লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
১৮৬৬ ঈসাব্দে কতিপয় মুখলিস, জমানার সেরা সন্তানদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল খালিস দ্বীনী প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ। ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর জেলার এক অঁজপাড়া গাঁয়ে জ্বলে উঠেছিল পৃথিবী মাত করা দিবাকর। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে অধ্যবধি গোটা বিশ্বে বিশেষ করে উপমহাদেশে দ্বীনে ইসলামের খিদমাতের প্রতিটি শাখায় রেখেছে প্রতিভার স্বাক্ষর। বললে অত্যুক্তি হবে না যে, এ উপমহাদেশে আল্লাহর রহমাতে মুহাম্মাদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত দ্বীনে শরীয়তের সহীহ মানহাজ-মাসলাক টিকিয়ে রেখেছে উলামায়ে দেওবন্দের কৃতিসন্তানেরা।
যে মাকসাদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ দ্বীনী ইদারা। অধ্যবধি সেই মাকসাদ, কর্মপদ্ধতি, সেই অনুপম আদর্শ থেকে একচুল নড়েনি। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে একই আদর্শ, একই কর্মপদ্ধতি, একই তাকাযা, একই মাকসাদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হাজারো, লাখো প্রতিষ্ঠান। উপমহাদেশের সীমান্ত পেড়িয়ে ইউরোপ আমেরিকাসহ পৃথিবীর মানচিত্রে ছড়িয়ে পড়েছে এর শাখাপ্রাশাখা। কওমী মাদরাসা। কওমের সহযোগিতায়, কওমের তত্বাবধানে, কওমের সন্তানদের নিয়েই এগিয়ে চলেছে কওমী মাদরাসা। যার শিকড় প্রোথিত হয়েছিল ছাত্তা মসজিদের ডালিম তলায়।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ দেড়শত বছরের ইতিহাস জন্ম দিয়েছে এক অপার বিস্ময়ের। সরকারী স্বীকৃতি ও সহযোগীতাহীন এসব প্রতিষ্ঠান অসংখ্য ঐতিহাসিক মনীষা তৈরী করে হতবাক করেছে গোটা বিশ্ব। ইলমে নববীর এমন বিভাগ নেই যাতে নেতৃত্বের আসনে আসীন হয়নি ফারেগীনে কওমী মাদরাসা।
তাফসীরুল কুরআন, শরহে হাদীস, দরসে হাদীস, ইলমে তাজবীদ, ইলমে তাসাওউফ, সমাজসেবা, রাষ্ট্রীয় স্বাধীকার আন্দোলন, রাজনীতি, সমাজ বিপ্লব, ইসলামী অর্থনীতি সর্বত্রই উলামায়ে দেওবন্দের রয়েছে সরব ও দাপুটে উপস্থিতি।
উলামায়ে দেওবন্দের হাতে পবিত্র কুরআনের অনুবাদ ও তাফসীর গ্রন্থ রচিত হয়েছে ৯০ এর অধিক। ইলমে হাদীস এবং হাদীস গ্রন্থের টিকা ও ব্যাখ্যা গ্রন্থ রচিত হয়েছে ১০০ এর উপরে। উসুলে ফিক্বহ, উলুমে ফিক্বহ এবং ফিক্বহে ইসলামী বিষয়ে উলামায়ে দেওবন্দের হাতে সংকলিত কিতাবের সংখ্যা শ’য়ের গন্ডি ছাড়িয়েছে বহু আগেই। ইলমে আদব বা সাহিত্য বিষয়ে উলামায়ে দেওবন্দের রচিত শুধু উর্দু আরবীতে রচিত কিতাব সংখ্যা পঞ্চাশোর্ধ। আধুনিক মাসায়েল এবং আকায়েদ বিষয়ে উর্দু আরবীতে লিখিত গ্রন্থ সংখ্যাও পঞ্চাশোর্ধ। সীরাত, তারীখ, ফিরাক্বে বাতিলা, ইলমে তাজবীদ ইত্যাদি বিষয়েও অমর সব গ্রন্থ রচনা করে উলামায়ে দেওবন্দ মুসলিম উম্মাহর প্রয়োজনে রেখেছে আলোকবর্তিকার ভূমিকা।
এছাড়া নাস্তিকতা, শিয়া রাফেজী মতবাদ, কাদিয়ানী মতবাদ, মুনকিরীনে হাদীস, শিরক ও বিদআদ, মুনকিরীনে ফিক্বহ এবং নানাভিদ ধর্মীয় ফিরক্বার প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধেও নিয়েছে শক্ত অবস্থান। গ্রন্থ রচনা, বয়ান, আন্দোলন ইত্যাদির মাধ্যমে দ্বীনে হককে রেখেছে বিজয়ী-সমুন্নত।
সরকারী স্বীকৃতিহীন এসব প্রতিষ্ঠান থেকেই জন্ম নিয়েছে দাওয়াত ও তাবলীগের নবজাগরণকারী দাঈয়ে ইসলাম ইলিয়াস রহঃ। এ কওমী মাদরাসাই উপহার দিয়েছে একজন সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী। ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে যিনি ছিলেন অগ্রসৈনিক। দেশপ্রেম আর স্বকীয়তা-স্বাতন্ত্রতা বজিয়ে ইসলামী রাজনীতির নিষ্কলুস পাঠ শিখিয়েছেন এ মহান মনীষী।
এ কওমী মাদরাসা। এ দারুল উলুম দেওবন্দ জাতিকে উপহার দিয়েছে বায়হাকীয়ে ছানী আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহঃ। ইলমে তাসাওউফের ময়দানে নেতৃত্বের আসন অলংকৃত করা মনীষী হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহঃ। ইলমে হাদীসের ময়দানে বিস্ময় পুরুষ হাবীবুর রহমান আজমী রহঃ, আব্দুর রশীদ নুমানী রহঃ এ বাগানেরই প্রস্ফুটিত গোলাপ। জিহাদের ময়দানে সিপাহসালার, দুর্বার দুঃসাহসী উবায়দুল্লাহ সিন্ধী তৈরী করেছিল এ কওমী মাদরাসাই।
আদব, আখলাক, বড়দের সম্মান, ছোটদের স্নেহ, দেশপ্রেম, স্বাধীনতা আন্দোলন, ইলমে নববীর চর্চা, নিজ ও সমাজ জীবনে সুন্নাতে নববীর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নই ছিল এ প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য। যে মেহনত ও মুজাহাদা আজো বহমান। আলহামদুলিল্লাহ।
ইংরেজ সরকারের হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়ে যাওয়া মাদরাসার দুঃখকে বুকে ধারণ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কওমী মাদরাসা। সরকারী সহযোগিতা ছাড়া, কেবলি আম জনতার স্বতস্ফুর্ত সহযোগিতাকে পূঁজি করে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলই ছিল এসব প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। সরকারী স্বীকৃতি নয় মহান মালিকের কাছ থেকে গ্রহণীয়তার স্বীকৃতির আদায়ে চলছিল চেষ্টা-মেহনত।
কালের পরিক্রমায়, সময়ের প্রয়োজনে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ে ভিন্ন চিন্তায় নিমগ্ন হয়েছেন অনেকেই। কওমী মাদরাসা সিলেবাস সংস্কার, সরকারী স্বীকৃতি বিষয়ে সরব প্রতিক্রিয়া চলছে খোদ এসব প্রতিষ্ঠানেই। মুখ খুলছেন বড়দের থেকে নিয়ে বাচ্চা পোলাপানও। জ্ঞানী উলামা থেকে নিয়ে অর্বাচিন ছেলেটাও। কলম ধরছেন মান্যবর ব্যক্তি থেকে অতি পণ্ডিত অদূরদর্শীও।
বড়কে সম্মান, নীতি-নৈতিকতা, যা ছিল এসব প্রতিষ্ঠানের গৌরব। সেই সবক ভুলে গিয়ে হাস্যকর অতি আধুনিক দরদী সেজেছেন কেউ কেউ। বেহিসেবী জবান আর হাজ্জাজী কলমে লিখে চলছেন অনেক কিছুই। চলছে নানা চিন্তনের অবাধ উদগিরণ।
যা দেখে লজ্জায়, অপমানে বাকরুদ্ধ আমাদের মত অনেকেই। যদি কওমী মাদরাসাকে ভালইবাসি। যদি এর কল্যাণকামীতাই আমার মাকসাদ। তাহলে এ কওমী মাদরাসা আমাকে যা শিখিয়েছে। তা আমার থেকে বিদূরিত হল কিভাবে?
যে শিক্ষা, যে প্রতিষ্ঠান আমাদের আদব শিখিয়েছে। শিখিয়েছে বড়কে সম্মান ও ছোটকে স্নেহ করা। যে শিক্ষার পরতে পরতে শিখেছি বড়দের ভুল না বলে “তাসামু” বলে সম্মানসূচক শব্দ ব্যবহার। আজ সে শিক্ষা সংস্কার দাবীতে আমার উচ্চারিত শব্দে আদব কোথায়? কোথায় আমার নীতি নৈতিকতা আর শ্রদ্ধাবোধ? এ গান্ধা জবানে কাসেমী কাফেলার পূণ্যময় শিক্ষা নিয়ে কথা বলার অধিকার আমাকে কে দিল?
আকাবীরদের পূণ্যময় হাতে লেখা কওমী মাদরাসা পরিচালনা নীতি বা উসূলে হাশতগানা অনুপাতে সময়ের প্রয়োজনে সিলেবাস সংস্কারের দাবি উঠা যৌক্তিক।
কারণ উসূলে হাশতগানার ৫ম উসুলে লিখা হয়েছে “পূর্ব থেকে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারিত রয়েছে কিংবা পরবর্তীতে পরামর্শের ভিত্তিতে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারণ করা হবে তা যাতে সমাপ্ত হয়; এই ভিত্তিতেই পাঠদান করতে হবে। অন্যথায় এ প্রতিষ্ঠান সুপ্রতিষ্ঠিত হবে না, আর যদি হয়ও তবু তা ফায়দাজনক হবে না।” [দেওবন্দ আন্দোলনঃ ইতিহাস ঐতিহ্য ও অবদান-১৭৮]
“পরবর্তীতে পরামর্শক্রমে যে পাঠ্যসূচী নির্ধারণ করা হবে” এ বাক্য দ্বারা পরিস্কারভাবে বুঝানো হয়েছে পরবর্তীতে প্রয়োজনে পরামর্শক্রমে পাঠ্যসূচীতে সংযোজন ও বিয়োজন হতে পারে।
সুতরাং আকাবীরদের সেই মূলনীতি অষ্টক অনুপাতেই কওমী মাদরাসা সিলেবাসে পরামর্শক্রমে সংস্কার করার দাবি মোটেই দোষণীয় নয়। সময়ের প্রেক্ষাপটে আমাদেরও দাবি-
১- কাফিয়া জামাত [৮ম শ্রেণী] পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজী, অংক, দেশ পরিচিতি, ইসলাম ও দেশের ইতিহাস, সমাজ বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গুলো ছাত্রদের উপযোগী সহজ পুস্তক রচনা করে সংযুক্ত করা হোক।
২- পড়ানোর মাধ্যম সর্বত্রই বাংলাকে গ্রহণ করা হোক।
৩- আরবী ভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছাত্রদের তৈরী করা হোক।
৪- ফিক্বহে ইসলামীর সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট নুসূস সমৃদ্ধ পাঠ গুরুত্বের সাথে পড়ানো হোক।
৫- সারা দেশের কওমী মাদরাসাগুলোতে মৌলিক শিক্ষা সিলেবাসে একতা রক্ষা করা হোক। যাতে করে কওমী শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা বৈষম্য তৈরী না হয়।
ইত্যাদি দাবি আমরা আদবের সাথে সংশ্লিষ্ট বড়দের কাছে পেশ করতেই পারি। কওমী মাদরাসার প্রতি ভালবাসা, এর অবদান বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার তীব্র আকাংখা আমাদের এতটুকু আগ্রহী করে তুলতেই পারে। আমরা মনে করি এটি দোষণীয় কিছু নয়।
কিন্তু কওমী মাদরাসা শিক্ষা সিলেবাস এতবেশি সংস্কার করা হোক যে, এর থেকে ইঞ্জিনিয়ার বের হবে, ডাক্তার, এডভোকেট বের হবে ইত্যাদি দাবিকে আমরা হাস্যকর ও অন্তসারশূণ্য মনে করি। যেমন কলেজ ভার্সিটি থেকে মুহাদ্দিস, মুফতী, মুফাসসির, হাফিজুল কুরআন বের করার আহমকী দাবিকে আমরা হাস্যকর মনে করি। সংস্কারের নামে ইলমে ওয়াহীর এক বিশাল ভান্ডার সমৃদ্ধ উর্দু ভাষা শিক্ষা বিদায় করার দাবিকে অপরিণামদর্শী বাচ্চাসূলভ দাবি বলেই আমাদের বিশ্বাস।
শিক্ষা সংস্কারের নামে যেন কওমী মাদরাসা যে আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত, যে মাকসাদে প্রতিষ্ঠিত তার মাঝে কোন ধরণের আঁচ না পরে।
আর সনদের স্বীকৃতি? এ বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের ভাবনা বড়দের কাছে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিতভাবে পেশ করতে পারি। কিন্তু তা যেন বড়দের সম্মানে আঘাত করে নয়। শালীনতার গন্ডি পেড়িয়ে নয়। নিজের বড়ত্ব জাহির করে নয়। পূর্ণ আদবের সাথে। বড়দের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে, আদবের সাথে নিজের ভাবনা উপস্থাপন করতে পারি।
কিন্তু ইদানিং আমরা যা দেখতে পাচ্ছি। কিছু অর্বাচিন যুবকের অবাধ আস্ফালন। মাদারিসে কওমীয়ার স্বঘোষিত হিতাকাংখীর আসনে সমাসিন কতিপয় অপরিণামদর্শী ভুঁইফোড় সংগঠনের কার্যক্রমে আমরা বিব্রত। লজ্জিত। বড়দের সম্মানহানীর এজেন্ডা নিয়ে যেন মাঠে নেমেছে এসব অতি কওমী দরদী ভাইগুলো। হাজ্জাজী কলম, বেহিসাবী বক্তব্য আর লাগামহীন আচরণ পুরো কওমী মাদরাসার আদর্শকেই আজ প্রশ্নবিদ্ধ করে দিচ্ছে।
আমরা স্পষ্ট শব্দে বলতে চাই!
যদি কওমী মাদরাসার আদর্শ অনুসরণ করে বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে নিজের দাবি দাওয়া পেশ না করতে পারো, তাহলে তোমাদের কোন অধিকার নেই এ আদর্শ প্রতিষ্ঠান নিয়ে ভাবার। আগে আদব শিখো। তারপর ভাবতে এসো এ পূণ্যময় শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে।