প্রচ্ছদ / আকিদা-বিশ্বাস / সালাফী আলেমদের আকিদাগত ভ্রান্তি ও মতবিরোধ [পর্ব-৩]

সালাফী আলেমদের আকিদাগত ভ্রান্তি ও মতবিরোধ [পর্ব-৩]

২য় পর্ব পড়ে নিন

আল্লাহ আরশে স্থির হয়েছেন:

আমরা জানি, গতিশীল বা ঘূর্ণনশীল বস্তুই কেবল স্থির হয়। আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে গতিশীল বা স্থির হওযার আকিদা মূলত: আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দেয়া। অথচ তথাকথিত সালাফী আলেমরা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে এই ভ্রান্ত আকিদা পোষণ করে থাকে।  পবিত্র কুরআনের সূরা ত্বহা ৫ নং আয়াত সহ বিভিন্ন জায়গায় ইস্তাওয়া শব্দ এসেছে। সালাফী আলেমরা ইস্তাওয়ার অর্থ করেছে বসা ও স্থির হওয়া। আমরা পূর্বের আলোচনায় আল্লাহ তায়ালা বসার ব্যাপারে সালাফীদের জঘন্য বক্তব্য উল্লেখ করেছি। এ পর্বে ইনশাআল্লাহ  তারা আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে যে স্থির হওযার মতো জঘন্য আকিদা রাখে তার বিস্তারিত প্রমাণ উল্লেখ করবো।

ইবনে উসাইমিনের বক্তব্য:

সালাফীদের ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. আল-আকিদাতুল ওযাসিতিয়্যা নামে একটি আকিদার কিতাব লিখেছেন। আকিদাতুল ওয়াসিতিয়্যা ব্যাখ্যা লিখেছেন ইবনে উসাইমিন। তিনি এর নাম দিয়েছেন, শরহুল আকিদাতিল ওয়াসিতিয়্যা। কিতাবটি দারু ইবনিল জাওযী প্রকাশ করেছে। ইবনে উসাইমিন এ কিতাবে লিখেছে,

” ইস্তাওয়ার অর্থ হলো, উচু হওয়া ও স্থির হওয়া”

[শরহুল আকিদাতিল ওয়াসিতিয়্যা, খ.১, পৃ.৩৫৭, দারু ইবনিল জাওযী]

স্ক্রিনশট:

ইবনে জিবরীনের বক্তব্য:

সালাফী শায়খ ইবনে জিবরীন আল-আকিদাতুল ওয়াসিতিয়্যার একটি ব্যাখ্যা লিখেছেন। তিনি এর নাম দিয়েছেন, আত-তালিকাতুজ জাকিয়্যা। তিনি এ কিতাবে লিখেছেন,

” অধিকাংশ আহলে সুন্নতের মতে “ইস্তাওয়া” এর অর্থ হলো স্থির হওয়া”

[আত-তা’লিকাতুজ জাকিয়্যা, পৃ.২১১-২১২, খ.১]

স্ত্রিনশট:

সালেহ আল-ফাউজানের বক্তব্য:

সালাফী শায়খ সালেহ আল-ফাউজান তার শরহু লুমআতিল ই’তেকাদ কিতাবে লিখেছে, 

” সালাফে সালেহীন ইস্তাওয়ার একটি ব্যাখ্যা করেছেন ” স্থির হওয়া”

[শরহু লুময়াতিল ই’তেকাদ, পৃ.৯১]

স্ক্রিনশট:

সালাফী শায়খদের স্ববিরোধীতা:

পূর্বে যাকে আহলে সুন্নতের আকিদা, সালাফে সালেহীনের আকিদা হিসেবে উল্লেখ করা হলো, সে আকিদা সম্পর্কে সালাফী শায়খরা বলছেন, এসব আকিদা থেকে আমরা সম্পূর্ণ মুক্ত। এধরনের দ্বিমুখী কথা সত্যিই বিস্ময়কর। সালাফীদের বিখ্যাত শায়খ, সউদি মুফতী বোর্ডের সদস্য ড. বকর আবু যায়েদ এই আকিদাকে সালাফীদের সম্পর্কে মিথ্যাচার বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ ইবনে তাইমিয়ার মতে আল্লাহ তায়ালা আরশে বসে আছেন। এমনকি তার মতে আল্লাহ তায়ালা মাছির পিঠেও বসতে পারেন। ইবনে তাইমিয়া যে আল্লাহর স্থির হওযার কথা বলেছেন, ড. বকর আবু যায়েদ এটি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তার মতে যারা ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে এধরনের কথা বলে তারা ইবনে তাইমিয়ার উপর মিথ্যাচার করে। কারণ ইবনে তাইমিয়া আল্লাহর স্থির হওয়ার আকিদা রাখতো না। ড. বকর আবু যায়েদ লিখছেন, 

 ” কিছু বিভ্রান্ত লোক ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে বলেছে,  তিনি আল্লাহর আরশের উপর স্থির হওয়ার কথা বলেছেন।  এটি ইবনে তাইমিয়ার উপর মিথ্যাচার ছাড়া কিছুই নয়”

[মু’জামুল মানাহিল লফজিয়্যা, পৃ.৯১]

স্ত্রিনশট:

আলবানীর বক্তব্য:

সালাফীদের শায়খ নাসীরুদ্দিন আলবানী লিখেছে,

” আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে স্থির হওয়ার কথা বলা বৈধ নয়। কারণ এটি মানুষের বৈশিষ্ট্য বা গুণ”

[মাওসুয়াতুল আলবানী, পৃ.৩৪৪]

স্ক্রিনশট:

সহীহ আকিদার ভাইদের কাছে অনুরোধ, দয়া করে জানাবেন, আপনাদের শায়খদের কে সহীহ আকিদার আর কে বাতিল আকিদার? প্রশ্নটি এড়িয়ে যাবেন না। জাতি আপনাদের সহীহ আকিদা জানতে চায়, সেই সাথে আপনাদের শায়খদের মাঝে কে সহীহ আকিদার আর কে বাতিল আকিদার তাও জানতে চায়। আশা করি, উত্তর না দিয়ে আমাদেরকে হতাশ করবেন না।

কুরসী হলো আল্লাহর দুটি পা রাখার স্থান:

আমরা দ্বিতীয় পর্বে বিস্তারিত প্রমাণসহ আলোচনা করেছি যে, বর্তমানের সালাফী আকিদার উৎস হলো ইহুদীদের আকিদা। এই কথাটি সালাফী আকিদার ক্ষেত্রে দিনের আলোর মতো সত্য। যারা সালাফীদের মৌলিক আকিদার কিতাব পড়েছেন, তাদের কারও কাছে বিষয়টি গোপন নয়। সাধারণ মানুষের সামনে তারা সহীহ আকিদার ঢেকুর তুললেও তাদের মৌলিক কিতাবে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের আকিদাগুলোই বর্ণনা করা হয়েছে। এমন সব জঘন্য আকিদা বর্ণনা করা হযেছে, যার সাথে ইসলামী আকিদার কোন সম্পর্ক নেই। এসব আকিদা ইসলামীকরণের জন্য বিভিন্ন জাল ও দুর্বল বর্ণনার সহযোগিতা নেয়া হয়েছে। অধিকাংশ জাল ও জয়ীফ বর্ণনা ইহুদীদের কাছ থেকে নেয়া। ইহুদীদের কাছ থেকে নেয়া সালাফীদের একটি আকিদা হলো, কুরসী হলো আল্লাহর উভয় পা রাখার স্থান। এর মাধ্যমে প্রথমে তারা নাউযুবিল্লাহ আল্লাহর জন্য দু’টি পা সাব্যস্ত করেছে। এরপর আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দিয়ে সেগুলোর জন্য রাখার কথা বলেছে। এবং আল্লাহর উভয় পা রাখার জন্য কুরসীর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। আমরা যে সূরা ইখলাসে পড়েছি, আল্লাহ তায়ালা অমুখাপেক্ষী, অথচ এদের বক্তব্য হলো, আল্লাহ তায়ালা কুরসীর উপর পা রাখেন। অর্থাৎ তিনি পা রাখার জন্য কুরসীর সহযোগিতা নেন। নাউযুবিল্লাহ। এধরনের জঘন্য সব আকিদা আল্লাহর জন্য তারা সাব্যস্ত করেছে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে হেফাজত করুন।

ইবনে উসাইমিনের বক্তব্য:

সালাফী শায়খ ইবনে উসাইমিন তার লমুয়াতুল ই’তেকাদ কিতাবের ব্যাখ্যায় লিখেছে,

” কুরসী আরশ থেকে ভিন্ন। কেননা আরশ হলো, যার উপর আল্লাহ তায়ালা স্থির হয়েছেন। আর কুরসী হলো আল্লাহর উভয় পা রাখার স্থান” 

[শরহু লুময়াতিল ই’তেকাদ, পৃ.৬৪]

স্ক্রিনশট:

সালেহ আল-ফাউজানের বক্তব্য:

সালাফী শায়খ সালেহ আল-ফাউজান আকিদাতুত ত্বহাবীর উপর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা লিখেছেন। তিনি এর নাম দিয়েছেন, আত-তা’লীকাতুল মুখতাসারা। তিনি এ কিতাবে লিখেছেন, 

” কুরসী হলো আরশের নীচে।  আর একটি আছার বর্ণিত হয়েছে যে, কুরসী হলো আল্লাহর উভয় পা রাখার স্থান”

[আত-তা’লীকাতুল মুখতাসারা আলাল আকিদাতিত ত্বহাবিয়্যা, পৃ.১২৪]

স্ত্রিনশট:

আব্দুল আজিজ রাজেহীর বক্তব্য: 

শায়খ আব্দুল আজিজ রাজেহী আকিদাতুত ত্বহাবীর একটি ব্যাখ্যা লিখেছেন। তার ব্যাখ্যার নাম হলো, আল-হিদায়াতুর রব্বানিয়া ফি শরহিল আকিদাতিত ত্বহাবীয়া। আব্দুল আজিজ রাজেহী লিখেছেন,

” সঠিক কথা হলো, কুরসী হলো আরশ ব্যতীত অন্য একটি সৃষ্টি। এটি আল্লাহর উভয় পা রাখার স্থান”

[আল-হিদায়াতুর রব্বানিয়া, পৃ.৩৯৬]

স্ক্রিনশট:

আব্দুর রহমান ইবনে নাসের আল-বাররাক এর বক্তব্য:

শায়খ আব্দুর রহমান ইবনে নাসের আল-বাররাক আকিদাতুত ত্বহাবীর একটি ব্যাখ্যা লিখেছেন। তার কিতাবের নাম হলো, শরহু আকিদাতিত ত্বহাবিয়্যা|। এ কিতাবে তিনি লিখেছেন, 

” আহলে সুন্নতের প্রসিদ্ধ বক্তব্য হলো, কুরসী হলো আল্লাহর একটি বড় মাখলুক। এটি আল্লাহর উভয় পা রাখার স্থান”  

[শরহুল আকিদাতিত ত্বহাবিয়্যা, পৃ.১৯০]

স্ত্রিনশট:

শায়খদের স্ববিরোধী বক্তব্যসমূহ:

ইবনে বাজের বক্তব্য: সম্ভবত এটি ইহুদী বর্ণনা

 শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে বাজ আকিদাতুত ত্বহাবীর একটি ব্যাখ্যা লিখেছে। তিনি এর নাম দিয়েছেন আত-তা’লীকাতুল বাজিয়া।  এ কিতাবে ইবনে বাজ লিখেছেন,

” ইবনে আব্বাস রা. এ বক্তব্যটি ইহুদীদের কিতাব থেকে গ্রহণ করেছেন।  কেননা, কুরসী আল্লাহর উভয় পা রাখার স্থান, এটি বলার জন্য রাসূল স. এর স্পষ্ট বক্তব্য প্রয়োজন, যেখানে ভিন্ন সম্ভাবনার অবকাশ থাকবে না। ইবনে আব্বাস রা. এর এ বক্তব্যটি সম্ভাবনাময়। কেননা, এটি বনী ইসরাইলদের বর্ণনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ তিনি হয়তো রাসূল স. থেকে এটি শোনেননি। কেননা, অকাট্য আয়াত দ্বারা প্রমাণিত যে, আল্লাহ আরশের উপরে রয়েছেন। আর কুরসী হলো, একটি সমুদ্রের নীচে। এই সমুদ্রের উপরে আরশ অবস্থিত। সুতরাং কুরসী আল্লাহর পা রাখার স্থান, এটি প্রমাণের জন্য স্পষ্ট বক্তব্য প্রয়োজন। নতুবা এটি বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। সম্ভাবনা রয়েছে, এটি একটি ইসরাইলী (ইহুদী) বর্ণনা”

[আত-তা’লিকাতুল বাজিয়া, পৃ.৬০৫]

স্ত্রিনশট:

শায়খ আলবানীর বক্তব্য: সম্ভবত এটি ইহুদী বর্ণনা

শায়খ আলবানী কুরসী আল্লাহর পা রাখার স্থান সম্পর্কে লিখেছে,

” সম্ভাবনা রয়েছে, এটি একটি ইসরাইলী বা ইহুদীদের বর্ণনা”

[মাউসুআতুল আলবানী, পৃ.৩১২]

স্ত্রিনশট:

আল্লাহ পাক আমাদেরকে ইহুদীদের আকিদা থেকে হেফাজত করুন।

নোট: পূর্বে আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা লেখার কথা কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকে হয়তো আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন যে, সালাফী শায়খরা আকিদাতুত ত্বহাবীর উপর এতো ব্যাখ্যা কেন লেখে?

আসলে সালাফী শায়খরা ইমাম ত্বহাবীর বক্তব্য ব্যাখ্যার জন্য এটার উপর বিশ্লেষণী কিতাব লেখে না। বরং এদের ব্যাখ্যা লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো, ইমাম ত্বাহাবীর আকিদা খন্ডন করে নিজেদের বাতিল আকিদা এর মাঝে প্রবেশ করানো, ইমাম ত্বহাবীর বক্তব্যের বিকৃত ব্যাখ্যা করা এবং নিজেদের বাতিল আকিদাসমূহকে আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যার নামে সমাজে প্রচার করা। সালাফীদের লেখা আকিদাতুত ত্বাহাবীর একটি ব্যাখ্যার সাথেও ইমাম ত্বহাবী রহ. এর দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। এগুলোকে ব্যাখ্যা না বলে, ইমাম ত্বাহাবীর আকিদা বিকৃতির কিতাব বলা যেতে পারে। ইবনে আবিল ইয থেকে শুরু করে সালাফীদের  যারাই এর ব্যাখ্যা করেছে, সবাই একই কাজ করেছে। ইবনে বাজ, আলবানীসহ সব সালাফীই একই পথের অনুসারী।  নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা সমাজে গ্রহণযোগ্য করার জন্য আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যার নাম দিয়েছে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সবধরনের ধোকা থেকে বেচে থাকার তৌফিক দান করুন।

সালাফী শায়খের জঘন্য উক্তি:

বর্তমান সালাফী আকিদার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দেহবাদী আকিদা লক্ষ্য করা যায়। এর একটি বাস্তব ও প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হলো, কুরসীর উপর পা রাখার আকিদাটি। সালাফী উসামা আল-কাসসাস ইসবাতু উলুবিল্লাহ  নামে একটি কিতাব লিখেছে। এ কিতাবে সে তার জঘন্য দেহবাদী আকিদার বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছে। সে লিখেছে,

” কুরসী হলো আল্লাহর উভয় পা রাখার স্থান। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তার উভয় পা কুরসীর উপর রাখেন এবং আরশের উপর বসেন বা স্থির হন”

স্ক্রিনশট:

 

এর চেয়ে স্পষ্ট দেহবাদী আকিদা আর কী হতে পারে? আল্লাহ পাক আমাদেরকে সহীহ আকিদার নামে প্রচারিত সকল ভ্রান্ত আকিদা থেকে বেচে থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন।

৪র্থ পর্ব

0Shares

আরও জানুন

নফল আদায়কারীর পিছনে কি ফরজ আদায়কারীর ইক্তিদা সহীহ হয়?

প্রশ্ন হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ নাকি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ইশার নামায পড়তেন। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *