প্রচ্ছদ / তাবলীগ জামাত / আল্লাহর রাস্তা বলতে কি শুধু জিহাদ উদ্দেশ্য?

আল্লাহর রাস্তা বলতে কি শুধু জিহাদ উদ্দেশ্য?

প্রশ্ন

যতটুকু জানি, রাসুলের যুগে ” আল্লাহর রাস্তা ” বলতে সাধারণত জিহাদ বা যুদ্ধের কথা বুঝানো হতো। কিন্তু বর্তমানে তাবলীগ জামাতের লোকেরা দাওয়াতে তাবলিগকেই আল্লাহর রাস্তা বলছেন। যদিও দেখা যায় ইসলাম ও মুসলমানের উপর হুমকি আসলেও তারা ( যুদ্ধ নয় বরং)  নিরব থাকেন। তবে কি দাওয়াতে তাবলিগকে সরাসরি আল্লাহর রাস্তা বলা সঠিক হবে? এবং আল্লাহর রাস্তার জন্য বর্নিত সকল ফজিলতও কি এর জন্য প্রযোজ্য হবে???

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

আল্লাহর রাস্তা তথা “ফী সাবীলিল্লাহ” শব্দ দ্বারা শুধুই “কিতাল ফী সাবীলিল্লাহ” রাসূল সাঃ এর যুগে বুঝানো হতো, কথাটি সঠিক নয়। বরং অনেক অর্থে ব্যবহৃত হতো। তবে “ফী সাবীলিল্লাহ” শব্দ দ্বারা এক নাম্বারে “কিতাল ফী সাবীলিল্লাহ” উদ্দেশ্য এতে কোন সন্দেহ নেই। এবং যারা সঠিকভাবে জিহাদরত আছেন, তারাই এক নাম্বার আল্লাহর রাস্তায় আছেন এতেও কোন সন্দেহ নেই।

বাকি দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতের সফরও আল্লাহর রাস্তা তথা “ফী সাবীলিল্লাহ”। এটিকে আল্লাহর রাস্তা না মানাও বাড়াবাড়ি ও কূপমন্ডুকতা ছাড়া কিছু নয়।

আল্লাহর রাস্তা বলতে শুধু জিহাদের সাথে খাস নয় বুঝাতে শুধু একটি হাদীসের উদাহরণ পেশ করছি-

عَنْ كَعْبِ بْنِ عُجْرَة، قَالَ: مَرَّ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلٌ، فَرَأَى أَصْحَابُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ جِلْدِهِ وَنَشَاطِهِ، فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ: لَوْ كَانَ هَذَا فِي سَبِيلِ اللهِ؟، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنْ كَانَ خَرَجَ يَسْعَى عَلَى وَلَدِهِ صِغَارًا فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللهِ، وَإِنْ كَانَ خَرَجَ يَسْعَى عَلَى أَبَوَيْنِ شَيْخَيْنِ كَبِيرَيْنِ فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللهِ، وَإِنْ كَانَ يَسْعَى عَلَى نَفْسِهِ يُعِفُّهَا فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللهِ، وَإِنْ كَانَ خَرَجَ رِيَاءً وَمُفَاخَرَةً فَهُوَ فِي سَبِيلِ الشَّيْطَانِ»

হযরত কাব বিন উজরা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূল সাঃ এর পাশ দিয়ে এক ব্যক্তি অতিক্রান্ত হচ্ছিল। নবীজী সাঃ এর সাহাবাগণ উক্ত ব্যক্তির শারিরীক সক্ষমতা ও উদ্দমতার দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন, হে আল্লাহর রাসূলঃ যদি এই ব্যক্তি কি ফী সাবীলিল্লাহে থাকতো? তখন রাসূল সাঃ ইরশাদ করলেন, যদি এ ব্যক্তি তার ছোট বাচ্চাদের লালন পালনের জন্য মেহনত করতে বেরিয়ে থাকে, তাহলে সে ফী সাবীলিল্লাহে রয়েছে। আর যদি সে বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের জন্য বেরিয়ে থাকে, তবু সে ফী সাবীলিল্লাহে রয়েছে। আর যদি সে নিজের মনকে পবিত্র রাখতে চেষ্টা-মেহনত করতে থাকে, তবু সে ফী সাবীলিল্লাহে রয়েছে। আর যে ব্যক্তি লৌকিকতা ও দাম্ভিকতা প্রদর্শনের জন্য বের হয়, সে হল ফী সাবীলিশ শয়তান তথা শয়তানের পথে রয়েছে। {আলমুজামুল কাবীর, হাদীস নং-২৮২, আলমুজামুল আওসাত, হাদীস নং-৬৮৩৫, আলমুজামুস সাগীর, হাদীস নং-৯৪০}

হাদীসটির ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসীনদের মন্তব্য

১-   আল্লামা মুনজিরী রহঃ বলেন, এ হাদীসের সকল রাবী সহীহ। {আততারগীব ওয়াত তারহীব-৩/১০৭}

২-   আল্লামা দিময়াতী রহঃ বলেন, এ হাদীসের সকল রাবী সহীহ। {আলমুত্তাজিরুর রাবীহ, বর্ণনা নং-২৫৫}

৩-   আল্লামা হায়তামী মক্কী রহঃ বলেন, এ হাদীসের সকল রাবী সহীহ। {আজযাওয়াজের-২/৬৫}

এরকম আরো অসংখ্য হাদীস রয়েছে। বিস্তারিত জানতে আমাদের প্রকাশিত “ফী সাবীলিল্লাহ শব্দের তাহকীকঃ তাবলীগী ভাইয়েরা কি এ শব্দটি গলদ ব্যবহার করছে?” লেখাটি পড়ুন।

আরেকটি অহেতুক অভিযোগ উত্থাপন করেছেন আপনি উক্ত প্রশ্নে। সেটি হল, তাবলীগের ভাইয়েরা মুসলমানদের উপর হুমকি আসলে চুপ থাকেন। এটি সঠিক কথা নয়।

আমরা সবাই তাবলীগী। তাবলীগী মানেই প্রতি মাসে তাবলীগে বের হতে হবে, বছরে চিল্লা দিয়ে বেড়াতে হবে বিষয়টি এমন নয়। আমাদের কিছু ভাই সময় বের করতে পারেন, তা’ই তারা প্রতি মাসে তাবলীগের বর্তমান প্রচলিত পদ্ধতিতে মেহনত করেন। যারা ইলমের মাধ্যমে তাবলীগ করার ক্ষমতা রাখেন, তারা মাদরাসায় দরস দেবার মাধ্যমে তাবলীগের মেহনত করে বেড়াচ্ছেন। যারা বয়ানের মাধ্যমে তাবলীগ করার ক্ষমতা রাখেন, তারা বয়ানের মাধ্যমে তাবলীগ করে যাচ্ছেন। যারা লিখনীর মাধ্যমে তাবলীগ করার ক্ষমতা রাখেন, তারা লিখনী দ্বারা তাবলীগ করে বেড়াচ্ছেন। আর যারা জিহাদের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীনকে বুলন্দ করার সুযোগ পেয়েছেন, তারা জিহাদের মাধ্যমে তাবলীগে দ্বীন ও দ্বীনকে উঁচু করে চলছেন।

আমরা কেউ কারো বিপরীত নই। বরং সময় সুযোগ হিসেবে কাজের বিকেন্দ্রীকরণ মাত্র। যেমন সকল সাহাবী জিহাদরত ছিলেন না। আবার সকল সাহাবী থেকে হাদীসের বর্ণনাও পাওয়া যায় না। সকল সাহাবী আবার মুফাসসির ছিলেন না। সকল সাহাবী আবার ফক্বীহ ছিলেন না। বরং যার যে যোগ্যতা, তিনি সেই বিষয়ে দ্বীনের কাজ করে গেছেন।

সবাই ছিলেন সবার সহযোগী। কেউ কারো কাজকে ছোট করে দেখতো না। এভাবেই দ্বীনের মাঝে পূর্ণতা আসে।

“তাবলীগের ভাইয়েরা কেন জিহাদে বেরিয়ে পড়ছে না” এ প্রশ্ন করা অবান্তর। তেমনি “সকল মুজাহিদরা কেন জিহাদ ছেড়ে তাবলীগে এসে পড়ছে না” এমন কথা বলাও আহমকী।

সকল মুহাদ্দিস শাইখুল হাদীসরা কেন হাদীস পড়ানো রেখে তাবলীগে/জিহাদে বেরিয়ে পড়ছে না এ প্রশ্ন করাও বোকামী বৈ কিছু নয়।

সবাইকে তার সামর্থ অনুপাতে দ্বীনের কাজ করে যেতে হবে। সবাই সবার সহযোগী হতে হবে। প্রয়োজনে সাহায্য করতে হবে। একজন অপরজনকে শ্রদ্ধা করতে হবে। ঘৃণা বা বিদ্বেষ নয়। তাহলেই দ্বীনের বিজয় সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।

আর তাবলীগ জামাত কোন রেজিষ্টার করা দল নয়। যারাই তাবলীগে যান, তারাই কিন্তু আবার মাঠে এসে অন্যায়ের প্রতিবাদে ইসলামী দলের নেতৃত্বে মিছিলে শরীক হয়। তারাই প্রয়োজনে জিহাদে অংশ নেয়।

বাকি তাবলীগের ব্যানারে অন্য কোন খিদমাতের কথা বলা হয় না। পার্থক্য এতটুকু। তাবলীগ জামাতকে তার আপন অবস্থায় ছেড়ে দেয়াই যৌক্তিক। তাবলীগ জামাতের বর্তমান পদ্ধতি সবার জন্য উন্মুক্ত। এখানে কোন দল নেই, কোন মত নেই। সবাই সমান।

বাকি সেই ব্যানার থেকে বেরিয়ে আপনি মুজাহিদও হতে পারেন, ইসলামী রাজনীতির সাথেও জড়াতে পারেন, আপনি কুরআন হাদীসের দরসদাতাও হতে পারেন।

বাকি তাবলীগের ব্যানারে আসলে আপনি কেবলি একজন মুবাল্লিগ। অন্য কিছু নয়।

আশা করি বিষয়টি পরিস্কার হয়েছে। অহেতুক তাবলীগ জামাত সম্পর্কে খারাপ ধারণা না করতে অনুরোধ থাকবে।

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

ইমেইল- [email protected]

[email protected]

 

0Shares

আরও জানুন

ইমামের সামনের সুতরা কি মাসবূক মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট?

প্রশ্ন ইমামের সুতরা মুসল্লিদের জন্য যথেষ্ট কি না? এবং ইমামের সুতরা মসবুক ব্যাক্তির জন্য যথেষ্ট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *