প্রচ্ছদ / ইতিহাস ও ঐতিহ্য / ইসলামের ইতিহাস পাঠ [পর্ব-১১] নেতৃস্থানীয় সাহাবা তাবেয়ীগণের ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত

ইসলামের ইতিহাস পাঠ [পর্ব-১১] নেতৃস্থানীয় সাহাবা তাবেয়ীগণের ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত

আবূ মুয়াবিয়া লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

আগের লেখাটি পড়ে নিন- ইয়াযিদের শাসন এবং হুসাইন রাঃ এর বাইয়াত হতে অস্বিকৃতি

হযরতে হুসাইন রাঃ কি রাষ্ট্রদ্রোহী ছিলেন?

এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। সেটি হল, ইয়াযিদের শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়ে যাবার পর হযরত হুসাইন রাঃ এর বিরোধীতা কি রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে ধর্তব্য হবে?

সত্য কথা হল, হযরত হুসাইন রাঃ এর বিরোধীতার শুরু লগ্ন থেকে শেষ পর্যন্ত যখন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে ঘটনা মোড় নিতে থাকে, তখনো তার অবস্থান এতোটাই সতর্ক ও ভারসম্যতার সাথে আঞ্জাম দিয়েছেন যে, তার কার্যকলাপের উপর রাষ্ট্রদ্রোহিতার মত ভয়াবহ অভিযোগ তোলার কোন সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে সমঝদারীর সাথে চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, হযরত হুসাইন রাঃ এর মতামত ও ইজতিহাদ অনুপাতে ইয়াযিদের খেলাফত পূর্ণ প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি।

কারণ, মুয়াবিয়া রাঃ এর জীবদ্দশায় নেয়া পরবর্তী খলীফা নির্ধারণ বিষয়ক বাইয়াত শুধুমাত্র একটি পরামর্শ ছিল। এর দ্বারা ইয়াযিদের খেলাফত সাব্যস্ত হয়ে যায় না।

আর তিনি যেহেতু ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেননি, তাই এখানো খলীফা হিসেবে ইয়াযিদ তার কছে স্বীকৃত হয়নি। এছাড়া কুফা থেকে যে চিঠি আসছিল, তা দ্বারা সাফ জানা যাচ্ছিল যে, পুরো ইরাকবাসী হযরতে হুসাইন রাঃ এর জন্য অপেক্ষমান। এখনো ইরাকে ইয়াযিদের বাইয়াতে খেলাফত পূর্ণতা পায়নি। তারা কেউ ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেনি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ইয়াযিদ যেহেতু তখনো পূর্ণ খলীফা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি, তাই তার বিরোধীতা রাষ্ট্রদ্রোহীতার অন্তর্ভূক্ত হবে না।

যেমন ইতোপূর্বে হযরত উসমান রাঃ এর হত্যার বিচার হবার আগে হযরত আলী রাঃ এর হাতে বাইয়াত হতে অস্বিকৃতি জানিয়েছিলেন আম্মাজান আয়শা রাঃ এবং মুয়াবিয়া রাঃ, তালহা ও যুবায়ের রাঃ। বাইয়াত না হওয়া এবং শামের লোকদের হযরত আলী রাঃ এর বাইয়াত হতে না চাওয়ার ফলে আয়শা রাঃ ও মুয়াবিয়া রাঃ এর বিরোধীতাকে রাষ্ট্রদ্রোহীতা হিসেবে ধরা কঠিন।

কারণ, তাদের ইজতিহাদী রায় হিসেবে উসমান রাঃ এর বিচার আগে করা বিষয়ে আলী রাঃ এর বিরোধীতা করাকে তারা রাষ্ট্রদ্রোহীতা মনে করেননি। কারণ, তাদের কাছে তখনো আলী রাঃ এর খিলাফত পূর্ণতা লাভ করেনি।
কিন্তু আসল হাকীকত ছিল ভিন্ন। শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে হযরত আলী রাঃ যথার্থ ছিলেন। আর মুয়াবিয়া রাঃ ও আম্মাজান আয়শা রাঃ এর ইজতিহাদী ভুল হয়েছিল।

আর মুজতাহিদ ভুল করলে কোন গোনাহ হয় না। বরং ভুল করলেও তারা সওয়াবের অংশীদার হয়ে থাকেন।
হযরত হুসাইন রাঃ এর বক্তব্য ও অবস্থান অনুপাতে ইয়াযিদের খেলাফত পূর্ণ হয়নি তখনো। কারণ, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান দুই শহর মক্কা ও মদীনার অধিকাংশ লোকেরা ইয়াযিদকে দিল থেকে খলীফা মানতে পারছিল না।

আর ইরাকের সংবাদ তিনি চিঠির মাধ্যমে জানতে পারছিলেন। কুফার গভর্ণর হযরত নু’মান বিন বশীর রাঃ ও ইয়াযিদের বিপরীতে হযরত হুসাইন রাঃ কে খলীফা মানতে প্রস্তুত ছিলেন। [আলমিহান-১৫০]

সেই হিসেবে হযরত হুসাইন রাঃ এ কাছে ইয়াযিদ জোরপূর্বক শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তি হিসেবেই প্রতিয়মান হয়।

এ হিসেবে হযরত হুসাইন রাঃ এর কাছে পরিস্কার হয় যে,

১ ইয়াযিদ মুসলমানদের ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে।

২ ইয়াযিদের খেলাফত এখানো পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

সুতরাং এখনি যদি তা রুখে দেয়া যায়, এবং পূর্বসূরী খোলাফায়ে রাশেদীনের পদ্ধতি অনুসারে রাষ্ট্রনায়ক নির্বাচনের পদ্ধতিকে পুনর্জিবীত করা যায়, তাহলে তা যুৎসই ও যথার্থ হবে। আর এজন্য চেষ্টা ও মেহনত করাটা রাষ্ট্রদ্রোহীতার অন্তর্ভূক্ত হবে না। যে রাষ্ট্রদ্রোহীতাকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।

এখন প্রতিবাদ প্রতিরোধ করাটা কোন প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে ফেলতে চেষ্টা করা নয়, বরং একটি বিভক্ত রাষ্ট্রকে একত্রিত করে খোলাফায়ে রাশেদীনের সোনালী পদ্ধতিতে ফিরিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা মাত্র।

এছাড়া হযরত হুসাইন রাঃ এর সামনে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এর ফরমানও ছিল যে, কোন অপছন্দনীয় কাজ দেখলে তা প্রতিহত করতে করতে হবে সাধ্যানুপাতে। প্রথমে হাত দিয়ে, না পারলে জবান দিয়ে, সর্বনিম্ন হলো মনের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে।

হযরত হুসাইন রাঃ এবং হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রাঃ তাই নিজের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে তাদের দৃষ্টিতে এ মাকরূহ কার্যক্রমকে বন্ধ করাকে নিজের উপর জরুরী বলে মনে করতে লাগলেন। এজন্য নিজের প্রাণকে উৎস্বর্গ করতেও দ্বিধাবোধ করবেন না।

মদীনায় ধরপাকড় এবং ওলীদ বিন উতবাকে বরখাস্তকরণ

ওলীদ হযরত হুসাইন রাঃ এবং হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রাঃ মক্কা রওনা হয়ে যাবার পর মাসআব বিন আব্দুর রহমান এবং আব্দুল্লাহ বিন মুতী’ আলআদয়ী রাঃ কে গ্রেফতার করে জেলে বন্দী করলেন। যারা আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রাঃ এর সমর্থক ছিলেন।

মদীনাবাসী হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রাঃ এর কাছে আবেদন করলেন যে, যেন প্রশাসন এভাবে কঠোরতা করা থেকে যেন বিরত থাকে।

হযরত ইবনে উমর রাঃ পেরেশান হয়ে ওলীদ বিন উতবার সাথে সাক্ষাৎ করেন। বললেন, ‘স্বীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত রাখতে হকের উপর অটল থাকো, জুলুম করো না। যাদের গ্রেফতার করেছো তারা নির্দোষ। তাদের ছেড়ে দাও’।

ওলীদ বিন উতবা ওজরখাহী পেশ করল। আমীরুল মু’মিনীন ইয়াযিদের আদেশ এমনটাই। তাই লঙ্ঘণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

মদীনাবাসী যখন দেখলো যে, আব্দুল্লাহ বিন উমর রাঃ এর মত ব্যক্তিত্ব এর সুপারিশ পর্যন্ত ফিরিয়ে দেয়া হল। তখন তারা জেলখানায় হামলা করে বসে। এর ফলে আব্দুল্লাহ বিন মুতী’ মুক্ত হয়ে মক্কায় চলে যান। আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রাঃ এর সাথে গিয়ে মিলে যান। [আনছাবুল আশরাফ-৫/৩০২]

হযরত হুসাইন রাঃ এবং ইবনে যুবায়ের রাঃ এর মদীনা থেকে বের হয়ে যাওয়ায় ইয়াযিদের চিন্তা বেড়ে যায়। উক্ত হযরতদ্বয়ের বাইয়াত নিতে অকৃতকার্য হবার সমস্ত দায়ভার ওলীদ বিন উতবার উপর চাপিয়ে তাকে বরখাস্ত করে দেন। তার স্থলে আমর বিন সাঈদ আললআশদাক কে নিয়োগদান করেন। যে কঠোর স্বভাবের অধিকারী বলে প্রসিদ্ধ ছিল। [তারীখে তাবারী-৫/৩৪৩] আমর বিন সাঈদ রমজানে মদীনা আগমন করে। [তারীখে তাবারী-৫/৩৪৩]

এসেই ঘোষণা দেয় যে, সে যেখানে তারা আশ্রয় নিয়েছেন সেই স্থানে হামলা করবে। [তারীখে খলীফা বিন খাইয়্যাত-২২৩] কিন্তু তার জন্য হামলা করার সুযোগ ছিল না। কারণ, শাওয়াল মাস নিকটবর্তী। হাজীদের কাফেলা মক্কায় আগমনের অপেক্ষমান। এমতাবস্থায় পবিত্র শহরে পবিত্র মাসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশের উপর হামলা করা কিছুতেই বরদাশত করবে না। তাই ইচ্ছে থাকা সত্বেও আমর বিন সাঈদ হামলা থেকে বিরত থাকে। হজ্জ্বে মওসূম শেষ হওয়া এবং হাজীদের ফিরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া ইয়াযিদ প্রশাসনের আর কোন উপায় ছিল না।

হযরত হুসাইন রাঃ ইরাক যাবার সংকল্প কেন করলেন?

এই উত্থান পতনের পরিস্থিতি নিয়ে হযরত হুসাইন রাঃ এবং আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রাঃ এর মাঝে দফায় দফায় পরামর্শ হয়। অবশেষে তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, একটি স্থানকে কেন্দ্র বানিয়ে নিজেদের মেহনত চালিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু কেন্দ্র কোন স্থানকে বানানো হবে? এ বিষয় নিয়ে উভয়ের মাঝে মতভেদ দেখা দেয়। আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রাঃ এর মত ছিল এই যে, মারকায মক্কাকে বানানো হোক। কারণ, মক্কাই সব’েচ নিরাপদ। মক্কা পুরো মুসিলম মিল্লাতের ঈমানী ও রূহানী কেন্দ্রভূমি। মক্কায় যেমন সাহায্যকারী নিজেদের গোত্র কোরাইশরা রয়েছে, তেমনি মুত্তাকী পরহেযগারদের এক বড় জামাতও বিদ্যমান।

তাই তিনি চাইলেন যে, হযরত হুসাইন রাঃ ও যেন মক্কাকেই কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণ করেন।

কিন্তু হযরত হুসাইন রাঃ এর কাছে ইরাক থেকে একের পর এক পত্র এবং প্রতিনিধি দল আসছিল। যারা হযরত হুসাইন রাঃ এক সর্বাত্মক সহযোগিতা করার আশ্বাস দেয়ায় তিনি ইরাক যাবার দিকেই মনস্থির করছিলেন।

ইরাকে যাবার পেছনে হুসাইন রাঃ এর প্রথম কারণ এই ছিল যে, আন্দোলনে সাধারণ মানুষের জানমাল হেফাযত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হেযাজের তুলনায় ইরাকে তার অনুসারীদের সংখ্যা বেশি থাকায় শক্তিও বেশি থাকবে। ফলে কম ক্ষতির সম্মুখিন হয়ে সফলতার মুখ দেখা সহজ হবে বলেই তিনি মনে করলেন।

দ্বিতীয়ত হযরত হুসাইন রাঃ নিজের জানের চেয়ে পবিত্র নগরীর পবিত্রতাকে রক্ষা করাকে বেশি জরুরী মনে করলেন। যে কারণেই হযরত উসমান রাঃ নিজের জানের কুরবানীতো পেশ করেছেন, কিন্তু পবিত্র নগরীতে রক্তপাত করাকে সাপোর্ট করেননি।

এ কারণে হযরত আলী রাঃ ও মক্কা মদীনা ছেড়ে কুফাকে রাজধানী বানিয়েছিলেন।

হযরত হুসাইন রাঃ জানতেন যে, এখন হজ্জ চলছে বলে তার উপর হামলা করা বন্ধ আছে। কিন্তু হজ্জ শেষ হতেই তার উপর আক্রমন করা হবে। তাই তিনি পবিত্র নগরীকে রক্তপাত থেকে রক্ষা করতে মক্কা ছেড়ে দেয়াকেই প্রাধান্য দিলেন। মক্কায় থাকাকালীন আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রাঃ কে বললেন, “যদি আমাকে অন্য কোথাও হত্যা করা হয়, তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু আমার কাছে এটা সহনীয় নয় যে, আমার কারণে পবিত্র নগরীর পবিত্রতা বিনষ্ট হোক”। [আখবারে মক্কা, ফাকেহীকৃত-২/২৪২]

এর দ্বারা বুঝা যায় যে, হযরত হুসাইন রাঃ কুফার লোকদের কৃত অঙ্গিকারভঙ্গের সম্ভাবনা এবং ইয়াযিদ প্রশাসনের কঠোরতার ব্যাপারে ওয়াকিফহাল ছিলেন।

যেহেতু ইরাকবাসী তার সাথে গাদ্দারী করতে পারে এ সন্দেহ ছিল। এ কারণেই তিনি ইরাক রওনা হবার বিষয়ে তাড়াহুড়া করেননি। বরং খোঁজখবর নিয়ে ধীরে সুস্থ্যে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

নেতৃস্থানীয় এবং মুরুব্বীগণ ইয়াযিদের হাতে কেন বাইয়াত হলেন?

প্রশ্ন হল, যদি ইয়াযিদের খেলাফতলাভ খোলাফায়ে রাশেদীনের তরীকায় না’ই হয়ে থাকে, তার কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীগণের বিরাট জামাত তার হাতে কেন বাইয়াত হয়েছিলেন?

বাস্তব কথা হল, তাদের মাঝে একদল হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর দলীল ও ইজতিহাদের সাথে একমত ছিলেন। আর কতক শরীয়তের আরেকটি হুকুম পালনের নিমিত্তে বাইয়াত হন। সেটি হল, “একতা ও ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখো। পরস্পর বিভক্ত হয়ো না”।

একতার উক্ত হুকুমটি কুরআন ও হাদীসের অনেক স্থানেই উদ্ধৃত হয়েছে। এ গুরুত্বপূর্ণ হুকুমটি পালনের জন্য কিছু কিছু অবস্থায় নিজের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনুত্তম বস্তুকে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই থেকে নেতৃস্থানীয় সাহাবা ও তাবেয়ীগণ ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে উম্মতকে একতাবদ্ধ রাখতে ভূমিকা রাখেন।

হামীদ বিন আব্দুর রহমানের এক বর্ণনায় এসেছে যে, ইয়াযিদ খলীফা হবার সময় তিনি একজন সাহাবীর কাছে গেলেন। তখন উক্ত সাহাবী বলেন, “তোমরা বল যে, ইয়াযিদ উম্মতের মাঝে সর্বোত্তম ব্যক্তি নয়, ইলম, ফাকাহাত এবং মর্যাদায় সবার চেয়ে উত্তমও নয়। আমিও একথাই বলি। কিন্তু আল্লাহর কসম! আমি উম্মতে মুহাম্মাদীর একত্রিত থাকাকে তাদের বিভক্ত হয়ে যাওয়ার উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকি। [তারীখে খলীফা বিন খাইয়্যাত-২১৭]

মুরব্বীশ্রেণীর ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত হবার আরেকটি কারণ ছিল এই যে, সেসময় ইয়াযিদ বিষয়ে কোন খারাপ ধারণা কারো ছিল না। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা, হাররার ঘটনা এবং কা’বা অবরোধ ইত্যাদির মাধ্যমে তার চরিত্রে যে কালোদাগ অঙ্কিত হয় তাতো প্রকাশ পায় খলীফা হবার পর। কিন্তু খলীফা হবার আগে ইয়াযিদের চারিত্রিক কোন মারত্মক পদস্খলনও সংঘটিত হয়নি।

সে ছিল পরীক্ষিত সেনানায়ক। হজ্জের প্রধান ইমামের দায়িত্বপালনকারী। একজন সাহাবীর সন্তান। তাবেয়ী। নেক ও মুত্তাকী পরিবারের সন্তান।

এইসব গুণাবলীর দিকে তাকিয়ে অনেক সাহাবা ও তাবেয়ীগণ ভালো কিছুই হবে সেই আশায় তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে নিয়েছিলেন।

এছাড়া নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি হাদীস রয়েছে-

عَنْ أَنَسٍ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ اسْمَعُوا وَأَطِيعُوا، وَإِنِ اسْتُعْمِلَ حَبَشِيٌّ كَأَنَّ رَأْسَهُ زَبِيبَةٌ ‏”‏‏

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা শোন ও আনুগত্য প্রকাশ কর, যদিও তোমাদের উপর এমন কোন হাবশীকে আমীর নিযুক্ত করা হয় যার মাথা কিসমিসের মতো। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৬৯৩, ইফাবা-৬৬০]

এ হাদীসের আলোকে বুঝা যায় যে, যখন কোন খলীফা যেভাবেই হোক যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে তাকে মেনে নেয়া উচিত। তার বিরোধীতা করা যাবে না। যদিও সে দেখতে কুৎসিত হয় না কেন।

উক্ত হাদীসের উপর আমল হিসেবেও অনেক সাহাবা ও তাবেয়ীগণ ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত হওয়াকেই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশের বাস্তবায়ন মনে করেছেন। তাই তার হাতে বাইয়াত হয়ে গেছেন।

আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ এবং আব্দুল্লাহ বিন উমর রাঃ এর ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত

ইয়াযিদের প্রতিনিধি যখন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ এর কাছে বাইয়াত নেবার জন্য মক্কা আসে, তখন তিনি উপস্থিত সবাইকে বলেন, “আল্লাহর কসম! মুয়াবিয়া তার আগের খলীফাদের মত ছিল না। কিন্তু তারপর তারমতও আর কেউ আসবে না। নিশ্চয় ইয়াযিদ তার নেক পরিবারের সন্তান। সুতরাং আপনারা সবাই স্বীয় স্থানে আরাম করে বসে থাকুন। ইয়াযিদের বাইয়াত করে তার আনুগত্ব করুন। তারপর তিনি নিজেও বাইয়াত হন। [আনছাবুল আশরাফ-৫/২৯০]

হযরত আব্দল্লাহ উমর রাঃ এর অবস্থান এই ছিল যে, যদি সবাই বাইয়াত হয়ে যায়, তাহলে তিনিও বাইয়াত হয়ে যাবেন। [আসসুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং-১৬৮০৯, আনছাবুল আশরাফ-৫/৩০১]

তাই তিনি যখন দেখলেন যে, অধিকাংশরাই বাইয়াত হয়ে গেছেন, তখন তিনিও বাইয়াত হয়ে যান। [সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং-১৬৬৩২]

বুঝা যায় যে, তার এ বাইয়াত মনের টানে ছিল না। সন্তুষ্টচিত্তে ছিল না। বরং সকলে হয়ে গেছেন দেখে বাধ্য হয়ে তিনিও বাইয়াত হয়েছেন। এ কারণেই তিনি তার বাইয়াত হবার সময় বলেন, “যদি এর মাধ্যমে ভালো হয়, তাহলে আমি রাজি, আর যদি ক্ষতি হয়, তাহলে আমরা ধৈর্যধারণ করবো। [তারীখে খলীফা বিন খাইয়্যাত-২১৭]

আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের প্রতি ইয়াযিদের পত্র

হযরত হুসাইন রাঃ মক্কায় অবস্থান করছিলেন। সে সময় আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ এর কাছে ইয়াযিদ একটি পত্র প্রেরণ করে। যার মাধ্যমে বুঝা যায় যে, সে হুসাইন রাঃ এর কার্যক্রম বিষয়ে নজর রাখছিল। তার থেকে বিদ্রোহের আশংকা করছিল। তাই পত্রের মাধ্যমে এ বিষয়ে কড়া হুশিয়ারী প্রদান করে।

পত্রে ইয়াযিদ লিখে যে,

“হুসাইন রাঃ এর নিকট পূর্ব থেকে লোকজন এসে তাকে খেলাফতের আশা দিচ্ছে। আপনি অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত অভিজ্ঞ মানুষ। যদি হুসাইন রাঃ এমন করেন, তাহলে আত্মীয়তার বন্ধন ছিড়ে যাবে। আপনি বংশের বড় এবং সম্মানিত ব্যক্তি। আপনি তাকে এ বিদ্রোহ থেকে বাঁধা প্রদান করুন।”

আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ উত্তরে লিখলেন,

“আমার প্রত্যাশা যে, হুসাইন রাঃ এর গমণ এমন কোন কাজের জন্য হবে না, যা আপনার জন্য অসন্তুষ্টির কারণ হবে। [তারীখে দামেশক-৪/২১০]

মোটকথা, দামেশক প্রশাসনের কাছে হুসাইন রাঃ এর বিষয়টি খুবই গুরুত্ববহ ছিল। হুসাইন রাঃ এর যোগাযোগ কুফার জনগণের সাথে হওয়ায় ইয়াযিদের ভয় হয় যে, তারা সম্মিলিতভাবে বিদ্রোহ করে বসবে।

এদিকে হযরত হুসাইন রাঃ ভাবলেন যে, ইয়াযিদ ও তার নির্ধারিত গভর্ণরেরা হুসাইন রাঃ এর অবস্থান সম্পর্কে না বুঝেই বিদ্রোহ মনে করে তাদেরকে হত্যা করতে উদ্যত হতে পারে।

কারণ, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তাকে হত্যা করার কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
হযরত আরফাজাহ রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

فَمَنْ أَرَادَ أَنْ يُفَرِّقَ أَمْرَ الْمُسْلِمِينَ وَهُمْ جَمِيعٌ فَاضْرِبُوهُ بِالسَّيْفِ كَائِنًا مَنْ كَانَ

মুসলিমগণ ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় যে ব্যক্তি তাদের কাজে বাধা দিবে সে যে-ই হোক, তোমরা তাকে তরবারি দিয়ে হত্যা করো। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৭৬২, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৫২]

সে যেই হোক না কেন, যদি সে মুসলমানদের একতার মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করতে আসে, তাহলে তাকে হত্যা করতে বলা হয়েছে।

যদিও হযরত হুসাইন রাঃ এর দৃষ্টিতে ইয়াযিদের খেলাফত পূর্ণতা পায়নি। এখনো তার অধীনে উম্মত একতাবদ্ধ হয়নি বলেই প্রতিয়মান হয়েছিল। তাই ইয়াযিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে তিনি একতা বিনষ্টের কারণ হিসেবে গণ্য করেননি।

কিন্তু ইয়াযিদ ও তার প্রশাসনের দৃষ্টিতে তা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা। তাই তারা যেকোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে বলে হযরত হুসাইন রাঃ আশংকা করলেন। এ কারণে, সরাসরি ইয়াযিদের সাথে কথা না বলে আগে কুফা গমণ করে নিজেদের শক্তিমত্তা মজবুত করার পর বিষয়টির সূরাহা করতে চেয়েছিলেন।

পরের লেখাটি পড়তে ক্লিক করুন

0Shares

আরও জানুন

নফল আদায়কারীর পিছনে কি ফরজ আদায়কারীর ইক্তিদা সহীহ হয়?

প্রশ্ন হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ নাকি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ইশার নামায পড়তেন। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *