প্রশ্ন
লা-মাযহাবী শায়েখ তাউসীফুর রহমান তার ভিডিও লেকচার “ফাযায়েলে আমালের হাকীকত” নামক বক্তব্যের এক স্থানে উল্লেখ করেছেন যে, ফাযায়েলে দরূদে একটি ঘটনা এসেছে যে, এক ব্যক্তি দোকান খুললে শুরুতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ পাঠ করতেন। তারপর তা লিখে রাখতেন। উক্ত ব্যক্তির মৃত্যুর সময় হয়ে গেলে লোকটি খুবই চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। তখন এক মাযযূব এসে বলেন যে, তোমার দরূদ নবীজী দরবারে উপস্থিত করা হয়েছে। আর তোমার নাজাতের ফায়সালা হচ্ছে।”
এটি বলার পর তিনি বলেছেন, এটি গায়েবের খবর। আল্লাহ ছাড়া যা আর কারো নেই। নাজাতের ফায়সালা হচ্ছে তা কিভাবে একজন বান্দা জানল?
বিস্তারিত জবাব দিয়ে বাধিত করবেন।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
এ তাউসীফুর রহমান যেমন জাহিল তেমনি দাজ্জাল। লোকটি এমন আত্মবিশ্বাসের সাথে মিথ্যা কথা বলে যা দেখে যে কেউ বিভ্রান্ত হতে পারে। ভিডিও লেকচারটি দেখে আমরা হয়রান হয়ে গেছি। একটা মানুষ দাড়ি টুপি মাথায়, সৌদী রুমালের ঘুমটা দিয়ে এমন মিথ্যাচার ও প্রতারণা কিভাবে করতে পারে?
ফাযায়েলে দরূদের উক্ত ঘটনার কোথাও “নাজাতের ফায়সালা হচ্ছে” শব্দটা নেই। এটি তাউসীফুর রহমানের লা-মাযহাবী প্রতারণামূলক মতবাদের কুশিক্ষার ফল। সত্যকে তাদের মিথ্যা মনে হয়, আর মিথ্যাকে মনে হয় সত্য। যে কথা ফাযায়েলে আমালে লিখা হয়নি, তা কি করে ফাযায়েলে আমালের বক্তব্য বলে চালানো হয়?
আমরা প্রথমে ফাযায়েলে দরূদের ঘটনাটি দেখে নেইঃ
আমার একজন বিশ্বস্ত বন্ধু আমার নিকট লক্ষ্ণৌ এর একজন বিখ্যাত কাতেবের ঘটনা বর্ণনা করেন যে, তাহার অভ্যাস ছিল প্রতি দিন সকাল বেলায় লেখা আরম্ভ করার শুরুতেই একটি সাদা খাতায় একবর দরূদ শরীফ লিখে রাখতো, তারপর লেখার কাজ শুরু করতো। উক্ত লোকটি যখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত তখন আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হয়ে বলতে লাগল, হায়! সেখানে আমার কি উপায় হবে? ইত্যবসরে একজন মাজযুব সেখানে উপস্থিত হয়ে বলতে লাগল, বাবা তুমি কেন ঘারড়াচ্ছো? তোমার সেই সাদা খাতাটা যেখানে দরূদ শরীফ লেখা হতো সেটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে পেশ করা হয়েছে। আর তা কবুল হচ্ছে। [ফাযায়েলে আমাল উর্দু- ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৭৪৬, বাংলা ফাযায়েলে দরূদ-৮৪, তাবলীগী কুতুবখানা]
উপরোক্ত ঘটনায় শুধু এতটুকু লেখা হয়েছে যে, উক্ত লোকের পঠিত দরূদ কবুল হয়েছে। ব্যস এতটুকুই। তাউসীফুর রহমানের বলা “লোকটির নাজাতের ফায়সালা হচ্ছে” মর্মে কোন কথার অস্তিত্বই উক্ত বক্তব্যের কোথাও নেই।
এটি তাউসীফুর রহমান মিথ্যুকের একটি মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়।
এবার তাউসীফুর রহমান সাহেবের আরেকটি অভিযোগ বাকি রইল। সেটি হল, দরূদ কবুল হবার গায়েবের খবর মাজযূব ব্যক্তিটি কিভাবে পেল?
আমরা ইতোপূর্বের প্রশ্নোত্তরে বিভিন্ন দলীলের আলোকে প্রমাণিত করেছি যে, এটি বুযুর্গদের কাশফ। এর নাম ইলমে গায়েব নয়।
আর কাশফ কুরআন, হাদীস ও খুলাফায়ে রাশেদীনদের দ্বারাই প্রমাণিত বিষয়।
আমাদের প্রকাশিত “কাশফ কারামতের হাকীকত ও প্রামাণিকতা” নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেটি দেখে নিতে পারেন।
তাছাড়া লা-মাযহাবী গায়রে মুকাল্লিদদের শাইখুল কুল ফিল কুল মিয়া নজীর হুসাইন দেহলবী সাহেব লিখেছেনঃ
“আল্লাহ তাআলা আউলিয়ায়ে কেরামকে কাশফ ও ইলহামের মাধ্যমে অদৃশ্যের বিষয় জানিয়ে দেন।”। [ফাতাওয়া নজীরিয়া-১/১৪৯]
মৌলভী নজীর হুসাইন দেহলবী সাহেবের উক্ত ফাতওয়ায় নি¤œ বর্ণিত আহলে হাদীস উলামাগণ দস্তখত করেনঃ
১- মুহাম্মদ কুতুবুদ্দীন।
২- নাওয়াজিশ আলী।
৩- মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ।
৪- মুহাম্মদ বশীরুদ্দীন কঙ্গী।
৫- সৈয়দ মাহবুব আলী যাফরী।
৬- মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী।
৭- মুহাম্মদ বিন বরকতুল্লাহ পাঞ্জাবী।
৮- আহমদুল্লাহ।
দ্রষ্টব্যঃ ফাতাওয়া নজীরিয়া-১/১৫২।
এ ফাতওয়াটি শায়েখ আবুল হাসানাত আলী মুহাম্মদ সা’দী তার কিতাব “ফাতাওয়া উলামায়ে হাদীস” এও নকল করেছেন। দেখুন ফাতাওয়া উলামায়ে হাদীস-৯/১৭৯।
উপরোক্ত নয়জনসহ আহলে হাদীস আলেম মিয়া নজীর হুসাইন। এ দশজন লা-মাযহাবী গায়রে মুকাল্লিদ, আহলে হাদীস আলেমের ব্যাপারে বর্তমান আহলে হাদীস লা-মাযহাবী আলেমদের ফাতওয়া কী হবে?
উপরোক্ত ফাতওয়া লেখার কারণে, এবং এর উপর দস্তখত করে এটিকে সমর্থন করার কারণে তার মুশরিক হলেন কি না? তারা শিরক করলেন কি না? এ বিষয়টি পরিস্কার করার জন্য বর্তমান লা-মাযহাবী শায়েখদের কাছে আবেদন রইল।
আমাদের প্রশ্নঃ
১
হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ এর পিতার কাশফ হল যে, তিনি উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়ে যাবেন। তিনি যেমনটি ভাবছিলেন ঠিক তাই হয়ে ছিল। দেখুন বুখারী, হাদীস নং ১৩৫১, তাওহীদ পাবলিকেশন্সের বুখারী-২/৫১।
কে কোথায় কিভাবে মারা যাবে, তা আল্লাহ তাআলাই জানেন। কিন্তু হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ এর পিতা জেনে গেলেন, তিনি কিভাবে কোথায় মারা যাবেন। এটিতো কাশফ ছাড়া কিভাবে হল। নিশ্চয় এটি কাশফ।
তাছাড়া ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় আরো লিখেছেন যে, এতে হযরত জাবের রাঃ এর পিতার কারামত নিহিত। কেননা, তিনি যেমনটি বলেছেন, তেমনি হয়েছিল। [ফাতহুল বারী-৩/২১৭]
এখন তাউসীফুর রহমানসহ সকল লা-মাযহাবী শায়েখদের কাছে আমাদের প্রশ্ন হল, হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ এর পিতাও কি গায়েব জানতেন? তিনিও কি আলিমুল গায়েব ছিলেন? নতুবা উক্ত ঘটনা সংঘটিত হল কিভাবে?
আর উক্ত কাশফ সম্পর্কিত ঘটনা ইমাম বুখারী তার কিতাবে আনার মাধ্যমে তিনি কি শিরক করেছেন?
একটু পরিস্কার করার অনুরোধ রইল।
২
তেমনি হযরত উমর বিন আলী বাজ্জার রহঃ [মৃত্যু-৭৪৯ হিজরী] তার সংকলিত “আলইলামুল আলিয়্যাহ ফী মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া” নামক গ্রন্থের ৫৩ নং পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর কারামতের ঘটনা। যা ইতোপূর্বের প্রশ্নোত্তরে বর্ণিত হয়েছে। লিংক- https://ahlehaqmedia.com/5355-2/
প্রশ্ন হল, বলা ছাড়াই ইবনে তাইমিয়া রহঃ এ কাছে মনের খবর কিভাবে প্রকাশিত হয়ে গেল? এ গায়েবের খবর ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর জেনে যাবার দ্বারা কি তিনি ইলমে গায়েবের অধিকারী হয়ে গেছেন?
৩
حَدَّثَنَا أَبُو أَحْمَدَ، حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ، عَنِ الْبَرَاءِ، أَوْ غَيْرِهِ، قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ مِنَ الْأَنْصَارِ بِالْعَبَّاسِ قَدْ أَسَرَهُ، فَقَالَ الْعَبَّاسُ: يَا رَسُولَ اللهِ، لَيْسَ هَذَا أَسَرَنِي، أَسَرَنِي رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ أَنْزِعُ مِنْ هَيْئَتِهِ كَذَا وَكَذَا، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِلرَّجُلِ: ” لَقَدْ آزَرَكَ اللهُ بِمَلَكٍ كَرِيمٍ “
সনদঃ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহঃ, তিনি আবু আহমাদ যুবায়রী থেকে, সুফিয়ান সাওরী থেকে, তিনি আবু ইসহাক থেকে, তিনি বারা বিন আযেব রাঃ থেকে।
অনুবাদঃ আনসারী এক ব্যক্তি হযরতকে আব্বাসকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসল। [হযরত আব্বাস রাঃ তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি]
তখন আব্বাস বলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এ আনসারী আমাকে বন্দী করেনি! আমাকে বন্দী করেছে এমন ধরণের এক ব্যক্তি! যার মাথার চুল কামানো ছিল, আর যার আকৃতি এমন এমন ছিল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাকে মহান ফেরেশতা দর্শন করিয়েছেন। [মুসনাদে আহমাদ-১৪/১৯২, হাদীস নং-১৮৪৯৯}
উক্ত হাদীস বিশুদ্ধ। যা আমরা কাশফের প্রমাণিকতার আলোচনায় বিস্তারিত আলোচনা করেছি। লিংক- https://ahlehaqmedia.com/5455/
এখন প্রশ্ন হল, ফেরেশতাতো গায়েবের বিষয়। হযরত আব্বাসের কাছে উক্ত গায়েবের বিষয় কিভাবে প্রকাশিত হল? তিনি কি আলিমুল গায়েব?
৪
লা-মাযহাবী শায়েখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী আরবের এক শায়েখের একটি আকিদাহ বিষয়ক বই অনুবাদ করেছেন। যেটি লা-মাযহাবী আহলে হাদীস নামধারী বন্ধুদের নিজস্ব প্রকাশনী “তাওহীদ পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত বইটির নাম হল, নাজাতপ্রাপ্ত দলের আকীদাহ। সে বইয়ে নাজাতপ্রাপ্ত দলের আকীদা উল্লেখ করা হয়েছে যে, আউলিয়া কেরামের কারামত সত্য। এটাই নাজাতপ্রাপ্ত দলের আকীদাহ। কারামতের প্রমাণ হিসেবে বুখারী মুসলিমে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে এসেছে যে, জুরাইজ নামক একজন ইবাদত গোজার ছিলেন। এক বেশ্যা মহিলা একজন রাখালের সাথে জিনা করে একটি বাচ্চা প্রসব করে। তখন লোকদের কাছে ছড়ানো হয় যে, বেশ্যা মহিলার প্রসব করা বাচ্চাটি জুরাইজের। তখন লোকেরা এসে জুরাইজের ইবাদতখানা ভেঙ্গে দেয় এবং তাকে মারধর করতে থাকে।
বিস্তারিত বিবরণের এক পর্যায়ে লিখা হয়েছে “জুরাইজ জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের কি হল? আমাকে মারছো কেন? আমার ইবাদতখাটিই বা কেন ভেঙ্গে ফেললে? লোকেরা বলল, তুমি এই মহিলার সাথে ব্যভিচার করেছো। যার কারণে মহিলাটি সন্তান প্রসব করেছে। জুরাইজ জিজ্ঞাসা করলঃ শিশুটি কোথায়? তারা শিশুটিকে নিয়ে আসল। জুরাইজন বলল আমাকে নামায পড়ার জন্য একটু সময় দাও। তারা তাকে নামায পড়ার সুযোগ দিল। নামায শেষ করে শিশুটির কাছে গিয়ে তার পেটে খুচা দিয়ে বললঃ এই ছেলে তোমার বাপ কে? ছেলেটি বলে দিল, ছাগলের রাখাল।” [নাজাতপ্রাপ্ত দলের আকীদাহ, পৃষ্ঠা-২৮১, লেখক হাফেজ বিন আহমাদ আল-হাকামী, অনুবাদক- আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী, প্রকাশক-তাওহীদ পাবলিকেশন্স]
এ ঘটনাটি বুখারীতেও এসেছে। দেখুন বুখারী, ২/৪৮৭-৪৮৮।
উক্ত ঘটনায় দু’টি প্রশ্ন!
১
জুরাইজ কিভাবে জানলেন যে, নামায পড়ে বাচ্চাকে খুচা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে বাচ্চাটি তার জন্মদাতা পিতার নাম বলে দিবে?
এ গায়েবের বিষয় তার কাছে কাশফ হল কিভাবে?
২
শিশু বাচ্চাটি কিভাবে তার পিতার নাম বলে দিল?
তার পিতার নাম তার কাছে কিভাবে কাশফ হয়ে গেল?
তাহলে কি জুরাইজ এবং শিশু বাচ্চাটি আলিমুল গায়েব? তারা ইলমে গায়েব জানেন?
আর উক্ত ঘটনাটি সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিমে নকল করার দ্বারা উক্ত কিতাবের লেখকের এবং আকিদা বইয়ের লেখকের হুকুম কী হবে?
উপরোক্ত চার প্রশ্নের যে জবাব তাউসীফুর রহমানসহ লা-মাযহাবী শায়েখগণ প্রদান করবেন একই জবাব আমাদেরও। এসবই কাশফ। যা আল্লাহ তাআলা তার প্রিয় কোন বান্দার মাধ্যমে প্রকাশ করে দেন। যা প্রকাশের কোন ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট বুযুর্গের থাকে না। এসব কাশফের ঘটনাকে শিরক বলা, ইলমে গায়েব বলা মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়।
কাশফ বিষয়ে জানতে হলে পড়ুন
কাশফ-কারামতের হাকীকত ও প্রামাণিকতা!
“কাশফ” সম্পর্কে শায়েখ মতিউর রহমান মাদানীর বিভ্রান্তির জবাব! [ভিডিও]
অপবাদের কবলে ফাযায়েলে আমাল [পর্ব ৭] অযুর পানিতে গোনাহ ঝরতে দেখা কি ইলমে গায়েব?
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
মুহাদ্দিস-জামিয়া উবাদা ইবনুল জাররাহ, ভাটারা ঢাকা।
ইমেইল– [email protected]