লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর তাকলীদ
গায়রে মুকাল্লিদ তথা কথিত আহলে হাদীস জামাতের নামকরা আলেম মাওলানা এনায়েতুল্লাহ আসরী সাহেব লিখেনঃ “গযনবী বুযুর্গরা বিশেষ করে এবং অন্যান্য আহলে হাদীসরা আমভাবে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর আমালান তাকলীদ করে থাকে। {আলইতরুল বালীগ-১৫৯, রাসায়েলে আহলে হাদীস, ২য় খন্ড}
গায়রে মুকাল্লিদ দাবিদারদের তাকলীদ নিয়ে ওহীদুজ্জামান সাহেবের ধমকি
মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান গায়রে মুকাল্লিদ সাহেব লিখেছেনঃ “আমাদের আহলে হাদীস ভাইয়েরা ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কাইয়্যুম, শাওকানী, শাহ ওয়ালী উল্লাহ এবং মাওলানা ইসামাঈল শহীদ রহঃ দের দ্বীনের ঠিকাদার বানিয়ে রেখেছে। যেখানেই এসব বুযুর্গদের বিপরীত মত কেউ গ্রহণ করেছে, সেখানেই তাদের পিছনে লেগে গেছে। ভাল-মন্দ বলতে শুরু করে দেয়। ভাইয়েরা! একটু ইনসাফতো করেন। সেই সাথে একটু ভেবে দেখুন! যখন তোমরা আবু হানীফা এবং ইমাম শাফেয়ী রহঃ দের তাকলীদ ছেড়ে দিয়েছো, সেখানে ইবনে তাইমিয়া, ইবনে কাইয়্যুম এবং শাওকানী রহঃ দের মত পরবর্তীদের তাকলীদের কী প্রয়োজন? {ওহীদুল লুগাত, মাদ্দা সার, হায়াতে ওহীদুজ্জামানের উদ্ধৃতিতে-১০২}
বাইতুল্লাহ-মসজিদে নববী ও মসজিদে আকসা ছাড়া কোন কিছুর জন্য সফর বৈধ নয়?
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেছেনঃ বাইতুল্লাহ, মসজিদে নববী ও মসজিদে আকসা ছাড়া অন্য কিছুর জন্য সফর বৈধ নয়। এমন কি রাসূল সাঃ এর রওজা যিয়ারতের জন্যও সফর করা জায়েজ নয়। [নুজুলুল আবরার-১/১৭৯}
কিন্তু সহীহ কথা হল, রাসূল সাঃ এর রওজা যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা জায়েজ এবং সওয়াবের কারণ। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর এ মাসআলায় ভুল করেছেন।
এ কারণেই আল্লামা ওহীদুজ্জামান গায়রে মুকাল্লিদ সাহেব লিখেনঃ “এ বাবের সর্বশেষ কথা হল, এ ব্যাপারে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ থেকে ভুল হয়েছে। তবুও তিনি একটি সওয়াব পাবেন। একটি মাসআলার ভুলের কারণে তার মর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে? কখনোই নয়। {তাইসীরুল বারী-২/১৯৭}
এখানে ওহীদুজ্জামান সাহেব স্পষ্টভাবে স্বীকার করলেন যে, এ মাসআলায় ইবনে তাইমিয়া রহঃ ভুলের মাঝে রয়েছেন। তারপরও তার অন্ধ তাকলীদ করে তিনি তার আরেক গ্রন্থে লিখেনঃ “যখন আল্লাহর কোন ঘরের উদ্দেশ্যে সফর করা বৈধ নয় এ তিনটি ঘর ছাড়া। সেখানে শুধু যিয়ারতের জন্য সফর করা কি করে বৈধ হতে পারে? {শরহে মুসলিম-৩/৪০৫}
তিন তালাকে এক তালাক
এক মজলিসে তিন তালাক দিলে এক তালাক পতিত হবে এ মতটি আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহঃ। গায়রে মুকাল্লিদ কথিত আহলে হাদীসদের মাঝে কতিপয় ব্যক্তি ছাড়া সকলেই ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর তাকলীদ করে এ মত পোষণ করেন যে, তিন তালাক দিলে এক তালাকই পতিত হবে।
মাওলানা শরফুদ্দীন দেহলবী আহলে হাদীস লিখেনঃ “আসল কথা হল, মুজীব সাহেব যে লিখেছেন যে, মুহাদ্দিসীনদের নিকট এক মজলিসের তিন তালাকে এক তালাকের হুকুমে হবে, এ মতবাদ সাহাবা রাঃ, তাবেয়ী, তাবেয়ীগণ, আইয়িম্মায়ে মুহাদ্দিসীন এবং মুতাকাদ্দিমীন আলেমদের নয়, বরং এ মতবাদ সাত শত বছর পরের মুহাদ্দিসীনদের। যারা ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর ফাতওয়ার পাবন্দ এবং অনুসারী। [ফাতাওয়া সানাবিয়্যাহ-২/২১৯}
এ ইবারত দ্বারা বুঝা গেল যে, এক মজলিসে তিন তালাক দিলে এক তালাক হবে মতটি সাহাবায়ে কেরাম বা তাবেয়ী তাবেয়ীগণের নয়, বরং এটি শায়েখ ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর মত। অথচ ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর অন্ধ তাকলীদ করে বর্তমানের সকল আহলে হাদীস নামধারীরা তিন তালাকে এক তালাকের ফাতওয়া প্রদান করে থাকে।
এ মাসআলায় ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর তাকলীদের কথা অস্বিকার করে কথিত আহলে হাদীস ভাইয়েরা বলতে পারেন যে, আরে! আমরাতো এ মাসআলায় ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর তাকলীদ করে একথা বলি না। আমরা এটা বলি মুসিলম শরীফের একটি বর্ণনা দ্বারা। যেখানে বলা হয়েছে যে, রাসূল সাঃ, হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাঃ, এবং হযরত ওমর রাঃ এর শাসনামলের প্রথম ভাগে তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হতো।
এ হাদীসের ভিত্তিতে আমরা তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করি। ইবনে তাইমিয়ার তাকলীদ করে নয়।
এ কথার জবাব হল, আল্লামা ইবনে হাজম [যাকে আহলে হাদীস নামধারীরা নিজেদের একজন বলে গণ্য করে] রহঃ লিখেছেনঃ মুসলিমের এ বর্ণনাটি রাসূল সাঃ এর হাদীস নয়। কেননা, এ বক্তব্যটি না রাসূল সাঃ এর বাণী, না তার কোন আমল, না রাসূল সাঃ থেকে এ ব্যাপারে তাকরীর রয়েছে। এটি হাদীসের তিন প্রকারের কোন প্রকারের মাঝেই শামিল নয়। {মুহাল্লা লিইবনে হাজম-১০/১০৬, নুজুলুল আবরার-২/৬৪}
আহলে হাদীসদের আলেম মাওলানা শরফুদ্দীন সাহেব দেহলবীও বলেনঃ এ হাদীস মারফু নয়। অর্থাৎ এটি রাসূল সাঃ এর হাদীস নয়। তাই তিনি লিখেনঃ “হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ এর মুসলিমের এ হাদীসটি মারফু নয়। এটি কতিপয় সাহাবীর আমল। যাদের রহিত হওয়ার কোন ইলম ছিল না। {ফাতাওয়া সানাবিয়্যাহ-২/২১৯}
সুতরাং একথা বলা যে, তিন তালাকে এক তালাক গণ্য করার বিষয়টি হাদীস থেকে গৃহিত তা সম্পূর্ণই মিথ্যাচার। বরং এটি পুরোটাই ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর অন্ধ তাকলীদের ফল।
মুহাদ্দিসীনদের তাকলীদ
গায়রে মুকাল্লিদদের প্রথম সারির আলেম মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী সাহেব লিখেছেনঃ
“গায়রে মুজতাহিদীন মুতালাকের জন্য মুজতাহিদীনদের তাকলীদ থেকে বের হয়ে আসা এবং তাদের অস্বিকার করার কোন জো নেই। তাদের কোথাও না কোথাও মুজতাহিদীন এবং মুহাদ্দিসীনদের আবশ্যকীয়ভাবে তাকলীদ করতে হয়। কিছু শাখাগত মাসআলার বিষয়ে হোক বা উসূল বা কায়দা-কানুনের ক্ষেত্রে হোক। চাই তা হাদীসের সহীহ বা জঈফ বলার ক্ষেত্রে হোক। {ইশাআতুস সুন্নাহ-১১/৩১২}
বাটালাবী সাহেবের বক্তব্য একথা সুষ্পষ্ট প্রমানিত করছে যে, যে ব্যক্তি মুজতাহিদে মুতলাক নয়, তার কোন না কোন স্থানে তাকলীদ করতেই হয়। চাই তা মাসআলা মাসায়েলের ক্ষেত্রে হোক, বা হাদীস সহীহ-জঈফ বলার ক্ষেত্রেই হোক না কেন।
সুতরাং গায়রে মুকাল্লিদ তথা কথিত আহলে হাদীসরা যে হাদীসকে সহীহ বা জঈফ বলছেন এটাতো মুহাদ্দিসীনদের মতের উপর তাকলীদ করেই।
হ্যাঁ, যেহেতু তাদের কাছে তাকলীদ শব্দের মাঝে চুলকানি রয়েছে, তাই তারা তাকলীদ শব্দ ব্যবহার না করে, এখানে তারা ইত্তেবাহ শব্দ ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু কাজ কিন্তু একই। তাকলীদের মাঝে যেমন একজন সাধারণ মুকাল্লিদ সাধারণত দলীল জিজ্ঞেস করে না। তেমনি মুহাদ্দিসীনগণের মন্তব্য মানার ক্ষেত্রেও অধিকাংশ সময় দলীল জানা যায় না। তাই মুহাদ্দিসীনদের কথা মেনে হাদীসকে সহীহ-জঈফ বলাওতো তাকলীদ।
নাসীরুদ্দীন আলবানীর স্বীকারোক্তি
১
গায়রে মুকাল্লিদদের বড় ইমাম শায়েখ নাসীরুদ্দীন আলবানী সাহেব এক হাদীসের সনদের ব্যাপারে জনৈক মুহাদ্দিস মন্তব্য করেন- رجاله رجال الصحيحতথা এর রাবীগণ সহীহ রাবী। এ কথাটি আল্লামা সুয়ুতী রহঃ নকল করে বলেছেন যে, হাদীসটি সহীহ।
এ বক্তব্যের উপর নাসীরুদ্দীন আলবানী সাহেব লিখেছেনঃ এ ব্যাপারে সুয়ুতী তার তাকলীদ করেছেন। {সিলসিলাতুজ জঈফাহ-২/৩৪০}
২
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ এক হাদীস সম্পর্কে লিখেছেনঃ رجاله ثقاتতথা এর রাবীগণ সিক্কা তথা তাদের উপর নির্ভর করা যায়।
এ বক্তব্যটিই আল্লামা ছানআনী রহঃ নকল করেছেন। এ ব্যাপারে আলবানী সাহেব লিখেছেনঃ “সানআনী তাকলীদ করেছেন”। {সিলসিলাতুল আহাদীসিজ জঈফাহ-২/৩৬২}
৩
আল্লামা ইবনে কাসীর রহঃ একটি হাদীসকে সহীহ বলেছেন। এ ব্যাপারে শায়েখ আলবানী সাহেব লিখেছেনঃ “শাওকানী, সিদ্দিক হাসান এবং আলুসী রহঃ এ ব্যাপারে তার তাকলীদ করেছেন। {সিলসিলাতুল আহাদীসিজ জঈফাহ-২/৩৮৭}
সারা দুনিয়া জানে যে, নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান এবং আল্লামা শাওকানী রহঃ আপনাদের ঘরাণার লোক তথা গায়রে মুকাল্লিদ। অথচ আল্লামা আলবানী সাহেবের তাহকীক অনুযায়ী তারা হাদীসের সহীহ-জঈফের ক্ষেত্রে হাফেজ ইবনে কাসীর শাফেয়ী রহঃ এর তাকলীদ করেছেন।
৪
আলবানী সাহেব নিজের ব্যাপারে মন্তব্য করে বলেনঃ
قلدت فى ذلك كله للجنة القائمة على تحقيقهতথা আমি এসব ব্যাপারে এ মজলিসের তাকলীদ করেছি, যা তাহকীকের জন্য কায়েম করা হয়েছে। {{সিলসিলাতুল আহাদীসিজ জঈফাহ-২/৩১৬}
শায়েখ আলবানী সাহেবের বক্তব্য একথা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় প্রমাণ করছে যে, পরবর্তী ব্যক্তিগণ পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসীনদের বক্তব্যের আলোকে হাদীসকে সহীহ-জঈফ বলাটা তাদেরই তাকলীদ করা। এ হিসেবে নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান এবং শাওকানী এবং আলবানী সাহেব নিজেকেও মুকাল্লিদ বলেছেন। অথচ এ তিনজনই গায়রে মুকাল্লিদ দাবিদার।
আহলে হাদীসদের কাছে নাসীরুদ্দীন আলবানীর মর্যাদা
ফাতাওয়া উলামায়ে হাদীস”কিতাবে শায়েখ আলবানীর পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয় যে,
“শায়েখ আলবানী জামিয়া ইসলামিয়া মদীনা ইউনিভার্ষিটির প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বংশের দিক থেকে তিনি ইংরেজ ছিলেন। তার খান্দানের লোকেরা যখন মুসলমান হন, তখন তারা হানাফী মাযহাব গ্রহণ করেন। আল্লাহ তাআলা তাকে ইলম ও ফজলের পূর্ণতা দান করেন। তিনি স্বীয় তাহকীকে আহলে হাদীস বনে যান। সিরিয়াতে শিক্ষকতা শুরু করেন। তার ইলমে হাদীসে বিশেষ করে আসমাউর রিজালের ক্ষেত্রে বিশেষ পান্ডিত্ব ছিল। আরব রাষ্ট্রসমূহে তার ইলমী গ্রহণযোগ্যতার প্রসিদ্ধি এমন ছিল যে, তার মত তাহকীক আর কারো ছিল না। {ফাতাওয়া উলামায়ে হাদীস-৩/১৭৬}
এই হল, আহলে হাদীসদের নিকট শায়েখ আলবানীর অবস্থান। সেই আলবানী সাহেব বলছেন যে, তিনি পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসীনদের মুকাল্লিদ ছিলেন। তাহলে নিজেরা তাকলীদ করে নফসে তাকলীদের উপর এমন খরগ হস্ত কেন?
তাকলীদ কী? তাকলীদ গায়রে মুকাল্লিদরাও করে কি?
তাকলীদের সংজ্ঞা গায়রে মুকাল্লিদদের কিতাব ফাতাওয়া নাজীরিয়্যাহ এর ১ম খন্ডের ১৮৪ নং পৃষ্ঠায় এভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে- “এমন ব্যক্তির কথা মানা, যার কথা শরয়ী দলীল এর নামই হল তাকলীদ”।
কথিত আহলে হাদীস দলের বড় আলেম জুবায়ের আলী জুয়ীর বক্তব্য হল- “হাদীসের সহীহ-জঈফ বলার বিষয়টি মুহাদ্দিসীনদের ইলহামের উপর নির্ভরশীল। {মুহাসসালাহ নূরুল আইনাইন-৮৫}
তাহলে কী দাঁড়াল? শুধু কুরআন ও হাদীসের দাবিদারদের জন্য আবশ্যক হয়, যখনি কোন হাদীসকে সহীহ বা জঈফ বলে মন্তব্য করবে, সাথে সাথে উক্ত হাদীসটিকে আল্লাহ বা রাসূল সাঃ এর বক্তব্যের আলোকে সহীহ বা জঈফ বলবে। কিন্তু তারা একাজটি করে না, বা কিয়ামত পর্যন্ত করতে পারবে না। এক্ষেত্রে তার কী করে থাকে? মুহাদ্দিসীনদের কথাকে দলীলহীনভাবে মেনে নেয়। [স্মর্তব্য যে, তাদের মতে দলীল কেবল কুরআন ও হাদীস, ইজমা বা কিয়াস কোন দলীল নয়]
আর জুবায়ে আলী জুয়ী সাহেব স্পষ্টই স্বীকার করেছেন যে, হাদীস সহীহ-জঈফ বলাটা মুহাদ্দিসীনদের ইলহামী সিদ্ধান্ত। আর ইলহাম কোন শরয়ী দলীল নয়। তাহলে শরয়ী দলীল ছাড়া কারো কথা মানার নামইতো তাকলীদ। এ তাকলীদ আপনারা সর্বদা করার পরও তাকলীদকে শিরক বলার আগে নিজেদের কী হুকুম কি হচ্ছে তা একবার ভেবে দেখেন কি?