প্রশ্ন
আসসালামু আলাইকুম ।
আমাকে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করলে অনেক উপকৃত হতাম।
আমি আল্লাহের উপর ভরসা করে, আপনাদের কাছে পরামশ চাচ্ছি, আশা করব কুরআন ও হাদিসের আলোকে একটা সমাধান পাব । আমি এপ্রিল ২০১৩ তে আমার পরিবারের পছন্দে মে কে না দেখে বিয়ে করি আমি নিয়মিত নামজ পড়ার এবং হালাল রুজি খাওয়ার চেষ্টা করে আসছি এবং সৎ পথে থাকার চেষ্টা করি, জানি না কতটুকু পেরেছি। আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে সংসার ভাল ভাবেই করে যাচ্ছিছিলাম, একবছর পর আমার স্ত্রী প্রেগনেন্ট হয় পেটে সন্তানের বয়স যখন ৫ মাস তখন সন্তান ভুমি্ষ্ঠ হয়ে মারা যায়, সন্তান অপরিপক্ক ছিল, ডাক্তার কোন কারন বলতে পারে নি। ঘটনাটি ঘটে গত নভেম্বরে । বিয়ের পর থেকেই আমি তাকে নামাজ পড়ার অনুরোধ করে আসছিলাম। কিন্তু সে তেমন মনোযোগি ছিল না। কিন্তু সন্তান মারা যাওয়ার পর সে খুব ধার্মিক হতে শুরু করে । এক পর্যায় তার আল্লাহ ভীতি এমন পর্যায় পৌছায় যে, সে তার অতীতের সব পাপ স্বীকার করতে থাকে। সে এ পর্যায় পাগলের মতো আল্লাহর ভরে নামাজে এবং এমনিতেই কান্না কাটি করতে থাকে। আর আমাকে বলতে থাকে যে, সে আমাকে ঠকিয়েছে। প্রায় হাফ পাগল হয়ে যায়। আমি তার পাপের কথা শুনতে চাইতাম না শুরুতে। কিন্তু তার মানসিক অবস্থা দেখে তার সব কথা শুনি। এখন আমি নিজেই প্রায় পাগলের মতো। সে আমাকে বলে যে, বিয়ের পুর্বে সে অনেক পুরুষের সাথে একাধিক বার যিনা, ব্যভিচার করেছে। এক কথায় সে একজন বহুগামী নারী ছিল বিয়ের আগে। সে এখন তওবা করেছে সে কখনও আর এ কাজ করবে না। সে এখন এমন যে, সে বলে সে আল্লাহ কে ঠিকভাবে ডাকতে পারে না। নামজ পড়তে বা আল্লাহকে ডাকতে শয়তান তাকে বিরক্ত করে। এমনকি সে আমাকে বলছে আমি তার সাথে সংসার করব কিনা এটা এখন আমার সিদ্ধান্ত । সে তার অপরাধ বোধ আর চেপে রাখতে পারেনি তাই সে সব বলে দিয়েছে। আমার সাথে আর প্রতারনা করতে পারছে না।
এমতাবস্থায় আমাকে আসলে কি করা উচিত ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি প্রায় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছি। আমি তো তাকে ২ বছর ধরে ভাল মনে করে সংসার করে এসেছি এবং ভালবেসে ফেলেছি। আমি না পারছি তার বিবাহ পূর্ব যিনা ব্যভিচার সহ্য করতে, না পারছি ২ বছর ধরে তাকে ভালবাসাকে উপেক্ষা করতে। আমার স্ত্রী আমাকে বলে সে চিন্তিত নয় আমি তার সাথে সংসার করব কিনা, সে চিন্তিত এটা ভেবে মরে গেলে আল্লাহ কে সে কি জবাব দিবে। আর আমার সিদ্ধান্ত যাই হোক মেনে নিবে। সে নামাযে শুধুই কান্না কাটি করে। আর আল্লাহ কে ডকে। সে প্রায় পাগলের মতো, আমিও প্রায় পাগলের মতো, কিন্তু আমি এখনও তার সাথে সংসার করে যাচ্ছি এক মাস হলো, কাউকে কিছু বলিনি বুঝতেও দেয়নি।
আরেকটি বিষয় আমি বিয়ের আগে কোন মে কে স্পর্শ কখনও করিনি। এখন আমি যদি বুকে পাথর বেধে আমার স্ত্রীকে মেনে নেই, সংসার করে যাই কোন সমস্যা আছে কি ? জানি না পারব কিনা। তবুও চেষ্টা করব।
আল্লাহ তো বড়ই ক্ষমাশীল, আল্লাহ যদি তাকে ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ তো মানুষকেও ক্ষমা করতে বলেছেন। আমার মনে হচেছ আমি মানসিক ভারসম্য হারাচিছ । নামাজ ও কুরআন পড়লে শুধু অন্তরে শান্তি পাই, আর বাকি সময় খুব অস্তির ও অশান্তিতে ভুগি । কোথায় গেলে শান্তি পাব আর কি করলে মানসিক অবস্থার উন্নতি হবে, জানি না। আমার ইদানিং নামাজ পড়তেও এটা সেটা মনে আসে মনোযোগ নষ্ট হয়। মনে হয় যেন দুনিয়াটা মিথ্যে সব ভুল সব ফাকি।
আর কুরআনে সবর ও ক্ষমা করার কথাও বলেছেন। তাহলে আমার কি উচিত না তাকে ক্ষমা করে দেওয়া যদিও আমি কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। আমি কিভাবে সবকিছু থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরব। বুঝতে পারছি না।
আমি পরামর্শ চাই।
নাম-ঠিকানা প্রকাশে অনুচ্ছুক
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
আপনার স্ত্রী এখন ছেড়ে দেয়া আপনার জন্য কিছুতেই সমীচিন হবে না। সেতো ইচ্ছে করলে তার পাপের কথা গোপন রাখতে পারতো। কিন্তু সে আপনাকে ঠকাতে চায়নি। তাই সব বলে দিয়েছে। যদিও তার এভাবে বলা উচিত হয়নি। কারণ নিজের পাপের কথা কোন মানুষকে বলা নিষেধ। কেবলি আল্লাহর কাছে বলে ক্ষমা চাইতে হয়।
আপনি মাথা থেকে আপনার স্ত্রীর পূর্বের জীবনের কথা ভুলে যান। বর্তমানের কথা ভাবুন। আপনি একজন ভাল মানুষ। আল্লাহর রহমাতে আপনার ঘরে একজন ভাল স্ত্রীই পাঠিয়েছেন। দুনিয়ার জীবন খুবই ক্ষণস্থায়ী ভাই। এইতো চোখটি বন্ধ হয়ে গেলে সবই শেষ। তাই এ অল্প দিনের জিন্দেগীতে একটি মেয়েকে যে অনুতপ্ত, বিধ্বস্ত তাকে একা করে দিবেন না। তার সাথে স্বাভাবিক জীবন যাপন করুন। তাকে কিছুতেই তার পূর্বের পাপের কারণে খোটা দিবেন না। কষ্ট দিবেন না। আল্লাহ তাআলা আপনাকে অবশ্যই উত্তম প্রতিদান দান করবেন।
আর যে ব্যক্তি মন থেকে ক্ষমা চায় তাকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। তাই সে তওবা করায় এখন আর কিন্তু পাপী নয়।তাই তার সাথে ভাল ব্যবহার করা উচিত। তাকে কষ্ট দেয়া উচিত হবে না। না কথায় না আচরণে। আল্লাহ তাআলা আপনার মনের অবস্থাকে পরিবর্তন করে দিন। নিয়মিত নামায পড়ুন। নামাযের পর দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের জন্য দুআ করুন। আর এসব বিষয়কে একদম ভুলে যেতে চেষ্টা করুন। কোনভাবেই এসব পাপের কথা কারো কাছে বলবেন ন। কখনো আলোচনাও করবেন না। বাড়িতে ধর্মীয় বই রাখুন। বিশেষ করে আশরাফ আলী থানবী রহঃ ও হাকীম আখতার রহঃ এর লিখিত তাসাওউফ সংক্রান্ত কিতাবগুলো কিনে আনুন। আপনিও পড়ুন। আপনার স্ত্রীকে পড়তে দিন। ইনশাআল্লাহ দ্বীনী সমঝ হলে এ সমস্যা থাকবে না। আমরা মন থেকে আপনার পরিবারের জন্য দুআ করি। আল্লাহ তাআলা আপনাকে ধৈর্যধারণের তৌফিক দান করুন। আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে কবুল করুন। আপনার স্ত্রীকেও একজন খোদাভীরু বান্দা হিসেবে কবুল করুন।
হাদীসে এসেছে
عَنْ أَبِي عُبَيْدَةَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «التَّائِبُ مِنَ الذَّنْبِ، كَمَنْ لَا ذَنْبَ لَهُ
হযরত আব্দুল্লা বিন মাসঈদ রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসল সাঃ ইরশাদ করেছেন, গুনাহ থেকে তওবাকারী সেই ব্যক্তির মত যার কোন গোনাহ নেই। {সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-৪২৫০}
عن أبي هريرة قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم لا يلج النار رجل بكي من خشية الله حتى يعود اللبن في الضرع ولا يجتمع غبار في سبيل الله ودخان جنهم
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন-“যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে সে ব্যক্তিকে (জাহান্নামের) অগ্নি স্পর্শ করা সম্ভব নয় যদিও দোহনকৃত দুধ উলানে ফিরানো সম্ভব হয়। আর জাহান্নামের ধোঁয়া এবং আল্লাহর পথে (চলার কারণে) উড়ন্ত ধুলি কখনো একসাথে হতে পারেনা। (নাসায়ী শরীফ, হাদিস নং-৩১০৮, সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং-১৬৩৩, ২৩১১, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪২৭)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً، إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِيَ مِنْهَا آخَرَ» أَوْ قَالَ: «غَيْرَهُ
হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, কোন মুমিন পুরুষ যেন কোন মুমিনা নারীকে শত্রু মনে না করে। কেননা, সে তার এক কাজকে নাপছন্দ করলে তার অপর কাজকে পছন্দ করবে। {মুসলিম, হাদীস নং-১৪৬৯}
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: “أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خلقا، وخياركم خياركم لنسائهم”
হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, মুমিনদের মধ্যে পূর্ণতর মুমিন সেই ব্যক্তি, যার আচার আচারণ উত্তম। আর তোমাদের মাঝে উত্তম সেই ব্যক্তি যে তার স্ত্রীদের কাছে উত্তম। {সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৪১৭৬}
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” إِنَّ مِنْ أَكْمَلِ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا، أَحْسَنَهُمْ خُلُقًا، وَأَلْطَفَهُمْ بِأَهْلِهِ
হযরত আয়শা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, মুমিনদের মাঝে সেই ব্যক্তি অধিকতর পূর্ণ মুমিন, যে ব্যক্তি সদাচারী এবং নিজ পরিবারের জন্য কোমল এবং অনুগ্রহশীল। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৪২০৪, তিরমিজী, হাদীস নং-২৬১২}
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
ALLAH TMI HEJFAJOT KORO