আবূ মুয়াবিয়া লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
আগের লেখাটি পড়ে নিন- খারেজীদের ষড়যন্ত্র
হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে মুসলমানদের পারস্পরিক শান্তি ও শৃঙ্খলা আবার ফিরে আসে। মুসলমানদের খুনে মুসলমানদের হাত রক্তাক্ত হবার লজ্জাজনক অধ্যায়ের বাহ্যিক পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু ইসলামের শত্রুরা তা কিছুতেই বরদাশত করতে পারেনি। তাই নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করে।
মুহাম্মদ বিন আবু বকর নামে এক কমবখত আব্দুর রহমান বিন মুলজিম নামক ঘাতককে মিশর থেকে কুফায় প্রেরণ করে। অভিশপ্ত আব্দুর রহমান বিন মুলজিম বাহ্যিকভাবে হযরত আলী রাঃ এর সাথে ভালবাসা ও মোহাব্বতের দাবী করতো। কুফায় এসে হযরত আলী রাঃ এর হাতে খিলাফতের বাইয়াত নিতে চায়। কিন্তু হযরতে আলী রাঃ তার বাইয়াত নিতে অস্বিকৃতি জানান। এ লোক লাগাতার তিন দিন পর্যন্ত বাইয়াতের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। বাধ্যগত থাকার অঙ্গীকার করতে থাকে। অবশেষে হযরত আলী রাঃ এ অভিশপ্তকে তার অঙ্গীকারের উপর বিশ্বাস করে তাকে বাইয়াত করে নেন। [তাবকাতে ইবনে সাদ-৩/১৫৯, উর্দু সংস্করণ]
এবার সে বাহ্যিকভাবে হযরত আলী রাঃ এর মোহাব্বতারীদের দলে শামিল হল। মুখে মুখে হযরত আলী রাঃ এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতো। আর তলে তলে মুসলমানদের পরস্পরে লড়াইয়ে লিপ্ত করতে ভয়ানক ষড়যন্ত্র পাকাতে থাকে। সে ভিতরে ভিতরে বিচ্ছিন্ন খারেজীদের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকে।
সেই সময় মিল্লাতে ইসলামিয়ায় তিনজন ব্যক্তিত্ব সাধারণ্যের কাছে সর্বাধিক মানব্যর ছিলেন। যারা জ্ঞান-গরিমা, বুদ্ধিমত্বা, দ্বীনের জন্য কুরবানী, তাক্বওয়া পরহেযগারী ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত ছিলেন। যাদের প্রতিজন পুরো মুসলিম মিল্লাতকে নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা রাখতেন। প্রতিজন কাফির মুশরিকদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম ছিলেন। তাদের একজন হলেন, আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী রাঃ। অপরজন কাতিবে ওহী আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ। তৃতীয়জন হলেন মিশর বিজেতা হযরত আমর বিন আস রাঃ।
ইসলামের দুশমন শক্তি চিন্তা করল যে, যতক্ষণ পর্যন্ত এ তিন ব্যক্তিত্বকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ শংকা থেকেই যাবে যে, মুসলমানরা এ তিন জনের কোন একজনের নেতৃত্বে আবার একতাবদ্ধ হয়ে কাফির মুশরিকদের ঘুম হারাম করে দিবে।
মুনাফিক গোষ্ঠি একথা ভাল করেই জানতো যে, মুসলমানদের একতা, ভ্রাতৃত্ব ও একতাবদ্ধতা তাদের জন্য মৃত্যুতুল্য। মুসলমানদের বিভেদ, বিবাদই হল,তাদের জন্য শক্তি ও কামিয়াবীর চাবিকাঠি।
মুসলমানদের একতাবদ্ধ হবার এ তিন পথিকৃত দুনিয়াতে থাকলে তাদের জন্য কখনোই শান্তিতে ঘুমানো সম্ভব হবে না। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, যে কোন মূল্যে এ তিন ব্যক্তিত্বকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
অভিশপ্ত খারিজীদের তিন ব্যক্তি আব্দুর রহমান বিন মুলজিম, বারর বিন আব্দুল্লাহ তামিমী এবং আমর বিন বরক তামিমী মক্কায় একত্র হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, ইসলামের এ মহান তিন পুরোধাকে ৪০ হিজরীর রমজানের ১৭ বা ২১ তারিখে হত্যা করা হবে। যেন মিল্লাতে ইসলামিয়া অভিভাবকশূণ্য হয়ে যায়। একতাবদ্ধ হবার আর কোন জায়গা বাকি না থাকে।
মুয়াবিয়া রাঃ কে হত্যার দায়িত্ব বারক বিন আব্দুল্লাহ তামিমী গ্রহণ করে। হযরত আমর বিন আস রাঃ কে হত্যার দায়িত্ব নেয় আমর বিন বকর তামিমী। আর আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী রাঃ কে হত্যার দায়িত্ব গ্রহণ করে অভিশপ্ত আব্দুর রহমান বিন মুলজিম।
এ তিন বদবখত স্বীয় কাজ আঞ্জাম দিতে নিজ নিজ লক্ষ্যবস্তুর দিকে রওনা হয়ে যায়।
নির্ধারিত তারিখে মিশরের কেন্দ্রীয় মসজিদে খঞ্জর নিয়ে ফজরের নামাযের সময় আমর বিন বকর তামিমী হযরত আমর বিন আস রাঃ কে হত্যার উদ্দেশ্যে পজিশন নিয়ে বসে থাকে। সৌভাগ্যবশত সেদিন শারিরীক অসুস্থ্যতার কারণে আমর বিন আস রাঃ মসজিদে আসতে পারেননি। নামায পড়ান হযরত খারেজা বিন হুজাফা। তাকেই আমর বিন আস মনে করে আমর বিন বকর তামিমী হামলা করলে খারেজা বিন হুজাইফা শহীদ হয়ে যান।
অন্যদিকে বরক বিন আব্দুল্লাহ তামিমী দামেশকের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ফজরের নামাযের সময় আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ কে হত্যার জন্য হামলা করে। কিন্তু আঘাত ভুল করায় মুয়াবিয়া রাঃ আহত হলেও শহীদ হওয়া থেকে রক্ষা পান। আল্লাহ তাআলা তাকে রক্ষা করেন।
অপরদিকে আব্দুর রহমান বিন মুলজিম কুফার জামে মসজিদের বাহিরে আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী রাঃ এর অপেক্ষায় ছিল। যখন তিনি আসলেন তখন অভিশপ্ত ইবনে মুলজিম বিষমাখা তলোয়ার দিয়ে তাকে আঘাত করলো। ফলে তিনি শহীদ হয়ে গেলেন। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া, বাংলা সংস্করণ- ৭/৫৭৮-৫৮৫, তারীখে তাবারী, আরবী সংস্করণ- ৫/১৪৩-১৪৯, তবক্বাতে ইবনে সাদ, উর্দু সংস্করণ-৩/১৬১]
পরের লেখাটি পড়ুনঃ হযরত হাসান রাঃ এর খিলাফত