাসআলায় ইমামের কাছে এ ব্যাপারে দলীল আছে তাই তার তাকলীদ করি। এমনই আমাদের শাইখুল কুল [মিয়া নজীর আহমদ সাহেব] সারা জীবনের আমল ছিল। {ইশাআতুস সুন্নাহ-২২/৩১০}

এ ইবারতের পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিটি তারীখে খতমে নবুয়াহ গ্রন্থের ৪৩৮ নং পৃষ্ঠায় দেখা যেতে পারে।

এর দ্বারা প্রমাণিত হল যে, গায়রে মুকাল্লিদ প্রচারকদের প্রধানদের একজন মিয়া নজীর আহমাদ এবং মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী সাহেব যে মাসআলায় কুরআন ও হাদীসে দলীল না পান, সেক্ষেত্রে তারা তাকলীদের রশি গলা পরিধান করে নিতেন।

তাকলীদের প্রতি বাটালবী সাহেবের আগ্রহের কারণ কি?

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যিনি তাকলীদের বিরুদ্ধে সবচে’বেশি শোরগোল করেছেন তার ইশাআতুস সুন্নাহ পত্রিকা দিয়ে। গায়রে মুকাল্লিদ মাযহাবকে ছড়িয়েছে পুরো উপমহাদেশে। সেই লোক তাকলীদের এত পক্ষে মানুষ হল কিভাবে? এর কারণ কি?

আসল কারণটি হল, আহলে হাদীসদের বড় বড় আলেম, বিতার্কিক, লেখক, প্রচারক, বক্তা, অনুসারী এরকম বিভিন্ন প্রকারের লোক গায়রে মুকাল্লিদিয়্যত প্রচার করতে করতে এক সময় সকল মতকেই গুডবাই বলে কাদিয়ানী হয়ে গেছে। কাদিয়ানী হওয়া এসব ব্যক্তিদের অধিকাংশ ছিল বাটালবী সাহেবের সরাসরি ছাত্র।

একথার স্বীকারোক্তি খোদ বাটালবী সাহেব তার সম্পাদিত পত্রিকা ইশাআতুস সুন্নাহ এর ১৫ নাম্বার খন্ডের ১৪৫ পৃষ্ঠায় স্পষ্ট ভাষায় করেছেন। যার ছাপা কপির ছবি তারীখে খতমে নবুয়াহ এর ২৬৬ নং পৃষ্ঠায় বিদ্যমান।

খাস আহলে হাদীস ব্যক্তিদের ছাড়া সাধারণ আহলে হাদীসদের মাঝে যারা কাদিয়ানী হয়ে গেছে তাদের সংখ্যাতো বলা কঠিন। তবে সংক্ষিপ্তভাবে মাওলানা বাটালবী সাহেব এই লিখেছেনঃ

“মির্যা কাদিয়ানীকে অনুসরণের মুসিবত অধিক হারে ছড়িয়েছে ঐ ফিরক্বার মাঝে, যারা সাধারণ ও মুর্খ হয়েও মুতলাকান তাকলীদকে ছেড়ে দিয়ে গায়রে মুকাল্লিদ হয়ে গেছে। অথবা ঐ সকল লোক যাদের নীচরী বলা হয়, যারা মূলত গায়রে মুকাল্লিদদেরই একটি শাখা”। [ইশাআতুস সুন্নাহ-১৫/২৭১}

এ ইবারতের প্রকাশিত ছবিটি তারীখে খতমে নবুয়াহ গ্রন্থের ৩৮১ নং পৃষ্ঠায় দেখতে পারেন।

মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী সাহেব যখন নিজেদের আহলে হাদীসদের চোখের সামনে দলে দলে কাদিয়ানী, খৃষ্টান আর মুরতাদ হতে দেখলেন। তখন তার পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতার কথা নি¤েœর শব্দে উল্লেখ করেনঃ

“পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতা দ্বারা আমার একথা বুঝে এসেছে যে, যে ব্যক্তি ইলম না থাকা সত্বেও মুজতাহিদে মুতলাকের দাবি করে, আর মুতলাক তাকলীদকে ছেড়ে দেয়, উক্ত ব্যক্তি অবশেষে ইসলাম ধর্মকেই গুডবাই জানিয়ে বসে। কুফরী, ইরতিদাদ এবং ফাসেকীর আরো অনেক কারণ দুনিয়াতে বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু দ্বীনদারদের বেদ্বীন হয়ে যাওয়ার সবচে’বড় মারাত্মক কারণ হল ইলমহীন হওয়া সত্বেও তাকলীদ ছেড়ে দেয়া। আহলে হাদীস দলের মাঝে যারা বে-ইলম বা কম ইলমের অধিকারী হয়েও তাকলীদ ছেড়ে দেয়ার দাবি করে, তাদের পরিণাম এমনি হয়। এ দলের সাধারণ লোকেরা স্বাধীনচেতা আর স্বীয় মত পূজারী হয়ে যায়। {ইশাআতুস সুন্নাহ-২/১১, প্রকাশ সাল-১৮৮৮ ঈসাব্দ}

তাকলীদ ছেড়ে দেয়া ইলমহীন আহলে হাদীসদের এ ভয়ংকরভাবে মুরতাদ হওয়ার প্রবণতা দেখে বাটালবী সাহেব তাকলীদ বিষয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেন। তখন তিনি লক্ষ্য করেন যে, তাকলীদের মাঝেই ঈমান ও আমলের নিরাপত্তা বিদ্যমান রয়েছে। এ কারণেই তিনি তাকলীদের সহযোগী হয়ে যান। সেই সাথে তিনি নিজেও হানাফী ফক্বীহদের তাকলীদ করতে শুরু করে দেন।

এ কারণেই আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলি যে, মুসলমান নাস্তিক হওয়া, মুরতাদ হওয়া, বিধর্মী হওয়ার প্রধান কারণের মাঝে একটি হল গায়রে মুকাল্লিদ হওয়া। গায়রে মুকাল্লিদ না হয়ে কেউ সহজে নাস্তিক হতে পারে না। ইলম না থাকা সত্বেও যখন নিজেকে মুজতাহিদ মনে করতে থাকে, আর কুরআন ও হাদীসের সকল মর্মার্থ বুঝে গেছে মনে করে, তখনি সে নাস্তিকতা, খৃষ্টান হওয়া আর কাদিয়ানী হওয়ার দিকে ধাবিত হয়। কারণ নিজের সমঝ ও বুঝকে কারো সমঝের সাথে যখন মিলানোর বা মান্য করার মানসিকতা যখন মনে না থাকে, তখন মন যেদিকে টানে সেদিকেই ধাবিত হয়ে পড়ে। নাস্তিকতার দিকে ধাবিত হলে নাস্তিক হয়ে যায়। খৃষ্টান হওয়ার দিকে ধাবিত হলে খৃষ্টান হওয়ার দিকে ধাবিত হলে খৃষ্টান হয়ে যায়। আর কাদিয়ানীর দিকে ধাবিত হলে কাদিয়ানী হয়ে যায়।

কিন্তু একজন মুকাল্লিদ তা সহজে পারবে না। কারণ সে তার নিজের বুঝকে পূর্ণাঙ্গ কখনোই মনে করে না। বরং বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির ব্যাখ্যাকে নিজের ব্যাখ্যার উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তাই কুরআন হাদীস পড়ে তার মনে খটকা লাগলে তা মুজতাহিদ বা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির বক্তব্যের আলোকে মিলিয়ে দেখে। সেই সাথে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির ব্যাখ্যার তাকলীদ করে কুরআনের সেই অর্থই বুঝে নেয়, যা মুজতাহিদ বুঝে ছিলেন। কিন্তু গায়রে মুকাল্লিদ ব্যক্তি এ নেয়ামত থেকে হয় বঞ্চিত।

আর সবচে’ভয়ংকর দিক হল, খৃষ্টানরা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় তাদের ধর্মমত প্রচার করে কুরআনের আয়াতের দলীলের ভিত্তিতে। হাদীসের দলীলের ভিত্তিতে। ঠিক তেমনি কাদিয়ানী তাদের ধর্মমত প্রচার করে কুরআন ও হাদীস দিয়েই। তাই গায়রে মুকাল্লিদরা স্বীয় মনের পূজা করে সহজেই খৃষ্টান বা কাদিয়ানীদের পাতা ফাঁদে পা দেয়। যা মুকাল্লিদের পক্ষে সহজ নয়।

আল্লাহ তাআলা আমাদের গায়রে মুকাল্লিদিয়্যাত ফিতনা থেকে হিফাযত করুন। আমীন। ছুম্মা।

0Shares

আরও জানুন

বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে একথাগুলো কি আমরা জানি?

সংগৃহিত  আমরা জানি না লালন আসলে কে? লালন ছিলেন বাউল সম্প্রদায়ের গুরু।আমরা কি জানি কারা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *