প্রচ্ছদ / আকিদা-বিশ্বাস / এছহাক রহঃ এর ভেদে মারেফত বইয়ের একটি কথার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে

এছহাক রহঃ এর ভেদে মারেফত বইয়ের একটি কথার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে

প্রশ্ন

আস্সালামু আলাইকুম
গতকাল আপনাদের একটি ভিডিও ক্লিপ দেখলাম যাহাতে পীর মুরীদি সম্পর্কে একটি
প্রশ্ন করা হয়েছে। জবাবে দেখলাম যে উনি চরমোনাই পীর কর্তিক লিখিত ভেদে
মারেফত এর একটি লেখা “আপনার দুইজন পীর থাকলে তারা আপনার দুই ডানা ধরে
জান্নাতে নিয়ে যাবে” কথাটা নাকি ভূল।
আচ্ছা আমি যদি বলি “আমি না দেখা জিনিসে সাক্খী দেই” এ কথাটাও কি ভূল?
আবার যদি বলি “আমি সত্যকে পছন্দ করি না” এ কথাটাও কি ভূল? যদি বলা হয়
কথাগুলো ভূল তাহলে আমি বলবো  এ ভূলটাতো আপনারাও করতেছেন। যদি বলাহয়
কিভাবে তাহলে আমি বলবো দেখুন আমার কথাগুলোকে কিন্তু দইটা অর্থে ভাগ করা
যায়
১-সাব্দিক অর্থে ২-রুপক অর্থে
যদি আপনি আমার কথাগুলোকে সাব্দিক অর্থে নেন তাহলে কথাগুলো ভূল আর যদি
রুপক অর্থে নেন তাহলে কথাগুলো সঠিক। যেমন আমি না দেখা জিনিসে সাক্খী দেই
কথাটার রপক অর্থ হলো আমি আল্লাহ কে দেখিনা অথচ না দেখেই সক্খী দেই যে
আল্লাহ আছেন।
সতরাং ভেদে মারেফতের কথাটাকে যদি রুপক অর্থে [তোমার যদি দুইজন পীর থাকে
আর উনারা যদি তোমাকে কোরআন হাদিস অনুযায়ি যে আদেশ করে, তা তুমি যদি
কোরআন হাদিস অনুযায়ি করতে পারো তাহলে তুমি জান্নাতি হবে বা তারা তোমাকে
জান্নাতে নিয়ে গেলো] নেয়া হয় তাহলে হয়তো আপনি ভুল নাও বলতে পারেন।
যাহোক এটা আমার মতামত, এ ব্যাপারে আপনার ব্যাখ্যা আশা করছি।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

মাশাআল্লাহ। আপনার চমৎকার জবাব শুনে ভাল লাগল। মূলত ভেদে মারেফত বইয়ে লিখা ইসহাক রহঃ এর বক্তব্য দ্বারা উদ্দেশ্য এটাই।

দুইজন মিলে জান্নাতে নিয়ে যাবে মানে হল, দুইজনেই কুরআন ও হাদীসের আলোকে জান্নাতের পথ দেখাবে।

যেমন একজন পথিক আপনার কাছে গন্তব্যে পৌঁছার পথ জিজ্ঞাসা করল, তখন আপনি জবাবে বললেন যে, গন্তব্যে পৌঁছার দু’টি পথ আছে। একটি হল বিপদজনক, যেখানে ডাকাত বা সন্ত্রাসীরা বসে আছে। আরেকটি পথ হল, নিরাপদ।

তখন উক্ত পথিক শুকরিয়া জানিয়ে বলল যে, ভাই আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন।

আসলে আপনি কি বাঁচিয়েছেন? আপনি শুধু পথ দেখিয়ে দিয়েছেন।

তো আপনার সঠিক পথ প্রদর্শন করার কারণে লোকটা আমল করে বেঁচে গেল। এ কারণে পথপ্রদর্শকই বাঁচিয়েছেন একথা বাহ্যিকতার দৃষ্টিতে বলা হয়।

তেমনি দুই পীর জান্নাতে নিয়ে যাবে, মানে হল, দুইজনই কুরআন ও হাদীসভিত্তিক সহীহ আমলের পথ বাতলে দিয়ে ব্যক্তি জান্নাতের পথে চলতে সহযোগিতা করবেন। যার ফলে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক আমল করে সহজে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।

এটাকেই দুই ডানা ধরে জান্নাতে নিয়ে যাবে বলে রূপক অর্থে ব্যক্ত করা হয়েছে।

যদি কেউ হাকীকী অর্থে বলে যে, পীর সাহেব জান্নাতে নিয়ে যাবে, তাহলে এটি সম্পূর্ণই কুফরী ও শিরকী বক্তব্য। এর দ্বারা ব্যক্তি ঈমান ও তাওহীদের বিশ্বাসের সীমানা থেকে বেরিয়ে যাবে।

পীর বা মুর্শীদ মূলত একজন পথপ্রদর্শক বা শিক্ষক।

তাদের কাজ কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক আমলের পথ মানুষকে বাতলে দেয়া। জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেয়া, বা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়ার কোন ক্ষমতা কোন পীরের নেই।

এমনকি খোদ পীর নিজেই জান্নাতে প্রবেশ বা জাহান্নাম থেকে মুক্ত হবার ক্ষমতা তার নেই।

এর পুরো ক্ষমতাই আল্লাহর হাতে।

সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি এ বিশ্বাস করে যে, তার পীর বা মুর্শীদ তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি সুষ্পষ্ট কুফরী করল। পরিস্কার শিরক করল। উক্ত ব্যক্তির নতুন করে ঈমান আনা আবশ্যক।

কিন্তু যদি এ আক্বিদা রাখে যে, পীর বা মুর্শীদ আমাকে কুরআন ও সুন্নাহের পথ দেখিয়ে জান্নাতের পথ দেখাবে, জাহান্নাম মুক্তির পথ দেখাবে, এ আকিদা রাখলে এটিকে কিছুতেই শিরক বলা যাবে না।

আবারো বলছি,

পীরকে জান্নাত দেবার মালিক মনে করলে ব্যক্তি মুশরিক হয়ে যায়।

পীরকে মুক্তিদাতা, সন্তানদাতা, সুখদাতা, কবরে মুক্তিদাতা ইত্যাদি মনে করলে ব্যক্তি মুশরিক হয়ে যাবে। পীর বা মুর্শীদ কেবলি একজন পথ প্রদর্শক। একজন শিক্ষক ছাড়া আর কিছুই নয়।

اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ (6) صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ

অনুবাদ-আমাদের সরল সঠিক পথ [সীরাতে মুস্তাকিম] দেখাও। তোমার নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের পথ। {সূরা ফাতিহা-৬,৭}

সূরায়ে ফাতিয়ায় মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর নিয়ামাতপ্রাপ্ত বান্দারা যে পথে চলেছেন সেটাকে সাব্যস্ত করেছেন সীরাতে মুস্তাকিম।

আর তার নিয়ামত প্রাপ্ত বান্দা হলেন-

الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ

অনুবাদ-যাদের উপর আল্লাহ তাআলা নিয়ামত দিয়েছেন, তারা হল নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ, ও নেককার বান্দাগণ। {সূরা নিসা-৬৯}

এ দু’ আয়াত একথাই প্রমাণ করছে যে, নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দা হলেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ, আর নেককারগণ, আর তাদের পথই সরল সঠিক তথা সীরাতে মুস্তাকিম। অর্থাৎ তাদের অনুসরণ করলেই সীরাতে মুস্তাকিমের উপর চলা হয়ে যাবে।

যেহেতু আমরা নবী দেখিনি, দেখিনি সিদ্দীকগণও, দেখিনি শহীদদের। তাই আমাদের সাধারণ মানুষদের কুরআন সুন্নাহ থেকে বের করে সীরাতে মুস্তাকিমের উপর চলার চেয়ে একজন পূর্ণ শরীয়তপন্থী হক্কানী বুযুর্গের অনুসরণ করার দ্বারা সীরাতে মুস্তাকিমের উপর চলাটা হবে সবচে’ সহজ। আর একজন শরীয়ত সম্পর্কে প্রাজ্ঞ আল্লাহ ওয়ালা ব্যক্তির সাহচর্য করার নামই হল পীর মুরিদী।

রাসূলে কারীম সাঃ একাধিক স্থানে নেককার ব্যক্তিদের সাহচর্য গ্রহণ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। যেমন-

عن أبي موسى رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه و سلم قال ( مثل الجليس الصالح والسوء كحامل المسك ونافخ الكير فحامل المسك إما أن يحذيك وإما أن تبتاع منه وإما أن تجد منه ريحا طيبة ونافخ الكير إما أن يحرق ثيابك وإما أن تجد ريحا خبيثة

অনুবাদ-হযরত আবু মুসা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-সৎসঙ্গ আর অসৎ সঙ্গের উদাহরণ হচ্ছে মেশক বহনকারী আর আগুনের পাত্রে ফুঁকদানকারীর মত। মেশক বহনকারী হয় তোমাকে কিছু দান করবে কিংবা তুমি নিজে কিছু খরীদ করবে। আর যে ব্যক্তি আগুনের পাত্রে ফুঁক দেয় সে হয়তো তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দিবে, অথবা ধোঁয়ার গন্ধ ছাড়া তুমি আর কিছুই পাবে না। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫২১৪, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৬৮৬০, মুসনাদুল বাজ্জার, হাদীস নং-৩১৯০, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৪৮৩১, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫৬১, মুসনাদে আবী ইয়ালা, হাদীস নং-৪২৯৫, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৯৬৬০, মুসনাদুল হুমায়দী, হাদীস নং-৭৭০, মুসনাদুশ শামীন, হাদীস নং-২৬২২, মুসনাদুশ শিহাব, হাদীস নং-১৩৭৭, মুসনাদে তায়ালিসী, হাদীস নং-৫১৫}

এছাড়াও অনেক হাদীস নেককার ও বুযুর্গ ব্যক্তিদের সাহচর্য গ্রহণের প্রতি তাগিদ বহন করে। আর সবচে’ বড় কথা হল-বর্তমান সময়ে অধিকাংশ মানুষই দ্বীন বিমুখ। যারাও দ্বীনমুখী, তাদের অধিকাংশই কুরআন হাদীসের আরবী ইবারতই সঠিকভাবে পড়তে জানে না, এর অর্থ জানবেতো দূরে থাক। আর যারাও বাংলা বা অনুবাদ পড়ে বুঝে, তাদের অধিকাংশই আয়াত বা হাদীসের পূর্বাপর হুকুম, বা এ বিধানের প্রেক্ষাপট, বিধানটি কোন সময়ের জন্য, কাদের জন্য ইত্যাদী বিষয়ে সম্যক অবহিত হতে পারে না। তাই বর্তমান সময়ে একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে কুরআন সুন্নাহ থেকে নিজে বের করে আল্লাহ তাআলার উদ্দিষ্ট সীরাতে মুস্তাকিমে চলা বান্দার জন্য কষ্টসাধ্য। তাই আল্লাহ তাআলা সহজ পথ বাতলে দিলেন একজন বুযুর্গের পথ অনুসরণ করবে, তো সীরাতে মুস্তাকিমেরই অনুসরণ হয়ে যাবে।

কিন্তু কথা হচ্ছে যার অনুসরণ করা হবে সে অবশ্যই সীরাতে মুস্তাকিমের পথিক হতে হবে। অর্থাৎ লোকটি {মুরশীদ বা পীর} এর মাঝে থাকতে হবে শরীয়তের পূর্ণ অনুসরণ। বাহ্যিক গোনাহ থেকে হতে হবে মুক্ত। কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে হতে হবে প্রাজ্ঞ। রাসূল সাঃ এর সুন্নাতের উপর হতে হবে অবিচল। এমন গুনের অধিকারী কোন ব্যক্তি যদি পাওয়া যায়, তাহলে তার কাছে গিয়ে তার কথা মত দ্বীনে শরীয়ত মানার নামই হল পীর মুরিদী। এরই নির্দেশ আল্লাহ তাআলা কুরআনে দিয়েছেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ (119

অনুবাদ-হে মুমিনরা! আল্লাহকে ভয় কর, আর সৎকর্মপরায়নশীলদের সাথে থাক। {সূরা তাওবা-১১৯)

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা-ইমাম আবূ হানীফা ইসলামী রিসার্চ সেন্টার পিরোজপুর।

ইমেইল[email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *