প্রশ্ন
আসসালামু আলাইকুম।
সম্মানিত মুফতী সাহেবের কাছে আমার প্রশ্ন হল, বাংলাদেশের অনেক বক্তাকেই দেখা যায়, মাইকে বয়ান করার সময়ও অতিরিক্ত জোরে আওয়াজ করে বয়ান করেন। আবার অনেকেই নরম সুরে বয়ান করেন।
আমার প্রশ্ন হল, কোনটি সুন্নত তরীকার বয়ান করার পদ্ধতি? জোরে চিল্লিয়ে বয়ান করা? নাকি নরম সুরে বয়ান করা?
উত্তরটি দ্রুত জানালে কৃতার্থ হবো।
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
আমরা প্রথমে দু’টি হাদীস দেখে নেইঃ
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا خَطَبَ احْمَرَّتْ عَيْنَاهُ، وَعَلَا صَوْتُهُ، وَاشْتَدَّ غَضَبُهُ، حَتَّى كَأَنَّهُ مُنْذِرُ جَيْشٍ
জাবির ইবনু আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ভাষণ দিতেন তখন তাঁর চোখ দুটি লাল হয়ে যেতো, কন্ঠস্বর জোরালো হতো, তাঁর ক্রোধ বৃদ্ধি পেতো, যেন তিনি কোন সেনাবাহিনীকে সতর্ক করছেন। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৮৬৭, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৪৫]
وَحُجْرُ بْنُ حُجْرٍ، قَالَا: أَتَيْنَا الْعِرْبَاضَ بْنَ سَارِيَةَ، وَهُوَ مِمَّنْ نَزَلَ فِيهِ {وَلَا عَلَى الَّذِينَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لَا أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ} [التوبة: 92] فَسَلَّمْنَا، وَقُلْنَا: أَتَيْنَاكَ زَائِرِينَ وَعَائِدِينَ وَمُقْتَبِسِينَ، فَقَالَ الْعِرْبَاضُ: صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ، ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُونُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوبُ، فَقَالَ قَائِلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ، فَمَاذَا تَعْهَدُ إِلَيْنَا؟
হাজার ইবন হাজার (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একদা আমরা ইরবায ইবন সারিয়া (রাঃ) এর নিকট গমন করি, যার শানে এ আয়াত নাযিল হয়ঃ তাদের জন্য কোন অসুবিধা নেই, যারা আপনার নিকট এ জন্য আসে যে, আপনি তাদের জন্য বাহনের ব্যবস্থা করবেন। আপনি বলেনঃ আমি তো তোমাদের জন্য কোন বাহন পাই না।
রাবী বলেনঃ আমরা তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁকে সালাম করি এবং বলিঃ আমরা আপনাকে দেখার জন্য, আপনার খিদ্মতের জন্য এবং আপনার কাছ থেকে কিছু সংগ্রহের জন্য এসেছি। তখন তিনি বলেনঃ একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সঙ্গে সালাত আদায়ের পর, আমাদের দিকে ফিরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন, যাতে আমাদের চোখ অশ্রু ভারাক্রান্ত হয় এবং অন্তর ভীত-সন্ত্রস্থ হয়। আমাদের মধ্যে একজন বলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! মনে হচ্ছে এ আপনার বিদায়ী ভাষণ, কাজেই আপনি আমাদের আরো কিছু অছীয়ত করুন। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৬০৭, ইফাবা-৪৫৫২, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৭১৪৫, তিরমিজী, হাদীস নং-২৬৭৬]
উপরোক্ত দু’টি হাদীসে আমরা দু’টি বয়ানের চিত্র দেখতে পাই।
সহীহ মুসলিমের হাদীস দ্বারা বুঝতে পারি যে, বয়ানের সময় উচু আওয়াজ করা এটি নববী বয়ান পদ্ধতির অন্তর্ভূক্ত।
দ্বিতীয় হাদীসটিতে দেখতে পাই যে, এমন হৃদয়কাড়া পদ্ধতিতে বয়ান করা যে, যাতে করে মানুষের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়, দিল নরম হয়, আল্লাহর ভয়ে কম্পমান হয়।
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, শুধু জোরে আওয়াজ নয়, বরং নরম সুরে বয়ান করাও সুন্নতের অন্তর্ভূক্ত।
উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা শাব্বির আহমাদ উসমানী রহঃ তার অনবদ্য শরাহ গ্রন্থ “ফাতহুল মুলহিম” এ বয়ানের তিনটি পদ্ধতি সালাফ থেকে নকল করেছেন। যথা-
১
নরম, কোমল এবং সুরেলা কণ্ঠে আল্লাহর নিয়ামত বর্ণনা করা। ভীতিকর শব্দ করে নয়। এর দ্বারা মানুষের অন্তর নরম হয় এবং বক্তার জন্যও তা আরামদায়ক হয়।
২
উত্থান পতন ব্যতীত স্বাভাবিক স্বরে বয়ান করা।
৩
জ্বালাময়ী শব্দে, তীব্র আওয়াজে বয়ান করা। [ফাতহুল মুলহিম-৫/৩২৬-৩২৭]
উপরোক্ত তিন পদ্ধতিতে বয়ান করাই সালাফে সালেহীন থেকে প্রমাণিত।
সুতরাং তীব্র আওয়াজে বয়ান করাও যেমন সুন্নাহ সম্মত। তেমনি নরম সুরে বক্তৃতা প্রদান করাও সুন্নাহ সম্মত।
এক পদ্ধতিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অন্য পদ্ধতিকে খেলাফে সুন্নাত বলার কোন সুযোগ নেই।
তবে উপস্থিত শ্রোতার দিকে লক্ষ্য করে বয়ান পদ্ধতির ভিন্নতা গ্রহণ করাই যুক্তি সঙ্গত।
প্রতিবাদী ও জাগরণী বয়ান তীব্র আওয়াজে হওয়াই সুন্নাহ সম্মত। আর দিল নরম করার উদ্দেশ্যে, মানুষকে আখেরাতমুখী করার মানসে করা বয়ান কোমল শব্দে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com