প্রচ্ছদ / তালাক/ডিভোর্স/হুরমত / পিতা মাতা রাজি না হলে স্ত্রীকে রাখবে না তালাক দিয়ে দিবে?

পিতা মাতা রাজি না হলে স্ত্রীকে রাখবে না তালাক দিয়ে দিবে?

প্রশ্ন

কলাবাগান,মিরপুর রোড হতে,

বখেদমতে জনাব, মুহতারাম ও মুকাররাম,

হযরত মাওলানা লুৎফুর রহমান ফরায়েজী সাহেব দামাত বারকাতুহুম,

السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ

ইসলামী দুনিয়ার উজ্জ্বল নক্ষত্র আল্লাহ আপনাকে দীঘায়ূ  দান করুক। হজরত আপনার ওয়েবসাইটটি চমৎকার লেগেছে এবং আপনার কর্মকাণ্ড সাহসিকতাপূর্ণ। হজরত আমি ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করেছি। আমার বাসা যাত্রাবাড়ী। বাবা সোনালি ব্যাংক এ চাকরি করেন। দাড়ি রেখেছি ভার্সিটিতে থাকা অবস্থায়,তাবলীগে ৩ দিন করে লাগানোতে আলহামদুলিল্লাহ্‌ দ্বীনের বুঝ পেয়েছি। আমি দাড়ি রাখার কিছুদিন পর, আমাদের এক এলাকার আত্মীয় এর বউ এবং তার মেয়েরা মাস্তুরাতের তালিমে যাওয়ার ফলে, তারাও দ্বীনের স্বাদ লাভ করেন।উনার এক মেয়ে- এখন যে আমার বিবি(নাম-সারা),ও কলেজে পড়ত, আমার চেয়ে ১ বছরের ছোট, সে তার কলেজ ছেড়ে দিয়ে মহিলা মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে যায় এবং সম্পূর্ণ পর্দা করা শুরু করে। সে আমাকে জানায়, সে দ্বীনদার স্বামী চায়, এবং সে মাদ্রাসায় পরতে চায়, আমি কি তাকে বিয়ে করতে রাজি আছি নাকি? আমি মাসোয়ারা করলাম আমার একজন উস্তাদ- মাওলানা মুনির সাহেব এর সাথে কারন আমি ভাবলাম, বিয়ে করলে আমি অনেক পাপ থেকে মুক্তি পাবো, শান্তিও পাবো, কিন্তু মা-বাবার অমতে আমি রাজি নই, আমি তাদের কষ্ট দিতে চাইনা, তাছারা একটা চাপ আসবে, যে দাড়ি-টুপি পড়ে এইসব করে,মাওলানা সাহেব বললেন, পরে তুমি খুব কষ্ট পাবা, এই ভাবে বিয়ে কইরো না, সবাইকে জানায়া কইরা, তারে ঘরে নিতে পারলে তাহলে কর। মেয়েটা আবার আমার সমবয়সী। তার আব্বা ,আমার আব্বার বন্ধু। আমি আর আম্মারে কিছু বলি নাই, আমার শরম লাগে আর আমার আম্মাও সামান্য ব্যাপারে হইচই শুরু করে দেয়।একদিন সপ্নে দেখলাম, মাওলানা মুনির হুজুর আমাকে বলতাছেন, তুমি তোমার আম্মাকে বল, আমি তারপর ও কিছু বলি নাই। কিন্তু পড়ে  আমার সমস্যা এতোবেড়ে গেল, আমি প্রায় ১ বছর পর আম্মাকে জানাই,এবং উনাকে বলি, তুমি দয়া করে আমাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করো।তখন উনি তেমন কিছু বলে নাই। কিছুদিন পর, এক বড় ভাই(উনি সাথি এবং বিয়েটাও উনি পড়ান) এর বাসায় বিয়ে করে ফেলি।এর কয়েকদিন পর ৩ চিল্লা দিতে সফরে চলে যাই, আসার পর চাকরি খুজতে শুরু করি। সফর হতে আসার ৭-৮ মাস পার হয়ে গেল, ওদের বাসা থেকে ওর বিয়ের খুব চাপ আসতে লাগলো, এর মাজে ওর অনেক গুলো ভাল ভাল বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, কিন্তু ও না করে দেয় ও তার বাসায় সব জানিয়ে দেয়, ওর বাসা থেকে ওকে উনেক বুঝাবার চেষ্টাও করে, কিন্তু ও অটল থাকে। এদিকে আমার মাকে আমি বলি, যে আমি চাকরি পেলে বিয়ে করবো ইনশাল্লাহ। আমার মা বলে,উল্টাপাল্টা কিছু করবানা, আমি বলি, আমি অনেক দূর আগিয়ে গেছি, ফেরত আসবার রাস্তা নেই, আমার মা আমার বাবাকে জানিয়ে দেয়, কিন্তু মেয়েটা কে তা বলেনাই। আমার বাবা আমাকে অনেক ধমকান, তার পরের দিন আমার মা হটাত করে আমার বাবাকে বলে দেয়, ঐ মেয়ের সাথে ওর সম্পক। আমার মা,আমার বিবি সম্পর্কে প্রচণ্ড খারাপ-খারাপ কথা আমার বাবাকে বলতে থাকে, আমাকে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়, আমিও চুপচাপ চলে আসি। এইদিকে আমার বাবা-মা, আমার বিবির পরিবারকে দোষারোপ করা শুরু করে, এমন সব কথা বলা শুরু করে, যার সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই, যেমন-তারা নাকি আমার সাথে মেয়েকে বিয়ে দেবার জন্য মেয়েকে বোরকা পরানো শুরু করেছে। তাবলীগ কেও দোষারোপ করা শুরু করে, আমি ১ সপ্তাহ পর বাসায় আসি, কিভাবে কি হয়েছে, সব জানাই, কিন্তু তারা আমাকে বলে আমার বিবিকে তালাক দিয়ে দিতে, আমি অস্বীকার করি, উনারা নানা ভাবে আবেগি ভাবে আমাকে বুঝাবার চেষ্টা করেন, আমি বলি, তোমাদের খেদমত করার সাথে তো আমার বিয়ের কোন সম্পর্ক নেই, আমি বিয়ে করেছি, চরিত্ত ঠিক রাখার জন্য। আর এই কাজে কেউ আমাকে প্ররোচনাও দেয় নাই। কিন্তু উনারা কখন যে ভাই বিয়ে পরাইছে তাদের ফ্যামিলিরে দোষ দেন বা কখনও আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে দোষ দিতে থাকে,আমি যতই বুঝাই, উনারা বলে আমি এখন বিয়ে করে,আমার শ্বশুর-শাশুড়ির পক্ষে চলে গেছি, নাহলে ওদের কিছু বললে,আমার উনাদের পক্ষ নেই কেন ? তাই আমিও  । আমার মা বলে, উনি মানলেও আমার বাবা মানবেননা। আমার বাবা বলে, হয় আমি সব ছেড়ে দিবো, নাহলে এই ঘরে আমার জায়গা নেই। মুল ব্যাপার যেটা নিয়ে তারা কথা বলছে, ওরা ভাড়া থাকে,আমাদের বাড়ি আছে।তারপর একই এলাকায়।

আমি কাপড়-চোপর নিয়ে ঘর হতে বের হয়ে আসি। আসার আগে আম্মার কাছ হতে দোয়া নিয়ে আসি, বুঝিয়ে আসি, আমি অবশ্যই তোমাদের খেদমত করবো, আব্বাকে যে করেই হোক বুঝাব। আজকে প্রায় ২ মাস ঘর থেকে আমি বাইরে। এর ভিতর আমার বাবা-মা, আমার বিবির ফ্যামিলি সম্পর্কেও অনেক আজেবাজে কথা বলতে থাকে। তাবলীগকে দোষারোপ করতে থাকে। আমার আব্বাকে বেশি উত্তেজিত করছে আমার মা। আমি উনাদের সাথে কোন খারাপ ব্যাবহার করিনি, আমি একজায়গায় ভাড়া থাকছি, চাকরি খুজছি। মাঝে মাঝে খবর পেয়েছি, যে ভাই বিয়ে পড়িয়েছে, তার ছোট ভাইকে আমার আব্বা একবার রাস্তায় ধরে তুই-তোকারি করে কথা বলেছে, আর আমার আম্মার পরিচিত ৩ জন মহিলা উনাদের বাসায় যেয়ে জোরে জোরে কথা বলে এসেছে। বাসায় আব্বা-আম্মাও নাকি কান্নাকাটি করতাছে।

হজরত,ক্ষমা চাই, লেখা অনেক বড় হয়ে গেছে, এখন আমি কি করতে পারি।আমার বিবি আমাকে উস্কাসছেনা।সে তার বোনের বাড়িতে আছে। ওর মাদ্রাসার পড়াও বন্ধ হয়ে গেছে, উর উপর ও ওর ফ্যামিলি মাঝে মাঝেই খুব চাপ দিচ্ছে। বাসায় চলে আসতে,তারা অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দিবে। এইসব আরকি।

এখন আমি বুঝতে পারছি না কি করবো? আমি কি আমার বিবিকে তালাক না দিয়ে আমার বাবা-মাকে অন্যায় ভাবে  অসন্তুষ্ট করছি, বাবা-মার অসন্তুষ্টমুলক হাদিস গুলো পড়লেই ভয় লাগে। কিন্তু তাদের অসন্তুষ্ট করার কোন ইচ্ছাই ছিলনা, প্রায় দেড় বছর আল্লাহতায়ালার কাছে অনেক দোয়া করেছি, যেন তারা কষ্ট না পান।

হজরত, আপনার সুচিন্তিত মতামত দ্বারা আমাকে উপকৃত করবেন। আল্লাহ পাক আপনাকে উত্তম বদলা দান করুক

নিবেদক

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

আসলে আপনার বিষয়টি খুবই জটিল আকার ধারণ করেছে। এটি সম্পূর্ণই সামাজিক ও পারিবারিক একটি বিষয়। আমার মত অধমের এর সঠিক পরামর্শ দেবার ক্ষমতা নেই।

আপনি ইচ্ছেকৃত হোক বা মনের অজান্তে হোক কিছু ভুল সিদ্ধান্ত আপনি নিয়ে ফেলেছেন। যা নেয়া আপনার জন্য উচিত হয়নি।

বর্তমানে পারিবারিকভাবে বিয়ে করাটাই অধিক যৌক্তিক হয়ে থাকে। যদিও এক্ষেত্রে ছেলে মেয়ের পছন্দটাকেই ইসলাম প্রাধান্য দিয়ে থাকে বেশি। কিন্তু আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট এর সম্পূর্ণ উল্টো। এখানে একই মেয়েকে বাবা মা পছন্দ করলে ভাল হয়, আর ছেলে নিজে পছন্দ করলেই নানা দোষ চলে আসে। যা বর্জন করা উচিত। ভালকে ভাল আর মন্দকে মন্দ হিসেবেই দেখা উচিত। ছেলে বা মেয়ে পছন্দ করেছে বলেই সম্পর্কটাকে মেনে না উচিত নয়।

যাইহোক, এখন আপনার কাছে ২টি পথ খোলা-

আত্মীয় স্বজনকে বুঝিয়ে বিয়েটাকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করুন। এক্ষেত্রে আপনার মুরুব্বী শ্রেণীর নিকটত্মীয় বা এলাকার কোন বড় আলেমের সহযোগিতা নিতে পারেন। যার কথা আপনার পিতা মাতা মানবেন।

বিবাহের পর অহেতুক তালাক প্রদান ইসলাম কিছুতেই সাপোর্ট করে না। তবু প্রয়োজনে তা বৈধ রাখা হয়েছে। যদি বিষয়টি এমনি দাঁড়ায়, এছাড়া আর কোন পথ বাকি না থাকে, সেই সাথে তালাক প্রদান করার দ্বারা আপনর জিনায় জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে পিতা মাতার সন্তুষ্টির জন্য স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিন।

আল্লাহ তাআলা আপনার পেরেশানী দূর করে দিন। সব কিছুকে সহজ করে দিন। আমীন।

عَنْ مُعَاذٍ قَالَ: أَوْصَانِي رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِعَشْرِ كَلِمَاتٍ قَالَ: ” لَا تُشْرِكْ بِاللهِ شَيْئًا وَإِنْ قُتِلْتَ وَحُرِّقْتَ، وَلَا تَعُقَّنَّ وَالِدَيْكَ، وَإِنْ أَمَرَاكَ أَنْ تَخْرُجَ مِنْ أَهْلِكَ وَمَالِكَ،

হযরত মুয়াজ রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাঃ আমাকে দশটি বিষয়ে ওসিয়ত করেছেন। তিনি বলেছেন, তুমি নিহত বা দগ্ধও হয়ে যাও তবু আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। যদি তোমার পরিবার ও সম্পদও ছেড়ে দিতে আদেশ দেন পিতা-মাতা তবু তাদের অবাধ্য হয়ো না। {মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২২০৭৫}

عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: كَانَتْ لِي امْرَأَةٌ كُنْتُ أُحِبُّهَا، وَكَانَ أَبِي يَكْرَهُهَا، فَقَالَ لِي: طَلِّقْهَا، فَأَبَيْتُ، فَأَتَى رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَذَكَرَ ذَلِكَ لَهُ، فَقَالَ: «طَلِّقْهَا» فَطَلَّقْتُهَا

হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার একজন স্ত্রী ছিল। যাকে আমি ভালবাসতাম। কিন্তু আমার পিতা [হযরত উমর বিন খাত্তাব রাঃ] তাকে পছন্দ করতো না। তিনি আমাকে বললেন, তাকে তালাক দিতে।কিন্তু আমি তালাক প্রদান করতে অস্বিকৃতি জানালাম। তখন আমার পিতা রাসূল সাঃ এর কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করলে রাসূল সাঃ বললেন, তাকে তালাক দিয়ে দিতে। ফলে আমি আমার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করি। {মুসনাদে আবু দাউদ তায়ালিসী, হাদীস নং-১৯৩১, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৪৭১২, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৫১৩৮}

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল- [email protected]

[email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *