প্রশ্ন
আসসালামু আলাইকুম সম্মানিত মুফতি সাহেব
তথাকথিত আহলে হাদিস ভাইয়েরা আমাকে প্রশ্ন করেছে, যদি পীর ধরা হালাল হতো তাহলে কেন আরব দেশ গুলোতে পীর নাই?
দ্রুত এবং দলিলসহ সমাধান দিয়ে তাদের উপযুক্ত জবাবের আশায় রইলাম।
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
উক্ত কথিত আহলে হাদীস ভাইয়েরা কি কুরআন হাদীসের অনুসারী নাকি আরব দেশের লোকদের অন্ধ মুকাল্লিদ? যদি কুরআন হাদীসের অনুসারী হয়ে থাকে, তাহলে পীর মুরীদী কুরআন ও হাদীসে আছে কি না? এটা হতো তাদের প্রশ্ন। কিন্তু আরব দেশে নেই কেন? এমন প্রশ্নতো আরব দেশের অন্ধ তাকলীদের প্রমাণ। আরব দেশের লোকেরা করলে মানবেন। আর তারা না করলে মানবেন না? এটা কি কথিত আহলে হাদীসদের শরীয়ত মান্য করার মানদণ্ড?
আরব দেশের লোকেরা অনেক কাজই করে থাকে, সবই কি আমাদের মানতে হবে বা করতে হবে? তাদের অনেকেই দাড়ি কাটেন। টাখনুর নিচ পর্যন্ত জুব্বা পড়েন। অনেকে নামাযও পড়েন না। মদও খান। হলিউড বলিউডের নায়ক নায়িকা ভাড়া করে এনে কনসার্টের নামে অশ্লীলতা করে। অশ্লীল সিনেমা সিনেমা হলে প্রদর্শন করে। লাখ লাখ টাকা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মদের বার আর জুয়ার আসরে উড়ায়। এখন আরবের লোকেরা করলেই যদি তা করতে হয়, আর তারা ছেড়ে দিলেই ছেড়ে দিতে হয়, তাহলেতো এসব নোংরামীও কথিত আহলে হাদীসরা শরীয়ত বানিয়ে দিবে।
আমাদের কাছে কোন দেশ ও গোষ্ঠি দলীল নয়। দলীল হলো, কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমা-কিয়াস।
উক্ত দলীলের আলোকে যদি পীর মুরীদী প্রমাণিত হয়, তাহলে তা আরব দেশের লোকেরা করুক বা না করুক তা আমাদের জন্য গ্রহণীয়। আর প্রমাণিত না হলে আরবের লোকেরা করলেও তা আমাদের কাছে গ্রহণীয় হবে না।
এবার আপনার প্রশ্নের উত্তরটি বুঝুন:
পীর মানে হলো মুরুব্বী। বয়স্ক। আরো সহজ ভাষায় বললে শিক্ষক। যিনি কুরআন ও হাদীসের উপরে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাতানো পথে আমল করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সহজ পথ বিষয়ে অভিজ্ঞ।
এমন একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির তত্বাবধানে দ্বীন পালনের প্রশিক্ষণ নেবার নামই হলো মুরীদ হওয়া। আর ঐ প্রশিক্ষক হলেন পীর।
এ পদ্ধতিই হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদ্ধতি। সাহাবায়ে কেরামগণ রাঃ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এভাবেই দ্বীন শিখেছেন। আমল করেছেন। আত্মাকে শুদ্ধ করেছেন।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে সাহাবায়ে কেরামগণ যেমন ইসলাম গ্রহণের বাইয়াত গ্রহণ করেছেন। তেমনি আমলের মাধ্যমে নিজের আত্মশুদ্ধির বাইয়াতও গ্রহণ করেছেন। যেমনটি আমরা পীর মুরীদীর বাইয়াতের মাঝে দেখতে পাই।
যেমন এক হাদীসে আসছে:
عَوْفُ بْنُ مَالِكٍ الْأَشْجَعِيُّ، قَالَ: كُنَّا عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، تِسْعَةً أَوْ ثَمَانِيَةً أَوْ سَبْعَةً، فَقَالَ: «أَلَا تُبَايِعُونَ رَسُولَ اللهِ؟» وَكُنَّا حَدِيثَ عَهْدٍ بِبَيْعَةٍ، فَقُلْنَا: قَدْ بَايَعْنَاكَ يَا رَسُولَ اللهِ، ثُمَّ قَالَ: «أَلَا تُبَايِعُونَ رَسُولَ اللهِ؟» فَقُلْنَا: قَدْ بَايَعْنَاكَ يَا رَسُولَ اللهِ، ثُمَّ قَالَ: «أَلَا تُبَايِعُونَ رَسُولَ اللهِ؟» قَالَ: فَبَسَطْنَاأَيْدِيَنَا وَقُلْنَا: قَدْ بَايَعْنَاكَ يَا رَسُولَ اللهِ، فَعَلَامَ نُبَايِعُكَ؟ قَالَ: «عَلَى أَنْ تَعْبُدُوا اللهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا، وَالصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ، وَتُطِيعُوا – وَأَسَرَّ كَلِمَةً خَفِيَّةً – وَلَا تَسْأَلُوا النَّاسَ شَيْئًا» فَلَقَدْ رَأَيْتُ بَعْضَ أُولَئِكَ النَّفَرِ يَسْقُطُ سَوْطُ أَحَدِهِمْ، فَمَا يَسْأَلُ أَحَدًا يُنَاوِلُهُ إِيَّاهُ
আউফ ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা নয় বা আট কিংবা সাতজন লোক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তিনি বললেন, তোমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বায়আত গ্রহণ করবে কি? অথচ আমরা কিছু দিন আগে তার হাতে বায়আত গ্রহণ করেছিলাম। তাই আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা তো আপনার নিকট বায়আত গ্রহণ করেছি। তিনি আবার বললেন, তোমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বায়আত গ্রহণ করবে কি? আমরা বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা তো বায়আত গ্রহণ করেছি। তিনি আবার বললেন, তোমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বায়আত গ্রহণ করবে কি?
তখন আমরা আমাদের হাত প্রসারিত করে দিলাম এবং বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা তো আপনার নিকট বায়আত গ্রহণ করেছি। এখনি আবার কিসের উপর বায়অোত গ্রহণ করবো? বললেন, (এ কথার উপর বায়আত গ্রহণ করবে যে,) তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে অন্য কাউকে শরীক করবে না। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করবে। আল্লাহর আনুগত্য করবে। তারপর তিনি ফিসফিস করে একটি কথা বললেন, মানুষের নিকট কোন কিছু সাওয়াল করবে না। আমি দেখেছি, এই কাফিলার কারো পশুর পৃষ্ট থেকে চাবুক পড়ে যাওয়ার পর সে কাউকে তা তুলে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানায়নি। {সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১০৪৩, ইফাবা-২২৩৫}
এ হাদীস খেয়াল করুন। সাহাবায়ে কেরাম ইতোপূর্বে ইসলামের বাইয়াত গ্রহণের পরও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার ইবাদতে মগ্ন থাকাসহ আরো অন্যান্য বিষয়ে আবার বাইয়াত নিয়েছেন। তাসাওউফ তথা পীর মুরীদীর বাইয়াতও তেমনি হয়ে থাকে।
সুতরাং পীর মুরীদী এটা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। হ্যাঁ, পীর শব্দটি কুরআন বা হাদীসে নেই। যেমন নামায শব্দ হাদীসে নেই। কিন্তু মূল বিষয় হাদীসে রয়েছে।
তাই ‘আরবের লোকেরা করে না’ বলে তাচ্ছিল্যভরে তা বাতিল করে দেয়া নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি আমলকে অবজ্ঞা করার শামিল। যা খুবই মারাত্মক গোনাহের কাজ। তাই এহেন কাজ যারা করে, তাদের তওবা করা আবশ্যক।
আরো পড়ুন: কুরআন ও হাদীস থাকতে পীর ধরতে হয় কেন?
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ইসলামিয়া দারুল হক লালবাগ ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা: কাসিমুল উলুম আলইসলামিয়া, সালেহপুর আমীনবাজার ঢাকা।
পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।
শাইখুল হাদীস: জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, সনমানিয়া, কাপাসিয়া, গাজীপুর।
ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com