আবূ মুয়াবিয়া লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
আগের লেখাটি পড়ে নিন– হযরত আয়শা রাঃ এবং মুয়াবিয়া রাঃ কেন বাইয়াত হননি?
এরকম পরিস্থিতিতে একটি ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়, হাশেমীরা মনে করে যে, উমাইয়ারা এ কারণে হযরত আলী রাঃ এর হাতে বাইয়াত হতে চাচ্ছে না, কারণ হযরত আলী রাঃ একজন হাশেমী। অপরদিকে বনু উমাইয়ারা মনে করতে লাগল যে, যেহেতু হযরত উসমান রাঃ এর হত্যাকারীরা হযরত আলী রাঃ এর সৈন্যদলে শরীক হয়ে গেছে, তাই হযরত আলী রাঃ তাদের থেকে উসমানের খুনীদের কিসাস নিতে চাচ্ছেন না।
পরস্পরের এ ভুল বুঝাবুঝি যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সেই সাথে মুনাফিক ও সাবায়ীদের ষড়যন্ত্র পরিবেশকে আরো জটিল থেকে জটিলতর করে তুলে।
হযরত আয়শা রাঃ তার অনুগত সৈন্যদল ও সাবাহাগণকে নিয়ে বসরায় পৌছে যান। অপরদিকে হযরতে আলী রাঃ তাদেরকে নিবৃত করার জন্য বসরায় আসেন।
উভয় দলের মাঝে সন্ধি হয় যে, হযরতে আলী রাঃ উসমান রাঃ এর হত্যাকারীদের থেকে নিজেকে সম্পর্কমুক্ত করে নিবেন।
একথা শুনেই সাবায়ীরা নিজের মৃত্যু দেখতে পায়। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, রাতের আঁধারে আয়শা রাঃ এর বাহিনীর উপর হামলা করবে। যেই কথা সেই কাজ। যখন উভয় দল নিজ নিজ তাবুতে সন্ধি চুক্তির খুশিতে নিশ্চিন্তে ঘুমের ঘোরে, তখনি সাবায়ী ষড়যন্ত্র শুরু হল। হামলা করা হল, হযরত আয়শা রাঃ এর বাহিনীর তাঁবুতে। মুহুর্তেই ছড়িয়ে পড়ল গুজব। হযরত আলী রাঃ এর বাহিনী চুক্তি ভঙ্গ করে হামলা করেছে। এ গুজবের সত্যাসত্যি যাচাইয়ের সময় ও সুযোগ ছিল না। শুরু হল ভয়াবহ যুদ্ধ। যুদ্ধের এক পর্যায়ে যুদ্ধ দ্রুত খতম করার মানসে হযরত আয়শা রাঃ কে বহনকারী উটকে নিশানা করা হয়। যেন তীরের আঘাতে উট বসে যায়। অবশেষে তাই হল। উট বসে গেল। যুদ্ধও থেমে গেল। দিনব্যাপী যুদ্ধ শেষে হযরত আয়শা রাঃ নিরাপদে মক্কায় চলে গেলেন।
এ যুদ্ধে আশারায়ে মুবাশশারা তথা নবীর জবানে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী হযরত তালহা রাঃ ও যুবায়ের রাঃ হযরতে আলী রাঃ এর বিরোধী দলে শামিল ছিলেন। অবশেষে শাহাদতের পেয়ালা পান করেন। হযরত আলী রাঃ তাদের শাহাদের উপর আফসোস প্রকাশ করেন এবং তাদের হত্যাকারীকে জাহান্নামী বলে সতর্ক করতেন। বারবার হযরত তালহা রাঃ এর হাত ধরে বলেন, এ হাত অনেক বার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শত্রুর হাত থেকে প্রতিরক্ষা করেছে।
সবচে’ বড় ক্ষতি এই হয় যে, উসমান রাঃ এর হত্যাকারীদের থেকে হযরত আলী রাঃ এর দূরে থাকা এবং সম্পর্ক ছিন্ন করা আরো দূঃরহ এবং কঠিন হয়ে যায়। আর এ কারণেই হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে কোন প্রকার সন্ধিচুক্তি করার পথও অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
জঙ্গে জামাল তথা উটের যুদ্ধের পর হযরত আলী রাঃ কুফাকে দারুল খিলাফাহ নির্ধারণ করেন। এখান থেকেই হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে সমঝোতা করার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন।
কিন্তু হযরতে মুয়াবিয়া রাঃ এর শর্ত ছিল আগে হযরত উসমান রাঃ এর হত্যাকারীদের থেকে কিসাস নিতে হবে। যা উক্ত পরিবেশে হযরত আলী রাঃ এর জন্য আঞ্জাম দেয়া ছিল অসম্ভব।
অবশেষে ৩৬ হিজরীর জিলহজ্জ মাসে ইরাক ও শামের মাঝামাঝি ‘সিফফীন’ নামক স্থানে উভয় দলের মাঝে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। লাগাতার দুই মাস যুদ্ধ চলতে থাকে। যাতে প্রায় ৭০ হাজার মুসলমান শহীদ হন।
যখনি বিবদমান দুই দলের মাঝে সন্ধি চুক্তির কোন কথা চলতো। তখনি মুনাফিক সাবায়ীরা রাতের আঁধারে পরস্পরের উপর হামলা করতো। আর হযরত আলী রাঃ কে বুঝাতো যে, আয়শা রাঃ এবং মুয়াবিয়া রাঃ এর বাহিনী হামলা করেছে। আর আয়শা ও মুয়াবিয়া রাঃ কে বুঝাতো যে, ওয়াদা ভঙ্গ করে আলী রাঃ এর বাহিনী হামলা করেছে। এমনভাবে বিষয়গুলো ভজঘট পাকিয়ে যায় যে, তাহকীক করার ফুরসতও পাওয়া যায় না। বরং যুদ্ধ বেঁধে যায়। এভাবেই সাবায়ীরা মুসলমানদের পরস্পর বিবাদে লিপ্ত রেখে শক্তি ক্ষয় করে নিজেদের উসমান হত্যার কিসাস থেকে বাঁচিয়ে রাখে।
মুসলমানদের যে তরবারী বদর উহুদে কাফেরদের বিরুদ্ধে উঠেছিল। যাদের তলোয়ারে ঝংকারে কেঁপে উঠেছিল রূম পারস্যের তখতে তাউস, সেই মুসলমানদের তরবারী এখন সাবায়ী ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে কাটছে নিজেরই ভাইয়ের গর্দান। ভুল বুঝাবুঝি এবং সাবায়ী ষড়যন্ত্রে সংঘটিত মুসলমানদের পারস্পরিক দু’টি ভয়াবহ যুদ্ধে প্রায় ৯০ হাজার মুসলমান শাহাদত বরণ করেন। হযরত আলী রাঃ মদীনাতুর রাসূলের সংস্রব ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদীনার বদলে স্থানান্তর করেন কুফায়। সেই দিন থেকে আর কখনো ইসলামী খিলাফতের রাজধানী মদীনা হতে পারেনি।
সন্ধিচুক্তি
সিফফীন প্রান্তরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অবশেষে আলী রাঃ মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে সন্ধিচুক্তি করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
তখন শিয়ানে আলীর এক গ্রুপ কঠিনভাবে এর বিরোধীতা শুরু করে। এরাই ঐ সকল লোক যাদের উদ্দেশ্য হল, মুসলমানদের মাঝে অনৈক্য ও বিভেদ জিইয়ে রাখা। মুসলমানদের ঐক্য ও একতা যাদের জন্য ছিল মৃত্যুতুল্য।
এসব লোকেরা এ কথা বলে হযরত আলী রাঃ এর বিরোধীতা শুরু করে যে, হযরত আলী রাঃ এর ইমামত এটা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত। সুতরাং তার বিরোধীতাকারীরা সবাই আল্লাহর বিধান লঙ্ঘণকারী হওয়ায় মুরতাদ। তাই তাদেরকে হত্যা করা আবশ্যক।
সারকথা হল, এ সমস্ত অতিভক্ত শিয়ারা হযরত আলী রাঃ এর ইমামতকে না মানার কারণে হযরত মুয়াবিয়া রাঃ কে কাফির মনে করতো, তাই তাকে হত্যা করাই আল্লাহর ফায়সালা বিবেচনা করতো, এবং হযরত আলী রাঃ তার সাথে সন্ধিচুক্তি করতে রাজী হওয়ায় তাকেও পথভ্রষ্ট মনে করতে শুরু করে।
প্রসিদ্ধ শিয়া লেখক ‘আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানী’ এর লিখিত বাংলা অনূদিত বই ‘বেলায়াতের দ্যুতি’। যা কালচারাল কাউন্সেলর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস ঢাকার তত্ত্বাবধানে লিখিত একটি প্রমাণ্য বই। সেই বইয়ে হযরত আলী রাঃ যখন হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে সন্ধিচুক্তিতে সম্মত হলেন, তখন তারই অনুসারী শিয়াদের একদল কিভাবে বিরোধীতা করছিল তার বিবরণ তুলে ধরা হয়। একাংশে এসেছেঃ- ‘লোকেরা চিৎকার করে বলতে লাগলঃ “আমরা কখনোই আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে মানুষকে ফায়সালাকারী হতে (ও হুকুম পাল্টে দিতে) দেবো না। আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন যে, মু’য়াবিয়া ও তার সহচরদেরকে নিহত হতে হবে কিংবা আমাদের শাসনাধীনে চলে আসতে হবে। সালিসের ঘটনাটি ছিলো আমাদের দ্বারা সংগঠিত একটি বিচ্যুতি। অতঃপর আমরা তা থেকে প্রত্যাবর্তন করেছি এবং তওবাহ করেছি; তুমিও [হযরত আলী রাঃ] প্রত্যাবর্তন করো ও তওবা করো, নতুবা আমরা তোমাকে পরিত্যাগ করবো’। [বেলায়েতের দ্যুতি- ৬২৬-৬২৭]
শিয়াদের কাছে গ্রহণযোগ্য গ্রন্থ ‘নাহজুল বালাগাহ’ এর মাঝে এসেছেঃ
আমিরুল মোমিনের অনুচরদের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে বললো, “হে আমীরুল মোমেনিন, আপনি প্রথমে সালিশীতে আমাদেরকে বারণ করেছিলেন এবং পরে উহার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। আমরা জানি না এ দু’টোর কোনটি বেশি সঠিক”। এতে আমিরুল মোমেনিন এক হাত অপর হাতের ওপর থাপ্পড় দিয়ে বললেনঃ যে ব্যক্তি অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এটাই তার পুরস্কার।” [নাহজ আল বালাগা, বাংলা অনুবাদ-১৪১]
মোটকথা হল, এ সমস্ত কট্টরপন্থী শিয়ারা হযরত মুয়াবিয়া রাঃ কে হত্যা করাই একমাত্র সঠিক বলে মনে করতো। সেই সাথে হযরত আলী রাঃ কেন মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে সন্ধি করতে রাজি হলেন এ জন্য তার উপর এতোটাই ক্ষীপ্ত ছিলেন যে, এ কারণে হযরতে আলী রাঃ কে পর্যন্ত পরিত্যাগ করতে উদ্ধত হয়। এসকল লোককেই ইতিহাস খারেজী নামে অভিহিত করে।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথা পরিস্কার বুঝা গেল যে, খারেজী সম্প্রদায় ছিল প্রথমে হযরত আলী রাঃ এর একান্ত অনুসারী। সেই সাথে তার ইমামতকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিশ্বাসকারী দল। হযরত আলী রাঃ এর বিরোধীদেরকে কাফির হিসেবে হত্যা করার মতও তারা পোষণ করতো।
হযরত আলী রাঃ হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর সাথে সন্ধিচুক্তিতে রাজি হওয়ায়, এবং হযরত মুয়াবিয়া রাঃ কে হত্যা করা থেকে বিরত থাকায় আল্লাহর বিধানের বিপরীত করেছেন দাবী করে তারা হযরত আলী রাঃ এর বিরোধীতায় লিপ্ত হয়। এমন কি হযরত আলী রাঃ কে কাফির পর্যন্ত মনে করতে শুরু করে।
সুতরাং যারা মনে করেন যে, খারেজীরা হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর পক্ষপাতী ছিল। বা তার অনুগামী ছিল তাদের এ ধারণাটি সম্পূর্ণই অজ্ঞতা এবং প্রমাণবিহীন একটি অসাড় দাবী ছাড়া কিছু নয়।
পরের পর্বটি পড়ুন– খারেজীদের ষড়যন্ত্র