হেযবুত তাওহীদের বিদআতী সালাতের পর্যালোচনা
দ্বীন-ইসলাম পরিপূর্ণ ।এখানে নতুন করে কোনো কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করার কোনো সুযোগ নেই।দ্বীনের নামে নতুন কিছু সংযোজন করা হল বিদআত ।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ
যে আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কোন নতুন বিষয় সংযুক্ত করবে যা তার অংশ নয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে (অর্থাৎ তা গ্রহণযোগ্য হবে না)।(সহীহ বুখারী- ২৬৯৭; সহীহ মুসলিম- ১৭১৮)
রাসূলুল্লহ ﷺ হতে যুগ পরম্পরায় উম্মতে মুসলিমার আদায়কৃত সালাতকে ভুল আখ্যা দিয়ে সালাতকে সামরিক প্রশিক্ষণ বলে ঘোষণা দিয়ে হিযবুত তাওহীদ নতুন এক বিদআতী সালাতের সূচনা করেছে।
বিজ্ঞ পাঠকের সমীপে আমরা তাদের বিদআতী সালাতের স্বরূপ তুলে ধরছিঃ
যেহেতু হিযবুত তাওহীদের মতে সালাত হল সামরিক প্রশিক্ষণ, তাই সালাতকে তারা আর্মি ট্রেনিং এর মত আদায় করে।’ইসলামের প্রকৃত সালাহ’ বইয়ের ২২-২৫ পৃষ্ঠাব্যাপী সালাতের যেসব রোকনগুলো বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশিক্ষণের সাথে মিলসম্পন্ন সেসব রোকন উল্লেখ করে তিনি তার মতবাদের স্বপক্ষে দলিল হিসেবে পেশ করেছেন ।যেমনঃ সালাতে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো, সোজা হয়ে দাঁড়ানো, চোখ বন্ধ না রাখা,ইমামের উচ্চস্বরে তাকবীর দেয়া ইত্যাদি।
বাহ্যিক সাদৃশ্যতার উপর ভিত্তি করে পন্নী সাহেব নতুন পদ্ধতির যে সালাত তৈরি করেছেন তা হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক ।যেমনঃ
🔸পন্নী সাহেবের পদ্ধতিঃ সালাতে ইমাম-মুক্তাদী একইসাথে রুকু-সিজদা ইত্যাদি করবেঃ
“ইসলামের প্রকৃত সালাহর নিয়ম হচ্ছে, এমামের তকবিরের জন্য সতর্ক, তৎপর হয়ে থাকা ও তকবিরের সঙ্গে সঙ্গে জামাতের সকলের সঙ্গে একত্রিতভাবে,একসাথে রুকুতে যাওয়া, এ’তেদাল করা,সাজদায় যাওয়া, সালাম ফেরানো ইত্যাদি করা; ঠিক যেমনভাবে প্যারেড,কুচকাওয়াজের সময় সামরিক বাহিনীর সৈনিকেরা সার্জেন্ট মেজরের(Sergeant-major) আদেশের সঙ্গে সঙ্গে সকলে একত্রিত ভাবে মার্চ করে,ডাইনে বামে ঘুরে দাঁড়ায়, বসে,দৌঁড়ায়।”(ইসলামের প্রকৃত সালাহ-২৬)
🔹হাদীসে বর্ণিত পদ্ধতিঃ ইমামের পরে মুক্তাদী রুকু-সিজদাহ করবেঃ
إِنَّ الإِمَامَ يَرْكَعُ قَبْلَكُمْ وَيَرْفَعُ قَبْلَكُمْ
ইমাম তোমাদের আগে রুকু’তে যাবে এবং তোমাদের আগে রুকু থেকে উঠবে।
إِنَّ الإِمَامَ يَسْجُدُ قَبْلَكُمْ وَيَرْفَعُ قَبْلَكُمْ
ইমাম তোমাদের আগে সাজদায় যাবে এবং তোমাদের আগে সাজদাহ থেকে উঠবে।
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” فَتِلْكَ بِتِلْكَ
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ তোমাদের তাকবীর ও সাজদাহ ইমামের পরে হবে।(সহীহ মুসলিম-৭৯০)
🔸পন্নী সাহেবের পদ্ধতিঃ রুকু- সিজদায় দ্রুত যেতে হবেঃ
“দ্রুত গতিতে রুকুতে যাবে,সিজদায় যাবে,সিজদা থেকে উঠে বসবে,সেজদা শেষ করে উঠে দাঁড়াবে।”(ইসলামের প্রকৃত সালাহ-২৫-২৬)
“বর্তমান বিকৃত ইসলামে যে সালাহ পড়া হয় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তা ইসলামের প্রকৃত সালাহর ঠিক বিপরীত । বর্তমানের মুসল্লিরা অতি ধীর গতিতে রুকু এবং সেজদায় যান,রুকু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পর সেজদায় যাওয়ার আগে এবং প্রথম সেজদা থেকে সেজদায় যাওয়ার আগে তারা কোনো সময় দেন না।অর্থাৎ বিশ্বনবীর শেখানো ও তাঁর নিজের কায়েম করা সালাতের ঠিক বিপরীত ।”(ইসলামের প্রকৃত সালাহ-২৬)
🔹হাদীসে বর্ণিত পদ্ধতিঃ ধীরস্থিরভাবে,শান্তহয়ে রুকু-সিজদায় যেতে হবেঃ
নাবী ﷺ বলেছেনঃ
إِذَا قُمْتَ إِلَى الصَّلَاةِ فَكَبِّرْ ثُمَّ اقْرَأْ مَا تَيَسَّرَ مَعَكَ مِنَ الْقُرْآنِ ثُمَّ ارْكَعْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ رَاكِعًا ثُمَّ ارْفَعْ حَتَّى تَعْتَدِلَ قَائِمًا ثُمَّ اسْجُدْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ سَاجِدًا ثُمَّ اجْلِسْ حَتَّى تَطْمَئِنَّ جَالِسًا ثُمَّ افْعَلْ ذَلِكَ فِي صَلَاتِكَ كُلِّهَا
তুমি সলাতে দাঁড়ানোর সময় সর্বপ্রথম তাকবীরে তাহরীমা বলবে। তারপর তোমার সুবিধানুযায়ী কুরআনের আয়াত পাঠ করবে, অতঃপর শান্তি ও স্থিরতার সাথে রুকূ‘ করবে, অতঃপর রুকূ‘ হতে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াবে। অতঃপর ধীরস্থিরভাবে সাজদাহ্ করবে। এরপর প্রশান্তির সাথে বসবে। এভাবেই তোমার পুরো সলাত আদায় করবে।(সুনানে আবু দাউদ-৪৯১; সহীহ বুখারী-৭৫৭)
পন্নী সাহেব এই হাদীসের এক আজব ব্যাখ্যা তৈরি করেছেন ।তিনি লিখেছেনঃ
“এখানে বুঝতে হবে যে সালাতের রোকনগুলো ধীরে আদায় করার অর্থ কী? এ ব্যাপারে বর্তমান মুসলিম বলে পরিচিত জনসংখ্যার মধ্যে ভুল ধারণা প্রচলিত আছে ।প্রচলিত ধারণা হচ্ছে এই যে ধীরে ধীরে নড়াচড়া, ওঠবোস করতে হবে।মোটেই তা নয়।যেহেতু মূলত সালাহ সামরিক প্রশিক্ষণ সেহেতু এর চলন ( Movement) দ্রুত হতে বাধ্য ।হাদীসের ধীর শব্দ প্রযোজ্য হচ্ছে ঐ দ্রুত চলনের মধ্যকার সময়ের, অর্থাৎ রুকুতে যাবার সময় দ্রুত, কিন্তু রুকুতে অর্থাৎ রুকু অবস্থায় যথেষ্ট সময়ক্ষেপন করা।………এমনিভাবে পন্নী সাহেব রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো এবং সিজদায় যাওয়ার পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন ।”(ইসলামের প্রকৃত সালাহ-২৫)
পন্নী সাহেবের এমন আজব ব্যাখ্যা তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে তার নিজস্ব মতবাদ- ‘সালাত হচ্ছে সামরিক প্রশিক্ষণ’ -এর গ্রহণযোগ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য।প্রশ্ন জাগে-যেখানে পৃথিবীর কোথাও এমন আজব রীতিতে সালাত পড়া হয় না,ইসলামের ইতিহাসে যার নজির নেই,সেখানে হুট করে তিনি কোথা হতে সঠিক পদ্ধতির নব আবিষ্কৃত এই সালাত পেলেন? তার উপর ওহী নাজিল হয়নি তো?(নাউযুবিল্লাহ)।
যেখানে হাদীসের বর্ণনা হচ্ছে সকল উম্মত একত্রে ভ্রান্তিতে নিপতিত হবে না,সেখানে গোটা উম্মতের সালাতকে বিকৃত বলা মানে হাদীসের বক্তব্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের নামান্তর ।(নাউযুবিল্লাহ)
🔸পন্নী সাহেবের পদ্ধতিঃ বৈঠকে বসে হাঁটুকে বাজপাখির শিকারের মতো ধরে রাখতে হবেঃ
“রুকু ও সাজদায় দুই হাত দিয়ে হাঁটুকে এমনভাবে ধোরতে হবে যেভাবে বাজপাখি তার শিকার ধরে।”বইয়ে সংযুক্ত ছবি দেখুন।(ইসলামের প্রকৃত সালাহ-৫২)
🔹হাদীসে বর্ণিত পদ্ধতিঃ দুই হাতকে উরুর উপর রাখতে হবেঃ
◾আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেনঃ
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا قَعَدَ يَدْعُو وَضَعَ يَدَهُ الْيُمْنَى عَلَى فَخِذِهِ الْيُمْنَى وَيَدَهُ الْيُسْرَى عَلَى فَخِذِهِ الْيُسْرَى
রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন দুআ করার জন্য বসতেন(তাশাহুদের দুআ), তখন ডান হাত ডান উরুর উপর রাখতেন এবং বাম হাত বাম উরুর উপর। (সহীহ মুসলিম-১১৮৬)
প্রিয় পাঠক, আপনি নিজেও ছবিতে দেখানো পদ্ধতিতে হাত রেখে দেখুন আপনার মেরুদণ্ড সম্পূর্ণ সোজা থাকবে না।পক্ষান্তরে যদি উরুর উপর হাত রাখেন তাহলে সম্পূর্ণ সোজা হয়ে বসা সম্ভব ।
এছাড়াও বৈঠকের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হল তাশাহুদের সময় আঙুল দ্বারা ইশারা করা।ইশারার গুরুত্ব সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছেঃ
◾অবশ্যই ঐ তর্জনী শয়তানের পক্ষে লোহা অপেক্ষা অধিক কষ্টদায়ক (খোঁচার দন্ড)। (মুসনাদে আহমাদ- ২/১১৯)
◾আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে,রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন দুআ করার জন্য(তাশাহুদের দুআ) বসতেন
أَشَارَ بِإِصْبَعِهِ السَّبَّابَةِ وَوَضَعَ إِبْهَامَهُ عَلَى إِصْبَعِهِ الْوُسْطَى وَيُلْقِمُ كَفَّهُ الْيُسْرَى رُكْبَتَهُ
শাহাদাত আংগুলি (তর্জনী) দ্বারা ইশারা করতেন এবং বৃদ্ধাঙ্গুল মধ্যমার উপর রাখতেন। আর বামহাতের তালূ দ্বারা বাম হাঁটু আকড়িয়ে ধরতেন। (সহীহ মুসলিম-১১৮৬)
⏩আঙ্গুল দ্বারা ইশারার পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
◾وَقَبَضَ ثِنْتَيْنِ وَحَلَّقَ حَلَقَةً وَرَأَيْتُهُ يَقُولُ هَكَذَا وَحَلَّقَ بِشْرٌ الإِبْهَامَ وَالْوُسْطَى وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ
দু’ আঙ্গুল গুটিয়ে বৃত্তাকার করলেন এবং তাঁকে আমি এভাবেই বলতে দেখলাম। বর্ণনাকারী বিশর (রহঃ) বৃদ্ধাংগুলিকে মধ্যমার সাথে মিলিয়ে বৃত্ত করলেন এবং শাহাদাত অংগুলি দ্বারা ইশারা করে দেখালেন।(সুনানে আবু দাউদ-৯৫৭)
প্রিয় পাঠক, হিযবুত তাওহীদের বর্ণিত পদ্ধতিতে হাত রাখলে এভাবে আঙুল গুটিয়ে বৃত্ত তৈরি করে ইশারা করা আদৌ সম্ভব কি?
সুতরাং, পন্নী সাহেবের তৈরিকৃত নতুন পদ্ধতি একান্তই তার নিজস্ব মনগড়া ।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
ﺇِﻥَّ ﺃَﺻْﺪَﻕَ ﺍﻟْﺤَﺪِﻳﺚِ ﻛِﺘَﺎﺏُ ﺍﻟﻠﻪِ ﻭَﺃَﺣْﺴَﻦَ ﺍﻟْﻬَﺪْﻱِ ﻫَﺪْﻱُ ﻣُﺤَﻤَّﺪٍ ﻭَﺷَﺮُّ ﺍﻷُﻣُﻮْﺭِ ﻣُﺤْﺪَﺛَﺎﺗُﻬَﺎ ﻭَﻛُﻞُّ ﻣُﺤْﺪَﺛَﺔٍ ﺑِﺪْﻋَﺔٌ ﻭَﻛُﻞُّ ﺑِﺪْﻋَﺔٍ ﺿَﻼَﻟَﺔٌ ﻭَﻛُﻞُّ ﺿَﻼَﻟَﺔٍ ﻓِﻲ ﺍﻟﻨَّﺎﺭِ . ﺭﻭﺍﻩ ﻣﺴﻠﻢ ﻭﺍﻟﻨﺴﺎﺋﻰ ﻭﺍﻟﻠﻔﻆ ﻟﻠﻨﺴﺎﺋﻰ
“নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহ তা’য়ালার কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদ ﷺ এর আদর্শ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। আর নব উদ্ভাবিত প্রত্যেক বিষয় বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআত হল ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম। ( সহীহ মুসলিম-১৫৩৫ ;সুনানে নাসায়ী- ১৫৬০)
এই নবআবিষ্কৃত হাদীস বহির্ভূত সালাতকে ‘প্রকৃত সালাত’ এর মোড়কে আমাদের সম্মুখে উপস্থাপন করছে -হিযবুত তাওহীদ।আপনার সামনে হিযবুত তাওহীদের পদ্ধতি ও হাদীসে বর্ণিত পদ্ধতি বিদ্যমান।তাই বিবেচনার দায়িত্ব আপনার উপর ছেড়ে দিলাম।