আবূ মুয়াবিয়া লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
আগের লেখাটি পড়ে নিন: ইবনে যিয়াদের নিয়োগ ও মুসলিম বিন আকীলের শাহাদত
ইবনে যিয়াদ কী চাচ্ছিল এবং কেন?
উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ চাইলে হুসাইনী কাফেলাকে দামেশকের দিকে যেতে দিতে পারতো। কিন্তু সে তা করেনি। আফসোসের বিষয় হল, চরম ধৃষ্টতার সাথে সে হুসাইন রাঃ কে দামেশকের দিকে যেতে না দিয়ে গ্রেফতার করে তার কাছে নিয়ে আসার স্পর্ধাসূচক আদেশ জারী করে।
প্রশ্ন হল, সে এমনটা করল কেন? তাহলে কি ইয়াযিদের পক্ষ থেকে হুসাইন রাঃ কে এভাবে গ্রেফতার করার নির্দেশ ছিল?
বাস্তব কথা হল, হযরত হুসাইন রাঃ ইরাক সীমান্তে পৌঁছার পর থেকে দশে মহররম পর্যন্ত কুফা ও দামেশকের মাঝে কোন প্রকার যোগাযোগ ও কথোপকথন করা সম্ভব ছিল না।
কারণ, কুফা ও দামেশকের মাঝে দূরত্ব হল ৯০৪ কিলোমিটার। যদি কোন দ্রুতগামী ঘোড়াও প্রতিদিন একশ’ কিলোমিটার সফর করে। তবু দামেশক পৌঁছতে নয় থেকে দশ দিন লেগে যাবে। আবার সেখান থেকে নতুন পয়গাম নিয়ে কুফা আসতেও এমন সময় লাগতো।
এর মানে ইয়াযিদের কাছ থেকে কুফায় পয়গাম আসতে কমপক্ষে ১৮ কিংবা ১৯ দিনের দরকার।
অথচ হুসাইন রাঃ ইরাক সীমান্তে আসার পর থেকে কারবালায় হত্যাযজ্ঞ পর্যন্ত ৫দিন সময়ও অতিক্রম করেনি। বরং ১০ই মুহররমই সকলকে শহীদ করে ফেলা হয়।
এর দ্বারা পরিস্কার বুঝা যায় যে, কারবালা প্রান্তরে ইবনে যিয়াদ কর্তৃক হত্যাযজ্ঞে ইয়াযিদের সরাসরি কোন নির্দেশ ছিল না।
বরং ইয়াযিদের আগের নির্দেশনা অনুপাতে সব ধরণের পদক্ষেপের জন্য নিজেকে উপযুক্ত মনে করে একক সিদ্ধান্তে সে তা করেছে। নতুন কোন নির্দেশের প্রয়োজন অনুভব করেনি।
ইয়াযিদের আগের নির্দেশনা ছিল কুফাকে নিয়ন্ত্রণ করা।
কুফার লোকজন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিল। হযরত হুসাইন রাঃও পরিস্থিতি আঁচ করে কুফার বদলে দামেশকে যাবার জন্য যাত্রা শুরু করে দিয়েছেন। এর মানে হুসাইন রাঃ এর কারণে কুফায় কোন প্রকার অস্থিরতা হবার সুযোগই ছিল না।
তারপরও উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ হুসাইন রাঃ কে দামেশক যেতে দিলো না কেন? তারতো এজন্য খুশি হবার কথা যে, সে তার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা পুরোপুরি শান্ত ও নিরাপদ রেখেছে। একটি পরীক্ষা থেকে নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু এরপরও সে কেন এমন পৈশাচিক কাজ করল?
আসলে ইবনে যিয়াদের কর্মকা- থেকে একথাই প্রতীয়মান হয় যে, সে একজন কঠোর মানসিকতা সম্পন্ন কমান্ডার ছাড়া কিছু নয়। তার দৃষ্টিতে হযরত হুসাইন রাঃ ছিলেন রাষ্ট্রের বিরোধী একজন ভয়ানক বিদ্রোহী মাত্র। বিদ্রোহী চরম পর্যায়ের অপরাধী হয়ে থাকে। এমন অপরাধীকে ক্ষমা করা যায় না।
এছাড়া তার মাথায় স্বৈরতান্ত্রিক দাপুটে শাসকের ভুতও সওয়ার হয়েছিল। সে যেভাবে মুসলিম বিন আকীল রাঃ এবং হুর বিন উরওয়াকে প্রকাশ্যে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তেমনি হুসাইন রাঃ কে হত্যা করে নিজের ক্ষমতার ত্রাস সৃষ্টি করতে চেয়েছে। যাতে করে ভবিষ্যতে আর কেউ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সাহস করবেতো দূরে থাক কল্পনাই করতে না পারে।
যদি ইবনে যিয়াদের শুধুমাত্র তার দায়িত্বপ্রাপ্ত কুফার ষড়যন্ত্রকারীদেরই নির্মূল করাই মাকসাদ হতো, তাহলে নুমান বিন বশীর রাঃ কে বরখাস্তকরণ এবং কুফায় তার নিয়োগ, আহলে ইরাকের উপর পূর্ণাঙ্গ আধিপত্য, মুসলিম বিন আকীল ও হুরকে হত্যা করার সংবাদ হযরত হুসাইন রাঃ এর কাছে পৌঁছতে দিতো। যাতে করে হুসাইন রাঃ কুফায় আসার চিন্তাই বাদ দিয়ে দেন।
কিন্তু হযরত হুসাইন রাঃ পর্যন্ত উপরোক্ত পটপরিবর্তনের সংবাদ না পৌঁছানোর জন্য শহরের সীমান্ত জুড়ে কড়া অবরোধ আরোপ করে সেই পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে হযরতে হুসাইন রাঃ সঠিক সময়ে সংবাদই পাননি।
এ কারণেই হযরত হুসাইন রাঃ কুফার সীমান্তে এসে গেছেন। আসলে ইবনে যিয়াদ এটাই চাচ্ছিল যে, হযরতে হুসাইন রাঃ বেখবর অবস্থায় কুফায় আসবেন আর তাঁকে অপ্রস্তুত অবস্থায় গ্রেফতার করা হবে।
সে যেন এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছে যে, সে কতবড় রাজনীতিবীদ! কত শক্তিমান শাসক। হযরত হুসাইন রাঃ এর মত ব্যক্তিত্বকে নিজের জালে আটকে ফেলেছে।
এজন্যই সে সীমান্তবর্তী টহল বাহিনীকে অর্ডার দিয়ে রেখেছিল যে, হযরত হুসাইন রাঃ আসার সাথে সাথে দ্রুত গ্রেফতার করে যেন তার দরবারে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু হযরত হুসাইন রাঃ এ নির্দেশ মানতে অস্বিকার করেন।
সেনা কমান্ডার হুর বিন ইয়াযিদ নবী পরিবারের প্রতি মোহাব্বত, তার কোমল হৃদয়ের কারণে হুসাইন রাঃ কে গ্রেফতার না করে চলে যেতে সুযোগ করে দেন।
উমর বিন সা’দের কারবালা রওনা
ইবনে যিয়াদ এবার উমর বিন সা’দকে তেহরানের গভর্ণরী দেবার আশ্বাস দিয়ে হুসাইন রাঃ কে নিঃশর্তে গ্রেফতার করার দায়িত্ব অর্পণ করে। আদেশ করে: যদি হুসাইন রাঃ স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ না করেন তাহলে যেন হত্যা করা হয়।
যেহেতু হুসাইন রাঃ এর মত ব্যক্তিত্বের উপর হাত উঠানো কিয়ামত পর্যন্তের জন্য বদনামীর কারণ হবে, তাই উমর বিন সা’দ এ দায়িত্ব গ্রহণে অক্ষমতা প্রকাশ করেন।
কিন্তু ইবনে যিয়াদ তার বাড়ি ঘর ধ্বংস করা এবং গর্দান উড়িয়ে দেবার ধমকি প্রদান করে। [তাবক্বাতে ইবনে সা’দ-৫/১৬৮]
উমর বিন সা’দ সকাল পর্যন্ত ভাবার জন্য সুযোগ চায়। সারা রাত চিন্তা করে সকালে সম্মতি জানিয়ে বাহিনী নিয়ে কারবালা প্রান্তরে পৌঁছে যায়। [তারীখে তাবারী-৫/৩৮৯]
কারবালা প্রান্তর
হিজরী ৬১ হিজরীর ৯ই মহররম।
কারবালা প্রান্তরে সরকারী বাহিনীর অফিসার উমর বিন সা’দ, শিমার বিন জিলজাওশান এবং হুসাইন বিন নুমাইরের সাথে হযরত হুসাইন রাঃ এর আলোচনা হয়। হযরত হুসাইন রাঃ তাদেরকে আল্লাহ ও ইসলামের ওয়াস্তা দিয়ে বলেন,
أَنْ يُسَيِّرُوهُ إِلَى أَمِيرِ الْمُؤْمِنِينَ يَزِيدَ فَيَضَعَ يَدَهُ فِي يَدِهِ،
আমাকে আমীরুল মু’মিনীন ইয়াযিদের কাছে যাবার সুযোগ দিন। আমি আমার হাত তার হাতে দিয়ে দেবো। [তারীখে তাবারী-৫/৩৯২, আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৮/১৭০]
কিন্তু ইবনে যিয়াদের পক্ষ থেকে হযরত হুসাইন রাঃ কে শর্তহীনভাবে গ্রেফতার করার আদেশ ছিল। তাই সেনাপ্রধান জবাব দিল: “এছাড়া কোন পথ নেই যে, আপনি সিদ্ধান্তের জন্য নিজেকে ইবনে যিয়াদের কাছে আত্মসমর্পণ করুন। [তারীখে তাবারী-৫/৩৯২, আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৮/১৭০]
হুসাইন রাঃ এর তিন প্রস্তাব
যখন সকল পথ রুদ্ধ হতে দেখলেন তখন হুসাইন রাঃ দ্বিতীয় পন্থা অবলম্বন করে তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন। যথা-
১)
আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানেই ফেরত যাবার সুযোগ দেয়া হোক।
২)
ইয়াযিদের কাছে যাবার সুযোগ দেয়া হোক। যেন তার হাতে বাইয়াত হতে পারেন। তাদের ভিতরকার মতভেদ যেন দূরিভূত হয়ে যায়।
৩)
ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্তে পৌঁছে দেয়া হোক। যেন তিনি অন্যান্য মুসলমানদের মতই জীবন যাপন করতে পারেন।
উমর বিন সা’দ এ প্রস্তাব মেনে নেয়। উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদকে এ বিষয়ে জানায়। কিন্তু ইবনে যিয়াদ তা অস্বিকার করে। শর্ত ছাড়া গ্রেফতার করার জন্য জোর নির্দেশ প্রদান করে। [তারীখে তাবারী-৫/৩৮৯, আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৮/১৯৭]
উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ প্রথমত হযরত হুসাইন রাঃ এর প্রস্তাব মেনে নিতে চাইলেন। কিন্তু শিমার বিন জিলজাওশান তাকে বুঝায় যে, শর্তহীন গ্রেফতারটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। যাতে করে সব কিছু হুকুমতের অধীন থাকে।
শিমার উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদকে বলে, আল্লাহ দুশমনকে আপনার কাবুতে এনে দিয়েছেন। আপনি তাকে ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন? [তারীখে তাবারী-৫/৪১৩-৪১৪, আলমিহান-১৫৪]
শিমারের কথা শুনে প্রভাবিত হয়ে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ হুসাইন রাঃ এর শান্তি প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। [আলমিহান-১৫৪] আবারো শর্তহীন আত্মসমপর্ণের জন্য হুসাইন রাঃ কে বলা হয়। কিন্তু এভাবে অসহায় আত্মসমর্পণ কেবল নবী পরিবারের অসম্মানই নয়, বরং সেই মহান উদ্দেশ্যও ধুলায় মিশে যায়, যে উদ্দেশ্য সফলের লক্ষ্যে নিজের পরিবারের সদস্য পর্যন্ত ঝুঁকির মুখে নিক্ষেপ করেছেন।
এ কারণে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, কিছুতেই তিনি শর্তহীন আত্মসমর্পণ করবেন না। [তারীখে তাবারী-৫/৩৩৯]
গ্রেফতার কেন হতে চাননি?
এখানে এ বিষয়টি অনেকের কাছেই আশ্চর্যের যে, হুসাইন রাঃ ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত হতে রাজী হবার পরও কেন ইবনে যিয়াদের কাছে বাইয়াত হতে রাজী হননি? অথচ ইবনে যিয়াদতো নিজের বাইয়াত নয়, বরং ইয়াযিদের আনুগত্বেরই বাইয়াত গ্রহণ করতো।
আসলে যারা এমনটি ধারণা করে থাকেন, তারা হুসাইন রাঃ এর মূল লক্ষ্য সম্পর্কে ভ্রুক্ষেপ না করার কারণেই এমন প্রশ্ন করছেন। তারা হুসাইন রাঃ কে সাধারণ ক্ষমতালোভী সাধারণ কেউ মনে করছে। নাউজুবিল্লাহ।
তারা এমনটা মনে করছেন যে, হুসাইন রাঃ শুধুমাত্র প্রাণরক্ষার তাগিদে ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত হতে রাজী হয়ে গেলেন। যে বাইয়াতের তিনি শুরু থেকে বিরোধী ছিলেন।
যদি তিনি প্রাণরক্ষার জন্যই এমনটি করে থাকেন, তাহলে নিজের চেয়ে চারগুণ বেশি প্রশিক্ষিত রাষ্ট্রীয় সৈন্যের বিপরীতে কেন মাথা ঝুঁকাননি? কেন নির্মমভাবে মাথা উঁচু করে কারবালা প্রান্তরে শাহাদতের পেয়ালা পান করেছেন?
আসল বিষয় হল, হযরত হুসাইন রাঃ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজের আজমত ও ইজতিহাদী অবস্থানের উপর অটল ছিলেন।
তিনি যেহেতু কুফী শিয়াদের পত্র ও দূতদের মাধ্যমে জেনেছেন যে, কুফীরা সবাই হুসাইন রাঃ এর অপেক্ষায়। তারা কেউ ইয়াযিদের পক্ষে নয়। তারা হুসাইন রাঃ এর নেতৃত্ব চায়। আর ইয়াযিদের ক্ষমতায় আরোহন পদ্ধতি পূর্ববর্তী খলীফাগণের স্বীকৃত পদ্ধতিতে ছিল না। তাই এ পদ্ধতির সংস্কার প্রয়োজন। যাতে করে এটি প্রচলিত হয়ে বংশীয় শাসনের ধার চালু হয়ে না যায়।
এ দু’টি মৌলিক বিষয়কে সামনে রেখে হযরতে হুসাইন রাঃ কুফায় আগমণ করেন। এসে যখন দেখলেন যে, কুফার শিয়ারা মিথ্যা বলেছে। আসলে পুরো ইরাক ইয়াযিদে খেলাফত মেনে নিয়েছে। তারা সকলেই ইয়াযিদের ঝান্ডার নিচে ঐক্যবদ্ধ। কেউ ইচ্ছেয়, কেউ অনিচ্ছায়। কিন্তু সকলেই ইয়াযিদের নেতৃত্ব ও হুকুমত মেনে নিয়েছে।
আর চিঠি লেখক কুফীরা। যারা নিজেদের শিয়া দাবী করেছে এরা সকলেই গাদ্দারী করে পলায়ন করেছে। তখন তিনি সরাসরি ইয়াযিদের সাথে সাক্ষাৎ করে তার হাতে বাইয়াত হতে চাইলেন। যাতে করে তার মূল উদ্দেশ্য বিষয়ে সরাসরি কথা বলে একটি সুরাহা বের করতে পারেন। যা রাজনৈতিক সন্ধি হবে।
এ সন্ধির ক্ষমতা কেবল ইয়াযিদের হাতেই আছে। উবায়দুল্লাহ যিয়াদের হাতে নেই। কারণ, সে কেবল একজন গভর্ণর। ইয়াযিদের হুকুমের গোলাম। এ কারণে তার হাতে বাইয়াত হয়ে কোন লাভ নেই। তাছাড়া সে নিঃশর্ত বাইয়াত নিয়ে হুসাইন রাঃ এর মূল উদ্দেশ্যের উপরই পানি ফেলে দিচ্ছিল। এ কারণে হযরতে হুসাইন রাঃ তার আদর্শের জন্য শহীদ হতে রাজী হলেন, কিন্তু আদর্শ বিসর্জন দিতে রাজী হলেন না।
একটু ভিন্ন দিক
হুসাইন রাঃ এর তিনটি প্রস্তাবের বিষয় শিয়া লেখকগণও তাদের গ্রন্থে সযতেœ উল্লেখ করেছন। যেমন-
১) মাকাতিলুত ত্বলিবীন, শিয়া আবুল ফারাজ ইসফাহানীকৃত-৭৫।
২) বিহারুল আনওয়ার, শিয়া মোল্লা বাকের মাজলিসীকৃত-১০/৪৪৬।
৩) নাসেখুত তাওয়ারীখ, শিয়া মীর্যা মুহাম্মদ ত্বকীকৃত-৬/২২৭।
৪) ই’লামুল ওরা শিয়া তাবরেসীকৃত-২২৪।
৫) মুনতাহাল আমাল, শিয়া আব্বাস বিন মুহাম্মদ কুম্মীকৃত-১/২৩৪।
৬) আলইরশাদ, শায়েখ মুফীদ শিয়া-২০১।
৭) তালখীসে শাফী, আবু জা’ফর তূসী শিয়া-৪৭১।
৮) তানযীহাতুল আনবিয়া, শরীফ মুর্তাজা শিয়া-১৭৭।
৯) গাদীরে খুম থেকে দামেস্ক, শিয়া আব্দুল মুমিন-৯৩।
১০) শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস, আব্বাস কুম্মীকৃত-১/১৭৭।
একইভাবে আহলে সুন্নাতের গ্রহণযোগ্য তারীখ গ্রন্থাবলীতেও উক্ত তিনটি প্রস্তাবের কথা আসছে। যেখানে ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত হবার কথা স্পষ্টই বলেছেন হযরত হুসাইন রাঃ। যেমন-
১) আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৮/১৯৭
২) শরহে আকায়েদ-৪৫১।
৩) তারীখে ইবনে খালদূন-২/১০৪।
৪) মা ছাবাতা মিনাস সুন্নাহ, শায়েখ আব্দুল হক দেহলবীকৃত-২৬।
৫) তারীখে কামেল, ইবনুল আছীরকৃত-৪/২৪।
৬) আলইছাবাহ, ইবনে হাজারকৃত-১/২৪২।
৭) তারীখুল খুলাফা-১২৪।
৮) রা’ছুল হুসাইন, ইবনে তাইমিয়াকৃত-২০।
৯) তাহযীবে তারীখে দামেশক, ইবনে আসাকীরকৃত-৪/৩৩৫।
১০) আনছাবুল আশরাফ, বালাজুরীকৃত-৩/১৮২।
কারবালার যুদ্ধ কি ইসলাম ও কুফরের যুদ্ধ ছিল?
হযরত হুসাইন রাঃ ও উমর বিন সা’দ এর মধ্যকার আলোচনা এবং হুসাইন রাঃ এর তিন প্রস্তাবের দিকে একটু ভালো করে নজর বুলালে আমাদের কাছে অনেক কিছু পরিস্কার হয়ে যায়।
ক) ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত হতে চাওয়া।
খ) ইয়াযিদের শাসনকৃত রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া।
গুরুত্বপূর্ণ এ দু’টি বিষয় এতে চলে আসছে। এর মানে ইয়াযিদের নিয়োগ পদ্ধতি হুসাইন রাঃ এর পছন্দ না হলেও, তিনি ইয়াজিদের শাসনকে কুফরী শাসন মনে করতেন না। তার হাতে বাইয়াত হওয়াকে কাফেরের হাতে বাইয়াত মনে করতেন না।
আর কারবালায় আগমণ ইসলাম ও কুফরীর পার্থক্য নির্ণয়ক বিষয় ছিল না।
যদি ইয়াযিদ তখন পর্যন্ত কাফের হতো। ইসলাম বিকৃতকারী হতো। ইসলামের দুশমন হতো। নবীজীর দুশমন হতো। তাহলে হুসাইন রাঃ কিভাবে তাকে আমীরুল মুমিনীন বলেন? কিভাবে তার হাতে বাইয়াত হতে বলেন? কিভাবে তার অধীনত রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্র বলেন?
তাহলে কি হুসাইন রাঃ কাফেরের হাতে বাইয়াত হতে চেয়েছেন? ইসলাম বিকৃতকারী, ইসলামের দুশমনের হাতে বাইয়াত হতে চাইলেন?
অবশ্যই নয়। হতেই পারে না।
হ্যাঁ। একথা ঠিক যে, ইয়াযিদের কারবালা ঘটনায় সম্পক্তৃতা এবং পরবর্তীতে হাররার ঘটনা ইত্যাদির মাধ্যমে ফাসেকী পরিস্কার হয়ে যায়। তার ঘৃণ্য চেহারা ফুটে উঠে। যা হুসাইন রাঃ এর কুফায় আগমণ পর্যন্ত পরিস্কার ছিল না।
যুদ্ধ যেভাবে শুরু
কথাবার্তা শেষ হয়ে যাবার পরও উমর বিন সা’দ যুদ্ধ না করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ইবনে যিয়াদ কুফায় বসে পুরো পরিস্থিতির ক্ষণে ক্ষণে সংবাদ রাখছিল। সে কড়া নির্দেশ প্রদান করে জুআইরিয়া বিন বদর তাইমীকে পাঠায় যে, উমর বিন সা’দকে বল যে, দ্রুত হামলা করতে, নতুবা তাকে হত্যা করা হবে।
উমর বিন সা’দ সেদিন সুযোগ দিল হুসাইন রাঃ কে চিন্তা ভাবনা করার জন্য।
পরদিন উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কড়া নির্দেশ পাবার পর উমর বিন সা’দ হাতিয়ার নিল এবং যুদ্ধ শুরু করার ঘোষণা দিল। [তারীখে তাবারী-৫/৩৯২]
৬১ হিজরীর মহররম মাসের ১০ তারিখ।
শুক্রবার মতান্তরে শনিবার উমর বিন সা’দ তার সঙ্গীদের নিয়ে ফজরের নামায শেষে যুদ্ধের জন্য সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল। উল্লেখ্য যে, সে দিন ছিল আশুরার দিন।
এদিকে হযরত হুসাইন রাঃ ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে নামায পড়লেন। আর তারা ছিলেন বত্রিশজন অশ্বারোহী এবং চল্লিশ পদাতিক যোদ্ধা। এরপর তিনি তাঁদেরকে সারিবদ্ধ করলেন। ডানপাশের কমান্ডার বানালেন যুহাইর বিন কায়সকে আর বাম পাশের জন্য নির্ধারণ করলেন হাবীব বিন মুতাহহারকে। তাঁর ঝাণ্ডা প্রদান করলেন তাঁর ভাই আব্বাস বিন আলীকে। আর তাঁদের সঙ্গের মেয়েদেরকে তাঁবুগুলিতে তাদের পেছনে নিয়ে আসলেন।
এদিকে হুসাইন রাঃ এর নির্দেশমত রাতেই তারা তাদের তাঁবুর পেছনে পরিখা খনন করে তাতে জ্বালানি কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি ফেলে রেখেছিলেন। এরপর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। যাতে করে পেছন থেকে কেউ তাঁবুর কাছে ঘেঁষতে না পারে। আর উমর বিন সা’দ তাঁর বাহিনীর ডান পার্শের কমান্ডার বানালো আমর বিন হাজ্জাজ আয যুবাইদীকে। বাম পাশের জন্য শিমার বিন জুলজাওশানকে।
অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল আযরাহ বিন কায়স আল আহমাসী। আর পদাদিক বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল শাবীছ বিন রিবয়ীর। আর ঝা-া ছিল ওয়ারদানের হাতে।
উভয় পক্ষ স্ব স্ব স্থানে স্থির হয়ে থাকলো। [আলবিদায়া ওয়াননিয়াহা-৮/১৭৮, আরবী, ৮/৩৩৩, বাংলা]
হুসাইন রাঃ এর গায়ে মোটা জোব্বা ছিল। উমর বিন সা’দের বাহিনীর উমর তাহয়ী নামক সৈন্য তীর ছুড়ল। তীর গিয়ে হুসাইন রাঃ এর কাঁধে এসে আঘাত করল। [তারীখে তাবারী-৫/৩৯২]
এ সময় কুফার ঘোরসওয়ার বাহিনীর কমান্ডার হুর বিন ইয়াযিদের বিবেক জাগ্রত হয়ে উঠল। সে সৈন্যবাহিনীর যুদ্ধাংদেহী মনোভাব দেখে তিরস্কার করে বলতে লাগল, তোমরা কি হুসাইন রাঃ এর আবেদন গ্রহণ করবে না? আল্লাহর কসম! যদি এমন দরখাস্ত তুর্কিস্তান ও দায়লামের কাফেররাও করতো, তাহলে তা তোমাদের জন্য রদ করা জায়েজ হতো না।
এতে করে সৈন্যদের মাঝে কোন প্রভাব সৃষ্টি হয়নি। তখন তিনি বেশ নিজ বাহিনী ছেড়ে হুসাইন রাঃ এর বাহিনীর দিকে এগিয়ে গেলেন। তাদের সাথে শরীক হয়ে গেলেন।
তার পূর্ব আচরণের জন্য হুসাইন রাঃ এর কাছে ক্ষমা চাইলেন। বলেন, আমি যদি আগে তাদের ইচ্ছের কথা জানতাম, তাহলে আমি আপনার সাথে ইয়াযিদের কাছে যেতাম।
এরপর তিনি বাহিনীর সামনে এসে উমর বিন সা’দকে বললেন, দুর্ভাগ্য! তোমাদের নবীর দৌহিত্রের প্রস্তাবিত তিনটি বিষয়ের একটিও কি তোমরা গ্রহণ করবে না? তখন সে বলল, তা গ্রহণ করার ক্ষমতা যদি আমার থাকতো, তাহলে আমি তা গ্রহণ করতাম। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৮/১৮০, ৮/৩৩৬]
তারপর যুদ্ধ শুরু হল। হুর বিন ইয়াযিদ ইবনে যিয়াদের বাহিনীর উপর হামলা করলেন। দুইজন সৈন্যকে হত্যা করে নিজেও শহীদ হয়ে গেলেন। [তারীখে তাবারী-৩/৩৯২]
হুসাইন রাঃ কে অপমান
যুদ্ধকালে এক বদবখত দাঁড়িয়ে আওয়াজ দিল: তোমাদের মাঝে কি হুসাইন আছে?
উত্তর আসল: আছে। তখন সে বলল, তাকে জাহান্নামের সুসংবাদ দাও।
হযরত হুসাইন রাঃ শুনে বললেন, না। বরং আল্লাহ তাআলা ক্ষমাকারী। তিনি মেহেরবান এবং দয়ালু। যার আনুগত্য করা হয়।
তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, তুমি কে?
সে বলল, আমি হাওজা এর ছেলে।
তখন তিনি অবচেতনে বলে ফেললেন, হে মালিক! তাকে জাহান্নামে টেনে নাও।
সে সময় তার ঘোড়া আচমকা ছুটতে শুরু করে। ফলে ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। তার পা রিকাবে আটকে যায়। ঘোড়া তাকে ছেচড়াতে ছেচড়াতে নিয়ে চলে। এর ফলে তার পুরো শরীর টুকরো টুকরো হয়ে যায়। রেকাবে শুধু তার পা দু’টি বাকি থাকে। [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-৩৭৩৬৯, আলমু’জামুল কাবীর, তাবারানীকৃত-৩/১১৬]
আব্দুল্লাহ এর শাহাদত
হযরত হুসাইন রাঃ এর ছেলে আব্দুল্লাহ। অত্যান্ত সুন্দর চেহারার অধিকারী ছিলেন। এক কুফী সৈন্য তাঁকে দেখে বলল, তাকেতো আমি অবশ্যই হত্যা করবো।
অন্যান্যরা বুঝাল যে, এমন ছোট্ট নাবালেগ শিশুকে হত্যা করে তোর কী ফায়দা?
কিন্তু সেই কুফী তার উপর হামলা করল এবং তাকে হত্যা করল। যখন তার উপর আঘাত করছিল, তখন আব্দুল্লাহ চিৎকার বলে উঠলেন: হে চাচা!
হযরত হুসাইন রাঃ আওয়াজ শুনে বলতে লাগলেন: এমন ব্যক্তির আওয়াজে লাব্বাইক, যার সাহায্যকারী কম কিন্তু শত্রু অনেক বেশি।
হুসাইন রাঃ হামলাকারীর উপর আক্রমণ করে এক আঘাতে তার এক হাত এবং আরেক আঘাতে তাকে হত্যা করেন। তারপর আম লড়াই শুরু হয়ে গেল। [আলমিহান-১৫৪]
চিঠিদাতা শিয়া কুফীদের গাদ্দারী
হুসাইন রাঃ যখন কুফার বদলে দামেশক যেতে প্রস্তুত হয়ে গেলেন। তখন কুফী শিয়ারা চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে। তাদের মূল মাকসাদ ছিল হুসাইন রাঃ কে ভুল বুঝিয়ে কুফায় এনে একটি হাঙ্গামা সৃষ্টি করা। কিন্তু হুসাইন রাঃ পরিস্থিতি বুঝে যান। চিঠি লেখক শিয়াদের মিথ্যাচার নিজ চোখে অবলোকন করেন।
শিয়াদের লক্ষ্য করে হুসাইন রাঃ এর বক্তব্য আমরা শিয়াদের গ্রন্থ থেকে একটু দেখে নেই:
হুসাইন রাঃ কুফীদের লক্ষ্য করে বলেন, আফসোস! তোমরাতো ঐ লোক! যারা আমার পিতা হযরত আলী রাঃ কে ধোঁকা দিয়েছো। তারপর তাকে শহীদ করেছো। তারপর আমার ভাই হাসান রাঃ কে আহত করেছো। আমার চাচাতো ভাই মুসলিম আকীল রাঃ কে কুফায় কতল করেছো। সত্য কথা হলো, যারাই তোমাদের প্রতারণায় ফেঁসে গেছে তারা বড় আহমক। [জালাউল উয়ূন]
হুসাইন রাঃ বলেন,
হে জনতা! তোমরা যেন ধ্বংস হও। দুর্দশাগ্রস্ত হও। তোমরা উৎসাহের সাথে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলে তোমাদের সাহায্য করার জন্য এবং আমরা তা করার জন্য দ্রুত অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু তোমরা এখন সে তরবারিগুলো কোষমুক্ত করেছো যা আমরা তোমাদের দিয়েছি এবং তোমরা আমাদের জন্য আগুন জ্বালিয়েছো যা আমরা তোমাদের ও আমাদের শত্রুদের জন্য জ্বালিয়েছিলাম। তোমরা তোমাদের শত্রুদের পক্ষ নিয়েছো এবং তাদের সাথে থেকে তোমাদের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অগ্রসর হয়েছো। [শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস-১/১৯৯-২০০]
হুসাইন রাঃ এর আরেকটি বক্তব্য আসছে শিয়াদের গ্রন্থে:
হে কুফার লোকেরা, তোমাদের মায়েরা তোমাদের হারাক। তোমরা আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলে, এরপর যখন তিনি তোমাদের কাছে এলেন, তোমরা তাকে শত্রুর হাতে তুলে দিলে। অথচ তোমরা তার জীবন রক্ষার্থে জীবন দিতে চেয়েছিলে। এখন তোমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছো তাকে হত্যা করার জন্য। তোমরা তাকে আটক করেছো এবং তার জামার কলার ধরেছো এবং তাকে চারদিক থেকে ঘেরাও করেছো যেন তিনি আল্লাহর প্রশস্ত শহরগুলোতে পালিয়ে যেতে না পারেন। [শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস-১/২০৭-২০৮]
হযরত হুসাইন রাঃ চিঠি প্রদান করে কুফায় দাওয়াতদাতা এসব শিয়া নামধারী গাদ্দারদের পল্টিবাজী দেখে দামেশক যাবার মনস্ত করেন। কিন্তু এসব গাদ্দাররা তখন তাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাবার আতংকে পড়ে যায়। কারণ, হুসাইন রাঃ এর সাথে তাদের চিঠি ছিল। যাতে তাদের নামও ছিল। যারা হুসাইন রাঃ কে কুফায় এসে তাদের বাইয়াত নিয়ে বিদ্রোহ করার প্ররোচনা দিয়েছিল।
এখন দামেশকে গিয়ে এসব ইয়াযিদকে দেখালে এসব চিঠি লেখকরা সব রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচারের মুখোমুখি হবে। তাই তারা কিছুতেই চাচ্ছিল না যে, হুসাইন রাঃ দামেশকে যান।
তাই তারা দ্রুতই হুসাইন রাঃ এর দলত্যাগ করে তাকে হত্যায় সহযোগিতা শুরু করে। যাতে করে তাদের গাদ্দারীর প্রমাণ বাকি না থাকে।
কুফার কিছু লোকেরা কারবালা প্রান্তরের বিভিন্ন উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখছিল। হুসাইন রাঃ এর সহায়তার জন্য আল্লাহর কাছে দুআও করতে ছিল। যেন আসমান থেকে সাহায্য এসে হুসাইন রাঃ কে উদ্ধার করে। কিন্তু নিজেরা কিছুই করতে রাজী নয়।
তখন একজন ওদের বলে যে, আরে আল্লাহর দুশমনেরা! একটু নিচে এসে হুসাইন রাঃ কে সাহায্য করছো না কেন?
কিন্তু তারা কোন উত্তরও না দিতে পারলো না। সাহায্য করতে এগিয়েও এলো না। [তারীখে তাবারী-৫/৩৯২]
হযরত হুসাইন রাঃ এর শাহাদত
হুসাইন রাঃ এর সাথে শ’য়ের কাছাকাছি লোক ছিল। তাদের মাঝে হযরত আলী রাঃ এর ৫ ছেলে। বনু হাশেমের ১৬ জন। বনু সালীম এবং বনু কেনানার এক এক দল ছিল। ইবনে উমর বিন যিয়াদ নামের এক ব্যক্তিও শামিল ছিল। [তারীখে তাবারী-৫/৩৯২]
অবশেষে এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সরকারী বাহিনীর হাতে হযরত হুসাইন রাঃ এর সকল সাথীবর্গ শহীদ হয়ে যান। যাদের মাঝে দশজন যুবক হুসাইন রাঃ এর নিজের ঘরের ছিলেন। এক তীর এসে হুসাইন রাঃ এর কোলের শিশুর গায়ে এসে লাগে। এতে উক্ত কোলের শিশুটিও শাহাদত বরণ করেন।
হুসাইন রাঃ শিশুটির শরীর থেকে রক্ত মুছতে মুছতে বললেন, হে আল্লাহ! আমাদের এবং তাদের মাঝে তুমিই ইনসাফ কর। ওরা আমাদের এজন্য ডেকেছে যে, তারা আমাদের সাহায্য করবে। কিন্তু ওরা এখন আমাদের হত্যা করছে। [তারীখে তাবারী-৫/৩৮৯]
হযরত হুসাইন রাঃ এর এ দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে যায় যে, ওরা শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হবে না। গায়ের কাপড় খুলে বেইজ্জাত করতে চাইবে। তাই তিনি তাঁবুতে ফিরে গেলেন। বললেন, আমাকে এমন একটা কাপড় দাও, যা কেউ ছিনিয়ে নিতে পছন্দ করবে না। যাতে করে কাপড় খুলে নিলেও কম দামী উক্ত চাদরটি যেন শরীরে রেখে যায়। একদম উলঙ্গ করে না ফেলে। তারপর তিনি একটি পুরাতন চাদর জামার নিচে পরিধান করলেন। তারপর তলোয়ার হাতে বেরিয়ে এলেন। [আলমু’জামুল কাবীর লিততাবারানী-৩/১১৭, তারীখে তাবারী-৫/৩৮৯]
দিনের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ইয়াযিদ বাহিনীর সৈন্যরা হযরত হুসাইন রাঃ কে হত্যার সুযোগ পেয়েও করছিল না। এর কারণ হল, তাদের কেউ হুসাইন রাঃ কে হত্যার দায় নিতে চাচ্ছিল না। একজন চাচ্ছিল অন্যজন হত্যা করুক।
অবশেষে শিমার জিলজাওশান সৈন্যদের আহবান করে বলল, তাঁকে হত্যার ব্যাপারে তোমাদের কিসের অপেক্ষা?
তখন যুরআন বিন শারীক তামীমী হুসাইন রাঃ এর দিকে অগ্রসর হয়ে কাঁধে তরবারী দ্বারা আঘাত করল। এরপর সিনান বিন আনাস আমর নাখয়ী তাঁকে বর্শা দ্বারা আঘাত করল। তারপর ঘোড়া থেকে নেমে মাথা কেটে ফেলে। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৮/৩৫২]
হুসাইন রাঃ বীরের মত লড়তে লড়তে কারবালা প্রান্তরে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেন। [আলমু’জামুল কাবীর লিততাবারানী-৩/১১৭, তারীখে তাবারী-৫/৩৮৯]
নিকৃষ্ট খুনীরা হযরতের শরীর থেকে সকল কাপড় খুলে নেয় পুরাতন চাদরটি ছাড়া। শরীর থেকে মাথাকে আলাদা করে ফেলে। [আলমু’জামুল কাবীর লিততাবারানী-৩/১১৭, তারীখে তাবারী-৫/৩৮৯]
শিমার হযরত আলী আসগর তথা যাইনুল আবেদীন রহঃ কে হত্যা করতে উদ্যত হয়। তখন হুমায়দ বিন মুসলিম তাকে তা থেকে নিবৃত করে। কারণ, তখন তিনি অসুস্থ্য ছিলেন।
এরপর সেনাপতি উমর বিন সা’দ এসে বলল, সবাই শুনে রাখ! কেউ যেন এ মেয়েদের তাঁবুতে প্রবেশ না করে এবং এই বালককে হত্যা না করে। আর যে তাঁদের কোন সামানপত্র নিয়েছে, সে যেন তা ফিরিয়ে দেয়। [আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৮/৩৫২]
শুহাদায়ে কারবালা
কারবালা প্রান্তরে হযরত হুসাইন রাঃ এর সাথে আবু তালেবের পরিবারের ১৮ জন ব্যক্তি শহীদ হন।
৬ জন হুসাইন রাঃ এর ভাই। যথা- ১) আব্বাস। ২) জা’ফর। ৩) উবায়দুল্লাহ। ৪) উসমান। ৫) মুহাম্মদ। ৬) আবু বকর।
২ জন হুসাইন রাঃ এর ছেলে। যথা ১) আব্দুল্লাহ। ২) আলী আকবর।
৩ জন হাসান রাঃ এর এর ছেলে। যথা- ১) কাসেম। ২) আবু বকর। ৩) আব্দুল্লাহ।
৩ জন আকীল বিন আবী তালেব রাঃ এর ছেলে (মুসলিম বিন আকীল রাঃ এর ভাই)। যথা- ১) জা’ফর। ২) আব্দুর রহমান। ৩) আব্দুল্লাহ।
২ জন আব্দুল্লাহ বিন জা’ফর বিন আবী তালেব রাঃ এর ছেলে। যথা- ১) আউন। ২) মুহাম্মদ।
২ জন আকীল রাঃ এর নাতি। যথা- ১) আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম। ২) মুহাম্মদ বিন আবী সাঈদ বিন আকীল।
উমর বিন সাঈদের সৈন্যদের ৮৮ জন নিহত হয়। [তারীখে খলীফা ইবনে খাইয়্যাত-২৩৪-২৩৫, আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-১১/৫৫১-৫৫২]
হুসাইন রাঃ এর ছেলে আলী বিন হুসাইন তথা যাইনুল আবেদীন অসুস্থ্য ছিলেন। উমর বিন সা’দ সৈন্যদের বলল, তাকে যেন কিছু না করা হয়। [তারীখুল কাবীর লিইবনে আবী খায়ছামা-২/৯১৪]
চলবে ইনশাআল্লাহ