প্রচ্ছদ / প্রবন্ধ নিবন্ধ / কওমী মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা বনাম কর্মসংস্থান ও জঙ্গিবাদ

কওমী মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা বনাম কর্মসংস্থান ও জঙ্গিবাদ

ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ

এ কথা দ্বিধাহীনভাবে সত্য যে, বর্তমান বাংলাদেশে দীন ও ইলমে দীনকে যথাসম্ভব বিশুদ্ধতা, নির্ভরযোগ্যতা ও আমানতদারী রক্ষা করে ইসলামের নিখুঁত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দানের যে কার্যক্রম কওমী মাদ্রাসার মাধ্যমে সম্পাদিত হচ্ছে সেটি আল্লাহর শোকর তুলনামূলকভাবে অধিকতর শ্রেষ্ঠ, উম্মতের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য এবং অধিকতর ফলপ্রসূ। পদ্ধতিগতভাবে এ শিক্ষা ১৮৬৬ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে শুরু হলেও এ শিক্ষার মূলধারা চলে আসছে খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের মুবারক যুগ থেকে। দীনের সহীহ তালীমের এই স্রোতধারা হয়ত যুগচাহিদার প্রেক্ষিতে কখনো কখনো কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন গ্রহণ করবে, কিন্তু সহীহ তালীমের ব্যবস্থা কিয়ামত পর্যন্ত দুনিয়ায় অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ

দ্বীনী শিক্ষার এই মারকাযগুলোকে আজ বাংলাদেশের কোনো কোনো সমালোচক ভুলবশত অসত্য বিশেষণে চিত্রায়িত করতে চান। এগুলোকে অপ্রয়োজনীয়, বেকার ও বেকারত্ব সৃষ্টিকারী, সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতার আখড়া ইত্যাকার কটুবাক্যে কালিমা লেপন করে এগুলোর ভাবগাম্ভীর্য বিনষ্ট করতে সচেষ্ট। এটি বড়ই দুঃখজনক। তারা ইনিয়ে বিনিয়ে টেনে জোড়াতালি দিয়ে বুঝাতে চান যে, এ সব মাদ্রাসায় পড়ে কোনো চাকরী নকরী পাওয়া যায় না, মনভরে টাকা-পয়সা কামাই করা যায় না, ইচ্ছামত চলাফেরা বা কাজকর্ম করা যায় না তাহলে এইসব প্রতিষ্ঠান দিয়ে সমাজের কী লাভ? যে যাই মনে করুক বা বলুক, আমাদের মতে কওমী মাদ্রাসার বর্তমান এ শিক্ষাধারা দীনে ইসলামের হেফাজত, লালন ও প্রচার প্রসারের জন্য একটি অতীব জরূরী, বস্তবমুখী ও ফলপ্রসূ কর্মসূচী। কওমী আলিমগণের জীবনে অভাব অনটন আছে, কিন্তু দুর্নীতি নেই। অনাহার অর্ধহার আছে, কিন্তু শেকায়েত বা চীৎকার নেই। মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদ, সম্প্রীতি, সহানুভূতি, পরমতসহিঞ্চুতা ও কল্যাণকামিতা আছে, কিন্তু চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, পারষ্পরিক   হানাহানির কোনো কিছু নেই। নিম্মে কওমী মাদ্রাসা পড়ুয়াদের রুজি-রোজগার, কর্মসংস্থান, চিন্তাধারা, তাদের অভাব অনটনের হাকীকত, তাদের মধ্যকার ‘বেকারত্ব’, তাদের শিক্ষাদান-পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে সংক্ষেপে কয়েকটি        বুনিয়াদী বিষয় তুলে ধরা হল।

১. চোখে রঙ্গিন চশমা পরে পৃথিবীর দিকে তাকালে পৃথিবীর সঠিক রং অনুমান করা যায় না। চশমা খুলে তাকালে তখনই আসল রং বুঝা যায়। কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা এবং আলিম-ওলামার কর্মক্ষেত্রকে অনেকে নিজের রঙ্গিন চশমায় দেখে থাকেন তাই সিদ্ধান্তও ভুল নিতে বাধ্য হন। এটি বড় দুঃখজনক বিষয়।

২. একশ্রেণীর লেখক বুদ্ধিজীবী আছেন যাদের চোখে বর্তমানে দেশে চলমান সাম্প্রদায়িকতা, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধাচরণ, খুনখারাবী, সন্ত্রাস, হানাহানি, মারামারি, হল দখলের প্রতিযোগিতা, বাজার করায়ত্তের যুদ্ধ,   মস্তানি, চাঁদাবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় তহবীল আত্মসাৎ, রাজনীতিকে হীনস্বার্থ উদ্ধারের কাজে ব্যবহার, সরকারী সম্পদ জবরদখল, হরতালের নামে দেশীয় সম্পদের ভাংচুর ও জ্বালাও পোড়াও, কৌশলে রাস্ট্রীয় অর্থের লুটপাট, শিরক-বিদআত ও অপসংস্কৃতির লালন ইত্যাদির কিছুই নজরে পড়ে না। তাই এগুলোর নিরসন নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যাথাও নেই। পক্ষান্তরে সেই নিরীহ কওমী মাদ্রাসার উলামা যারা শুধুমাত্র পবিত্র কুরআন কিতাব নিয়েই আজীবন পড়ে আছেন, যারা সূফী পীরবুযর্গ হিসাবে সর্বদা আত্মপ্রচার বিমুখ হয়ে গোশানাশীন থাকতে ভালবাসেন, যারা নিজেদের ছাত্র শিক্ষক নিয়ে ২৪ ঘন্টার জিন্দেগী কীভাবে মহান আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের হুকুমমতো চলা যায়, কীভাবে নিজেরা ভালো ও পাপমুক্ত থাকা যায় এবং কীভাবে অন্য ভাইকে ভালো ও পাপমুক্ত থাকতে উৎসাহিত করা যায়- শুধু এসব কাজেই মশগুল রয়েছেন, তাদেরকে জোর জবরদস্তি করে বেকার, অভাবী, অথর্ব, অকর্মণ্য, সন্ত্রাসী ও জঙ্গি প্রমাণ করার পেছনে যারা উঠে পড়ে লেগে আছেন তারা আসলে কারা? তাদের এই অপতৎপরতার আসল উদ্দেশ্য কী? এসব করে তারা কী আনন্দ পান এটা গভীরভাবে বুঝার দাবী রাখে।

৩. কওমী মাদ্রাসা দুনিয়ার অপরাপর ধর্মীয় শিক্ষা মতোই একটি ধর্মীয় শিক্ষা। ধর্মকে নিজ অস্তিস্তের উপর সঠিকভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে এই ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকা আবশ্যক।

বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় নির্বিশেষে দুনিয়ার কোনো শিক্ষাব্যবস্থাই শিক্ষার্থীদের জন্য নিছক রুজি-রোজগার বা দুনিয়া কামাই করাকে নিজ শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য ও আদর্শ বলে ঘোষণা দেয়নি। ছাত্রদের জ্ঞান ও প্রতিভার উপযুক্ত বিকাশ সাধনই হল সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভিন্ন উদ্দেশ্য। নিছক টাকা পয়সা কামাই করার শিক্ষাদান কারোই উদ্দেশ্য নয়। তাহলে কাওমী মাদ্রাসায় পড়ুয়া কোনো আলিমকে শুধু এই মানদন্ডে  বিচার করা যে, ‘তিনি তার এই লেখাপড়া দ্বারা মাসে কত টাকা রোজগার করতে পারেন’ কতটুকু যৌক্তিক?

৪. দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিতরা বেকার নন, কর্মহীন নন, তবে দুনিয়াবিমুখ, আত্মপ্রচারবিমুখ, অল্পেতুষ্ট ও আখিরাতমুখী। তাঁদের বাহ্যিক অবস্থা দেখে দুনিয়াদার লোকেরা অনেক সময় ভুল করে এবং ভুল বুঝে। দুনিয়াদার লোকেরা তাদেরকে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে চেষ্টা করে বিধায় এই বিভ্রান্তি ঘটে। তারা একবার চশমা পাল্টিয়ে যদি তাকাতেন তাহলে দেখতেন যে, তাঁরা বেকার তো নয়ই; বরং ভীষণ ব্যস্ত। সাধারণ মানুষকে দীনের সহীহ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানপূর্বক নৈতিকতা ও আদর্শের উপরে আনা এবং তাদেরকে আখিরাতমুখী বানানোর মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজে তারা আত্মনিয়োজিত। তাঁদের কাজের জন্য এত বিপুল পরিমাণ ক্ষেত্র এখনো সামনে পড়ে আছে যা সম্পাদন করা অতিব জরুরী, কিন্তু সময়ের অভাবে তাঁরা হাত দিতে সুযোগ পাচ্ছেন না। এমন একটি মহান কাজে এতটা ব্যস্ত ও মশগুল আলিমদেরকে কেউ যদি বেকার ও কর্মহীন বলে মনে করে সেটা তার চিন্তাধারার ত্রুটি, কথাটি বুঝা দরকার।

৫. কওমী উলামা সরকারী বা বেসরকারী কোনো চাকুরীতে নেই, তাই তাঁরা অভাবী, অভাবের তাড়নায় তাঁরা সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়ে থাকেন, তাঁরা সন্ত্রাসী  চিন্তা লালন করেন বিধায় জঙ্গিবাদ তাঁদের গৃহে আস্তানা করে আছে-এসব অশ্রাব্য যুক্তি বাস্তবতাবিমুখ কোনো অন্ধকে বলা যায়, কোনো চক্ষুষ্মান ও সচেতন ব্যক্তির কাছে এ কথা বলে পাত্তা পাওয়া যায় না।

৬. প্রবাদ আছে, অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়। আমরা এই প্রবাদ সর্বাংশে সত্য মনে করি না। এই প্রবাদ যারা বলে বেড়ান হয়তো তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিংবা সেই সব মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যাদের ভিতরে ঈমান ও আমলের নূর নেই। কিন্তু যাদের দিলের ভিতর ঈমান ও আমলের নূর আছে, যারা সহীহ ইলমে দীন তথা ইলমে জাহির ও ইলমে বাতিনের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত তারা অনাহারে কাটিয়েও নিজ স্বভাবের মধ্যে চুল পরিমাণ বিচ্যুতি আসতে দেন না। তাঁদের ক্ষেত্রে এ প্রবাদ সম্পূর্ণ ভুল। বরং বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, অপকর্ম, দুর্নীতি অত্যাচার ইত্যাদির ৮০% ঘটে সমাজের ধনী লোকদের দ্বারা আর হয়তোবা ২০% ঘটে গরীব লোকদের মাধ্যমে। এই বাস্তব পরিসংখ্যাণ উপরোক্ত প্রবাদকে নিঃসন্দেহে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে।

৭. কে বলেছে যে, মানুষ অভাবের কারণে সন্ত্রাসী হয়? অভাবের কারণে মানুষ সন্ত্রাসী হয় না; বরং অভাবের কারণে মানুষ তুলনামূলক বেশী ধার্মিক হয়, বেশী খোদাভীরু ও আল্লাহওয়ালা হয়। সমাজের ধনী লোকদের চেয়ে দরিদ্র লোকেরা বেশী ধার্মিক হওয়ার নেপথ্যে এই সত্যই লুকিয়ে আছে। বস্ত্তত কোনো মানুষ যদি সন্ত্রাসী হয় তাহলে সে সন্ত্রাসী হয় মন্দ সাহচর্য, মন্দ পরিবেশ এবং অশিক্ষা বা কুশিক্ষার কারণে কিংবা জীবনযাত্রায় মওত ও আখিরাতের ভয় বিদ্যমান না থাকার কারণে। দিল ও দেমাগের মধ্যে নৈতিকতার ছোঁয়া না লাগার কারণে। রোগের সঠিক কারণ নির্ণয় না করে আমরা জাতিকে ঔষধ সেবন করিয়ে যাচ্ছি তাতে রোগ তো সারবেই না বরং আরো বাড়বে। চিন্তাশীল মহলের জন্য বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করা জরুরী।

৮. কওমী উলামা মনেপ্রাণে নিজেদেরকে ওয়ারিসে নবীর উচ্চ মাকামে পৌঁছাতে আকাংখী। তাই তাঁরা সকল কাজে সকল ক্ষেত্রে সকল অবস্থায় নিজেদেরকে সুন্নত তথা ইসলামের নিখুঁত আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখতে সচেষ্ট। কেননা নিজেরা নিখুঁত আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত না থাকলে অন্যদেরকে এই নিখুঁত আদর্শের দাওয়াত প্রদান অসম্ভব। নিখুঁত আদর্শ ও নিখুঁত নৈতিকতার উপর অটল থাকতে হলে জরুরী হল দুনিয়াবিমুখিতা, যুহদ ও তাকওয়া, কষ্টসহিঞ্চুতা, সবর ও শোকর, অল্পেতুষ্টি ইত্যাকার গুণাগুণ। আফসোস! দুনিয়াদার লোকেরা তাঁদের এ অবস্থাকে ভুলবশত দরিদ্রতাক্লিষ্ট ও অভাবী বলে মনে করে। আসলে তাঁদের এটা তথাকথিত দারিদ্র নয়; এই দারিদ্রের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক মহাসম্মান, এক মহা ইসতিগনা।

৯. দ্বীনদার আলিম-ওলামা আল্লাহ পাকের দেয়া হায়াতকে কাজে লাগানোর জন্য নিশ্চয় উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র খোঁজেন। আবার কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে নিজেকে আমানতদারীর সাথে লাগিয়ে রাখেন। তাঁরা জীবনের সময়গুলো অপচয় হতে দেন না। এটা হল মূল উদ্দেশ্য ও আদর্শ। পাশাপাশি তার জন্য কমবেশী রুজি রোজগারের ব্যবস্থাও হয়ে গেল তো শোকর আদায় করেন। আর না হল তো সবর করেন। শোকর কিংবা সবর দুইটির যে কোনো একটির সঙ্গেই তিনি আছেন। কাজেই তাঁদের জীবন-যাত্রায় কোনো অস্থিরতা নেই, অশান্তি নেই, কোনো অতৃপ্তিও নেই। এটাই হল মুসলমানী জীবন। দুনিয়ায় দুটি টাকার জন্য যারা হরহামেশা দৌড়ায় আর দৌড়ায়, আপাদমস্তক ঘর্মক্ত হয়ে যায়, জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নেমে পড়ে তাদের পক্ষে এই মহান জীবনদর্শনকে বুঝা একটু কঠিনই বটে।

১০. কওমী উলামার চিন্তাচেতনা অনুসারে দীন হল ‘জরুরী’ আর দুনিয়ায় চলার জন্য টাকা পয়সা হল‘জরুরত’। জরুরী জিনিস যেমন শ্বাস নিশ্বাস গ্রহণ করা। এরূপ জরূরী জিনিসকে সর্বদা সম্মুখে রাখতে হয় এবং প্রাধান্য দিতে হয়। কখনো এটিকে কাটছাট করা যায় না বা পেছনে ফেলা যায় না। জরুরত সর্বদা প্রয়োজনের সাথে নির্ণীত হয়। যখন যতটুকু ঠিক তখন ততটুকু। এর বাইরে এক বিন্দুও নয়। জরুরতকে গ্রহণ করা হবে কিন্তু প্রয়োজন ফুড়ানোর পর তা আর দরকার নেই। আবার কখনো জরুরী ও জরুরতের মধ্যে পরস্পর সংঘাত দেখা দিলে জরুরী জিনিসকে অক্ষুণ্ণ রাখা হবে আর জরুরতকে কুরবান করা হবে। ধর্ম দর্শনের এই মহাসত্য অনেকেই বুঝে না। আর বুঝলেও আমল করতে হিম্মত করে না। তাই যারা হিম্মত করে আমল করছেন তাদের অবজ্ঞা নয় ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ।

১১. মহান আল্লাহ তার বান্দার জন্মের পূর্বেই তার রিযকের ব্যবস্থা ও আয়োজন করে রেখেছেন। সেই আয়োজন ও বরাদ্দ যথাসময়ে যথারীতি শেষ না করা অবধি কাউকে তিনি মারা যেতে দেন না। তাছাড়া তিনি কোন বান্দাকে না খেয়েও মারেন না। বরাদ্দ রিযিক তার কাছে সময়মত পৌঁছবেই। হয়তো ইজ্জতের সাথে, নয়তো যিল্লতীর সাথে। বান্দা যদি আল্লাহর হুকুম মেনে চলে, আল্লাহর দীনের কাজ করার মধ্যে মশগুল থাকে তাহলে সেই বরাদ্দ রিযিক তার কাছে পৌঁছবে অত্যন্ত ইজ্জতের সাথে। আর সে যদি আল্লাহর হুকুমকে বাদ দিয়ে নিছক দুনিয়া কামাইর ধান্ধায় লিপ্ত থাকে তাহলে বরাদ্দের এক তিল বেশী তো পাবেই না, আর যা পাবে তাও পাবে অত্যন্ত যিল্লতীর সাথে। রিযকের এই মাসআলার জাহির একরকম আর বাতিন অন্য রকম। ইসলামের বিগত ১৪শত বছরের ইতিহাসে দেখা গিয়েছে যে, প্রত্যেক যুগেই দুনিয়ার ধান্ধায় পড়ে থাকা মানুষের তুলনায় তাওয়াক্কুল ওয়ালা লোকেরা কোনো অংশেই কম রিযকপ্রাপ্ত হয়নি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে তাওয়াক্কুল ওয়ালারা তুলনামূলকভাবে বেশী রিযক পেয়েছেন।

১২. বলা হচ্ছে কওমী আলিমদের কর্মক্ষেত্র নেই। আসলে কি ঘটনা এ রকম? তাঁদের কর্মক্ষেত্র বিপুল ও অসংখ্য। তবে এগুলো কঠিন পর্দা দিয়ে আড়াল করে রাখা হয়েছে যা খোলা হয়নি কিংবা খোলা হচ্ছে না কিংবা খুলতে দেওয়া হচ্ছে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার বিধান মতে প্রতি ১০ জন মানুষের জন্য অন্তত ১ জন স্বাস্থ্য চিকিৎসক এবং ১ জন আইন উপদেষ্টা বিদ্যমান থাকা মানুষের মৌলিক অধিকার। পৃথিবীর দেশে দেশে এই বিধান অনুসারে চিকিৎসক ও আইন উপদেষ্টা রাখার ব্যবস্থা চলছে। শরীর ও রূহ এ দুয়ের সমন্বয়ে হল মানুষ। ইসলামের দৃষ্টিতে রূহের আওতা ও পরিধি শরীরের আওতা ও পরিধির চেয়ে অনেক বেশী। সামান্য শরীরের জন্য যদি বিশ্ববিবেক প্রতি ১০ জনের জন্য একজন চিকিৎসক ও একজন আইন উপদেষ্টার প্রয়োজন মনে করে তাহলে ওহে জান্নাত জাহান্নামে বিশ্বাসী মুসলমান! তোমাদের বিবেক কি জাগ্রত হয় না যে, প্রতি ১০ জন মুসলমানের রূহ ও দিল হেফাযতের জন্য ১ জন করে রূহের চিকিৎসক ও ১ জন করে শরীঅতের আইন উপদেষ্টা বিদ্যমান থাকা তোমাদের মৌলিক অধিকার? একজন হক্কানী আলিম  মানুষের দিল, রূহ, নফস ও মনন জগতের চিকিৎসক, তিনি হচ্ছেন মানুষের যাবতীয় আমল আখলাক আকীদা কাজকর্ম লেনদেন চলফেরা ইত্যাদির আইন উপদেষ্টা। বিশ্ব বিবেকের নীতি অনুসারে আমরা যদি চিন্তা করে দেখি তাহলে দেখব আলিমদের কর্মক্ষেত্র কত বিপুল, কত অসংখ্য যা আড়ালে লুকিয়ে আছে। যাকে আড়াল থেকে মুক্ত করা হচ্ছে না।

১৩. জ্ঞান অর্থাৎ ইলম দুই ধরনের। ইলমে দুনিয়া ও ইলমে দীন। উভয়ের জন্য আছে ভিন্ন ভিন্ন কর্মক্ষেত্র। বাস্তব পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখা যায় যে, ইলমে দুনিয়ার কর্মক্ষেত্র সীমিত, এখানে কর্মক্ষেত্রের চেয়ে কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা বেশী। ফলে লক্ষ লক্ষ লোক শিক্ষিত হয়েও বেকার অবস্থায় দিন গুযরান করছে। আর ইলমে দীনের কর্মক্ষেত্র অসংখ্য। এখানে কর্মক্ষেত্রের চেয়ে কর্মপ্রার্থীর সংখ্যা অনেক কম। ফলত এখানে কাজ করার মত যথাসংখ্যক লোক পাওয়া যাচ্ছে না। এই কাকরাইলে প্রতিদিন তাবলীগের প্রতিটি জামাআতের সাথে অন্তত একজন করে আলিম রাখতে চেষ্টা করা হয় কিন্তু পাওয়া যায় না। প্রতিটি জনপদের ৫০টি গৃহের জন্য    অন্তত একটি মকতব এবং অন্তত ৩ জন শিক্ষক প্রয়োজন। অথচ লোকের অভাবে শিক্ষক দেওয়া যাচ্ছে না। এখানে আরো একটি জিনিস পরিস্কার করে নিতে হচ্ছে যে, কোন কর্মক্ষেত্রই অটোমেটিক পাওয়া যায় না। সেটি বানিয়ে নিতে হয়। দুনিয়াদার লোকেরা দুনিয়ার গরজে নিজেদের প্রয়োজনীয় কর্মক্ষেত্রগুলো ঠিকই বানিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু দীনদার মুসলমানরা নিজেদের দীনের প্রয়োজনীয় কর্মক্ষেত্রগুলো বানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন না। এখানেই হল অসুবিধা।

অবশ্য আলিমদেরও এখানে কিছু ক্রটি আছে তা বলতেই হবে। তাঁরা সর্বসাধারণকে সেভাবে উৎসাহিত করছেন না বলেই ক্ষেত্রগুলো আড়াল থেকে ফুটে উঠছে না।

১৪. কোনো কোনো মাদ্রাসায় অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে বলে মাঝে মাঝে বিশেষ চিন্তা চেতনার ধারক পত্র পত্রিকায় নিউজ আসে। এই যুগ তথ্য সন্ত্রাসের যুগ, মিডিয়াসন্ত্রাসের যুগ, বন্ধুর বেশে ঢুকে শত্রুর মত আচরণের যুগ। আলিমদের দুনিয়া বিমুখিতার সস্তা সুযোগ নিয়ে তাদের বিষয়ে নানা ধরনের নাটক বানিয়ে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য করে দেখানো খুব কঠিন কাজ নয়। তাই এসব ক্ষেত্রে সাবধানতার সঙ্গে থাকা এবং আল্লাহ পাকের কাছে হেফাযতের জন্য খুব বেশী বেশী দুআ রোনাজারী অব্যহত রাখা আবশ্যক। ষড়যন্ত্র তা যত সূক্ষ্মই হোক না কেন মহান আল্লাহর চোখকে তো আর ফাঁকি দিতে পারে না। আর যদি আল্লাহ পাক কোন বান্দার জন্য দীনের লাইনে কোন কুরবানী মনজুর করেন তাহলে  সাহাবায়ে কিরামের মত সেই কুরবানী গর্বের সাথে কবুল করে নেওয়া সে তো আমাদের আকাবির আসলাফ এবং সাহাবায়ে কিরামের শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার।

আর আমাদের দেশবাসীর কাছে আমাদের আবেদন হল, এসব ক্ষেত্রে আমানতদারীর সাথে মূল সত্যটি অনুধাবনের জন্য চেষ্টা করুন। কোনো কারণে আবেগপ্রবণ হয়ে কিংবা অতি উৎসাহী হয়ে কিংবা কান কথা শুনে কিংবা দুরাচারী প্রতারকদের প্রতারনায় পড়ে কোনো অসত্য কথা আপণার মুখ থেকে বের হয়ে গেলে আল্লাহর আদালতে নিশ্চয় আপনাকে জবাবদিহী করতে হবে।

আর একটি কথা হল, কোথাও সত্যসত্যই এরূপ ঘটনা ঘটে থাকলে সেটা হবে মূলস্রোত থেকে ঝরে পড়া কোনো ব্যক্তি বিশেষের অপরাধ। ব্যক্তির অপরাধকে ব্যক্তির পরিমন্ডলে সীমাবদ্ধ রাখা হল ন্যায়পরায়ণতা। এক ব্যক্তির কোন অপরাধের জন্য তার গোটা কাওমকে শাস্তি দেওয়া দুনিয়ার কারো আদালতে বৈধ নয়। আপনি একজন মুসলমান। আপনার বিবেকের আদালতে কেন এরূপ অন্যায় রায় হবে? বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের উপর আজ এই অবিচার চলছে। কোনো ইহুদী কোনো অপরাধ করলে গোটা ইহুদী জাতিকে দায়ী করা হয় না। কোনো খৃস্টান কোনো অপরাধ করলে গোটা খৃস্টান জাতিকে দায়ী করা হয় না। কিন্তু কোনো মুসলমান বিশ্বের কোথাও কোনো অপরাধ (?) করলে সেই দায় গোটা মুসলিম জাতি গোটা মুসলিম বিশ্বের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। অমুসলিমদের এই অস্ত্র আমাদের দেশে কোনো কোনো মানুষ কওমী মাদ্রাসা ও কওমী আলিমদের জন্যও ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। আমরা দুআ করি আল্লাহ তাদের হেদায়েত দান করেন।

১৫. গণমানুষের চিন্তা চেতনা ও আশা আকাংখা পুরণের যথাযথ ব্যবস্থা করা হল গণতান্ত্রিক সরকারের অন্যতম দায়িত্ব ও অন্যতম কাজ। জনগণের উপর জনগণের চিন্তা চেতনার বিপরীত কোনো চিন্তা বা কোনো কাজ চাপিয়ে দেওয়া গণতান্ত্রিক সরকার করতে পারে না। এ দেশের কওমী মাদ্রাসাগুলো এদেশের গণমানুষ দ্বারা পরিচালিত। গণমানুষ দ্বারা প্রত্যক্ষ ভাবে পরিচালিত বিধায় এখনো এসব মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে কোনো দুর্নীতি নেই। ফলে এখনো এসব মাদ্রাসা সমাজকে নৈতিকতা ও ধার্মিকতা সম্পন্ন ফলন হিসাবে কিছু হক্কানী আলিম উপহার দিয়ে যাচ্ছে। যারা এই সমাজকে নৈতিকতা ও ধার্মিকতার উপদেশ দিতে সক্ষম হচ্ছেন। কওমী মাদ্রাসার এই ব্যবস্থাপনা যদি গণমানুষের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়, বৃটিশ পলিসি মত এটিকে কাটছাঁট করে অকর্মন্য বানানো হয় কিংবা জাগতিক বিষয়াবলি অন্তর্ভুক্তির নামে এই ব্যবস্থাপনাটিকে ভারাক্রান্ত করে তোলা হয় তাহলে একদিকে যেমন আমাদের আকাবিরের মেহনতের সাথে খিয়ানত করা হবে তেমনি অন্যদিকে সমাজে কিছু ভাল ফলন পাওয়ার এই শেষ দুয়ারটিও বন্ধ হয়ে যাবে। যার পরিণাম দাঁড়াবে খুবই বিপজ্জনক।

১৬. কওমী মাদ্রাসায় জঙ্গি, জঙ্গিবাদিতা, জঙ্গিবাদিতার মদদ দান ইত্যাদির লেশ মাত্রও নেই আর কোনো কালে ছিলও না। কওমী শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অন্যায়ভাবে কোনো মানুষ কেন কোনো পশু বা জীবজন্তুকেও হত্যা করা বা কষ্ট দেওয়া হারাম মর্মে শিক্ষা দেওয়া হয়। মমত্ববোধের এই শিক্ষা তাঁরা শিক্ষার্থীদেরকে নিয়মিত দিয়ে থাকেন। অন্যায়ভাবে একটি পিপড়াকেও কষ্ট দেওয়া বা পিষ্ট করা হারাম ও গুনাহে কবীরা বলে যারা ২৪ ঘন্টা শিক্ষা ও দীক্ষা দিচ্ছেন, যারা ছাত্রদেরকে মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে খালকে খোদার প্রতি দরদ ও মমত্ববোধ পোষণের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, যারা রাতে উঠে ছাত্র শিক্ষক নিয়ে তাহাজ্জুদ, যিকর, মুরাকাবা, দুআ, রোনাজারী করে আল্লাহর কাছে নিজের জন্য ও সমস্ত উম্মতের জন্য সার্বিক কল্যাণ ও কামিয়াবীর দুআ করছেন, উম্মতের জন্য চোখের পানি ছেড়ে হামেশা কাঁদছেন, তাদেরকে যখন সন্ত্রাসী বা জঙ্গি বলে গালি দেওয়া হয় কিংবা কৌশলে অপকৌশলে জঙ্গি (?) প্রমাণ করে দেখানোর চেষ্টা করা হয় তখন মনে রাখবেন, এই জুলুম আল্লাহ পাক সহ্য করবেন না। তাই আমাদের সকলের আরো সাবধান হওয়া উচিৎ। আল্লাহ আমাদেরকে সহীহ চিন্তা চেতনা দান করুন। আমীন। #

আরও জানুন

হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম কি গান বাজনা করতেন?

প্রশ্ন লেখক কবি দার্শনিক জনাব ফরহাদ মজহার তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, “ইসলামে গান বাজনা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আহলে হক্ব বাংলা মিডিয়া সার্ভিস