প্রশ্ন
জনাব
আসসালামু আলাইকুম,
আমি মোঃ অমুক (নামটি উহ্য রাখা হল), পিতা মৃত কেরামত আলী, বিগত ২১/০৫/২০১৪ তারিখ অমুক (নামটি উহ্য রাখা হল), পিতা মৃত আব্দুল মান্নান এর সহিত ইসলামিক শরীয়া মোতাবেক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই।
বিবাহের পর সংসার জীবন খুব ভালভাবেই চলছিল, আমরা দূজনই সরকারি চাকুরীজীবী, আমি বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা এবং সে নেত্রকোনা সদর এর একটি প্রাইমারি স্কুলে সহকারী শিক্ষকের চাকুরী করে।
আমি বিবাহের পরে আমার চাকরি বদলীযোগ্য না হওয়ায় তাকে ঢাকায় বদলী করে নিতে চাইলে তার পারিবার তাকে দিয়ে লোন তুলানোয় সে তার বড় ভাই, মা ও আমার মাকে দিয়ে আমাকে নিষেধ করায় আমি যাতে তাকে ঢাকায় বদলী না করাই, তার কথামতো আমি বদলী করাইনি।
এদিকে আমি চাকুরীর সুবাদে ঢাকায় থাকায় সে তার বাপের বাড়িতে থাকতে থাকে। আর আমি প্রতি সপ্তাহে শুক্র, শনি মাঝে মাঝে একদিন বাড়িয়ে ছুটি নিয়ে আসতাম আবার কোন সময় ১৫দিন পরেও আসতাম।
এভাবে আমাদের সংসার জীবন ভালই চলছিল, এদিকে ৮/১০/১৫ তারিখে আমাদের একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে, আমার স্ত্রী সরকারি চাকুরীজীবী হওয়া সত্ত্বেও আমি তার কাছে টাকা পয়সার কোন হিসাব তো চাইনি বরং বাচ্চা আসার আগে আলোচনা সাপেক্ষে অনিয়মিত বাচ্চা পেটে আসার পর নিয়মিত তাদের খোরপোষ বাবদ ৫/ ৬ হাজার টাকা, আর বাড়িতে আসলে বাজার করে দিয়ে আসতাম।
আমার স্ত্রী ও এ ব্যাপারে কোনদিন কোন অভিযোগ করেনি।
এভাবে আমাদের সংসার জীবন ভালই চলছিল।
বিগত ১৮/১/১৮ সালে আমার বাবার মৃত্যুর খবর শুনে বাড়িতে যাই। পরেরদিন সকালে আমার স্ত্রী আর আমি বিছানায় শুয়ে থাকাবস্থায় বাচ্চার ডাকাডাকি শুনে বাহিরে যাই, দরজায় গিয়ে দেখি আমার একজন চাচাতো বোন বেহুশ হয়ে দরজায় পরে আছে।
আমি তাকে ধরাধরি করে তাদের ঘরে দিয়ে আমার বাচ্চাকে কোলে করে নিয়ে আসার সময় একই জায়গায় আমিও পরে যাই, এবং সেই থেকে আমার কোমর থেকে দু’পা অবশ হয়ে যায়।
পরে যখন আমাকে হাসপাতালে নেওয়া হয় আমি তখন আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম তুমি যদি কোনদিন অন্য কোন বিষয়ে চিন্তা করো আমাকে জানিও।
তখন সে বলল তুমি অযথা চিন্তা করোনা আমি কোনদিন তোমাকে ছেড়ে যাবোনা,এভাবে সে আমার সাথে থাকতে থাকে।
এভাবে অসুস্থতার সময় আমার সাথে সাত আটমাস থাকার পর সে একদিন বাপের বাড়িতে যায় এবং আমাকে জানায় ১৫দিন পরে আসবে।
এর পর কল দিই সে বলে দুইমাস পরে আসব, ৫ মাস পরে আসব, এরপর আমি তার মাকে ফোন করে বলি থাকে পাঠানোর জন্য সে আসেনি।
এরপর তার বোনজামাইকে বলি পাঠাতে সে আসেনি। তার খালাতো ভাই খোকন মিয়া, মামাত ভাই রহমতকে দিয়ে কয়েক দফা বলার পরও সে আসেনি।
অবশেষে আমি নিজে ফোনে জানাই আমি তাকে নিতে আসবো, এটা শুনে সে তড়িঘড়ি করে মুফতিকে ভুল তথ্য দিয়ে ফতোয়া আনে এবং মিথ্যা হলফনামা দিয়ে এভিডেবিট তৈরি করে কাজীর মাধ্যমে তালাকনামার নোটিশ পাঠায়।
তার জঘন্য মিথ্যাচারগুলো নিম্নরূপ:
১। আমি তাকে প্রায়শই শারীরিকভাবে অত্যাচার ও নির্যাতন করতাম। (যা সম্পুর্ণ মিথ্যা)
২। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তার এবং বাচ্চার ভরণপোষন দেইনি । (যা সম্পুর্ণ মিথ্যা)
অথচ তার ভরন পোষন বাবধ ৪, ৫ কোনমাসে ৬ হাজার, প্রতিমাসে সপ্তাহে বাজার, কাপড় চোপর সামর্থ্য অনুযায়ী দেওয়া হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক, নেত্রকোনা শাখায় আমার স্ত্রীর নামে একাউন্ট খুলে প্রতিমাসে আমি ৩,০০০ টাকা জমা দিতাম।
৩। শারীরিক অসুস্থতা ( সত্য)
তবে বিছানা থেকে উঠতে পারিনা তা মিথ্যা।
ফতোয়ার আবেদনে উল্লেখিত অসুস্থতার তারিখ ভুল। (ফতোয়ার ডেট ভুল ২৭/১০/১৬ ইসায়ী উল্লেখ, অথচ আমি অসুস্থ ১৯/১/১৮ সালে)
৪। আমি উত্তেজনা বশত দুই বৎসর পুর্বে মৌখিকভাবে তালাক প্রদান করিয়া তাকে ও আমার বাচ্চাকে বাড়ি থেকে বের করে দেই। ( যা সম্পুর্ণ বানোয়াট ও গুরুতর মিথ্যা অপবাদ।
৫। আমি খারাপ, বদমেজাজি, ঝগড়াটে ইত্যাদি সম্পুর্ণ মিথ্যা।
৬। স্বামীর বাড়ি থেকে গোস্যা করে কয়েকবার বাপের বাড়ি চলে যাওয়া। ( সম্পুর্ণ মিথ্যা)
এখন আমার প্রশ্ন হলো:
১। আমি তালাকনামায় তাকে লিখিত ও মৌখিক কোন অনুমতি বা ক্ষমতা না দেওয়া সত্বেও
২। অসুস্থতা ব্যতিত উপরোক্ত সবগুলি মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে
৩। বিচারক কর্তৃক আমাকে তলব না করে ও চিকিৎসার সময় না দিয়ে
৪। মুফতি কর্তৃক উল্লেখিত পদ্ধতিতে আমার বা আমার কোন পক্ষকে অবহিত না করে শুধু নোটিশের মাধ্যমে স্ত্রী কর্তৃক তালাক দেওয়া কি ইসলামিক শরীয়তের আলোকে বৈধ হয়েছ।
( ফতোয়ার আবেদন, ফতোয়া, হলফনামা, তালাকের নকল সংযুক্ত করা হয়েছে, এখানে উল্লেখ্য আমার কাবিননামাটি অসুস্থতার সময় ঢাকায় রেখে আসছিলাম তা হারিয়ে গেছে বিদায় সংযুক্ত করতে পারিন,, তবে কাজী কর্তৃক প্রদত্ত নকলের কপিতে ক্ষমতা প্রদান না করার কথাটি উল্লেখ আছে।)
দয়া করে কুরআন হাদীসের আলোকে সমাধান দিবেন।
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
আপনার স্ত্রী যে ফাতওয়া মুফতীর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে। সেই ফাতওয়াটি যথার্থও সঠিক। সেখানের কোথাও আপনার স্ত্রী নিজে নিজে তালাক নিয়ে নিতে পারবে এমন কথা বলা হয়নি।
বরং বলা হয়েছে যে, আপনার স্ত্রী আপনার কাছ থেকে কোন কৌশলে তালাক নিয়ে নিতে। কিংবা আপনার সাথে খোলা তালাক করে নিতে।
যদি এতেও সক্ষম না হয়, তাহলে সালিশী বসিয়ে আপনার উপস্থিতিতে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আপনার শারিরীক অক্ষমতা প্রমাণিত হলে সে নিজের উপর সালিশের মাধ্যমে তালাক পতিত করে নিতে।
সুতরাং ফাতওয়াটি ভুল বলার কোন সুযোগ নেই।
আপনি যদি আপনার স্ত্রীকে তালাক প্রদান না করে থাকেন, কিংবা তালাকের অধিকার প্রদান করে না থাকেন, তাহলে আপনার স্ত্রী নিজের উপর তালাক পতিত করতে পারে না।
তবে আপনি যদি শারিরীকভাবে অক্ষমই হন। ভালো হবার কোন সম্ভাবনাই না থাকে, তাহলে আপনার উচিত স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয়া। অহেতুক স্ত্রীকে কষ্ট দেয়া আপনার জন্য উচিত হবে না।
আর যদি সুস্থ্য হবার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে আপনার স্ত্রীকে এ বিষয়ে বুঝিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করতে বলা উচিত।
বাকি আপনার স্ত্রী যেভাবে আপনার তালাকের অধিকার প্রদান ছাড়াই নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে নিজের উপর তালাক পতিত করে নিয়েছে তা শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে তালাক বলে ধর্তব্য হবে না।
তাই সে এখনো আপনার স্ত্রী হিসেবে বাকি আছে।
একথা জেনে রাখবেন যে, দাম্পত্য জীবন জোর করে করা যায় না। দুইজনের মনের মিলটাই এখানে মুখ্য। শারিরীক সম্পর্ক ছাড়াও দাম্পত্য জীবন হতে পারে। আবার শারিরীক সম্পর্ক ছাড়া দাম্পত্য জীবন অনেক সময়ই অসম্ভব হয়ে পড়ে।
তাই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আপনার সুস্থ্য হবার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে আপনার উচিত স্ত্রীকে তালাক দেয়া, কিংবা খোলা করে নেয়া।
এভাবে একজন নারীকে কষ্ট দেয়া কোনভাবেই উচিত নয়।
وَإِنِ امْرَأَةٌ خَافَتْ مِن بَعْلِهَا نُشُوزًا أَوْ إِعْرَاضًا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَن يُصْلِحَا بَيْنَهُمَا صُلْحًا ۚ وَالصُّلْحُ خَيْرٌ ۗ وَأُحْضِرَتِ الْأَنفُسُ الشُّحَّ ۚ وَإِن تُحْسِنُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا [٤:١٢٨]
যদি কোন নারী স্বীয় স্বামীর পক্ষ থেকে অসদাচরণ কিংবা উপেক্ষার আশংকা করে, তবে পরস্পর কোন মীমাংসা করে নিলে তাদের উভয়ের কোন গোনাহ নাই। মীমাংসা উত্তম। মনের সামনে লোভ বিদ্যমান আছে। যদি তোমরা উত্তম কাজ কর এবং খোদাভীরু হও, তবে, আল্লাহ তোমাদের সব কাজের খবর রাখেন। [সূরা নিসা-১২৭]
عن ابن المسيب رض قال: الطلاق بالرجال والعدة بالنساء (مصنف عبد الرزاق-7/236، رقم-12951)
عن عبد الله بن مسعود رض قال: الطلاق بالرجال والعدة بالنساء (المعجم الكبير للطبرانى-9/337، رقم-9697)
الطلاق بالرجال والعدة بالنساء… وقوله فإنه حينئذ أنسب من أن يراد به الإيقاع بالرجال، ولأنه معلوم من قوله تعالى فطلقوهن. الآية. (مرقاة المفاتيح، باب الخلع والطلاق، البحث على أن العبرة فى العدة بالمرأة-6/396، تحت رقم الحديث-3289)
جعل الطلاق بيد الزوج لا بيد الزوجة
إن الذى يملك الطلاق إنما هو الزوج…. ولا تلملكه الزوجة إلا بتوكيل من الزوج أو تفويض منه (الفقه الأسلامى وأدلته-7/347، 355)
لأن الطلاق لا يكون من النساء (رد المحتار-4/361)
ومحله المنكوحة وأهله زوج عاقل بالغ مستقظ (الدر المختار مع رد المحتار-4/431، هندية-1/348، 353
وفي رد المحتار- وأنواعه ثلاثة : تفويض ، وتوكيل ، ورسالة وألفاظ التفويض ثلاثة : تخيير وأمر بيد ، ومشيئة .
( قال لها اختاري أو أمرك بيدك ينوي ) تفويض ( الطلاق ) لأنها كناية فلا يعملان بلا نية ( أو طلقي نفسك فلها أن تطلق في مجلس علمها به ) مشافهة أو إخبارا ( وإن طال ) يوما أو أكثر ما لم يوقته ويمضي الوقت قبل علمها ( ما لم تقم ) لتبدل مجلسها حقيقة ( أو ) حكما بأن ( تعمل ما يقطعه ) مما يدل على الإعراض لأنه تمليك فيتوقف على قبول في المجلس لا توكيل ، فلم يصح رجوعه ، حتى لو خيرها ثم حلف أن لا يطلقها فطلقت لم يحنث في الأصح ( لا ) تطلق ( بعده ) أي المجلس ( إلا إذا زاد ) في قوله طلقي نفسك وأخواته ( متى شئت أو متى ما شئت أو إذا شئت أو إذا ما شئت ) فلا يتقيد بالمجلس ( ولم يصح رجوعه ) لما مر (رد المحتار-كتاب الطلاق، باب تفويض الطلاق-4/452
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক ও প্রধান মুফতী-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
ইমেইল– [email protected]