প্রচ্ছদ / জায়েজ নাজায়েজ / খতমে তারাবীতে ইমাম সাহেব দ্রুত তিলাতওয়াত করলে মুসল্লিদের করণীয় কী?

খতমে তারাবীতে ইমাম সাহেব দ্রুত তিলাতওয়াত করলে মুসল্লিদের করণীয় কী?

প্রশ্ন

আসসালামু আলাইকুম।

পার্শ্ববর্তী মসজিদ সমুহে তারাবিহ এর নামাজ তাড়াহুড়া করে পড়ানো হয়, হাফেজ সাহেবের কেরাত স্পষ্ট বুঝা যায় না এবং রুকু সিজদাও খুব তাড়াহুড়া করে আদায় করে অর্থাৎ সুন্নাত মতে আদায় হয় না।

তাই  কয়েকজন ব্যাক্তি মিলে তাদের ক্লাবের বারান্দায় সুরা তারাবিহ এর ব্যাবস্থা করেছিল, যেখানে শুধু এশা ও তারাবিহ নামাজ টা পড়ানো হয়। অন্য ৪ ওয়াক্তের নামাজ পড়া হয় না। পহেলা রমজান থেকে   ২৪ ই রমজান দিবাগত রাত পর্যন্ত  উক্ত ক্লাবের বারান্দায় এশা ও তারাবিহ এর নামাজ নিয়মিত জামাতে পড়া হয়েছিল। ২৬-ই রমজান উক্ত ক্লাবের মুসল্লিগণ সবাই গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল যে ২৬-রমজান থেকে ৩০ই রমজান পর্যন্ত  তারাবিহ এর নামাজ উক্ত ক্লাবের বারান্দায় পড়ানো হবে না।
এখন প্রশ্ন হলো, এটা কি জায়েজ আছে?  নাকি তাদের কে অবশ্যই ৩০ ই রমজান পর্যন্ত উক্ত ক্লাবের বারান্দায় তারাবিহ এর নামাজ চালায় যেতে হবে ?

বিঃদ্রঃ- মুসল্লিগণ কেউ এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা না।মুস্ললি সংখ্যা(৮-১০) জন। একেকজনের বাড়ি একেক জাগায়।  ছুটিতে সবাই বাড়ি যেতে চাচ্ছে।

জাযাকুমুল্লাহু খাইরাল জাযা

উত্তর

وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم

উপরোক্ত প্রশ্নে দু’টি প্রশ্ন মূলত রয়েছে। যথা-

তারাবীহ নামাযে ইমাম সাহেব তাড়াহুড়া করে নামায পড়ালে তার ইক্তিদা না করে অন্যত্র নামায পড়বে কি না?

তারাবীহ নামায মসজিদ ছাড়া এক স্থানে শুরু করার পর তা রমজানের শেষ পর্যন্ত পড়তে হবে? নাকি মাঝখানে নামায বন্ধ করে জায়েজ আছে?

১ম প্রশ্নের জবাব

প্রথম প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ।

কুরআনে কারীম তাড়াহুড়া করে পড়া উচিত নয়। আর যদি তিলাওয়াত বুঝাই না যায়, কিংবা অর্থ পাল্টে যায়, তাহলে এভাবে তিলাওয়াত করা পরিস্কার হারাম।

এটি আমাদের দেশের আম রোগ হয়ে গেছে। তারাবীতে খতম করতেই হবে। আর কুরআন খতমের নামে হাফিজ সাহেবরা পুরো কুরআনকেই খতম করে দেয়ার দুঃসাহসিক অভিযানে নেমে পড়েন। যা পড়েন তা কোনভাবেই কুরআন তিলাওয়াত বলে মনে হয় না। যেন কোন মন্ত্র পড়ছেন।

এভাবে কুরআন তিলাওয়াত করা কোনভাবেই জায়েজ নয়। বরং হারাম। হারাম। হারাম।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের পদ্ধতি বর্ণনা করে ইরশাদ করেছেনঃ

وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا [٧٣:٤

এবং কোরআন আবৃত্তি করুন সুবিন্যস্ত ভাবে ও স্পষ্টভাবে। [সূরা মুজ্জাম্মিল ৭৩: ৪]

যেখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই তার কুরআন তিলাওয়াতের নির্দেশ দিচ্ছেন স্পষ্ট ও তারতীলের সাথে। সেখানে এভাবে তাড়াহুড়া করে মন্ত্র পড়া কিভাবে বৈধ হতে পারে?

এটি কুরআনের সাথে ঠাট্টা ছাড়া আর কিছু নয়।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بِالقُرْآنِ

হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, সে আমাদের দলভূক্ত নয়, যে সুন্দর সূরে কুরআন তিলাওয়াত করে না। [বুখারী, হাদীস নং-৭৫২৭]

যদি তারতীলের সাথে পড়লে দাঁড়িয়ে থাকা অসহনীয় কষ্টকরই হয়ে যায়, তাহলে খতমে তারাবীহ পড়ার দরকার কি? সূরা তারাবীহ পড়লেই হয়।

এখন প্রশ্ন হল, যদি কোথাও তাড়াহুড়া করে খতমে তারাবীহ পড়া হয়, তাহলে এক্ষেত্রে সচেতন মুসল্লিদের করণীয় কী?

১)

সম্ভব হলে ইমাম সাহেবকে বলে তাড়াহুড়া বন্ধ করে ধীরস্থীরভাবে বা স্পষ্ট শব্দে তিলাওয়াতের জন্য অনুরোধ করবে।

যদি ইমাম বা মসজিদ কমিটি তা মেনে নেয়, তাহলে উক্ত মসজিদেই নামায পড়তে হবে।

 

যদি ইমাম সাহেব না মানেন, বা মসজিদ কর্তৃপক্ষ তা করতে না দেয়, তাহলে দুই সূরত। যথা-

ক)

ইমাম সাহেবের দ্রুত তিলাওয়াতের ফলে কুরআানের অর্থ বিকৃতি ঘটে।

খ)

অর্থ বিকৃতি ঘটে না, বরং শব্দ স্পষ্টই হয়, কিন্তু পড়েন দ্রুত।

এ দুই সূরতের প্রথম সূরতে উক্ত ইমামের পিছনে নামায পড়া জায়েজ হবে না। বরং অন্যত্র নামাযের ব্যবস্থা করতে হবে।

আর যদি দ্বিতীয় সূরত হয়, তাহলে কাছাকাছি কোথাও ধীরস্থীরভাবে তিলাওয়াতকারী মসজিদের ইমাম না থাকলে উক্ত ইমামের পিছনেই নামায পড়তে হবে।

আলাদা সূরা তারাবীহ পড়বে না।

কারণ, সূরা তারাবীহ পড়ার দ্বারা খতমে কুরআনের সুন্নত আদায় হবে না।

তারাবীতে খতমে কুরআন করা সুন্নত। আর শব্দ স্পষ্ট তথা অর্থবিকৃতি হয় না, কিন্তু দ্রুত তিলাওয়াত করে, তাহলে একাজটি অনুত্তম হলেও নাজায়েজ বা হারাম নয়। এ কারণে নামায ভঙ্গ হয় না।

তাই

খতমে তারাবীহের সুন্নত বাদ দিয়ে আলাদাভাবে সূরা তারাবীহ পড়া উচিত হবে না।

وفى الدر المختار: (وَالْخَتْمُ) مَرَّةً سُنَّةٌ وَمَرَّتَيْنِ فَضِيلَةٌ وَثَلَاثًا أَفْضَلُ. (وَلَا يُتْرَكُ) الْخَتْمُ (لِكَسَلِ الْقَوْمِ) لَكِنْ فِي الِاخْتِيَارِ: الْأَفْضَلُ فِي زَمَانِنَا قَدْرُ مَا لَا يَثْقُلُ عَلَيْهِمْ، وَأَقَرَّهُ الْمُصَنِّفُ وَغَيْرُهُ. وَفِي الْمُجْتَبَى عَنْ الْإِمَامِ: لَوْ قَرَأَ ثَلَاثًا قِصَارًا أَوْ آيَةً طَوِيلَةً فِي الْفَرْضِ فَقَدْ أَحْسَنَ وَلَمْ يُسِئْ، فَمَا ظَنُّك بِالتَّرَاوِيحِ؟ وَفِي فَضَائِلِ رَمَضَانَ لِلزَّاهِدِيِّ: أَفْتَى أَبُو الْفَضْلِ الْكَرْمَانِيُّ وَالْوَبَرِيُّ أَنَّهُ إذَا قَرَأَ فِي التَّرَاوِيحِ الْفَاتِحَةَ وَآيَةً أَوْ آيَتَيْنِ لَا يُكْرَهُ، وَمَنْ لَمْ يَكُنْ عَالِمًا بِأَهْلِ زَمَانِهِ فَهُوَ جَاهِلٌ.

وفى رد المحتار:فَالْحَاصِلُ أَنَّ الْمُصَحَّحَ فِي الْمَذْهَبِ أَنَّ الْخَتْمَ سُنَّةٌ لَكِنْ لَا يَلْزَمُ مِنْهُ عَدَمُ تَرْكِهِ إذَا لَزِمَ مِنْهُ تَنْفِيرُ الْقَوْمِ وَتَعْطِيلُ كَثِيرٍ مِنْ الْمَسَاجِدِ خُصُوصًا فِي زَمَانِنَا فَالظَّاهِرُ اخْتِيَارُ الْأَخَفِّ عَلَى الْقَوْمِ. (رد المحتار، كتاب الصلاة، باب الوتر والنوافل-2/497-498، مبحث صلاة التراويح)

وفى الدر المختار: وَيَجْتَنِبُ الْمُنْكَرَاتِ هَذْرَمَةَ الْقِرَاءَةِ، وَتَرْكَ تَعَوُّذٍ وَتَسْمِيَةٍ، وَطُمَأْنِينَةٍ، وَتَسْبِيحٍ، وَاسْتِرَاحَةٍ

وقال ابن عابدين: (قَوْلُهُ هَذْرَمَةَ) بِفَتْحِ الْهَاءِ وَسُكُونِ الذَّالِ الْمُعْجَمَةِ وَفَتْحِ الرَّاءِ: سُرْعَةُ الْكَلَامِ وَالْقِرَاءَةِ قَامُوسٌ، وَهُوَ مَنْصُوبٌ عَلَى الْبَدَلِيَّةِ مِنْ الْمُنْكَرَاتِ، )رد المحتار، كتاب الصلاة، باب الوتر، مبحث التراويح-2/499، حاشية الطحطاوى على مراقى الفلاح-415)

فى مراقى الفلاح: ويحذر من الهذرمة، وترك الترتيل، وترك تعديل الأركان، وغيرها كما فعله من لا خشية له

وفى حاشيته: قوله: “ويحذر من الهدرمة” الموجود في النسخ التي بأيدينا بالدال المهملة والذي في الدر بالذال المعجمة وفسرها في القاموس بسرعة الكلام والقراءة قوله: “وترك الترتيل” في القاموس رتل الكلام ترتيلا أحسن تأليفه اهـ والمراد أن لا يعطي التلاوة وحقها (حاشية الطحطاوى على مراقى الفلاح، كتاب الصلاة، فصل فى صلاة التراويح-416)

দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব

মসজিদ ছাড়া অন্যত্র প্রয়োজনে নামায শুরু করলে, সেখানে নামায মাস শেষ পর্যন্ত নামায চালিয়ে যাওয়া কোন জরুরী বিষয় নয়। প্রয়োজন তার প্রয়োজন পর্যন্ত সীমিত থাকে

قَاعِدَة الضرورات تقدر بِقَدرِهَا (قواعد الفقه لعميم الاحسان، رقم القاعدة-171

والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা-ইমাম আবূ হানীফা ইসলামী রিসার্চ সেন্টার পিরোজপুর।

ইমেইল[email protected]

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *