প্রচ্ছদ / তালাক/ডিভোর্স/হুরমত / ‘ওইসব হুজুরদের কথা বিশ্বাস করলে তালাক হয়ে গেছে চলে যাও” বলার দ্বারা কি কোন তালাক পতিত হয়?

‘ওইসব হুজুরদের কথা বিশ্বাস করলে তালাক হয়ে গেছে চলে যাও” বলার দ্বারা কি কোন তালাক পতিত হয়?

প্রশ্ন

আসসালামু আলাইকুম।

আমার স্ত্রী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে। নবম শ্রেনীতে পড়ার সময় সে একটা সাধারন পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তায় পরে যায়। এবং প্রায় ৫-৬ মাস এভাবে থাকার পরে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।

কলেজে পড়ার সময় সে আরও একটি বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় পরে। এবারে সে কয়েকমাস এভাবে যাওয়ার পরে পরিবারকে জানায়। তার বাবা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তারের চিকিৎসায় আলহামদুলিল্লাহ ভালো হয়ে যায়।

বিয়ের কিছুদিন পরে ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি বলি,

“আমি তোমার সাথে সংসার করতে চাচ্ছিনা।”

সে এটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পরে যায় যে আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমি স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হই তালাক হয়নি। এটা ওকে বলার পরেও ওর দুশ্চিন্তা যায় না। পুর্বের ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা ওষুধ খেয়ে ভালো হয়। এভাবে মাঝে মাঝেই আমার স্ত্রী নানা বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে। মাঝে মাঝে ওষুধ খায়। অনেক সময়ই খায় না।

আমার স্ত্রী এখন গর্ভবতী আলহামদুলিল্লাহ। সে এখনও এসব বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। সে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবে তালাক বিষয়ে সার্চ করে, আর্টিকেল পড়ে ভিডিও দেখে। এতে করে তার টেনশন আরও বাড়ে। আমি ওকে বুঝানোর উদ্দেশ্যে এসব আর্টিকেল ও ভিডিও দেখি। আমার মতামত জানাই। এই বোঝানো বা আলোচনার সময়ে স্বভাবতই তালাক বা ডিভোর্স শব্দ চলে আসে। সে এটা নিয়েও দুশ্চিন্তায় পরে যায় যে, আমি বোঝানোর সময় তালাক শব্দ বলায় তালাক হয়ে গেছে কিনা? উল্লেখ্য পেটে বাচ্চা থাকায় ও এখন ডিপ্রেশন এর ওষুধ খেতে পারছে না।

এমতাবস্থায় কয়েকদিন আগে ও আমাকে একটা আর্টিকেল দেখায় যেখানে তালাক বিষয়ে প্রচলিত কিছু ফতোয়া (আর্টিকেলের ভাষায় হুজুরদের বক্তব্য) এর বিপক্ষে যুক্তি দেখানো হয় কুরআনের আয়াতের (সম্ভবত সুরা বাক্বারা এবং আত-ত্বলাক) মাধ্যমে। সেই আর্টিকেল নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে আমি বলি,

“ওইসব হুজুরদের কথা বিশ্বাস করলে আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে, চলে যাও।”

এই কথা দ্বারা উদ্দেশ্য ছিলো ওই কথাগুলো (প্রচলিত ফতোয়া) ভুল এটা বোঝানো।

আমি ওকে বোঝানোর জন্য এই কথাটা ব্যাখ্যা করে বলি। এরপর ওর ধারণা হয়, এই কথার দ্বারা আমাদের তালাক হয়ে গেছে।

আমি বর্তমানে যেখানে আছি সেখানকার বড় মসজিদের ইমাম ও খতিব সাহেবের কাছে এই ব্যাপারে কথা বলি। ওনারা আমাকে আশ্বস্ত করেন এর দ্বারা তালাক হয়নি। এরপরও আমার স্ত্রীর সন্দেহ যায় না। এবারে সে বলে ওই কথার দ্বারা এক তালাক হয়েছে এবং আমি কয়েকবার ওই কথাটা বলেছি (প্রকৃতপক্ষে আমি একবারই বলেছি এবং বোঝানোর নিয়তে বলেছি), তাই যতবার বলেছি ততবার তালাক হয়েছে। এরপরে আমি আবারও ইমাম সাহেবের কাছে যাই। উনি আমাকে আবারও বলেন এই কথায় তালাক হয়নি। এবং পানি পরে দেন ও বেশি বেশি জিকির করতে বলেন যাতে এসব মনে না আসে।

এরপরেও তার সন্দেহ যায় না সে বলতে থাকে যে তুমি ইমাম সাহেবের কাছে পুরো ঘটনা বলো নাই শুধু ওই কথাটা ( হুজুরদের বিশ্বাস করলে ডিভোর্স হয়ে গেছে চলে যাও)  নিয়ে কথা বলছো বিস্তারিত ঘটনা বললে কি বলতো?

বিস্তারিত ঘটনার বিবরন এরকম।

ওই আর্টিকেলের মধ্যে একটা পয়েন্ট ছিলো (তালাক নিয়ে অধ্যয়ন করার সময়, তার স্ত্রীর কথা স্মরণ করে তালাক শব্দটি উচ্চারণ করলে, তালাক পতিত হবে না। তবে ইচ্ছাকৃত স্ত্রীর কথা স্বরণ করে তালাক শব্দ বললে, তালাক পতিত হবে।)  এটা আমার ভুল মনে হয়েছে। তখন সে বলে, “কিভাবে ভুল?” আমি বলি, ” ওরা বলেছে অধ্যয়ন করার সময় স্মরণ করলে হয়ে যাবে।” সে বলে, “না ওরা তো এটা বলেনি”, আমি বলি, “ওরা তাই বলছে”। সে বলে, ” তুমি আমার মনে সন্দেহ ঢুকাচ্ছ কেন?”। আমি উত্তরে বলি, “যেটা ঠিক সেটাই জানবা তুমি, কিসের সন্দেহ”।

(কিছুক্ষণ পরে)

আমি বলি, ” তুমি কি এটা বিশ্বাস করছ?” সে এর উত্তরে কি বলেছে মনে নেই। (এখন সে একবার বলে,  “পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছেনা, সন্দেহ হচ্ছে” এটা বলেছে, আবার বলে “হ্যাঁ বিশ্বাস হচ্ছে” এটা বলেছে, আবার বলে কোনো উত্তর দেয়নি।) তখন আমি রেগে গিয়ে বলি, “ওইসব, হুজুরদের কথা বিশ্বাস করলে ডিভোর্স হয়ে গেছে, চলে যাও।” (এখানে ওইসব বলেছি নাকি আচ্ছা বলেছি নাকি যদি বলেছি সেটা আমার স্ত্রীর মনে নেই, কিন্তু আমার মনে আছে ওইসব বলেছি) তখন সে এটা শুনে পাগলামি শুরু করে দেয়। বারবার বলে, “কি বললে তুমি!” আমি বলি, “হ্যাঁ, হুজুরদের কথা বিশ্বাস করলে ডিভোর্স হয়ে গেছে, চলে যাও।” (এ কথা আমি ২য় বার বলিনি, আমার স্ত্রী একবার বলছে বলেছি, আবার বলছে বলি নাই) তারপরও পাগলামি করতে থাকার পরে আমি বলি, “শোনো এটা শর্তযুক্ত কথা, হুজুরদের কথা বিশ্বাস করলে আরও তিনটা কথা মানতে হবে, কুরআন ভুল, আমি তালাকের নিয়্যত করে তালাক শব্দ উচ্চারন করেছি আলোচনার সময়, (৩য় শর্ত মনে নেই)”। সে কি বলছে তার মনে নেই। (পরবর্তীতে অফিস থেকে আসার পরে সে জিজ্ঞেস করে, “তিনটা শর্তই কি মানতে হবে?” আমি বলি, “হ্যাঁ তিনটাই মানতে হবে।” সে বলে, “না আমি তিনটা শর্ত মানিনা।”) আমি বলি, ” আচ্ছা ভাবতে থাকো, আমি অফিস থেকে আসার পরে বলবা।” এরপর আমি অফিসে চলে যাই, রাতে বাসায় আসার পর আমাদের মধ্যে নিম্নোক্ত কথাবার্তা হয়।

আমার স্ত্রী মনে করছিল যে এটা (“হুজুরদের কথা বিশ্বাস করলে ডিভোর্স হয়ে গেছে”) শর্তযুক্ত তালাক হয়েছে এবং সে বিশ্বাস করলেই ডিভোর্স হয়ে গেছে। কিন্তু আমার কথা ছিলো যে একথা আমি বলেছি শুধু বোঝানোর উদ্দ্যশ্যে। সে আমার কথা মানতে অস্বীকার করায় তাকে শুধু বুঝানোর উদ্দ্যেশ্য নিম্নোক্ত কথাগুলো বলি।

আমি বলি, “তুমি কি বিশ্বাস করেছিলে?” সে বলে, “না করিনি”। আমি বলি, ” তাহলে তোমার হিসেবেই তো ডিভোর্স হয়নি”। সে আবার বলে, “নাকি বিশ্বাস করেছিলাম, মনে নেই। যদি ভবিষ্যতে বিশ্বাস করি তাহলে কি হবে?”। আসলে সে তখন কি বলেছিলো তার ভালো করে নেই।  এজন্য আমি বলি, “দেখো, ওই কথাটা শুধু তখনকার জন্যই ছিলো,  দুপুরে যা বলেছ বাদ দাও, এখন বলো, তুমি কি বিশ্বাস করেছিলে?” সে উত্তরে বলে, “না করিনি”। আমি বললাম, “তাহলে তো তালাক হয়নি”। সে বলে, “না তালাক হয়নি, কিন্তু আমি যদি ভবিষ্যতে বিশ্বাস করি তাহলে তালাক হবে কিনা?” আমি উত্তরে বলি, “না ভবিষ্যতে এই নিয়ে আর কথা বলতে চাইনা, তুমি এখনই ফাইনাল উত্তর দাও, তারপর এই কথা আমরা শেষ করে দেই”। সে বলে, ” না, আমি এখন বিশ্বাস করছিনা”। আমি বললাম, “তাহলে আমরা এই কথা এখানেই শেষ করে দিলাম, এ নিয়ে আর কখনও কেউ কথা বলবনা”। এবং সে তাতে রাজী হয়।

একটু পরে সে এসে বলে, ” আমার একটু একটু বিশ্বাস হচ্ছে, তাতে কি আমাদের কিছু হবে?” তখন আমি বলি, “তোমার বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করার সময় পার হয়ে গেছে, এখন আর এসব নিয়ে কথা বলে লাভ নেই”৷ তারপরও তার পাগলামী যায় না, শুধু বলতে থাকে, ” আমি বিশ্বাস করলে কি হবে?” আমি উত্তরে বলি, “কিছুই হবে না।” তারপরও না মানায় আমি অন্যভাবে বুঝানোর জন্য বলি, “ধরো ওই কথাটা শর্তযুক্ত তালাক হয়েছে, আমি এখন শর্ত তুলে নিলাম”। সে বলে “শর্ত তুলে নিলে কসম ভঙ্গের কাফফারা দিতে হবে, দুইটা রোজা থাকা লাগবে”। আমি তাতে রাজী হই কিন্তু ও তাতেও শান্ত হয়না।

পরেরদিন সকালে আমি নতুন অ্যাপ্রোচ নেই ওকে বুঝানোর জন্য। আমি বলি, “ধরে নাও, ওই কথার দ্বারা এক তালাক হয়ে গেছে, তাতেও তো কোনো সমস্যা নেই, আমাদের সম্পর্ক ঠিকই আছে”। তারপরও সে মানেনা।

এরপরও তার সন্দেহ যায় না। নতুন নতুন প্রশ্ন করা শুরু করে। তার প্রশ্নগুলো হলো:

১। উপরোক্ত ঘটনার বিবরণ মনে তালাক হয়েছে কিনা?

২। “আমরা এই কথা শেষ করে দিলাম, এই নিয়ে আর কথা বলব না” এই কথার পরে আবার এই নিয়ে কথা বলায় নতুন করে ঘটনাপ্রবাহ শুরু হলো কিনা? অর্থাৎ আমি কথা শেষ করে দেয়ার পরেও সে নতুন করে সেই কথা আবার তোলায় আগের কথাই চলমান আছে নাকি আগের কথা কি শেষ হয়ে নতুন করে বিশ্বাস করলে তালাক পতিত হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কিনা এবং তালাক পতিত হয়েছে কিনা?

৩। “ধরে নাও এক তালাক হয়ে গেছে” এই কথায় তালাক হয়েছে কিনা? এবং এই বারবার বলায় যতবার বলেছি ততবার তালাক হয়েছে কিনা?

৪। তার মতে “ধরে নাও এক তালাক হয়ে গেছে” এই কথার দ্বারা তালাক হয়ে গেছে। আমি বলি, “তাহলে তোমার যুক্তিমত তো এখনো তালাক হচ্ছে।” প্রশ্ন হলো: ‘তাহলে তোমার যুক্তিমত এখনো তালাক হচ্ছে’ এই কথার দ্বারা তালাক হবে কিনা?

৫। প্রচলিত কথাগুলো ঠিক হলে তালাক হবে কিনা?

৬। সে হুজুরদের কথা বিশ্বাস করলে তালাক হবে কিনা?

৭। ‘যদি হুজুরদের কথা বিশ্বাস করো তাহলে ডিভোর্স হয়ে গেছে’ এই কথার দ্বারা তালাক পতিত হয়েছে কিনা?

মুফতি সাহেব, দয়ে করে আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে মনের সংশয় দূর করবেন।

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

উপরোক্ত কথোপকথন এবং বিবরণ অনুপাতে স্ত্রীর উপর কোন প্রকার তালাক পতিত হয়নি।

আপনার স্ত্রীর মানসিক ডাক্তার দেখানো জরুরী। এমন সাধারণ বিষয় নিয়ে এভাবে পেচাতে থাকা এটা ভালো লক্ষণ নয়। তাকে এসব চিন্তা মাথা থেকে দূরে রাখতে বলবেন।

কয়েকটি বিষয় খেয়াল করতে বলবেন:

১ তালাক সংক্রান্ত কোন প্রকার লেখা ও ভিডিও দেখা বন্ধ করে দিতে বলবেন।

২ এ সংক্রান্ত চিন্তা আসলে অন্য বিষয় নিয়ে ভাবতে ও মগ্ন হয়ে যেতে বলবেন।

৩ বেশি বেশি ইস্তিগফার এবং সূরা ফালাক ও নাসের আমল করতে বলবেন।

৪ তালাক সংক্রান্ত কোন প্রশ্ন কাউকে করতেও নিষেধ করবেন।

৫ বেশি সমস্যা মনে হলে অবশ্যই মানসিক ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।

এ ওয়াসওয়াসার এ রোগ বাড়তে দিলে তা ভয়াবহ মানসিক সমস্যায় পরিণত হয়। আল্লাহ তাআলা আপনার সংসার সুন্দর এবং অনাগত সন্তানের দুনিয়া আগমন এবং ভবিষ্যত সফল ও সুন্দর হবার আন্তরিক দুআ করি।


منها شك هل طلق أم لا لم يقع (الأشباه-108، جديد-196)

عدم الشك من الزوج فى الطلاق وهو شرط الحكم بوقوع الطلاق حتى لو شك فيه لا يحكم بوقوعه (بدائعل الصنائع، كتاب الطلاق، فصل فى الرسالة-3\126، جديد-3\199)

يشترط بالاتفاق القصد فى الطلاق، وهو إرادة التلفظ به ولو لم ينو فلا يقع طلاق فقيه يكره ولا طلاق حاك عن نفسه أو غيره لأنه لام يقصد معناه، بل قصد التعليم والحكاية، (الفقه الاسلام وادلته، كتاب الطلاق، باب شروط الطلاق-7/368)

لو كرر مسائل الطلاق بحضرة زوجته ويقول: أنت طالق ولا ينوى طلاقا لا تطلق، (فتح القدير، كتاب الطلاق، باب ايقاع الطلاق-4/4)

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।

ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com 

আরও জানুন

বিছানায় লেগে থাকা শুকনো বীর্যে ভিজা হাত লাগলে কি হাত নাপাক হয়ে যায়?

প্রশ্ন আসসালামু আলাইকুম, বীর্য যদি শুকিয়ে যায় (বিছানায় পড়া) সেই জায়গায় ভিজা হাত লাগে আবার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস