প্রশ্ন
আসসালামু আলাইকুম।
হযরত আমাদের এলাকায় এক ব্যক্তি দাবী করছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াতপ্রাপ্তির আগে শিরক করতেন। মূর্তিপূজাও করেছেন।
আমরা এর প্রতিবাদ করি। কিন্তু আমাদের কাছে দলীল না থাকায় লোকটি এলাকায় ফিতনা সৃষ্টি করছে। আশা করি এ বিষয়ে দলীলসহ উত্তর দিয়ে আমাদের উপকৃত করবেন।
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
শুধু আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই নয়, বরং আগের সমস্ত নবীগণই নবুওয়াতের পূর্বেই আল্লাহর ওলী হয়ে থাকেন!
নবূওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে যদিও নবী-রাসূলগণ নবী-রাসূল অভিধায় আখ্যায়িত হন না, কিন্তু ঐ সময় ওলী ও সিদ্দীক অবশ্যই থাকেন। আর তাঁদের এ বিলায়াত এতোটা পূর্ণ ও সম্পূর্ণ হয়ে থাকে যে, বড় বড় ওলী-আল্লাহ ও সিদ্দীকগণের বিলায়াত ও সত্যবাদিতা তাঁদের বিলায়াতের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার যোগ্যতো নয়ই, বরং সমুদ্রের তুলনায় এক ফোটা পানি কিংবা সূর্যের তুলনায় একটি রশ্মির সাথে তুলনার মতোই কেবল এটা তুলনীয়।
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার বাণী:
وَلَقَدْ آتَيْنَا إِبْرَاهِيمَ رُشْدَهُ مِن قَبْلُ وَكُنَّا بِهِ عَالِمِينَ ﴿الأنبياء: ٥١
আমিতো এর পূর্বে (নবূওয়াতের পূর্বে) ইবরাহীমকে সৎ, সঠিক পথের জ্ঞান দিয়েছিলাম এবং তার সম্পর্কে ছিলাম সম্মক অবগত। [সূরা আম্বিয়া-৫১]
হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:
يَا يَحْيَىٰ خُذِ الْكِتَابَ بِقُوَّةٍ وَآتَيْنَاهُ الْحُكْمَ صَبِيًّا، وَحَنَانًا مِّن لَّدُنَّا وَزَكَاةً ۖ وَكَانَ تَقِيًّا، وَبَرًّا بِوَالِدَيْهِ وَلَمْ يَكُن جَبَّارًا عَصِيًّا ﴿مريم: ١٢-14
হে ইয়াহইয়া দৃঢ়তার সাথে এই গ্রন্থ ধারণ কর। আমি তাকে শৈশবেই বিচারবুদ্ধি দান করেছিলাম। এবং নিজের পক্ষ থেকে আগ্রহ ও পবিত্রতা দিয়েছি। সে ছিল পরহেযগার। পিতা-মাতার অনুগত এবং সে উদ্ধত, নাফরমান ছিল না। [সূরা মারিয়াম-১২-১৪]
এসব আয়াত একথাই প্রমাণ করে যে, নবী রাসূলগণ নবূওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বেই উচ্চমার্গের ওলী ও সিদ্দীক হয়ে থাকেন। অনুরূপভাবে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও জন্ম থেকেই শিরক ও মূর্তিপূজা হতে এবং সর্বপ্রকার শিরকী সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ পাক-পবিত্র ছিলেন। যেমনটি ইবনে হিশাম রহঃ বলেছেন:
فَشَبَّ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَاَللَّهُ تَعَالَى يَكْلَؤُهُ وَيَحْفَظُهُ وَيَحُوطُهُ مِنْ أَقْذَارِ الْجَاهِلِيَّةِ، لِمَا يُرِيدُ بِهِ مِنْ كَرَامَتِهِ وَرِسَالَتِهِ، حَتَّى بَلَغَ أَنْ كَانَ رَجُلًا، وَأَفْضَلَ قَوْمِهِ مُرُوءَةً، وَأَحْسَنَهُمْ خُلُقًا، وَأَكْرَمَهُمْ حَسَبًا، وَأَحْسَنَهُمْ جِوَارًا، وَأَعْظَمَهُمْ حِلْمًا، وَأَصْدَقَهُمْ حَدِيثًا، وَأَعْظَمَهُمْ أَمَانَةً، وَأَبْعَدَهُمْ مِنْ الْفُحْشِ وَالْأَخْلَاقِ الَّتِي تُدَنِّسُ الرِّجَالَ، تَنَزُّهًا وَتَكَرُّمًا، حَتَّى مَا اسْمُهُ فِي قَوْمِهِ إلَّا الْأَمِينُ، لِمَا جَمَعَ اللَّهُ فِيهِ مِنْ الْأُمُورِ الصَّالِحَةِ (سيرت ابن هشام، شركة مكتبة ومطبعة مصطفى البابي الحلبي-1/183)
“অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ অবস্থায় যৌবনে পদার্পন করলেন যে, আল্লাহ তাআলা তাঁকে হিফাযত ও দেখাশোনা করতেন এবং জাহিলিয়্যাতের সমস্ত নোংরামী থেকে আল্লাহ তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতেন। কারণ, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ছিল, তিনি তাকে নবূওয়াত ও রিসালাত এবং সর্বপ্রকার ইজ্জত ও সম্মান দ্বারা ভূষিত করবেন। এভাবে তিনি পরিপূর্ণতা লাভ করলেন। চাল-চলন ও সুন্দর চরিত্র, বংশ মর্যাদা, সহনশীলতা ও ধৈর্য, সত্যবাদিতা ও আমানতদারীতে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। এবং অশ্লীলতা ও নিকৃষ্ট চরিত্র থেকে এতো বেশি দূরে থাকেন যে, তাঁর নাম ‘আমীন’ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে”। [সীরাতে ইবনে হিশাম-১/৬২]
হযরত আলী রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করা হলো, ‘আপনি কি কোন সময় কোন মূর্তির পূজা করেছেন?’ তিনি ইরশাদ করলেন, ‘না’। আর এও বলেন যে, ‘আমি সব সময়ই এগুলোকে কুফরী মনে করতাম। যদিও সে সময় আমার কিতাব ও ঈমানের জ্ঞান ছিল না’। [সীরাতে মুস্তাফা-১/১১৭]
أَخْبَرَنَا هِشَامٌ، عَنْ أَبِيهِ، حَدَّثَنِي جَارٌ لِخَدِيجَةَ بِنْتِ خُوَيْلِدٍ، أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَقُولُ لِخَدِيجَةَ: ” أَيْ خَدِيجَةُ، وَاللهِ لَا أَعْبُدُ اللَّاتَ أَبَدًا، وَاللهِ لَا أَعْبُدُ الْعُزَّى أَبَدًا
হযরত উরওয়া বিন যুবায়ের রাঃ থেকে বর্ণিত যে, হযরত খাদীজা রাঃ এর একজন প্রতিবেশী বর্ণনা করেন, আমি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কর্তৃক হযরত খাদিজাকে বলতে শুনেছি যে, ‘আল্লাহর কসম, আমি কখনোই লাত এর পূজা করবো না, আল্লাহর কসম, আমি কখনো উযযার পূজা করবো না’। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৩০৬৭, মাযমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস নং-১৩৮৬১]
وَكَانَ صَنَمًا مِنْ نُحَاسٍ يُقَالُ لَهُ: إِسَافُ وَنَائِلَةُ يَتَمَسَّحُ بِهِ الْمُشْرِكُونَ إِذَا طَافُوا، فَطَافَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَطُفْتُ مَعَهُ، فَلَمَّا مَرَرْتُ مَسَحْتُ بِهِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا تَمَسَّهُ» ، قَالَ زَيْدٌ: فَطُفْنَا، فَقُلْتُ فِي نَفْسِي: لَأَمَسَّنَّهُ حَتَّى أَنْظُرَ مَا يَقُولُ، فَمَسَحْتُهُ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَلَمْ تُنْهَ؟» قَالَ زَيْدٌ: فَوَالَّذِي أَكْرَمَهُ وَأَنْزَلَ عَلَيْهِ الْكِتَابَ مَا اسْتَلَمْتُ صَنَمًا حَتَّى أَكْرَمَهُ اللَّهُ بِالَّذِي أَكْرَمَهُ، وَأَنْزَلَ عَلَيْهِ الْكِتَابَ
হযরত জায়েদ বিন হারিসা রাঃ বলেন, জাহিলী যুগে যখন মুশরিকরা কা’বা শরীফ তওয়াফ করতো, তখন আসাফ ও নায়েলা (মূর্তি) কে স্পর্শ করতো। একবার আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে বাইতুল্লাহ তওয়াফ করি। যখন ঐ মূর্তিগুলোর নিকটবর্তী হলাম, তখন আমি তা স্পর্শ করলাম। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এগুলো ছুঁতে নিষেধ করলেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, দেখি তো ছুঁলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী বলেন? এটা ভেবে আমি দ্বিতীয়বার স্পর্শ করলাম। এবারে তিনি একটু রূঢ়ভাবে বলেন, আমি তোমাকে এ কাজ করতে নিষেধ করিনি? জায়েদ বলেন, ঐ সত্তার কসম যিনি তাকে সম্মানিত করেছেন, এবং তার উপর কিতাব নাজিল করেছেন, আমি আর মূর্তির সামনে নত হইনি, এমন কি আল্লাহ তাআলা তাকে নবূওয়াত ও রিসালাত দানে ধন্য করলেন এবং তার প্রতি স্বীয় কালাম অবতীর্ণ করলেন। [মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন, হাদীস নং-৪৯৫৬]
সীরাত ও হাদীসের উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা একথা পরিস্কার যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবূওয়াতপ্রাপ্তির আগ থেকেই কখনোই মূর্তিপূজাসহ কোন প্রকার শিরকী কাজ করেননি।
সুতরাং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে নবূওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বে শিরক বা মূর্তিপূজার নিসবত করা চূড়ান্ত বেআদবী এবং সীরাত সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ইসলামিয়া দারুল হক লালবাগ ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা: কাসিমুল উলুম আলইসলামিয়া, সালেহপুর আমীনবাজার ঢাকা।
পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।
শাইখুল হাদীস: জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, সনমানিয়া, কাপাসিয়া, গাজীপুর।
ইমেইল– [email protected]