প্রচ্ছদ / আকিদা-বিশ্বাস / অপবাদের কবলে ফাযায়েলে আমাল [পর্ব ৭] অযুর পানিতে গোনাহ ঝরতে দেখা কি ইলমে গায়েব?

অপবাদের কবলে ফাযায়েলে আমাল [পর্ব ৭] অযুর পানিতে গোনাহ ঝরতে দেখা কি ইলমে গায়েব?

প্রশ্ন

ফাযায়েলে আমালে লিখা হয়েছে যে, জনৈক বুযুর্গ কাশফের মাধ্যমে অজুর পানি দেখে বলে দিতেন যে, উক্ত ব্যক্তি কি গোনাহ করেছে? অযুর পানির সাথে গোনাহ ঝরতো। আর সেই পানি দেখে বুযুর্গ ব্যক্তি বলে দিতে পারে যে, গোনাহ কোনটি ছিল?

এটা কি ইলমে গায়েব নয়?

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

না, এটি ইলমে গায়েব নয়। বরং কাশফ। আর উক্ত ঘটনাটি ঘটেছে ইমাম আজম আবূ হানীফা রহঃ এর ব্যাপারে। তিনি অযুর পানি দেখে কোন গোনাহ পানি দ্বারা ঝরে পড়ছে তা বলে দিতে পারতেন।

যেহেতু শায়েখ জাকারিয়া রহঃ নিজেই লিখে দিয়েছেন যে, উক্ত ব্যাপারটি কাশফের মাধ্যমে হতো, তাই পরিস্কার যে, এটি ইলমে গায়েবের বিষয় নয়। বরং কাশফের বিষয়।

এখন প্রশ্ন হল, কাশফ ও ইলমে গায়েব একই জিনিস? নাকি ভিন্ন?

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ পরিস্কার লিখেছেন যে, وَلَيْسَ هَذَا من علم الْغَيْب কাশফ ইলমে গায়েব নয়। [কিতাবুর রূহ-২৯৬]

কাশফকে ইলমে গায়েব সাব্যস্তকারীদের কাছে প্রশ্ন!

যারা কাশফকে ইলমে গায়েব মনে করেন, তাদের কাছে আমাদের প্রশ্ন হলঃ

ইমাম গাযালী রহঃ [মৃত্যু ৫০৫ হিজরী] হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাঃ এর একটি কাশফের ঘটনা উল্লেখ করে দলীল পেশ করে বলেনঃ

وقال أبو بكر الصديق رضي الله عنه لعائشة رضي الله عنها عند موته إنما هما أخواك وأختاك وكانت زوجته حاملاً فولدت بنتاً فكان قد عرف قبل الولادة أنها بنت

হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাঃ তার কন্যা আয়শা রাঃ মৃত্যুর সময় বললেন, তোমার ভাই এবং তোমার দুই বোন। [অথচ সে ময় বোন ছিল একজন] সে সময় আবু বকর রাঃ এর স্ত্রী গর্ভবতী ছিলেন। [আবু বকর সিদ্দীক রাঃ এর ইন্তেকালের পর] তারপর তার স্ত্রী কন্যা সন্তান প্রসব করেন। অথচ জন্ম গ্রহণের আগেই আবু বকর রাঃ কন্যা সন্তান হবার বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন। [ইহয়াউ উলুমিদ্দীন-৩/২৩]

1

মুসনিদুল হিন্দ শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ লিখেছেনঃ

হযরত সিদ্দিকে আকবর রাঃ হযরত আয়শা রাঃ কে বললেন, যে সম্পদ আমি তোমাকে দিয়েছি, যদি তুমি তা হাসিল করে থাকো, তাহলে ঠিক আছে, নতুবা আমার মৃত্যুর পর তোমার সাথে তোমার দুই এবং দুই বোনও মিরাছের মাঝে শরীক হবে।

একথা শুনে হযরত আয়শা রাঃ বললেন, আমার বোনতো হল, একজন আসমা, দ্বিতীয় বোনটা কে? তখন আবু বকর সিদ্দীক রাঃ বললেন, বিনতে খারেজা গর্ভবতী। আমার মনে হচ্ছে সে কন্যা সন্তান প্রসব করবে।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ বলেন, সিদ্দিকে আকবর রাঃ এর মৃত্যুর পর হযরত আয়শা রাঃ এর বোন উম্মে কুলসুম জন্ম গ্রহণ করেন।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলবী রহঃ উক্ত ঘটনাকে কাশফের দলীল হিসেবে উপস্থাপন করে বলেন, “এ ঘটনা হযরত সিদ্দিকে আকবর রাঃ এর কাশফ। যার দ্বারা আল্লাহ তাআলা তাকে লুকানো বিষয়কে তার কাছে প্রকাশ করে দিয়েছেন। [ইযালাতুল খাফা-৩/৭৭]

আবু বকর সিদ্দীক রাঃ এর উক্ত ঘটনা ইমাম মালিক রহঃ তার বিখ্যাত গ্রন্থ “মুয়াত্তা মালিক” এর মাঝেও সনদসহ নকল করেছেন। দেখুন মুয়াত্তা মালিক-৩১৪, ভিন্ন ছাপা, হাদীস নং-২৭৮৩]

2

সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং-১১৯৪৮।

লক্ষ্য করুন!

উক্ত ঘটনায় হযরত আবু বকর রাঃ এর স্ত্রীর গর্ভে থাকা সন্তানের কন্যা সন্তান হবার সংবাদ কিভাবে জানতে পারলেন? তার কাছে কি ওহী আসতো? নিশ্চয় নয়। তাহলে তিনি কিভাবে জানলেন?

তাহলে লা-মাযহাবী বন্ধুদের দাবী অনুপাতে আবু বকর রাঃ ইলমে গায়েবের অধিকারী ছিলেন?

নিশ্চয় নয়। আমরা পরিস্কার বলি যে, এটি কাশফের মাধ্যমে আবু বকর রাঃ কে জানানো হয়েছিল।

وأخبرنا أبو عبد الرحمن: محمد بن الحسين السلمي، أخبرني نصر بن أحمد ابن محمد، حدثني محمد بن عمرو البصري، حدثنا محمد بن الحسين ابن إبراهيم قال:

قال الربيع: دخلنا على الشافعي عند وفاته أنا والبويطي والمزني ومحمد ابن عبد الله بن عبد الحكم. قال: فنظر إلينا الشافعي ساعة فأطال ثم التفت إلينا فقال: أمّا أنت يا أبا يعقوب فتموت في حديدك. وأما أنت يا مزني فستكون لك بمصر هَنَاتٌ وهَنَات، ولتدركن زماناً تكون أقيس أهل ذلك الزمان.

وأما أنت يا محمد فسترجع إلى مذهبك أبيك.

وأما أنت يا ربيع فأنت أنفعهم لي في نشر الكتب. قم يا أبا يعقوب فتسلم الحلقة. قال الربيع: فكان كما قال.

রবী রহঃ বলেন, আমি, বুআইতী, মুযানী এবং মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত হলাম। তখন ইমাম শাফেয়ী রহঃ আমাদের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর আমাদের দিকে ফিরে বললেন, হে আবু ইয়াকুব! তুমি লোহার মাঝে ইন্তেকাল করবে।

আর হে মুযানী তোমার জন্য অনেক দুর্যোগ বিপদ আসবে। আর তুমি এমন এক সময় পাবে, যখন তুমি সে সময়ের সেরা যুক্তিবাদী হবে।

আর হে মুহাম্মদ তুমি অচিরেই তোমার পিতার মতবাদে ফিরে যাবে।

আর হে রবী! তুমি আমার কিতাব প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। হে আবু ইয়াকুব দাড়াও! তারপর বৈঠক শেষ করা হল।

রবী বলেন, ইমাম শাফেয়ী রহঃ যেমন বলেছিলেন, হুবহু তা’ই হয়েছিল। [মানাকেবুশ শাফেয়ী লিলবায়হাকী-২/১৩৬]

3

লা-মাযহাবী বন্ধুদের কাছে এবার আমাদের প্রশ্ন হল, ইমাম শাফেয়ী রহঃ এতগুলো বিষয় যা এখনো ঘটেনি, তা কিভাবে হুবহু বলে দিলেন? যা পরবর্তীতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল!

তাহলে কি ইমাম শাফেয়ী রহঃ গায়েব জানতেন?

উক্ত ঘটনার সংকলক ইমাম বায়হাকী রহঃ এর ক্ষেত্রে এবং ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর বিষয়ে লা-মাযহাবী বন্ধুদের ফাতওয়াটা কি একবার জানতে পারি কি?

হযরত উমর বিন আলী বাজ্জার রহঃ [মৃত্যু-৭৪৯ হিজরী] তার সংকলিত “আলামুল আলিয়্যাহ ফী মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেনঃ

جرى بيني وَبَين بعض الْفُضَلَاء مُنَازعَة فِي عدَّة مسَائِل وَطَالَ كلامنا فِيهَا وَجَعَلنَا نقطع الْكَلَام فِي كل مَسْأَلَة بِأَن نرْجِع الى الشَّيْخ وَمَا يرجحه من القَوْل فِيهَا

ثمَّ أَن الشَّيْخ رَضِي الله عَنهُ حضر فَلَمَّا هممنا بسؤاله عَن ذَلِك سبقنَا هُوَ وَشرع يذكر لنا مَسْأَلَة مَسْأَلَة كَمَا كُنَّا فِيهِ وَجعل يذكر غَالب مَا أوردناه فِي كل مسأله وَيذكر اقوال الْعلمَاء ثمَّ يرجح مِنْهَا مَا يرجحه الدَّلِيل حَتَّى أَتَى على آخر مَا أردنَا ان نَسْأَلهُ عَنهُ وَبَين لنا مَا قصدنا أَن نستعلمه مِنْهُ فَبَقيت أَنا وصاحبي وَمن حَضَرنَا أَولا مبهوتين متعجبين مِمَّا كاشفنا بِهِ وأظهره الله عَلَيْهِ مِمَّا كَانَ فِي خواطرنا

আমার ও কতিপয় উলামায়ে কেরামের সাথে কয়েকটি মাসআলা নিয়ে বিতর্ক চলছিল। এ ব্যাপারে আমাদের কথা দীর্ঘায়িত হচ্ছিল। তখন আমরা প্রতিটি মাসআলার বিতর্ক এ বলে বন্ধ করলাম যে, আমরা এ বিষয়ে শায়েখ [ইবনে তাইমিয়া রহঃ] কে জিজ্ঞাসা করবো, তারপর তিনি যা প্রাধান্য দেন সেটি মেনে নিব।

তারপর শায়েখ উপস্থিত হলেন। যখন আমরা হযরতের সামনে আমাদের কাংখিত প্রশ্নগুলো করতে মনস্থ করলাম, তখনি তিনি আমরা যে মাসআলা বলতে চাচ্ছিলাম, তা তিনি এক এক করে আমরা যে তারতীবে  চাচ্ছিলাম সেভাবেই উল্লেখ করতে লাগলেন। আমরা উক্ত মাসআলাগুলোতে যা বলেছি তার অধিকাংশই তিনি বলে ফেললেন। সেই সাথে এসব মাসআলায় উলামায়ে কেরামের মন্তব্যগুলো উল্লেখ করলেন। তারপর দলীলের আলোকে একেকটি প্রাধান্য দিলেন। আমরা জানতে চাচ্ছিলাম হযরতের কাছে এর সবই তিনি বলে ফেললেন।

[হযরতের উত্তর শুনে] আমরা ও আমার সাথীরা ও উপস্থিত ব্যক্তিরা সবাই হতবাক হয়ে গেল। আল্লাহ তাআলা আমাদের অন্তরের বিষয়গুলো তার সামনে প্রকাশ করে দিয়েছেন। [আলআলামুল আলিয়্যাহ ফী মানাকিবী ইবনে তাইমিয়া-৫৩]

4

ফাযায়েলে আমালে উদ্ধৃত ঘটনার উপর অভিযোগ উত্থাপনকারী বন্ধুদের কাছে আমাদের বিনীত প্রশ্ন হল, ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর কাছে প্রশ্ন করার আগেই ধারাবাহিকভাবে সকল প্রশ্নের জবাব বলে দেয়ার ঘটনাকে তারা কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মনের কথা আগেই জেনে ফেলা কি তাদের বক্তব্য অনুপাতে ইলমে গায়েব নয়?

আর সবচে’ বড় বিষয় হল, শায়েখ জাকারিয়া রহঃ ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কিত উক্ত ঘটনাটি নিজে নিজে আবিস্কার করেননি। বরং আল্লামা শা’রানী রহঃ [মৃত্যু ৯৭৩ হিজরী] এর কিতাব “কিতাবুল মীযান” থেকে নকল করেছেন।

দেখুন-১/৩৩৩।

5

শায়েখ জাকারিয়া রহঃ যেখানে পরিস্কার শব্দে লিখেছেন যে, আল্লামা শা’রানী রহঃ তার মীযানুল কুবরাতে উক্ত ঘটনা উল্লেখ করেছেন। দেখুন ফাযায়েলে আমালের ইবারতঃ

আল্লামা শা’রানী রহঃ মীযানুল কুবরা নামক কিতাবে লিখিয়াছেন, হযরত ইমাম আবূ হানীফা রহঃ কাহাকেও অজু করিতে দেখিলে অজুর পানিতে ধৌত হইয়া যাওয়া গোনাহ দেখিতে পাইতেন এবং গোনাহটি কবীরা না ছগীরা অথবা মাকরূহ না অনুত্তম তাহাও অন্যান্য দৃশ্যমান বস্তুর ন্যায় বুঝিতে পারিতেন। [ফাযায়েলে আমাল উর্দু-৫৬০, বাংলা ফাযায়েলে আমাল-৫৫১, ফাজায়েলে জিকির-২৪৫]

তাহলে উপরোক্ত ঘটনার উপর অভিযোগ থাকলে অভিযোগ প্রথমে করতে হবে আল্লামা শা’রানী রহঃ এর উপর। তারপর অভিযোগ হবে ফাযায়েলে আমালের উপর। বর্ণনাকারীর উপর কোন ফাতওয়া নেই, কিন্তু নকলকারীর উপর ফাতওয়াবাজী এ কেমন প্রতারণা?

শেষ কথা

যারা ফাযায়েলে আমালে বর্ণিত কাশফ সম্পর্কিত বিষয়টির উপর অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, তাদের কাছে আমাদের উপরোক্ত ৩টি প্রশ্নের জবাব চাই। যে জবাব তাদের হবে, একই জবাব আমাদের হবে।

কিন্তু এটি কোন ইনসাফ হতে পারে না যে, ইমাম মালিক, ইমাম কুরতুবী, ইমাম গাজালী, ইমাম শা’রানীসহ বিশ্ববিখ্যাত সকল উলামায়ে কেরাম একই ঘটনা উদ্ধৃত করলে শিরককারী হবেন না, ইলমে গায়েবের দাবীদার হবেন না, আর শায়েখ  জাকারিয়া পূর্ববর্তীদের থেকে ঘটনা নকল করার কারণে শিরককারী হয়ে যাবেন, এটি বেইনসাফী ও প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।

আল্লাহ তাআলা এসব প্রতারক লা-মাযহাবী থেকে উম্মতে মুসলিমাকে হিফাযত করুন।

অপবাদের কবলে ফাযায়েলে আমাল [পর্ব-৬] মৃত্যুর পর কথা বলা সম্বলিত ঘটনা বলা কি শিরক?

অপবাদের কবলে ফাযায়েলে আমাল [পর্ব ৮] জনৈক ব্যক্তির দরূদ লেখা সম্পর্কিত ফাযায়েলে দরূদের ঘটনার উপর অভিযোগ!

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

মুহাদ্দিস-জামিয়া উবাদা ইবনুল জাররাহ, ভাটারা ঢাকা।

ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com

 

আরও জানুন

নাপাক লুঙ্গি পরিধান করে ফরজ গোসল করলে শরীর ও লুঙ্গি পবিত্র হবে কি?

প্রশ্ন নাপাক কাপড়ে কি ফরজ গোসল করলে পাক হওয়া যায়? উত্তর بسم الله الرحمن الرحيم …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস