প্রশ্নকর্তা- মাহিন
দেশঃ বাংলাদেশ
বিসয়ঃ বাতিল ফিরকা
প্রশ্ন নং-১
হযরত ঈসা আঃ এবং হযরত মাহদী আঃ মুজতাহিদ হবেন। তাই তাদের জন্য কারো মাযহাবের তাকলীদ করা জায়েজ নয়। কুরআনে কারীমের কোন আয়াতের হুকুম রহিত হয়ে গেছে, কোন আয়াতের হুকুম বহাল আছে, কোন আয়াত কোন প্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে, কোন আয়াত কাদের উদ্দেশ্য করে নাজিল হয়েছ। কোন আয়াতাংশের প্রকৃত অর্থ কি? আরবী ব্যাকরণের কোন নীতিতে পড়েছে এই বাক্যটি? এই আয়াত বা হাদীসে কী কী অলংকারশাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে? সেই সাথে কোনটি সহীহ হাদীস কোনটি দুর্বল হাদীস? কোন হাদীস কি কারণে দুর্বল? কোন হাদীস কী কারণে শক্তিশালী? হাদীসের বর্ণনাকারীদের জীবনী একদম নখদর্পনে থাকা আলেম এখন নাই। তাহলে রসুলুল্লাহ (সঃ) এর যুগের এত বছর পরে এসে ইমাম মাহদি কিভাবে এই বিষয় গুলোতে দক্ষতা অর্জন করবেন?
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
দীর্ঘ এক জমানায় জ্ঞানী ও মেধাবী ব্যক্তি না থাকা পরবর্তী কোন জমানায় জ্ঞানী ও মেধাবী ব্যক্তি তৈরী হওয়াকে কি অসম্ভব করে দেয়?
কোন এক দীর্ঘ সময় বিজ্ঞ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার না থাকা কি পরবর্তীতে কোনদিনই বিজ্ঞ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার তৈরী হতে বাধা দেবে?
এটা কেমন প্রশ্ন ভাই?
উপরোল্লিখিত বিষয়ের প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বর্তমানে বিদ্যমান না থাকা সত্বেও পরবর্তীতে কোন ব্যক্তি এসে উপরোক্ত বিষয়ে পারদর্শী হতে পারবে না, এমন প্রশ্ন আপনার মনে কেন উদয় হচ্ছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। বর্তমানে নেই এমন মেধাবী, তাই বলে পরবর্তীতে এমন মেধাবী তৈরী হতে পারবে না এমন অক্ষমতো আমাদের রব সর্বশক্তিমান আল্লাহ নন। তিনি ইচ্ছে করলেই পূর্ববর্তী জমানার চেয়েও বড় মুজতাহিদ পরবর্তীতে সৃষ্টি করতে পারেন। তেমনি ইমাম মাহদী আঃ এবং হযরত ঈসা আঃ কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইজতিহাদের যোগ্যতা দিয়েই প্রেরণ করবেন।
প্রশ্ন নং-২
৪র্থ শতাব্দীর উলামায়ে কিরাম একটি মাযহাবের অনুসরণকে বাধ্যতামূলক বলে মত দিয়েছেন,যা সেই কালের ওলামায়ে কিরামের সর্বসম্মত সীদ্ধান্ত ছিল। আর একবার উম্মতের মাঝে ইজমা হয়ে গেলে তা পরবর্তীদের মানা আবশ্যক হয়ে যায়। এই ইজমা কত সালে এবং কোথায় সংঘটিত হয়েছে? কোন আলেমদের উপস্থিতিতে এই ইজমা হয়েছিল? ইজমা যে হয়েছিল তার নির্ভরযোগ্য সূত্র কি?
ইজমা যদি কোন মতের উপর একবার হয় পরবর্তীতে যুগের প্রেক্ষাপটে কি পূর্বের ইজমার বিপরীত ইজমা হওয়া সম্ভব না?
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
৪র্থ শতাব্দির উলামায়ে কেরামের চার ইমামের যেকোন এক ইমামের মাযহাবের অনুসরণ আবশ্যক হওয়ার উপর ইজমা বিষয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহে এসেছে। যেমন-
আলইনসাফ-৫২, ৫৭-৫৯।
মাদারে হক-৩৪১।
ইন্তিসারুল হক বজওয়াবে মিয়ারে হক-১৫৩।
আলমুআফাকাত-৪/১৪৬
আলমাজমূ শরহুল মুহাজ্জাব-১/৯১
একবার ইজমা হলে পরবর্তীতে সে ইজমার বিপরীতে ইজমা হলে পূর্বের ইজমা বাতিল হয় না। কারণ, পূর্বের ইজমাটি যেমন শক্তিশালী পরবর্তী ইজমাও তেমনি। সমান পর্যায়ের দুই দলীল একটি অপরটির দ্বারা বাতিল হয় না। বরং একটির চেয়ে আরেকটি শক্তিশালী হলে এক দলীলের উপর আরেক দলীলকে বাতিল করা যায়। এ কারণেই ইজতিহাদের ভিত্তিতে একটি মতকে প্রাধান্য দেয়ার পর পরদিন ইজতিহাদ পাল্টে গেলে নতুন ইজতিহাদের মাধ্যমে পূর্বের ইজতিহাদের দ্বারা করা ফায়সালাকে পাল্টানো জায়েজ নয়। তবে নতুন করে এমন মাসআলার ফায়সালা করতে গেলে নতুন ইজতিহাদ অনুযায়ী ফায়সালা করতে হবে। কিন্তু পূর্বের ইজতিহাদের দ্বারা কার্যকর হওয়া রায় বর্তমান পরিবর্তিত ইজতিহাদ দ্বারা পাল্টানো জায়েজ নয়।
এ কারণেই হযরত উমর রাঃ একদিন একটি বিষয়ের ফায়সালা ইজতিহাদের মাধ্যমে করার পর, পরদিন এমনি আরেক মামলার রায় ইজতিহাদ পরিবর্তনের কারণে ভিন্ন দিলে যখন তাকে এ বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন তিনি বলেন, تِلْكَ على مَا قضينا وَهَذِه على مَا نقضي. অর্থাৎ সেটি তাই যেভাবে আমি এর ফায়সালা করেছিলাম, আর এটি সেভাবেই হবে, যেমনটি এখন করলাম। {শরহুল কাওয়ায়িদিল ফিক্বহিয়্যাহ লিজজারকা, কায়দা নং-১৫}
ইসলামী ফিক্বহের প্রসিদ্ধ কায়দা তথা মূলনীতি হল, الِاجْتِهَاد لَا ينْقض بِمثلِهِতথা একটি ইজতিহাদ তারমত আরেকটি ইজতিহাদের দ্বারা ভেঙ্গে যাবে না। {শরহুল কাওয়ায়িদিল ফিক্বহিয়্যাহ লিজজারকা, কায়দা নং-১৫}
এ কারণেই একবার ইজমা হয়ে যাওয়ার পর তারমত আরেকটি ইজমা দ্বারা পূর্ববর্তী ইজমার বিপরীত করা বৈধ হবে না।
প্রশ্ন নং- ৩
নাজাতপ্রাপ্ত হল সেই দল-যারা নবীজী সাঃ এর সুন্নাত ও সাহাবায়ে কিরামের জামাতের মত ও পথের অনুসারী। এক কথায় যারা সুন্নাতধারী, সেই সাথে সাহাবাদের মত ও পথের অনুসারী। যাকে আমরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত বলে থাকি (সুন্নি)। আহলে হাদিস, জামাতে ইসলাম, তাবলীগ জামাত- এনারা কি সুন্নি থেকে ভিন্ন ভিন্ন দল নাকি সুন্নিরই অন্তর্ভুক্ত? ইনারা কি বাতিল ফিরকা হিসেবে বিবেচিত হবেন? নাকি পৃথিবীময়ই সুন্নি বিদ্যমান আছেন কিন্তু একেক স্থানে একেক নামে পরিচিত?
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
উক্ত বক্তব্যে একটি মূলনীতি বলা হয়েছে। যারা রাসূল সাঃ এর সুন্নত এবং সাহাবাগণের জামাতের সুন্নতের অনুসরণ করে তারা হল নাজাতপ্রাপ্ত দল। এটাকেই বলা হয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত।
হাদীসটি দেখে নেয়া যাক প্রথমে-
عن عبد الله بن عمرو قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ليأتين على أمتي ما أتى على بني إسرائيل حذو النعل بالنعل حتى إن كان منهم من أتى أمه علانية لكان في أمتي من يصنع ذلك وإن بني إسرائيل تفرقت على ثنتين وسبعين ملة وتفترق أمتي على ثلاث وسبعين ملة كلهم في النار إلا ملة واحدة قالوا ومن هي يا رسول الله قال ما أنا عليه وأصحابي (سنن الترمذى-كتاب الايمان، باب ما جاء في افتراق الأمة، رقم الحديث-2641)
অর্থ-হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-আমার উম্মত তা’ই করবে যা করেছে বনী ইসরাঈলের লোকেরা। এক জুতা অপর জুতার সমান হওয়ার মত। এমনকি যদি ওদের মাঝে কেউ মায়ের সাথে প্রকাশ্যে জিনা করে থাকে, তাহলে এই উম্মতের মাঝেও এরকম ব্যক্তি হবে যে একাজটি করবে। আর নিশ্চয় বনী ইসরাঈল ছিল ৭২ দলে বিভক্ত। আর আমার উম্মত হবে ৭৩ দলে বিভক্ত। এই সব দলই হবে জাহান্নামী একটি দল ছাড়া। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন-সেই দলটি কারা? নবীজী সাঃ বললেন-যারা আমার ও আমার সাহাবাদের মত ও পথ অনুসরণ করবে। {সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-২৬৪১, আল মু’জামুল কাবীর, হাদীস নং-৭৬৫৯, আল মু’জামুল আওসাত, হাদীস নং-৪৮৮৯, কানযুল উম্মাল ফি সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফআল, হাদীস নং-১০৬০}
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত কোন দলের বা সংগঠনের নাম নয়। এটি একটি আদর্শের নাম। যে আদর্শটি রাসূল সাঃ এর সুন্নত ও সাহাবাগণের সুন্নত দ্বারা নির্ধারিত হবে।
সুতরাং যাদের মাঝেই উপরোক্ত দু’টি গুণ পাওয়া যাবে, তারাই নাজাতপ্রাপ্ত দল আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত।
উক্ত মূলনীতির আলোকে আপনিই নির্র্দিষ্ট করে নিতে পারবেন আপনার বলা উপরোক্ত দলসমূহের মাঝে কারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত তথা নাজাতপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভূক্ত?
জামাতে ইসলাম সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি তথা আদর্শ মানে না, তাই তারা এক হিসেবে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভূক্ত নয়।
আহলে হাদীসরা খুলাফায়ে রাশেদীন রাঃ এর সুন্নতকে দলীল মানে না, একারণেই হযরত উমর রাঃ এর আমল থেকে মসজিদে নববীসহ বাইতুল্লাহ শরীফে অদ্যবধি আদায় হওয়া বিশ রাকাতের সুন্নতকে মানে না, হযরত উমর রাঃ এর আমল থেকে জারি হওয়া নির্দেশনা “এক মজলিসে দেয়া তিন তালাক তিন তালাকই গণ্য”মাসআলা মানে না। আহলে হাদীস দাবিদাররা খলীফায়ে রাশেদ হযরত উসমান রাঃ এর সময়কাল থেকে জারি হওয়া জুমআর দুই আজানকে অস্বিকার করে সাহাবাগণের জামাতকে অমান্য করে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত থেকে বেরিয়ে গেছে।
তাবলীগ জামাত যেহেতু নবীর সুন্নতকে যেমন দলীল মানে, তেমনি সাহাবাগণের সুন্নতকেও দলীল মানে। তাই তারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত থেকে যাচ্ছে।
আবারো বলছি, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত কোন নির্দিষ্ট দলের নাম নয়। এটি হল আদর্শের নাম। নবীর সুন্নত আর সাহাবাগণের সুন্নতের অনুসারীরাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামআত।
মাজারপূজা, কবরপূজা করে নাম আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত নামের সংগঠন করলেই আহলে সুন্নতের অনুসারী হওয়া যায় না। আহলে সুন্নতের অনুসারী হওয়ার জন্য নবীজী সাঃ এর সুন্নত ও সাহাবাগণের সুন্নতকে আঁকড়ে ধরতে হবে। নাম যা’ই হোক না কেন, উক্ত দু’টি গুণ যাদের মাঝেই পাওয়া যাবে তারাই নাজাতপ্রাপ্ত আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভূক্ত হবে। চাই দলটি কোন ইসলামী রাজনৈতিক দল হোক বা হক্কানী পীর-মাশায়েখের জামাত হোক, বা উলামা মাশায়েখদের জামাত হোক। নাম যা’ই হোক না কেন, উপরোক্ত আদর্শ থাকলে সবাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভূক্ত হবেন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।