প্রচ্ছদ / তাসাউফ / বুযুর্গানে দ্বীন এক দিনে কুরআন খতম ও হাজার রাকাত নামায পড়ে কি বিদআত করেছেন?

বুযুর্গানে দ্বীন এক দিনে কুরআন খতম ও হাজার রাকাত নামায পড়ে কি বিদআত করেছেন?

প্রশ্ন

আসসালামু আলাইকুম মুফতি সাহেব . . কেমন আছেন ?
একটু বিরক্ত করতে হল . .
কথিত আহলে হাদিসরা প্রশ্ন করে অমুক বুযূর্গ ১ হাযার রাকাত নামায পড়ে,৩ দিনের আগে কূরআন খতম করে,সারা জীবন রোযা রাখে,সারা রাত জেগে ৩০/৪০ বছর যাবৎ নফল ইবাদত করে এগুলোকি রাসূলের হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক নয়,বৈরাগ্য নয়,বিদআত নয় ?? এভাবেকি পরিবারের হক নষ্ট হয় না ??

রাসূলতো এমন করেন নি বরং নিষেধ করেছেন . .
এসব কি রাসূলের কথার সাথে সাংঘর্ষিক নয় ??
এসব কি রাসূলের হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক নয় ??

হযরত অভিযোগগুলির জবাব দিলে খুব উপকার হত . .

রেজওয়ানূর রহমান।

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

অন্য কারো হক নষ্ট করে নফল ইবাদতে বেশি করে মগ্ন হতে রাসূল সাঃ হাদীসে নিষেধ করেছেন। কিন্তু কারো হক নষ্ট না হলে বেশি পরিমাণ নফল ইবাদত করতে রাসূল সাঃ হাদীসের কোথাও নিষেধ করেননি।

উসমান বিন মাজঊন রাঃ সহ যেসব সাহাবীদের বিষয়ে হাদীসে অতিরিক্ত ইবাদতের নিষেধাজ্ঞার হাদীস এসেছে, সেসব হাদীস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেসব সাহাবাগণ স্ত্রীর হক পর্যন্ত আদায়ে কমতি করে ফেলেছেন অতিরিক্ত ইবাদত করতে গিয়ে। ইবাদত বেশি করার আগ্রহে খাসি হয়ে যাবারও মনস্থ করেছিলেন। এ কারণে রাসূল সাঃ তাদের নিরোৎসাহিত করেছেন।

কিন্তু এর মানে অতিরিক্ত ইবাদত করা বিদআত একথা প্রমানিত হয় না। কারণ সাহাবায়ে কেরাম রাঃ থেকে এরকম অনেক বর্ণনা আছে যে, সাহাবাগণ বেশি বেশি ইবাদত করতেন। যা বেশি ইবাদত করা সওয়াবের কাজ হওয়া প্রমাণিত হবার প্রকিষ্ট দলীল।

সুতরাং বুঝা গেল, কারো হক নষ্ট না হলে অতিরিক্ত ইবাদত বিদআত হওয়াতো দূরে থাক, অনেক পূণ্যের কাজ। যা শুধু ভাগ্যবানদের নসীবেই জুটে।

কয়েকটি উদাহরণ নিচে উদ্ধৃত হল,

حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ جَعْفَرِ بْنِ حَمْدَانَ، ثَنَا عَبْدُ اللهِ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ حَنْبَلٍ، حَدَّثَنِي أَبِي، ثَنَا حَمَّادُ بْنُ خَالِدٍ، ثَنَا الزُّبَيْرُ بْنُ عَبْدِ اللهِ، عَنْ جَدَّةٍ لَهُ يُقَالُ لَهَا: زَهِيمَةُ، قَالَتْ: «كَانَ عُثْمَانُ يَصُومُ الدَّهْرَ، وَيَقُومُ اللَّيْلَ إِلَّا هَجْعَةً مِنْ أَوَّلِهِ»

 (حلية الأولياء لحافظ ابو نعيم احمد بن عبد الله بن احمد بن اسحاق-1/56)

হযরত যুবায়ের বিন আব্দুল্লাহ তার দাদী যাহিমা থেকে বর্ণনা করেন, উসমান রাঃ সারা বছর রোযা রাখতেন, এবং সারা রাত নামায পড়তেন, তবে শুরু রাতে ঘুমাতেন। (হিলয়াতুল আওয়ালিয়া-১/৫৬]

حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ أَحْمَدَ، ثَنَا أَبُو يَزِيدَ الْقَرَاطِيسِيُّ، ثَنَا أَسَدُ بْنُ مُوسَى، ثَنَا سَلَّامُ بْنُ مِسْكِينٍ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ سِيرِينَ، قَالَ: قَالَتِ امْرَأَةُ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ حِينَ أَطَافُوا بِهِ يُرِيدُونَ قَتَلَهُ: «إِنْ تَقْتُلُوهُ أَوْ تَتْرُكُوهُ فَإِنَّهُ كَانَ يُحْيِي اللَّيْلَ كُلَّهُ فِي رَكْعَةٍ يَجْمَعُ فِيهَا الْقُرْآنَ»

 (حلية الأولياء-1/56)

মুহাম্মদ বিন সিরীন রহঃ থেকে বর্ণিত। উসমান রাঃ এর স্ত্রী বলেন, যখন লোকেরা হযরত উসমান রাঃ এর হত্যার জন্য ঘুরছিল। তখন তাকে হত্যা করুক বা ছেড়ে দিক, তিনি পুরো রাতই নামায পড়তেন, প্রতি রাকআতে এক খতম কুরআন পড়তেন। (হিলয়াতুল আওয়ালিয়া-১/৫৬]

হযরত উমর বিন খাত্তাব রাঃ এর জীবনীতে ইবনে কাসীর রহঃ লিখেনঃ

كان يصلى بالناس العشاء ثم يدخل بيته فلا يزال يصلى إلى الفجر، وما مات حتى سرد الصوم، (البداية والنهاية-7/135)

তিনি লোকদের সাথে ইশার নামায আদায় করতেন, তারপর ঘরে এসে ফজর পর্যন্ত সারারাত নামায পড়তেন। ধারাবাহিক রোযা রাখা অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৭/১৩৫]

حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ أَحْمَدَ، ثَنَا يَزِيدُ الْقَرَاطِيسِيُّ، ثَنَا أَسَدٌ، ثَنَا الْوَلِيدُ بْنُ مُسْلِمٍ، ثَنَا ابْنُ جَابِرٍ، حَدَّثَنِي سُلَيْمَانُ بْنُ مُوسَى، عَنْ نَافِعٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ، أَنَّهُ كَانَ يُحْيِي اللَّيْلَ صَلَاةً ثُمَّ يَقُولُ: يَا نَافِعُ أَسْحَرْنَا؟ فَيَقُولُ: لَا! فَيُعَاوِدُ الصَّلَاةَ، ثُمَّ يَقُولُ: يَا نَافِعُ أَسْحَرْنَا؟ فَيَقُولُ: نَعَمْ! فَيَقْعُدُ وَيَسْتَغْفِرُ وَيَدْعُو حَتَّى يُصْبِحَ.

নাফে থেকে বর্ণিত। ইবনে উমর রাঃ রাত সজাগ থাকতেন নামায পড়ে। তারপর বলতেনঃ হে নাফে! সকাল প্রভাত হয়ে গেছে? নাফে বলতেনঃ নাহ। তখন তিনি আাবার নামাযে রত হতেন। তারপর আবার জিজ্ঞাসা করতেনঃ হে নাফে! সকাল হয়ে গেছে? তিনি বলতেনঃ হ্যাঁ, তারপর তিনি বসে পড়তেন এবং ইস্তিগফার এবং সকাল পর্যন্ত দুআ করতেন। [হিলয়াতুল আওলিয়া-১/৩০৪]

حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ الْحَسَنِ، ثَنَا بِشْرُ بْنُ مُوسَى، ثَنَا خَلَّادُ بْنُ يَحْيَى، ثَنَا عَبْدُ الْعَزِيزِ بْنُ أَبِي رَوَّادٍ، وَحَدَّثَنَا أَبُو مُحَمَّدِ بْنُ حَيَّانَ، ثَنَا أَبُو يَعْلَى، ثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْحُسَيْنِ الْبُرْجُلَانِيُّ، ثَنَا زَيْدُ بْنُ الْحُبَابِ، ثَنَا عَبْدُ الْعَزِيزِ بْنُ أَبِي رَوَّادٍ، عَنْ نَافِعٍ: أَنَّ ابْنَ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ كَانَ إِذَا فَاتَتْهُ صَلَاةُ الْعِشَاءِ فِي جَمَاعَةٍ أَحْيَا بَقِيَّةَ لَيْلَتِهِ، وَقَالَ بِشْرُ بْنُ مُوسَى: أَحْيَا لَيْلَتَهُ.

নাফে থেকে বর্ণিত। নিশ্চয় ইবনে উমর রাঃ ইশার নামায জামাতে শেষ করার পর সারা রাত সজাগ [থেকে ইবাদত] করতেন। [হিলয়াতুল আওলিয়া-১/৩০৩]

সাহাবায়ে কেরাম রাঃ থেকে সারা রাত জেগে ইবাদত করা ও লাগাতার রোযা রাখা সম্বলিত এরকম অসংখ্য বর্ণনা পেশ করা যাবে।

শুধু তাই নয় সালাফে সালেহীনদের মাঝে এভাবে ইবাদত করার ব্যাপক প্রচলন ছিল। কেউ এ এভাবে ইবাদত করাকে বিদআত মনে করেননি। সাহাবায়ে কিরাম রাঃ, যারা সরাসরি রাসূল সাঃ থেকে দ্বীন শিখেছেন। হযরত উমর রাঃ, হযরত উসমান রাঃ, হযরত ইবনে উমর রাঃ এর মত বড় বড় সাহাবাগণ যেভাবে ইবাদত করতেন তা বিদআত? নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক।

মুখ সামলে কথা বলা উচিত। দুই একটি হাদীস পড়ে, বা হাদীসের মর্ম না বুঝেই ঢালাও বিদআতের ফাতওয়া খুবই ভয়ানক। আল্লাহ হিফাযত করুন।

আরো কিছু সাহাবী রাঃ এর আমলের একটি তালিকা পেশ করছি-

হযরত তামীম বিন আউস রাঃ প্রতি রাকআতে এক খতম কুরআন পড়তেন, কখনো কখনো এক আয়াত পড়তে পড়তেই রাত পাড় করে দিতেন। [ফাতহুল মুবীন বিশরহিল আরবাঈন লিইবনে হাজার আলমক্কী-১০৮]

শাদ্দাদ আলআনসারী রাঃ ও সারারাত নামায পড়তেন। [হিলয়াতুল আওলিয়া-১/২৬৪]

হযরত আলী বিন আবী তালিব রাঃ প্রতিদিন আট খতম কুরআন পড়তেন। [ইকামাতুল হুজ্জাহ লি আব্দুল হাই লৌক্ষ্ণভী-৬৪]

তাবেয়ীদের আমল

حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ حُجْرٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا مَسْلَمَةُ بْنُ عَمْرٍو، قَالَ: كَانَ عُمَيْرُ بْنُ هَانِئٍ، يُصَلِّي كُلَّ يَوْمٍ أَلْفَ سَجْدَةٍ، وَيُسَبِّحُ مِائَةَ أَلْفِ تَسْبِيحَةٍ.

উবায়ের বিন হানী রহঃ প্রতিদিন পাঁচশত রাকাত নামায পড়তেন এবং এক লাখ বার তাসবীহ পড়তেন। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-৩৪১৫]

উয়াইস করনী রহঃ কোন রাতে সারারাত রুকু করতেন, কোন রাতে সারারাত সেজদায় কাটাতেন। [হিলয়াতুল আওলিয়া-২/৮৭]

আমের বিন আব্দুল্লাহ রহঃ প্রতিদিন এক হাজার রাকাত নামায পড়তেন। [হিলয়াতুল আওলিয়া-২/৮৮]

এমনিভাবে মাসরূক রহঃ সারা রাত ইবাদত করতেন, আসওয়াদ রহঃ রমজানে দুই দিনে কুরআন খতম করতেন, প্রখ্যাত তাবেয়ী সাঈদ বিন মুসাইয়্যিব রহঃ পঞ্চাশ বছর ইশার অজু দিয়ে ফজর নামায পড়েছেন।

 

হিলয়াতুল আওলিয়া ওয়া তাবক্বাতুল আসফিয়া নামক কিতাবে আবু নুআইম, ইমাম যাহাবী তার আলইবার নামক গ্রন্থে, ইবনে কাসীর রহঃ আলবিদায়া ওয়াননিহায়া গ্রন্থে, আল্লামা ইয়াফেয়ী তার মিরআতুল যিনান নামক কিতাবে তাবেয়ীগণ, তাবে তাবেয়ীগণ থেকে এমন অসংখ্য ঘটনা এনেছেন। যাতে সাহাবাগণ রাঃ, তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীগণ সারা রাত ইবাদত করা, এক দাঁড়ানোতে কুরআন খতম করা, এক রাতে কুরআন খতম করা, ধারাবাহিক রোযা রাখা সম্বলিত অসংখ্য প্রমাণ বিদ্যমান।

আরো জানতে পড়ুন- আল্লামা আব্দুল হাই লৌক্ষ্ণভী রহঃ কৃত ‍“ইক্বামাতুল হুজ্জাহ আলা আন্না ইকছারিত তাআব্দুদি লাইছা বিবিদআহ” নামক গ্রন্থটি।

যারা বুযুর্গানে দ্বীনের উক্ত আমলকে বিদআত বলতে চান, তারা কি এও বলবেন যে, উপরোক্ত কাজ হযরত উমর রাঃ, হযরত উসমান রাঃ, হযরত আলী রাঃসহ সাহাবায়ে কেরামের বিশাল জামাতও বিদআতে লিপ্ত ছিলেন? বিদআতে লিপ্ত ছিলেন তাবেয়ীগণের বিশাল জামাতও? নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক।

সাহাবাগণকে অনুসরণের নির্দেশ আল্লাহর নবী পরিস্কার ভাষায় হাদীসে দিয়েছেন। সাহাবীদের সুন্নাহকে অনুসরণের নির্দেশও হাদীসে এসেছে। যা পরিস্কার প্রমাণ করে উপরোক্ত পদ্ধতিতে ইবাদত করা কোন বিদআতি কর্ম নয়। বরং খুবই প্রশংসনীয় কাজ। যাদের সামর্থ আছে তাদের ওভাবেই ইবাদত করা উচিত। বাকি পরিবারের হকের প্রতিও ভ্রুক্ষেপ রাখা চাই।

 

এ বিষয়ে আরেকটি প্রশ্নের উত্তর দেখতে পারেন-

এশার ওজু দ্বারা ফজরের নামায এবং এক হাজার রাকাত নামায পড়ার সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাই ?

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

ইমেইল- ahlehaqmedia2014@gmail.com

আরও জানুন

আট ভরি স্বর্নের উপর কতটুকু যাকাত আবশ্যক?

প্রশ্ন আচ্ছালামুয়ালাইকুম। মুহতারাম আমার একটা প্রশ্ন স্বর্ণের কত ভরি হলে যাকাত দিতে হবে। আর আমার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস