প্রচ্ছদ / ইতিহাস ও ঐতিহ্য / ফিলিস্তিন-সমস্যা: বৃটিশ ও আমেরিকান নথিপত্রের আলোকে

ফিলিস্তিন-সমস্যা: বৃটিশ ও আমেরিকান নথিপত্রের আলোকে

মূল: ওয়াজেহ রশিদ হাসানি নদবি

ভাষান্তর: মুফতী আজীজুর রহমান হাসান ফরায়েজী

বৃটিশ নথিপত্রের আলোকে

১০ আগস্ট ১৮৪০ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পামারস্টোন তুর্কিতে নিযুক্ত বৃটিশ রাষ্ট্রদূতকে চিঠি লেখেন—ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বসবাসরত ইহুদিদের মাঝে এই অনুভূতি বেড়ে গেছে যে, এখন ফিলিস্তিনে নিজেদের দেশ প্রতিষ্ঠা করার সময় নিকটে এসে গেছে। আর এ কথা ভালো করেই জানা আছে যে, ইউরোপের ইহুদিরা বড় সম্পদশালী। সুতরাং যখন ইহুদি জাতি উসমানি বাদশার তত্ত্বাবধান ও সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ফিরে আসবে, তখন তারা মুহাম্মদ আলি ও তার স্থলাভিষিক্তদের বিপজ্জনক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। তুর্কি সরকারও এটাকে ফিলিস্তিন-সমস্যার ক্ষেত্রে উপকারী মনে করে যে, এরকম একটি মামুলি আইনের মাধ্যমে তারা অনেক দেশে নিজের সহযোগী ও বন্ধু লাভ করতে পারবে।

১৮৬১ সালে বৃটিশ লেখক থমস ক্লার্ক তার হিন্দুস্তান ও ফিলিস্তিন বইতে লেখেন, ইসরায়েল জাতিকে যদি দ্বিতীয়বার দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে অচিরেই ইসরায়েলের বংশধরদের মাঝে জাগরণ ও তৎপরতা সৃষ্টি হয়ে যাবে। আর এতে সবচেয়ে বেশি লাভ হবে আমাদের। বিশ্বাস রাখতে হবে, ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা খুবই জরুরি। ব্রিটেন যদি ব্যবসাকে তাদের মেরুদণ্ড মনে করে আর তাদের এ কথা জানা থাকে যে, এই ব্যবসা তিনটি মহাদেশের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, পাশাপাশি তার এ কথাও জানা থাকে যে, ইহুদিরা মৌলিকভাবেই মহাজন ও ব্যবসায়ী জাতি, তাহলে তাদের নিজেদের ব্যবসার উন্নতি ও প্রসারের স্বার্থে বনি ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনে প্রতিষ্ঠা করা একান্ত জরুরি। নতুন করে তাদের জাতীয়তা ও দেশ ফিরিয়ে দেওয়া হোক। কেননা, পৃথিবীর কোনো শক্তি এটি তাদের থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে না।

১৩ মার্চ ১৯১৬ সালে রাশিয়ার সাবেক রাজধানী পেট্রোগ্রাডে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ দূতাবাস রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটি চিঠি পাঠায়, যেখানে সে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অবস্থান সম্পর্কে রুশদের মতামত জানতে চাচ্ছিল। সেই চিঠিতে স্যার এডওয়ার্ড গ্রে পরিষ্কার ভাষায় লিখেছে, এই সময়ে ব্রিটিশরাজ ফিলিস্তিনে ইহুদিদের বসতি স্থাপনের ব্যাপারে পূর্ণ মনোযোগ দিচ্ছে। চিঠিতে উল্লেখিত দৃষ্টিভঙ্গি যদি শুদ্ধ হয়, তাহলে জায়নবাদের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ফলাফল অর্জিত হবে। আর সবচেয়ে বড় যে ফায়দাটি হবে—এভাবে প্রাচ্য ও আমেরিকার ইহুদিদের নিজেদের মিত্রপক্ষে নিয়ে আসা যাবে।

২ নভেম্বর ১৯১৭ ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী অঙ্গীকার করেছে, মহামান্য ব্রিটিশরাজের সরকার (His Majesty) পূর্ণ সহানুভূতি ও দায়িত্বশীলতার সাথে ফিলিস্তিন ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ভাবছে। তার রাষ্ট্র এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সবধরনের সম্ভাব্য চেষ্টা করবে এবং এমনসব কাজ থেকে বিরত থাকবে, যার ফলে ফিলিস্তিনে বসবাসরত অ-ইহুদি জনপদবাসীর নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার প্রভাবিত হয় অথবা অন্যান্য রাষ্ট্রে বসবাসরত ইহুদিদের অধিকার ও তাদের রাজনৈতিক অবস্থান প্রভাবিত হয়।

১ আগস্ট ১৯১৯ সালে বালফুরকে পাঠানো একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, জায়নিস্টদের ব্যাপারে চারটি রাষ্ট্র নিজেদের অঙ্গীকার খুবই চমৎকারভাবে পুরো করেছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, জায়নিস্টরা—চাই সঠিক হোক বা ভুল, ভালো হোক বা খারাপ—আমাদের সভ্যতা, আমাদের বর্তমান প্রয়োজন ও আমাদের ভবিষ্যতপ্রত্যাশা পূরণে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তারা আরব রাষ্ট্রগুলোতে বসবাস করা ৭০০ হাজার আরদের প্রত্যাশার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি গুরুত্বের দাবিদার।

২০ এপ্রিল ১৯২০ যখন বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর কাউন্সিল ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটকে মঞ্জুরি দিয়ে দেয়, তখন ব্রিটিশরাজ ইহুদিদের নামে একটি বার্তায় বলে, সকল বন্ধুরাষ্ট্র এই সিদ্ধান্ত ও অঙ্গীকার করেছে যে, ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনে ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে নিশ্চয়তায় পরিণত করা হবে।([1])

আমেরিকান নথিপত্রের আলোকে

আমেরিকার বিশেষজ্ঞদের একটি কমিশন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসনকে ১২ জানুয়ারি ১৯১৯ নিজেদের একটি বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করে যে, কমিশন সুপারিশ করছে, ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জাতীয় বাসভূমি প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া হোক আর দুনিয়ার সকল ইহুদির কাছে আবেদন জানানো হোক, তারা যেন ফিলিস্তিন এসে বসবাস করে। তাদের সবধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করা হোক। পাশাপাশি এ বিষয়টিরও খেয়াল রাখা হোক যে, অ-ইহুদি কারও অধিকার যেন প্রভাবিত না হয়।

আমেরিকার একটি বিশেষ কমিটি ফিলিস্তিনের জমিগুলো সার্ভে করে ২৮ আগস্ট ১৯১৯ রিপোর্ট পেশ করে। যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়, ফিলিস্তিনের মূল অ-ইহুদি জনপদ—যা শতকরা ৯০%—ফিলিস্তিনে জায়নবাদী আয়োজন মেনে নেবে না। পাশাপাশি এটিও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, জায়নবাদী ও ইহুদিদের সাথে শত্রুতার অনুভূতি এখন শুধু ফিলিস্তিনের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। সকল ইংরেজ অফিসারের মত হলো, জায়নবাদী আয়োজন এখন শুধু সেনাবল দিয়েই বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। আর সেই সেনাসংখ্যাও পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের চেয়ে কম হতে পারবে না।

এটি এ কথারও প্রমাণ বহন করে যে, জায়নবাদী প্রোগ্রামে ফিলিস্তিনের মূল বাসিন্দাদের অধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন রয়েছে, তাই এই প্রহসনমূলক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করতে হবে। অপরদিকে জায়নিস্টদের মৌলিক দাবি হলো, তারা ফিলিস্তিনে দুই হাজার বছর ধরে বাস করছে। এই দাবি অগ্রাহ্যকর। যারা ফিলিস্তিনকে ইহুদিরাষ্ট্র বানাতে চায়, তাদের ফলাফল সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই, তেমনই ফিলিস্তিনে বিদ্যমান বিরোধিতা ও শত্রুতা সম্পর্কেও সঠিক ধারণা নেই; বিশেষ করে পৃথিবীর সেসব স্থানে যেখানকার মানুষজন ফিলিস্তিনকে পবিত্র ভূমি মনে করে। অন্য শব্দে বললে, ফিলিস্তিনে ইহুদিদের হিজরত নিশ্চিত করা হোক এবং ফিলিস্তিনকে ইহুদি রাষ্ট্র বানানোর পরিকল্পনা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা উচিত।

১৬ মার্চ ১৯৪৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাংকলিন রোজভেল্ট তার এক বক্তব্যে বলেছে, আজ আমার নিজেকে বড় সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। কারণ, ইহুদি আশ্রয়াকামীদের জন্য আজ ফিলিস্তিনের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে যখন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে, তখন সেসব লোকেরা ন্যায়বিচার পাবে, যারা ইহুদিদের জন্য জাতীয় বাসভূমি প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের সরকার ও মার্কিন জনগণ সবাই এটি অনুভব করে। আর আজ তো একটু বেশিই অনুভব হচ্ছে।

ডিসেম্বর ১৯৪৫ ইউরোপের ইহুদিদের সমস্যা ও ফিলিস্তিন-সমস্যার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য যে ইঙ্গ-মার্কিন কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তার প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, তাৎক্ষণিকভাবে সেসকল ইহুদিদের ফিলিস্তিনে প্রবেশের অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হোক, যারা নাৎসি ও ফ্যাসিস্টদের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে আমেরিকা ও বৃটেন—উভয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

ফিলিস্তিনকে ইহুদি ও ফিলিস্তিনি—দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত না করা হোক। এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক, যাতে ইহুদি-খৃস্টান-মুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়।

ইহুদিদের নিজের দেশ ও জাতীয় ইহুদিরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক রয়েছে, যদিও তাদের সংখ্যা অনেক কম। কিন্তু এটি এখন বাস্তবতায় পরিণত হয়ে গেছে। পাশাপাশি এটিও জেনে রাখা উচিত, ফিলিস্তিন নিরেট ইহুদি রাষ্ট্র নয়, আর না ভবিষ্যতে এমনটি হতে পারে; এটি আরব বিশ্বের দুই রাস্তার মুখে রয়েছে। আর আরববাসী—যাদের পূর্বপুরুষ প্রাচীনকাল থেকে এখানের মূল বাসিন্দা—তারা এটিকে নিজেদের জাতীয় আবাসভূমি মনে করে।

আরব ও ইহুদি—উভয়কে পরিষ্কার শব্দে বলে দেওয়া হোক, যদি কেউ চরমপন্থা গ্রহণ করে অথবা বেআইনি কোনো সেনাবাহিনী গঠন করে, তাহলে তাকে পিষে ফেলা হবে।

বাদশা আবদুল আজিজের এক চিঠির জবাবে—যেখানে তিনি ফিলিস্তিন-ইস্যুতে আমেরিকার অবস্থান নিয়ে নিজের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন—আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান লিখেছেন, আমেরিকা তার অবস্থানের ওপর অটল রয়েছে। আর তা হলো, জনসাধারণকে তার রাজত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে, আবার ফিলিস্তিনে ইহুদিদের পুনর্বাসনও জরুরি।

২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত ইহুদি-খৃস্টান কনফারেন্সে বক্তৃতাকালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি বলেছে, আমার বিশ্বাস, আরব ও ইহুদি—উভয় শহরবাসী বন্ধুত্বের ব্যাপারে একমত হয়ে যাবে আর এর জন্য অভ্যন্তরীণভাবে তাদের উভয়ের যেসব নিন্দা-ভর্ৎসনা ও অভিযোগের মুখে পড়তে হবে, সেগুলো তারা সহ্য করে নেবে। তারা যুদ্ধের পথ ছেড়ে সকল প্রচেষ্টা ও সম্পদ উন্নয়নমূলক কাজে লাগাবে। ইসরায়েল একটি দীপ্যমান প্রদীপ, যা মধ্যপ্রাচ্যে জ্বলজ্বল করছে।

২৭ অক্টোবর ১৯৯৪ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তার ইসরায়েল সফরের সময় ইসরায়েলের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে এই বক্তব্য দিয়েছিল যে, তোমাদের পতন আমাদের পতন। আমেরিকা আজও তোমাদের সাথে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।([2])

[1]. ওপরিউক্ত সবগুলো উদ্বৃতির জন্য দেখা যেতে পারে وثائق فلسطين الهيئة المصرية العامة للاستعلامات পৃষ্ঠা : ৪৮, ৫৩, ১৯১, ২১৭, ২৫৭, ২৭৫

[2]. ওপরিউক্ত সবগুলো উদ্বৃতির জন্য দেখা যেতে পারে وثائق فلسطين الهيئة المصرية العامة للاستعلامات পৃষ্ঠা : ২৪১, ২৫৯, ৭৩৫, ৭৬৫, ৮৫৯, ১৫৬১

 

(পুনরায় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত “ফিলিস্তিন: সাম্রাজ্যবাদ ও মুসলিমবিশ্ব” বই থেকে সংগৃহিত)

আরও জানুন

কারবালা কাহিনী ও তার প্রকৃত স্বরূপ

বইটি পড়তে বা ডাউনলোড করতে ক্লিক করুন! কারবালা কাহিনী ও তার প্রকৃত স্বরূপ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *