প্রচ্ছদ / প্রবন্ধ নিবন্ধ / হেযবুত তাওহীদের ভ্রান্ত মতবাদ (৩১)

হেযবুত তাওহীদের ভ্রান্ত মতবাদ (৩১)

কুরআনের আয়াতের তাফসীরগত মতপার্থক্য ও ফিকহী মতপার্থক্য কুফরী,শিরক ও বিদআত, তাই গোটা মুসলিম উম্মাহ কাফের ও মুশরিক

হেযবুত তাওহীদের বক্তব্যঃ 

মহানবী (দঃ) কোরানের আয়াতগুলির কোনটার অর্থ,ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ, তর্কাতর্কিকে কুফর বোলে ঘোষণা দিয়েছেন ।তার জীবিতকালে তার সাহাবাদের মধ্যে কোরানের আয়াতের অর্থ নিয়ে কোন মতভেদ, তর্ক হয়নি,ফেকাহ নিয়ে আলাদা আলাদা দল (মাযহাব) গঠন তো চিন্তার বাইরে ।কোন সন্দেহ নেই যে কেউ ও রকম কোন চেষ্টা কোরলে তিনি তাকে হত্যা করার হুকুম দিতেন ।তার ওফাতের বহু পরে যখন ঠিক ঐ কাজটাই করা শুরু হল,তখন ওটা শুধু যে কুফর হলো তাই নয়,ওটা বেদাত অর্থাৎ শেরেকও হলো,কারণ মহানবীর (দঃ) সময় ওটা ছিলো না।সেই তখন থেকে ঐ কুফর ,বে’দাত ও শেরক কাজ আজ পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে চোলে আসছে ।শুধু চোলে আসছে না বিকৃত ও বিপরীত আক্বীদার ফলে ঐ শেরক ও কুফর মহা সওয়াবের, পূণ্যের কাজ মনে কোরে করা হোচ্ছে।যে জাতি বা জনসংখ্যা হাজার বছরেরও বেশী সময় ধোরে শেরক ও কুফর কোরে আসছে সেটাকে কার্যতঃ কাফের ও মোশরেক বলায় ভুল কোথায়? (এই ইসলাম ইসলাম নয়-৩২৭)

পর্যালোচনাঃ

সুবাহানাল্লহ! কাফির- মুশরিক সাব্যস্ত করার কি এক আজিব মূলনীতি আবিষ্কার করেছেন পন্নী সাহেব।তার বক্তব্য অনুপাতে ফিকহী মতপার্থক্য যেহেতু কুফর,তাই উম্মাহর প্রথিতযশা ইমামগণ কাফের ছিলেন,কারণ তাদের মধ্যে এ ধরণের মতপার্থক্য বিদ্যমান ছিল ।(নাউযুবিল্লাহ)

আসুন আমরা দেখে নেই সত্যিই এসকল মতপার্থক্য কুফর,শিরক ও বিদআত কিনা এবং সাহাবীদের মধ্যে এর নজির আছে কিনা।

অর্থগত ও তাফসীরগত মতপার্থক্যঃ

সূরা ইখলাসের ২য় আয়াতে اَللّٰہُ الصَّمَدُ এর الصَّمَدُ শব্দের অর্থ নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে ।

আলী (রাঃ) এর মতে- ‘সামাদ’ হচ্ছেন এমন এক সত্তা যাঁর কাছে সবাই তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য পেশ করে থাকে।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর মতে- তিনি এমন সরদার, নেতা, যাঁর নেতৃত্ব পূর্ণতা লাভ করেছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

ইবন আব্বাস (রাঃ) এর মতে- যে সরদার তার নেতৃত্ব, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, ধৈর্য, সংযম, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা তথা শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার সমস্ত গুণাবলিতে সম্পূর্ণ পূর্ণতার অধিকারী তিনি সামাদ। (তাবারী,ইবনে কাসীর)

সূরা বাণী ইসরাইল এর ৭১ নং আয়াত-

یَوۡمَ نَدۡعُوۡا کُلَّ اُنَاسٍۭ بِاِمَامِہِمۡ

এই আয়াতে ‘ইমাম’ শব্দের তাফসীরেঃ

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত রয়েছে -এখানে ‘ইমাম’ শব্দের অর্থ নেতা। অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নেতার নাম দ্বারা ডাকা হবে এবং সবাইকে এক জায়গায় জমায়েত করা হবে।(ফাতহুল কাদীর)

ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর মতে- ইমাম শব্দ দ্বারা কিতাব উদ্দেশ্য অর্থাৎ আল্লহ ﷻ এর আহকামের কিতাব অথবা আমলনামা। (তাবারী)

এরকম আরো অনেক তাফসীরগত মতপার্থক্যের প্রমাণ রয়েছে ।

মাসয়ালাগত মতপার্থক্যঃ

১.বিদায় হজ্জ্বের ধরণ সংক্রান্ত মতপার্থক্যঃ

রাসূলুল্লাহ ﷺ বিদায় হজ্জ সম্পাদন করেছেন আর সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তা প্রত্যক্ষ করেছেন। পরে সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) লোকদের কাছে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সেই হজ্জের ধরণ বর্ণনা করতে গিয়ে
কেউ বলেছেন, তিনি ‘হজ্জে তামাত্তু’ করেছেন।

কেউ বলেছেন, তিনি ‘হজ্জে কিরান’ করেছেন।

আবার কারো কারো মতে সেটা ছিলো ‘হজ্জে ইফরাদ’।(বিস্তারিত আলোচনা- আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৫ম খন্ড)

[তামাত্তু হজ্জ্বঃ সে ধরণের হজ্জকে বলা হয় যাতে হজ্জ্বের মাসগুলোতে মক্কা গিয়ে উমরা আদায় এবং মাথা মুণ্ডন করে ইহরাম খুলে ফেলা হয়। অতঃপর জিলহজ মাসের আট তারিখে আবার নতুন করে ইহরাম বেঁধে হজ্জ আদায় করা হয়।

কিরান হজ্জঃ সেই হজ্জকে বলা হয়, যাতে উমরা এবং হজ্জ উভয়টার জন্যে একত্রে ইহরাম বাঁধা হয় এবং উভয়টা সমাপ্ত করার পর ইহরাম খোলা হয়।

ইফরাদ হজ্জঃ উমরা বিহীন হজ্জকে ইফরাদ বলা হয়।]

২.রমল করা সংক্রান্ত মতপার্থক্যঃ

[তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে কাঁধ হেলিয়ে-দুলিয়ে চলাকে রমল বলে]

উমর রাঃ এর মতে রমল করা সুন্নত।

নাফে (রহঃ) বলেনঃ

سَمِعْتُ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ، يَقُولُ: فِيمَ الرَّمَلَانُ الْيَوْمَ وَالْكَشْفُ عَنِ المَنَاكِبِ وَقَدْ أَطَّأَ اللَّهُ الْإِسْلَامَ، وَنَفَى الْكُفْرَ وَأَهْلَهُ مَعَ ذَلِكَ لَا نَدَعُ شَيْئًا كُنَّا نَفْعَلُهُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ

আমি ‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রাযি.)-কে বলতে শুনেছি, রমল করা এবং কাঁধ খোলা রাখা এখন তেমন গুরুত্ববহ নয়। কেননা মহান আল্লাহ ইসলামকে বিজয়ী ও শক্তিশালী করেছেন এবং কুফর ও কাফির দু‘টোই নির্মূল করেছেন। তথাপি আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সময়ে যে কাজ করেছি তা কখনো বর্জন করবো না। (সুনান আবু দাউদ-১৮৮৭,১৮৯১)

ইবনে আব্বাস রাঃ এর মতে রাসূলুল্লাহ ﷺ যে রমল করেছিলেন, তা ছিলো একটি আকস্মিক ঘটনা। মক্কার মুশরিকদের একটি ভৎসনার জবাবে তিনি সাময়িকভাবে এ কাজটি করেছিলেন।

ইবনে আব্বাস রাঃ বর্ণনা করেনঃ

زَمَنَ الْحُدَيْبِيَةِ دَعُوا مُحَمَّدًا وَأَصْحَابَهُ حَتَّى يَمُوتُوا مَوْتَ النَّغَفِ فَلَمَّا صَالَحُوهُ عَلَى أَنْ يَجِيئُوا مِنَ الْعَامِ الْمُقْبِلِ، فَيُقِيمُوا بِمَكَّةَ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ، فَقَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ وَالْمُشْرِكُونَ مِنْ قِبَلِ قُعَيْقِعَانَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ لِأَصْحَابِهِ: ارْمُلُوا بِالْبَيْتِ ثَلَاثًا، وَلَيْسَ بِسُنَّةٍ

হুদায়বিয়ার সময় কুরাইশগণ মুসলিমদেরকে তিরস্কারস্বরূপ বলেছিল যে, মুহাম্মাদ ﷺ এবং তাঁর সাথীদের এভাবেই থাকতে দাও। এমন কি তারা উট ও বকরীর মতো মৃত্যু বরণ করে নিঃশেষ হবে। অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে সন্ধি চুক্তি করলো, মুসলিমরা আগামী বছর এসে মক্কায় তিন দিন অবস্থান করবে। সুতরাং পরবর্তী বছর রাসূলুল্লাহ ﷺ আসলেন। মুশরিকরা ‘কুয়াইকিয়ান পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত হলো (মুসলিমদের অবস্থান লক্ষ্য করতে)। এসময় রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর সাহাবীদের নির্দেশ দিলেন যে, তাওয়াফের মধ্যে তিনবার রমল করো। সুতরাং তারা তাই করলেন। এরূপ করা মূলতঃ সুন্নাত নয়। (সুনান আবু দাউদ-১৮৮৫)

৩.রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ‘আবতাহ’ নামক স্থানে অবতরণ কেন্দ্রিক মতপার্থক্যঃ

বিদায় হজ্জ্বে রাসূলুল্লাহ ﷺ ‘আবতাহ’ নামক স্থানে অবতরণ করেছিলেন ।আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা) এর দৃষ্টিতে এটাও হজ্জ্বের আমল সমূহের একটি আমল।তাই হাজীদের জন্য সেখানে অবস্থান করা সুন্নত ।

ইবনু উমার (রাঃ) বর্ণিত যে,

عَنْ ابْنِ عُمَرَ أَنَّهُ كَانَ إِذَا أَقْبَلَ بَاتَ بِذِي طُوًى حَتَّى إِذَا أَصْبَحَ دَخَلَ وَإِذَا نَفَرَ مَرَّ بِذِي طُوًى وَبَاتَ بِهَا حَتَّى يُصْبِحَ وَكَانَ يَذْكُرُ أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ كَانَ يَفْعَلُ ذَلِكَ

তিনি যখনই মক্কা্ আসতেন তখনই যু-তুয়া উপত্যকায় রাত যাপন করতেন। আর সকাল হলে (মক্কা্য়) প্রবেশ করতেন। ফিরার সময়ও তিনি যু-তুয়ার দিকে যেতেন এবং সেখানে ভোর পর্যন্ত অবস্থান করতেন। ইবনু ‘উমার (রাঃ) বলতেন যে, নাবী ﷺ এরূপ করতেন। (সহীহ বুখারী-১৭৬৯)

কিন্তু হযরত আয়িশা (রা) এবং আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) এর মতে, তিনি সেখানে ঘটনাক্রমে অবতরন করেছিলেন। সুতরাং সেটা হজ্জের সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত নয়।

আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ

إِنَّمَا كَانَ مَنْزِلٌ يَنْزِلُهُ النَّبِيُّ ﷺ لِيَكُونَ أَسْمَحَ لِخُرُوجِهِ يَعْنِي بِالأَبْطَحِ

তা হল একটি মানযিল মাত্র, যেখানে নাবী ﷺ অবতরণ করতেন, যাতে বেরিয়ে যাওয়া সহজতর হয় অর্থাৎ এর দ্বারা আবতাহ বুঝানো হয়েছে।(সহীহ বুখারী-১৭৬৫)

ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

لَيْسَ التَّحْصِيبُ بِشَيْءٍ إِنَّمَا هُوَ مَنْزِلٌ نَزَلَهُ رَسُولُ اللهِ ﷺ

মুহাস্সাবে অবতরণ করা (হজ্জের)কিছুই নয়, এ তো শুধু একটি মানযিল, যেখানে নাবী ﷺ অবতরণ করেছিলেন। (সহীহ বুখারী-১৭৬৬)

৪.পালক পুত্র বানানোর পদ্ধতি সংক্রান্ত মতপার্থক্যঃ

সাধারণ নিয়ম হচ্ছে দুধ পানের বয়সের মধ্যে কোনো মহিলা কোনো শিশুকে দুধ পান করালে শিশুটি তার দুধপানকারী সন্তান বলে গণ্য হবে।

কিন্তু আয়েশা রাঃ মনে করতেন প্রাপ্ত বয়স্ক যে কোনো ব্যক্তিকে একই পদ্ধতিতে দুধের সন্তান বানানো যায়।এর সূত্রপাত হয়েছে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে।হযরত হুযায়ফা রাঃ এর গোলাম সালেম রাঃ এর দুধ পানের ঘটনা।ঘটনাটি হলঃ

সালিম এক আনসারী মহিলার ক্রীতদাস ছিলো। জাহিলী যুগের নিয়ম ছিলো, কেউ কাউকে পালক পুত্র হিসাবে গ্রহণ করলে লোকেরা তাকে ঐ ব্যক্তির পুত্র হিসেবে সম্বোধন করতো এবং ঐ লোক মারা গেলে পরিত্যক্ত সম্পদের উত্তরাধিকারীও তাকে করা হতো। কিন্তু যখন মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ এ আয়াত অবতীর্ণ করলেনঃ ‘‘তাদেরকে (পালক পুত্রদেরকে) তাদের (প্রকৃত) পিতার নামে ডাকবে। তারা তোমাদের দীনি ভাই ও বন্ধু’’ (সূরা আহযাব)। অতঃপর তাদের প্রকৃত পিতার নাম ধরেই ডাকা আরম্ভ হয়। আর পিতার সন্ধান না পাওয়া গেলে তাকে বন্ধু ও দীনি ভাই বলে ডাকা হতো। পরবর্তীতে আবূ হুযাইফাহ ইবনু ‘উত্ববাহর স্ত্রী সাহলা সুহাইল ইবনু ‘আমর আল-কুরাইশী আল-‘আমিরী (রাযি.) এসে বলেন, হে আল্লাহ রাসূল! সালিমকে আমরা আমাদের পুত্র গণ্য করি। সে আমার ও আবূ হুযাইফাহর সাথে একই ঘরে থাকে। আর সে আমাকে একই বস্ত্রের মধ্যে দেখেছে। আল্লাহ যা কিছু অবতীর্ণ করেছেন আপনি তা ভালোভাবে অবহিত। এখন তার ব্যাপারে আপনি কি নির্দেশ দেন?

নবী ﷺ বললেনঃ তাকে তোমার দুধ পান করাও। সুতরাং তিনি তাকে পাঁচ ঢোক দুধ পান করান। তখন থেকে সে তার দুধ পানকারী সন্তান গণ্য হয়।(সুনান আবু দাউদ-২০৬১)

রাসূলুল্লাহ ﷺ একমাত্র তাকেই এই হুকুম দিয়েছিলেন ।

কিন্তু হযরত আয়েশা রাঃ উক্ত হুকুমকে ব্যাপক মনে করে ব্যাপক আকারে হুকুম লাগিয়েছেন।(সহীহ বুখারী-৫১০২; সুনান আবু দাউদ-২০৬১)

অপরদিকে অন্য উম্মাহাতুল মু’মিনীন রাঃ সর্বাবস্থায় এর হুকুম অস্বীকার করেছেন ।

উম্মু সালামাহ্ (রাযিঃ) বলতেনঃ

أَبَى سَائِرُ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ ﷺ أَنْ يُدْخِلْنَ عَلَيْهِنَّ أَحَدًا بِتِلْكَ الرَّضَاعَةِ وَقُلْنَ لِعَائِشَةَ وَاللَّهِ مَا نَرَى هَذَا إِلاَّ رُخْصَةً أَرْخَصَهَا رَسُولُ اللَّهِ ﷺ لِسَالِمٍ خَاصَّةً فَمَا هُوَ بِدَاخِلٍ عَلَيْنَا أَحَدٌ بِهَذِهِ الرَّضَاعَةِ وَلاَ رَائِينَا

রসূলুল্লাহ ﷺ এর সকল সহধর্মিণী দুধপান সম্পর্কের দ্বারা কাউকে তাদের নিকট প্রবেশ করতে নিষেধ করেন এবং তারা আয়িশাহ্ (রাযিঃ) কে বলেন, আল্লাহর কসম আমরা এটাকে (প্রাপ্ত বয়সে দুধপান দ্বারা হুরমত সাব্যস্ত হওয়াকে) একটি বিশেষ অনুমতি মনে করি যা রসূলুল্লাহ ﷺ কেবল সালিমের জন্য দিয়েছিলেন। অতএব এ ধরনের দুধপানের মাধ্যমে কেউ আমাদের নিকট প্রবেশ করতে পারবে না এবং আমাদের প্রতি দৃষ্টিপাতও করতে পারবে না।(সহীহ বুখারী-৩৪৯৭;সুনান আবু দাউদ-২০৬১)

৫.মৃত ব্যক্তিকে পরিবারবর্গের কান্নার কারণে শাস্তি দেওয়া সংক্রান্ত মতপার্থক্যঃ

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাঃ এর মতে মৃত ব্যক্তিকে পরিবারবর্গের কান্নার কারণে শাস্তি দেওয়া হয়।

ইবনে ওমর রাঃ বলেনঃ

إِنَّ الْمَيِّتَ لَيُعَذَّبُ بِبُكَاءِ الْحَىِّ عَلَيْهِ

মৃত ব্যক্তিকে জীবিতদের কান্নাকাটির কারণে শাস্তি দেওয়া হয়। (সুনানে তিরমিযি-১০০৬)

আয়েশা রাঃ এর মতে বিশেষ এক মহিলার ব্যপারে এ হুকুম দেওয়া হয়েছিল ।সে ইয়াহুদী মহিলা মৃত্যু বরণ করার পর তার পরিবারের লোক কান্নাকাটি করছিল ও তাকে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল ।

আয়েশা রাঃ বলেনঃ

أَمَا إِنَّهُ لَمْ يَكْذِبْ وَلَكِنَّهُ نَسِيَ أَوْ أَخْطَأَ إِنَّمَا مَرَّ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى يَهُودِيَّةٍ يُبْكَى عَلَيْهَا فَقَالَ ‏ “‏ إِنَّهُمْ لَيَبْكُونَ عَلَيْهَا وَإِنَّهَا لَتُعَذَّبُ فِي قَبْرِهَا

কোন এক ইয়াহুদি নারীর লাশের বা কবরের পাশ দিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাচ্ছিলেন। তখন তার জন্য কান্নাকাটি করা হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেনঃ তার জন্য তো এরা কান্নাকাটি করছে, অথচ তাকে কবরের মাঝে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।(সুনানে তিরমিযি-১০০৬)

৬.বর্গাচাষের নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত মতপার্থক্যঃ

হযরত রাফে ইবনে খাদিজ রাঃ এর মতে বর্গাচাষ না-জায়েজ।

রাফি‘ ইবনু খাদীজা (রাঃ) বলেনঃ

كُنَّا نُخَابِرُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ ، فَذَكَرَ أَنَّ بَعْضَ عُمُومَتِهِ أَتَاهُ، فَقَالَ: نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ أَمْرٍ كَانَ لَنَا نَافِعًا، وَطَوَاعِيَةُ اللَّهِ وَرَسُولِهِ أَنْفَعُ لَنَا، وَأَنْفَعُ

আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর যুগে জমি ভাগচাষে খাটাতাম। তিনি উল্লেখ করলেন, তার এক চাচা তার কাছে এসে বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ একটি কাজ বর্জন করতে বলেছেন, যা আমাদের জন্য লাভজনক ছিলো। কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা আমাদের জন্য তার চেয়েও অধিক লাভজনক ও কল্যাণকর। (সুনানে আবু দাউদ-৩৩৯৫)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মতে উক্ত নিষেধাজ্ঞার কারণ ছিল একজন মুসলিমের সাথে উত্তম ব্যবহার করা।মাসআলার দিক থেকে না-জায়েজ হওয়ার কারণে নয়।

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেনঃ

أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ لَمْ يَنْهَ عَنْهُ وَلَكِنْ قَالَ أَنْ يَمْنَحَ أَحَدُكُمْ أَخَاهُ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَأْخُذَ عَلَيْهِ خَرْجًا مَعْلُومًا

নাবী ﷺ বর্গাচাষ নিষেধ করেননি। তবে তিনি বলেছেন, তোমাদের কেউ তার ভাইকে জমি দান করুক, এটা তার জন্য তার ভাইয়ের কাছ হতে নির্দিষ্ট উপার্জন গ্রহণ করার চেয়ে উত্তম। (সহীহ বুখারী-২৩৩০)

৭.বনূ কুরাইযায় নামাজ পড়া সংক্রান্ত মতপার্থক্যঃ

ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ

قَالَ النَّبِيُّ ﷺ يَوْمَ الْأَحْزَابِ لَا يُصَلِّيَنَّ أَحَدٌ الْعَصْرَ إِلَّا فِيْ بَنِيْ قُرَيْظَةَ فَأَدْرَكَ بَعْضُهُمْ الْعَصْرَ فِي الطَّرِيْقِ فَقَالَ بَعْضُهُمْ لَا نُصَلِّيْ حَتَّى نَأْتِيَهَا وَقَالَ بَعْضُهُمْ بَلْ نُصَلِّيْ لَمْ يُرِدْ مِنَّا ذَلِكَ فَذُكِرَ ذَلِكَ لِلنَّبِيِّ ﷺ فَلَمْ يُعَنِّفْ وَاحِدًا مِنْهُمْ

নাবী ﷺ আহযাব যুদ্ধের দিন (যুদ্ধ শেষে) বললেন, বনূ কুরাইযায় না পৌঁছে কেউ ‘আসরের সালাত আদায় করবে না।তাদের একাংশের পথিমধ্যে আসরের সালাতের সময় হয়ে গেলে কেউ কেউ বললেন, আমরা সেখানে পৌঁছার আগে সালাত আদায় করব না। আবার কেউ কেউ বললেন, আমরা এখনই সালাত আদায় করব, সময় হলেও রাস্তায় সালাত আদায় করা যাবে না উদ্দেশ্য তা নয়। বিষয়টি নাবী ﷺ এর কাছে বলা হলে তিনি তাদের কোন দলের প্রতিই অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করেননি।(সহীহ বুখারী-৪১১৯)

এ ধরনের মতপার্থক্য এখানেই শেষ নয়,বরং হাদীসের পাতায় পাতায় এ ধরনের অসংখ্য মতপার্থক্যের প্রমাণ বিদ্যমান।লিখনীর কলেবর বড় হয়ে যাবার আশংকায় কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে ।

এ সকল মতপার্থক্যের কারণ কি?

বিজ্ঞ পাঠক,লক্ষ্য করুনঃ

১নং মতপার্থক্যের কারণ ছিল- ধারণাগত বিশ্লেষণের পার্থক্য।একাধিক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে একটি কাজ করতে দেখেছেন ।আর মানুষের বুঝ শক্তি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে।ফলে প্রত্যেকেই নিজের বুঝশক্তি অনুযায়ী ঘটনা বর্ণনা করেছেন ।

২ নং এবং ৩নং মতপার্থক্যের কারণ ছিল- রাসূল ﷺ এর কজের ধরণ নির্ণয়ের পার্থক্য। সাহাবায়ে কিরাম (রা) নবী করীম ﷺ কে একটি কাজ করতে দেখেছেন। (কিন্তু মানবিক চিন্তার প্রকৃতিগত তারতম্যের কারণে কাজটির ধরন ও গুরুত্ব অনুধাবনের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়।)। ফলে কেউ রাসূল ﷺ এর উক্ত কাজটিকে মনে করেছেন ইবাদাত আর কেউ মনে করেছেন মুবাহ।

৪ নং ও ৫নং মতপার্থক্যের কারণ ছিল- খাছ হুকুমকে ব্যপক মনে করা কিংবা ব্যাপক হুকুমকে খাছ মনে করা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বিশেষ কোন ব্যক্তির জন্য কোন হুকুমকে খাসভাবে দিয়েছেন ।কিন্তু মজলিসে উপস্থিত কেউ সেটাকে ব্যাপক হুকুম মনে করে সেভাবেই বর্ণনা করেছেন ।অথবা তার উল্টো ঘটনা।

৬ নং মতপার্থক্যের কারণ ছিল- হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অনেক সময় কোনো হুকুমকে বর্ণনাকারী কোন কারণের উপর প্রয়োগ করেছেন ।অর্থাৎ হাদীসে বর্ণিত হুকুম কোন কারণে হয়েছে ।আবার অন্য বর্ণনাকারী ঐ হুকুমকেই অন্য কারণের উপর প্রয়োগ করেছেন ।

সুতরাং বুঝা গেল দ্বীনি আহকামগুলো দুই ভাগে বিভক্ত ।

১.এমন সব মাসয়ালা যেগুলোর বিষয়ে চিন্তা ফিকির ও মতানৈক্য করা নিষেধ ।যেমনঃ তাওহীদ, রিসালাত ও অন্যান্য মৌলিক আক্বিদা।

২.এমন সব মাসয়ালা যেগুলোর বিষয়ে চিন্তা ফিকির ও মতানৈক্য করার সুযোগ রয়েছে ।যেমন উপরের উদাহরণগুলো।এবং এসব মতানৈক্যের কারণ সম্পর্কেও উপরে ধারণা দেয়া হয়েছে ।এ ধরণের মতানৈক্য কুরআন হাদীসে বর্ণিত নিষিদ্ধ মতানৈক্যের অন্তর্ভূক্ত নয়।

৭ নং উদাহরণটি লক্ষ্য করুনঃ এখানে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) -দের মতানৈক্য স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সম্মুখে পেশ করার পর রাসূলুল্লাহ ﷺ কাউকেই তিরস্কার করেন নি।এতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে এ ধরণের মতপার্থক্য স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ কর্তৃকই অনুমোদিত ।

এ ধরনের মতপার্থক্য গুলোই ইমামদের মধ্যে বিদ্যমান।তাই এসব অনুমোদিত মতপার্থক্য কে কুফরী বলা এবং এর ভিত্তিতে গোটা উম্মতে মুসলিমাকে কাফের ফতোয়া প্রদান একদিকে যেমন বিভ্রান্তিকর তেমনি অপরদিকে এটি হাদীসশাস্ত্রে বায়েজিদ খান পন্নীর অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ।

(সঙ্কলনে Abdur Rahman Masum)

0Shares

আরও জানুন

হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম কি গান বাজনা করতেন?

প্রশ্ন লেখক কবি দার্শনিক জনাব ফরহাদ মজহার তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, “ইসলামে গান বাজনা …