প্রচ্ছদ / ভ্রান্ত মতবাদ / হেযবুত তাওহীদের ভ্রান্ত মতবাদ-১৮

হেযবুত তাওহীদের ভ্রান্ত মতবাদ-১৮

সালাত মৌলিক ইবাদাত নয়, সালাত হচ্ছে কুচকাওয়াজ,জিহাদের প্রশিক্ষণ

হেযবুত তাওহীদের বক্তব্যঃ 

আমাদের আজ যারা ইসলাম শেখান তাদের ইসলাম সম্বন্ধে আকিদা বিকৃত। এই দীনের উদ্দেশ্য কী, ঐ উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া কী, দীনের মূল্যবোধের গুরুত্ব অর্থাৎ Priority কী এসব তাদের বিকৃত, উল্টাপাল্টা হোয়ে গেছে। এরা ওয়াজ করেন, শিক্ষা দেন-নামাজ পড়ো নামাজ পড়ো, যেন নামাজই উদ্দেশ্য। নামাজ উদ্দেশ্য নয়, নামাজ প্রক্রিয়া, উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া। সংগ্রামের মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর আইনের শাসনে আনার মত দুরূহ ও বিরাট কাজের দায়িত্ব যে জাতির উপর অর্পণ করা আছে তাদের যে চরিত্র প্রয়োজন, যে কোরবানি করার শক্তির প্রয়োজন, যে ঐক্য ও শৃঙ্খলার প্রয়োজন তা সৃষ্টি করে এই নামাজ। (হিযবুত তাওহীদের ওয়েব সাইটে প্রকাশিত -নামাজের প্রকৃত উদ্দেশ্য (তৃতীয় পর্ব)- প্রবন্ধ)

সালাতের প্রশিক্ষণ শুধু আমাদের যুদ্ধ শেখায় না,সালাহ চারিত্রিক, দৈহিক, মানসিক, আত্মিক,আধ্যাত্মিক বহু প্রকারের শিক্ষা দেয় যদিও যুদ্ধের প্রশিক্ষণটাই প্রথম ও মুখ্য।সালাতের দৃশ্য পৃথিবীতে আর একটি মাত্র দৃশ্যের সঙ্গে নিলে, আর কিছুর সাথেই মিলে না,আর সেটা হচ্ছে পৃথিবীর যে কোনো সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজের সঙ্গে ।(ইসলামের প্রকৃত সালাহ-২১)

সালাতকে কুচকাওয়াজ ঘোষণা দিয়েই ক্ষ্যান্ত হয় নি।বরং সালাতকে তারা কুচকাওয়াজের মতই আদায় করে।

কুচকাওয়াজের মত নব আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে হিযবুত তাওহীদের সালাত দেখুনঃ https://youtu.be/-KOPsZXSLTw

পর্যালোচনাঃ

ইসলামের অন্যান্য বিধানের মতো সালাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিধানও হিযবুত তাওহীদের বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা পায় নি।অন্যান্য ইবাদাতের মতো সালাতকেও তারা জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস চালিয়েছে ।হিযবুত তাওহীদের লিখনী হতে দুটি বিষয় ফুটে উঠেছে ।

(ক)সালাত উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া।
(খ)সালাত হচ্ছে কুচকাওয়াজ বা জিহাদের প্রশিক্ষণ।

দুটো মতবাদই কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থি ।

(ক) সালাত কি উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া নাকি সালাত-ই মূল উদ্দেশ্য?

পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লহ ﷻ ইরশাদ করেনঃ

اَلَّذِیۡنَ اِنۡ مَّکَّنّٰہُمۡ فِی الۡاَرۡضِ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتَوُا الزَّکٰوۃَ وَ اَمَرُوۡا بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ نَہَوۡا عَنِ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ لِلّٰہِ عَاقِبَۃُ الۡاُمُوۡرِ

তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারভূক্ত।(সূরা হজ্জ-৪১)

এ আয়াত থেকে বুঝা যায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে সালাত ,যাকাত প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ।অতএব মূল উদ্দেশ্য হল সালাত,যাকাত প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করা এবং রাষ্ট্র তার জন্য সহায়ক।

(খ) সালাত কি কুচকাওয়াজ বা জিহাদের ট্রেনিং?

[এক] সালাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান,ইসলামের ৫টি রোকনের অন্যতম একটি ।সালাত এর মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লহ এর হুকুম পালন ও তাঁর নৈকট্য অর্জন।

পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লহ ﷻ ইরশাদ করেনঃ
وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّکٰوۃَ ؕ

তোমরা সালাত কায়েম কর এবং জাকাত প্রদান কর। (সূরা বাকারা – ১১০)

اِنَّ الصَّلٰوۃَ کَانَتۡ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ کِتٰبًا مَّوۡقُوۡتًا

নিশ্চয় সালাত মুমিনদের ওপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরজ। (সূরা নিসা -১০৩)

وَ مَاۤ اُمِرُوۡۤا اِلَّا لِیَعۡبُدُوا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ ۬ۙ حُنَفَآءَ وَ یُقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ یُؤۡتُوا الزَّکٰوۃَ وَ ذٰلِکَ دِیۡنُ الۡقَیِّمَۃِ

আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে । তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে; সালাত কায়েম করে এবং জাকাত দেয়; আর এটিই হল সঠিক দীন। (সূরা বাইয়িনা-৫)

এসকল আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হয় যে সালাত আল্লহ ﷻ এর হুকুম।তাই তা পালন করা আবশ্যকরণীয়।

সালাতের মাধ্যমে আল্লহ ﷻ এর নৈকট্য হাসিল হয়।

আল্লহ ﷻ বলেনঃ

সেজদা কর এবং নিকটবর্তী হও।’ (সূরা আলাক- ১৯)

এই আয়াতে নবী করীম ﷺ – কে আদেশ করা হয়েছে যে, আবু জাহলের কথায় কৰ্ণপাত করবেন না এবং সেজদা ও সালাতে মশগুল থাকুন। সিজদা করা মানে সালাত আদায় করা। অর্থাৎ হে নবী ! আপনি নিৰ্ভয়ে আগের মতো সালাত আদায় করতে থাকুন। এর মাধ্যমে নিজের রবের নৈকট্য লাভ করুন। কারণ, এটাই আল্লাহ্‌ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনের উপায়। [কুরতুবী]

রাসূলুল্লাহ ‌ﷺ বলেনঃ

“বান্দা যখন সেজদায় থাকে, তখন তার পালনকর্তার অধিক নিকটবর্তী হয়। তাই তোমরা সেজদায় বেশী পরিমাণে দো‘আ কর।” (সহীহ মুসলিম-৪৮২; আবুদাউদ-৮৭৫; নাসায়ী- ২/২২৬; মুসনাদে আহমাদ-২/৩৭০)

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ

قَالَ قَالَ النَّبِيُّ إِنَّ الْمُؤْمِنَ إِذَا كَانَ فِي الصَّلاَةِ فَإِنَّمَا يُنَاجِي رَبَّهُ
নাবী ﷺ বলেছেনঃ মু’মিন যখন সালাতে থাকে, তখন সে তার প্রতিপালকের সাথে একান্তে কথা বলে।(সহীহ বুখারী- ৪১৩)

এসকল আয়াত ও হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় সালাতের মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লহ ﷻ এর হুকুম পালন ও তাঁর নৈকট্য অর্জন।

[দুই] এছাড়াও সালাতের আরও বিভিন্ন উপকারিতা কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে ।সালাতের মাধ্যমে গুনাহ মাফ হয়,সালাত অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে,সালাত আনুগত্য-শৃঙ্খলা ইত্যাদি শিক্ষা দেয়।কিন্তু কুরআন ও হাদীসের কোথাও সালাতকে প্রশিক্ষণ/ কুচকাওয়াজ বলা হয় নি।

তাহলে পন্নী সাহেবের দাবির ভিত্তি কি?এর ভিত্তি হচ্ছে- হাদীসে বর্ণিত সালাতের পদ্ধতিকে জাগতিক বিষয়ের সাথে তুলনা করা।

বিজ্ঞ পাঠক,নিম্নের হাদীসটি লক্ষ করুনঃ

হজরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, এক রাতে রাসূলুল্লাহ ﷺ আমার ঘরে এসে আমার সঙ্গে শয়ন করলেন। কিছুক্ষণ পর আমাকে বললেনঃ

يا عائشة ذريني أتعبد لربي، قالت: قلت: والله إني لأحب قربك، وأحب ما يسرك، قالت: فقام فتطهر، ثم قام يصلي، فلم يزل يبكي حتى بل حجره، ثم بكى. فلم يزل يبكي حتى بل الأرض

‘হে আয়েশা! আমি আমার রবের ইবাদত করতে চাই। আমাকে যেতে দাও।’ আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি আপনার একান্ত কাছে থাকতে চাই। আবার এও চাই যে, আপনি মহান আল্লাহর ইবাদত করবেন। তিনি বিছানা থেকে উঠে পবিত্র হয়ে সালাতে দাঁড়ালেন। তিনি কাঁদতে আরম্ভ করলেন। কাঁদতে কাঁদতে তার দাঁড়ি ভিজে গেল, মাটি ভিজে গেল। তিনি কাঁদতে থাকলেন।(ইবনে হিব্বান : ৬২০)

এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ সালাতকে ইবাদাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, কুচকাওয়াজ/প্রশিক্ষণ হিসেবে নয়।

শত শত বছর ধরে চলে আসা সালাতের পদ্ধতির বিপরীতে পন্নী সাহেবের আবিষ্কৃত নতুন পদ্ধতির সালাত দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে- তবে কি যুগ যুগ ধরে এই উম্মত ভুল সালাত পড়ে আসছে? অথচ হাদীসের বর্ণনা হচ্ছে -এই উম্মত একইসাথে সবাই ভ্রান্তিতে লিপ্ত হবে না।

এছাড়াও হযরত আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ قَالَ ‏ “‏ إِنَّ اللَّهَ يَبْعَثُ لِهَذِهِ الأُمَّةِ عَلَى رَأْسِ كُلِّ مِائَةِ سَنَةٍ مَنْ يُجَدِّدُ لَهَا دِينَهَا ‏”‏ ‏

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ এই উম্মাতের জন্য প্রতি একশত বছরের শিরোভাগে এমন লোকের আবির্ভাব ঘটাবেন, যিনি এই উম্মাতের দীনকে তার জন্য সংস্কার করবেন।(সুনানে আবু দাউদ-৪২৯১)

এই হাদীস অনুযায়ী ইসলাম একটা দীর্ঘ সময় সময় ধরে বিকৃত থাকার কোন সুযোগ নেই।যদি পন্নী সাহেবের আবিষ্কৃত পদ্ধতি সঠিক হত,তাহলে উক্ত হাদীস অনুযায়ী ইসলামের ইতিহাসে এর নজির থাকত।সুতরাং হঠাৎ করেই নতুন পদ্ধতির সালাত পন্নী সাহেবের নব আবিষ্কৃত পদ্ধতি ছাড়া আর কিছুই নয়।

[তিন] হিযবুত তাওহীদের দাবি অনুযায়ী যদি সালাতকে জিহাদের প্রশিক্ষণ/কুচকাওয়াজ হিসেবে মেনে নেয়া হয়,তাহলে প্রশ্ন হয়,প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা কি সারাজীবন একই রকম থাকে ,নাকি প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর এর গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস পায়?

সালাতকে প্রশিক্ষণ ধরা হলে জিহাদের মাধ্যমে ইসলামী হুকুমত কায়েম হওয়ার পর প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা কি আগের মত বহাল থাকবে?কারণ ইসলামী হুকুমত কায়েম হয়ে গেলে জিহাদ ফরজে কিফায়া অবস্থায় থাকে।তো তখন কি ট্রেনিং হিসেবে সালাত এর বিধান ফরজে কিফায়া হবে নাকি সালাত সর্বাবস্থায় সকল বালেগ-বালেগার উপর ফরজে আইন ?

এছাড়াও যাদের উপর জিহাদ ফরজ হয় না,যেমন অন্ধ ও বিভিন্ন শ্রেণীর মাজুর,তাদের উপর কি সালাত ফরজ নয়?

সুতরাং উক্ত ধারণা কোনভাবেই সহীহ হতে পারে না।বরং তা দ্বীনের মধ্যে নতুন সংযোজন ।

0Shares

আরও জানুন

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াতপ্রাপ্তির আগে শিরক করেছেন?

প্রশ্ন আসসালামু আলাইকুম। হযরত আমাদের এলাকায় এক ব্যক্তি দাবী করছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম …