আল্লামা মনজূর নূমানী রহঃ
ইসলামের বুনিয়াদি ও মৌলিক শিক্ষাগুলোর মধ্যে কালিমা ও নামাযের পরই যাকাতের স্থান। যাকাত ইসলামের তৃতীয় রোকন বা খুঁটি। যে মুসলমানের নিকট নির্ধারিত পরিমাণ ধনদৌলত থাকবে, সে প্রতিবছর হিসাব করে সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ গরিব-মিসকীনকে দিয়ে দিবে। এ সম্পর্কিত মাসলা-মাসায়েল আলেমগণের কাছ থেকে জেনে নেওয়া আবশ্যক।
কোরআন শরীফের বহু জায়গায় নামাযের সঙ্গে যাকাতের কথা এসেছে। যদি আপনি তেলাওয়াত করে অভ্যস্ত থাকেন তাহলে সম্ভবত বিষয়টি আপনারও গোচরীভূত হয়ে থাকবে। আল্লাহ বার বার বলেছেন, ‘নামায পড়ো, যাকাত দাও।’ কয়েকটি আয়াতে তো নামায ও যাকাতকে মুমিন-মুসলমানের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য বলেও উল্লেখ করা হয়েছে,
الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ
(মুত্তাকী মুসলমান তারা) যারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে। সূরা ২৭, আয়াত ৩
বোঝাগেল, যে ব্যক্তি যাকাত আদায় করে না, সে প্রকৃত মুসলমান নয়। কেননা প্রকৃত মুসলমানের ভেতর যে গুণাবলী থাকা উচিৎ, তার মাঝে সেই গুণাবলী নেই। মোটকথা নামায না পড়া যেমন কাফের-মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য; মুমিন মুসলমানের নয়, এরশাদ হচ্ছে,
وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ
নামায আদায় করে যাও, নামায ছেড়ে দিয়ে মুশরিকের দলভুক্ত হয়ে যেও না। ¬সূরা ৩০, আয়াত ৩১
তেমনি যাকাত আদায় না করাও কাফের মুশরিকের বৈশিষ্ট্য; মুত্তাকী মুসলমানের নয়। আল্লাহ পাক বলেন,
وَوَيْلٌ لِلْمُشْرِكِينَ. الَّذِينَ لَا يُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ بِالْآخِرَةِ هُمْ كَافِرُونَ
মুশরিকদের জন্য অশুভ পরিণাম, যারা যাকাত আদায় করে না, আসলে এরা পরকাল-বিশ্বাসীই নয়। সূরা ৪১, আয়াত ৬-৭
যাকাত অনাদায়ে শাস্তি
যারা যাকাত আদায় করে না, কেয়ামতের দিন তাদের কী কঠিন শাস্তি হবে, তা শুনলেই গা শিউরে উঠে, হৃদয় কেঁপে উঠে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ. يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ
যারা স্বর্ণরৌপ্য তথা ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখে, আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না (যাকাত আদায় করে না, হে রাসূল!) আপনি তাদেরকে সেই দিনের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিয়ে দিন, যেদিন স্বর্ণরৌপ্য জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তাদের চোয়ালে, পৃষ্ঠে ও পার্শ্বে দাগানো হবে। আর বলা হবে, এতো সেই সোনারূপা, যা তোমরা কুক্ষিগত করে রাখতে। সুতরাং আজ সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার মজা দেখো। সূরা তাওবা ৯/৩৪-৩৫
একটি হাদীসে আয়াতের এ বিষয়বস্তু আরো বিস্তারিতভাবে এসেছে,
مَا مِنْ صَاحِبِ كَنْزٍ لَا يُؤَدِّي زَكَاتَهُ، إِلَّا أُحْمِيَ عَلَيْهِ فِي نَارِ جَهَنَّمَ، فَيُجْعَلُ صَفَائِحَ فَيُكْوَى بِهَا جَنْبَاهُ، وَجَبِينُهُ حَتَّى يَحْكُمَ اللهُ بَيْنَ عِبَادِهِ، فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ
যে ব্যক্তির নিকট সোনারূপা আছে, কিন্তু সে এর হকসমূহ আদায় করে না (যাকাত দেয় না), কেয়ামতের দিন সেই স্বর্ণরৌপ্য দিয়ে পাত বানানো হবে। এরপর দোযখের আগুনে তা পুড়িয়ে উত্তপ্ত করে তার পিঠে, পার্শ্বে ও কপালে দাগ দেওয়া হবে। কেয়ামত সংগঠিত হওয়া এবং বিচার-কার্য শেষ হওয়া পর্যন্ত পুরো সময় এই আযাব তার উপর চলতে থাকবে। আর এ সময়ের দৈর্ঘ্য হবে পঞ্চাশ হাজার বছর। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৮৭
কিছু হাদীসে এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার কঠিন শাস্তির কথা এসেছে। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে তাঁর আযাব ও গজব থেকে হেফাজত করুন।
আসলে আল্লাহ তাআলা যাকে স্বচ্ছল ও বিত্তবান বানিয়েছেন, সে যদি যাকাত না দেয়, আল্লাহর দেখানো পথে খরচ না করে, তবে নিঃসন্দেহে সে বড় নিমকহারাম ও জালেম। কেয়ামতের দিন যত কঠিন শাস্তিই তাকে দেয়া হোক, সেটা তার জন্য যথার্থই হবে।
বড় একটি জুলুম ও নাশোকরি
তাছাড়া ভাবার বিষয় যে, যাকাত প্রদানের মাধ্যমে তো আপন সমাজেরই গরিব-দুঃখী মানুষের সেবা করা হয়। সুতরাং যাকাত আদায় না করার দ্বারা দুঃখী-দরিদ্র মানুষের হক ও অধিকার পদদলিত করা হয়।
দ্বীনী ভাই ও বোন!
একটু চিন্তা করুন, আপনার দখলে যে ধনসম্পদ আছে, সে তো আল্লাহ পাকেরই দান, আবার আমরা নিজেরাও তো আল্লাহর সৃষ্টি, তাঁরই গোলাম বান্দা-বান্দী। তিনি যদি সমস্ত টাকা-পয়সা তলব করেন এমনকি যদি জীবনটাও দিয়ে দিতে বলেন, তাহলেও তো আমাদের কোনো প্রকার চুঁচেরা না করে সব কিছু তাঁর নামে উৎসর্গ করে দেয়া উচিৎ। সেখানে আল্লাহ পাক অতিরিক্ত সম্পদের মাত্র চল্লিশ ভাগের এক (শতকরা আড়াই) ভাগ দিতে বলেছেন। এটা তো আমাদের প্রতি আল্লাহ পাকের বড় করুণা এবং অনুগ্রহ! সুতরাং আল্লাহ পাকের এই বিধান পালনে শৈথিল্য প্রদর্শন করা বড়ই নাশোকরি ও অন্যায়।
যাকাতের সওয়াব ও ফজীলত
তদুপরি আল্লাহ তাআলার অসীম দয়া যে, তিনি যাকাত আদায়কারীকে অনেক অনেক সওয়াব ও নেকী দানের ফায়সালা করেছেন। অথচ এখানে বান্দার কোনো প্রাপ্য ছিলো না। কারণ বান্দা যা দান করছে, তাতো আল্লাহ পাকেরই। তিনি এর বিনিময়ে কোনো সওয়াব না দিলে অন্যায় কিছু হতো না। কিন্তু আমাদের আল্লাহ বড় দয়ালু, তাঁর দেয়া মাল থেকে যখন কোনো কিছু আমরা দান করি, তখন তিনি খুবই খুশী হন, অনেক অনেক নেকী ও সওয়াব দান করেন। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
مَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِائَةُ حَبَّةٍ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ
যারা আল্লাহর রাস্তায় মাল খরচ করে, তাদের খরচকৃত জিনিসের উদাহরণ হলো ঐ শষ্যদানার মতো, যে এক দানা থেকে সাতটি শীষ উদগত হয়, যে শীষগুলির প্রত্যেকটিতে আবার থাকে একশ করে দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তাকে এর চেও বেশী দান করেন। তিনি সব ধরণের স্বচ্ছলতার অধিকারী, সর্ব বিষয়ে সম্যক অবগত। সুরা বাকারা ২/২৬১
অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন,
الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ثُمَّ لَا يُتْبِعُونَ مَا أَنْفَقُوا مَنًّا وَلَا أَذًى لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ
যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে এবং ব্যায় করার পর খোটা বা কষ্ট দেয় না, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট মহাপুরস্কার অপেক্ষা করছে। তারা আগত পরিস্থিতিতে ভীত সন্ত্রস্ত হবে না এবং বিগত কিছুর জন্য তারা দুঃখিত হবে না। সুরা বাকারা ২/২৬২
এই আয়াত দুটিতে আল্লাহ পাক দান-খয়রাতকারীর জন্য তিনটি ওয়াদা করেছেন:
১। যত দান করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে এর শতগুণ বেশী বরকত দুনিয়াতেই দান করবেন।
২। আখেরাতে তাকে অনেক বড় সওয়াব ও নেয়ামত দান করবেন।
৩। কেয়ামতের দিন তার কোনো শংকা-ভয় এবং দুঃখ-দুশ্চিন্তা থাকবে না। সুবহানাল্লাহ!
আমার ভাই ও বোন!
এই সকল ওয়াদার উপর সাহাবায়ে কেরামের একীন ছিলো, বিশ্বাস ছিলো। তাদের ঈমানের অবস্থা এমন ছিলো যে, যখন দান-খয়রাতের ফযিলতের উপর কোনো আয়াত নাযিল হতো আর নবীজির যবান মোবারক থেকে সেই বিবরণ তারা শুনতেন, তখন গরীব সাহাবীরা বাজারের দিকে ছুটে যেতেন। কুলিগিরি করে পিঠে বোঝা বয়ে দুচার পয়সা যা পেতেন তাই আল্লাহর রাস্তায় সদকা করে দিতেন। সুবহানাল্লাহ!
যাকাত দানের ফযিলত সম্পর্কে একটি হাদীসে এসেছে-
ثَلَاثٌ مَنْ فَعَلَهُنَّ فَقَدْ طَعِمَ طَعْمَ الْإِيمَانِ: مَنْ عَبَدَ اللَّهَ وَحْدَهُ وَأَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَأَعْطَى زَكَاةَ مَالِهِ طَيِّبَةً بِهَا نَفْسُهُ، رَافِدَةً عَلَيْهِ كُلَّ عَامٍ. أَخْرَجَهُ الطَّبَرَانِيُّ أَيْضًا وَجَوَّدَ إسْنَادَهُ كما في نيل الاوطار للشوكاني.
তিনটি বিষয় যে ব্যক্তি গ্রহণ করবে, সে ঈমানের মজা ও স্বাদ পেতে থাকবে:
১। একমাত্র আল্লাহ তাআলার ইবাদত করা।
২। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর উপর সত্যিকারের ঈমান আনা ও বিশ্বাস রাখা ।
৩। প্রতি বছর স্বতস্ফূর্তভাবে আপন মালের যাকাত আদায় করা। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ১৫৮২
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে ঈমানের মজা ও স্বাদ নসীব করুন।
দান-খয়রাতের দুনিয়াবি ফায়দা
যাকাত-সদকা এবং অন্যান্য দান খয়রাতের অনেক বড় বড় দুনিয়াবি ফায়দাও রয়েছে। যে ব্যক্তি দান খয়রাত করে, সে তার আত্মায় এক অভূতপূর্ব আনন্দ এবং অলৈাকিক প্রশান্তি লাভ করে। দরিদ্র মানুষের সহিংস দৃষ্টি থেকে সে রক্ষা পায়, বরং দরিদ্র মানুষেরা তার কল্যাণ কামনা করতে থাকে, তাকে ভালোবাসে। জনসাধারণের হৃদয়ে তার মর্যাদাপূর্ণ আসন তৈরি হয়। বিপদে-আপদে সকলের সহযোগিতা সে লাভ করে। আল্লাহ পাকও তার ধনদৌলতে বরকত দান করেন। একটি হাদীসে নবীজী এরশাদ করেন,
أَنْفِقْ يَا ابْنَ آدَمَ أُنْفقْ عَلَيْكَ
আল্লাহ তাআলা আদম-সন্তানকে ডেকে বলেন, হে বনি আদম! (আমার দেয়া মাল অভাবী মানুষের অভাব মোচনে, জনকল্যাণমূলক কাজে ও ধর্মীয় প্রয়োজনে) খরচ করে যাও, আমিও তোমাকে অবিরাম দিতে থাকবো। সহীহ বোখারী, হাদীস নং ৫৩৫২
অন্য একটি হাদীসে নবীজি বলেন,
ثَلَاثٌ أُقْسِمُ عَلَيْهِنَّ وَأُحَدِّثُكُمْ حَدِيثًا فَاحْفَظُوهُ فَأَمَّا الَّذِي أُقْسِمُ عَلَيْهِنَّ فَإِنَّهُ مَا نَقَصَ مَالُ عَبْدٍ مِنْ صَدَقَةٍ
আমি কসম করে বলতে পারি, দান সদকা করার কারণে মাল কমে না। সুনানে তিরমিযি, হাদীস নং ২৩২৫
আল্লাহ পাক আমাদেরকে এই সকল হাদীসের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও একীন হাসিল করার এবং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দান-সদকা করার তাওফীক দান করুন, আমীন।