প্রচ্ছদ / প্রশ্নোত্তর / হাফেজদের জন্য জান্নাতে ‘মারজান’ নামক লেকের পারে একটি সোসাইটি দেয়া হবে?

হাফেজদের জন্য জান্নাতে ‘মারজান’ নামক লেকের পারে একটি সোসাইটি দেয়া হবে?

প্রশ্ন

বাংলাদেশের এক প্রসিদ্ধ বক্তা তার এক বয়ানে বলেন:

“যেই ছেলেটা হাফেজ হলো। হাদীসে আছে। আল্লাহ যদি মওত পর্যন্ত একে টিকায়া রাখে হেফজের উপরে। আর ঈমানী মওত হয়। তাকে কুরআন সুরক্ষিত করার কারণে আল্লাহ একটা সোসাইটি একে গিফট দিবে।

যেমন ঢাকা শহরের ভিতরে হাতিরঝিল একটা আকর্ষণীয় জাগা। ঠিক না? হ্যা? কী বলেন? হ্যা? ওরকম একটা ঝিলে, সোসাইটিতে লেকের পাড়ে তাকে একটা শহর দিবে। ঐ লেকটার নাম হলো ‘মারজান’।

ان فى الجنة لنهرا، وناريئان، يقال له ريئان، فيه مدينة من مرجان

মারজান পাথর দিয়া একটা সোসাইটি বানায়া দিবে।

فيه سبعين الف بابا

ঢুকতে হলে সত্তর হাজার দরজা ক্রস করে ঢুকতে হবে।

على كل باب سبعين الف ملائكة

প্রত্যেক গেটে সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রটোকলের জন্য রেডি থাকবে। যখন সে সত্তর হাজার গেট অতিক্রম শেষ হবে। তো চারশ নব্বই কোটি ফেরেশতার প্রটোকল আর স্যালুট কমপ্লিট হবে। এবং প্রত্যেকের হাতে একেকটা উপঢৌকন থাকবে। এক ধরণের না। চারশ নব্বই কোটির হাতে চারশ নব্বই কোটি প্রকারের উপঢৌকন থাকবে। আর হাফেজকে দিবে আর বলবে:

هذا كرامة للقرآن

এটা কুরআনের সম্মানার্থে দেয়া হইল। মা বাবা যখন ট্যুরে যাবে ঐ শহরে। ঐ সোসাইটিতে। তাইলে তখন মা বাবাকেও এরকম স্যালুট দিবে এবং উপঢৌকন দিবে। মাতৃত্বের আর পিতৃত্বের উপঢৌকন দিবে। বলেন কত বড় মর্যাদা?”

উপরোক্ত বয়ানে উদ্ধৃত হাদীসটির কোন বাস্তবতা আছে কি না? দয়া করে দলীলের আলোকে জানাবেন।

উত্তর

بسم الله الرحمن الرحيم

এ সংক্রান্ত একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। সেটি হলো:

أنبأنا أبو الحسن علي بن المسلم ثنا عبد العزيز بن أحمد أنبأنا تمام بن محمد أنبأنا أبو يعقوب الأذرعي حدثنا أبو بكر محمد بن عثمان الأذرعي حدثنا أبو عبيد محمد بن حسان الأذرعي ثنا محمد بن خالد ثنا كثير بن سليم قال سمعت أنس بن مالك يقول قال رسول الله (صلى الله عليه وسلم) ‌في ‌الجنة ‌نهر ‌يقال ‌له ‌الريان عليه مدينة من مرجان لها سبعون ألف باب من ذهب وفضة لحامل القرآن

হযরতে আনাস বিন মালেক রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: জান্নাতে একটি নহর থাকবে। যাকে ‘রাইয়্যান’ বলা হয়। তাতে মারজানের তৈরী একটি শহর থাকবে। যাতে থাকবে স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত সত্তর হাজার দরজা কুরআনের ধারকদের জন্য। [তারীখে দিমাশক লিইবনে আসাকীর-৫৪/১৯৯, বর্ণনা নং-১১৪৪৭, রাবী নং-৬৭৩৫]

ব্যস এতটুকুই ইবনে আসাকীর রহঃ তার তারীখে দিমাশক গ্রন্থে এনেছেন।

এ বর্ণনা বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের মন্তব্য হলো: আব্দুল লতীফ হুমাইম রহঃ মন্তব্য করেন:

إسناده موضوع؛ كثير بن سليم الضبي؛ قال يحيى والدارقطني: (ضعيف). وقال النسائي: (متروك). وقال أبو زرعة: (واهي الحديث). وقال ابن حبان: (هو كثير بن عبد اللَّه يروي عن أنس ويضع عليه)

এর সনদ জাল। উক্ত হাদীস বর্ণনাকারী কাসীর বিন সালীম বিষয়ে ইয়াহইয়া বিন মাঈন এবং ইমাম দারা কুতনী রহঃ বলেন: সে জঈফ। ইমাম নাসায়ী রহঃ বলেন: সে পরিত্যাজ্য। ইমাম আবূ যুরআ রহঃ বলেন: সে অতিশয় দুর্বল বর্ণনাকারী। এবং ইবনে হিব্বান রহঃ বলেন: কাসীর হযরত আনাস রাঃ থেকে হাদীস বর্ণনা করে এবং সে তাঁর থেকে বানোয়াট বর্ণনা করে থাকে। [আলমওসূআতুল হাদীছিয়্যাহ-২২/৩০৫, বর্ণনা নং-২৭২৯]

জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহঃ মন্তব্য করেন:

ابن عساكر عن أنس وفيه كثير بن سليم متروك

ইবনে আসাকীর এটি আনাস রাঃ থেকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর সনদে ‘কাসীর বিন সালীম’ আছেন। যিনি হাদীস বর্ণনায় পরিত্যাজ্য। [জামিউল আহাদীস-১৪/৪৭৯, বর্ণনা নং-১৪৭৭৬]

একই মন্তব্য করেন: আলাউদ্দীন আলী বিন হুসামুদ্দীন কাযীখান রহঃ। [কানযুল উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফআল-১/৫৫০, বর্ণনা নং-২৪৬৩]

এর মানে এ হাদীস সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং জাল। এতে কোন প্রকার সন্দেহ নেই।

এমন একটি জাল বর্ণনা এতোটা আত্মবিশ্বাসের সাথে বর্ণনা করার সাথে সাথে মাওলানা নিজের পক্ষ থেকে আরো কিছু বানোয়াট কথা সংযুক্ত করে আরো মারাত্মক জঘন্য কাজ করেছেন।

নবীজীর হাদীস নিয়ে এমন মিথ্যাচার আমাদের যারপরনাই বিস্মিত করে।  

উক্ত বক্তা ‘রাইয়্যান’ শব্দকে বারবার ‘রাইআন’ বলে ভুল শব্দ প্রয়োগের সাথে সাথে সেসব বিষয় নিজের পক্ষ থেকে বৃদ্ধি করেছেন:

প্রত্যেক গেটে সত্তর হাজার ফেরেশতা থাকবে।

চারশ নব্বই কোটি ফেরেশতা স্যালুট দিবে।

চারশ নব্বই কোটি ফেরেশতা আলাদা আলাদা উপহার দিবে।

ফেরেশতারা বলবে: এটা কুরআনের সম্মানার্থে দেয়া হলো।

উক্ত শহরে হাফেজের মা বাবারা বেড়াতে যাবে।

হাফেজদের মা বাবাকেও চারশ নব্বই কোটি ফেরেশতা স্যালুট ও উপহার দিবে।

সুতরাং এ হাদীস সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং জাল। এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই।

সেইসাথে এমন জাল বর্ণনার সাথে নিজের পক্ষ থেকে আরো বানোয়াট কথা সংযুক্ত করায় উক্ত বক্তা সাহেবের তওবা করত: উম্মতের সামনে এ ভুল সংশোধনী দেয়া আবশ্যক।

নতুবা এমন বানোয়াট বর্ণনাকারীর বয়ান শোনা জায়েজ নেই।

والله اعلم بالصواب

উত্তর লিখনে

লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

পরিচালক-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া ইসলামিয়া দারুল হক লালবাগ ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা: জামিয়াতুস সুন্নাহ কামরাঙ্গিরচর, ঢাকা।

উস্তাজুল ইফতা: কাসিমুল উলুম আলইসলামিয়া, সালেহপুর আমীনবাজার ঢাকা।

পরিচালক: শুকুন্দী ঝালখালী তা’লীমুস সুন্নাহ দারুল উলুম মাদরাসা, মনোহরদী নরসিংদী।

শাইখুল হাদীস: জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, সনমানিয়া, কাপাসিয়া, গাজীপুর।

ইমেইল[email protected]

0Shares

আরও জানুন

মাগরিবের আজানের পর কিভাবে তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামায পড়বে?

প্রশ্ন মাগরিবের আযান ও একামতের মাঝে যদি কোন নামাজ না পড়া যায়, তাহলে আযানের সাথে …