প্রশ্ন
আসসালামু আলাইকুম
ফিকহে হানাফী অনুযায়ী হজে পাথর নিক্ষেপ করতে ভুলে গেলে কাফফারা দিতে হয় বলে আমি জেনেছি।
কিন্তু সহীহ বুখারীর ৮৩ নং হাদিসে বলা আছে পাথর নিক্ষেপ করতে ভুলে গেলে কোন ক্ষতি নেই,কাফ্ফারা দেওয়ার কথা বলা হয় নি।
কিন্তু ফিকহে হানাফির কোন ফতোয়াই দলিলবিহীন নয় বলেই আমি মনে করি।
তাই পাথর নিক্ষেপ করতে ভুলে গেলে কাফফারা দেওয়ার সুস্পষ্ট কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক দলিল জানতে চাচ্ছি।
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
হজ্জ্বের সময় ইয়ামুন নহরে চারটি কাজ করা হয়। যথা, রমী, নহর, হলক বা কছর এবং তাওয়াফে যিয়ারত।
এ চার কাজে ধারাবাহিকতাও এটাই। প্রথমে রমী করবে। তারপর নহর করবে। তারপর হলক করবে। তারপর তাওয়াফে যিয়ারত করবে।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হজ্জের আমল দ্বারা এমনটিই প্রমাণিত। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২৯৫০, ৩১৫২]
كما فى حديث جابر الطويل عند مسلم فى صحيحه، فى كتاب الحج، باب حجة النبى صلى الله عليه وسلم رقم- 2950، ففيه ذكر الأمور الثلاثة سوى الحلق، وذكر الحلق فى حديث أنس عند مسلم فى صحيحه فى كتاب الحج، باب بيان أن السنة يوم النحر أن يرمى ثم ينحر ثم يحلق، رقم-3152)
ইমাম আবূ হানীফা রহঃ এর মতে প্রথম তিনটির উপরোক্ত তারতীব রক্ষা করা ওয়াজিব। আগপর হয়ে গেলে দম ওয়াজিব হবে।
ইমাম আবূ ইউসুফ রহঃ এবং ইমাম মুহাম্মদ রহঃ সহ জমহুরদের মতে তারতীব ওয়াজিব নয়। সুতরাং আগপর হয়ে গেলে দম ওয়াজিব হবে না।
[আলমুগনী-৩/২৩১, ২৩০, আলমাজমূ শরহুল মুহাজ্জাব-৮/১৬০, ৮/২১৬, হেদায়া মাআ ফাতহুল কাদীর-২/৪৬৯, আলবাহরুর রায়েক-৩/২৪-২৫, বাদায়েউস সানায়ে-২/১৫৮]জমহুরদের দলীল বুখারী শরীফের উপরোক্ত হাদীস। যেখানে রমী করার আগে কুরবানী করা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে নবীজী উত্তর দিয়েছেন “রমী কর, কোন সমস্যা নেই”।
হাদীসের শেষে রাবী আরো পরিস্কার শব্দেই বলে দিলেন যে,
فَمَا سُئِلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ شَيْءٍ قُدِّمَ وَلاَ أُخِّرَ إِلَّا قَالَ: «افْعَلْ وَلاَ حَرَجَ»
‘নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন পূর্বে বা পরে করা যে কোন কাজ সম্পর্কেই জিজ্ঞাসিত হচ্ছিলেন, তিনি এ কথাই বলেছিলেনঃ কর, কোন ক্ষতি নেই। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৮৩, ১৭৩৬]
ইমাম আবূ হানীফা রহঃ এর মতের দলীল হল, হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ এর ফাতওয়া। যা ইবনে আবী শাইবা রহঃ নকল করেছেন:
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: «مَنْ قَدَّمَ شَيْئًا مِنْ حَجِّهِ أَوْ أَخَّرَهُ، فَلْيُهْرِقْ لِذَلِكَ دَمًا»
ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি হজ্জের মাঝে কোন রুকন আগপিছ করে তাহলে এ কারণে দম দিতে হবে। [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-৩/৩৪৫, হাদীস নং-১৪৯৫৪,৫৮]
এ বর্ণনায় ইবরাহীম বিন মুহাজির নামে একজন রাবী আছেন।
যাকে মুহাদ্দিসগণের মাঝে কেউ কেউ জঈফ বলেছেন।
তবে অনেক মুহাদ্দিসগণই তাকে তাসদীক বা তার মাঝে কোন সমস্যা নেই বলে মন্তব্য করেছেন।
ইমাম সুফিয়ান সাওরী বলেছেন, তার মাঝে কোন সমস্যা নেই।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহঃ বলেছেন, তার ব্যাপারে কোন সমস্যা নেই।
আব্দুর রহমান বিন মাহদী রহঃ ও তার মাঝে কোন সমস্যা আছে বলে মনে করতেন না। ইয়াহইয়া বিন মাঈন রহঃ ইবরাহীম বিন মুহাজিরকে তার সামনে জঈফ বললে, তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে যান। এবং একথাকে খুবই অপছন্দ করেন। ইমাম আবু দাউদ হাদীসের ক্ষেত্রে গ্রহণীয় বলে মন্তব্য করেছেন। ইবনে সা’দ তাকে সিক্বা বলে মন্তব্য করেছেন। [আলজরহু ওয়াততা’দীল-২/১৩৩, রাবী নং-৪২১, তাহযীবুত তাহযীব-১/১৬৭-১৬৮, রাবী নং-৩০১, মীযানুল ই’তিদাল-১/৬৭, রাবী নং-২২৫]
ইমাম মুসলিম রহঃ তার কিতাব সহীহ মুসলিমে তার থেকে হাদীস এনেছেন। যেমন হাদীস নং-৩৩২।
এছাড়া সুনান চতুষ্টয় তথা সুনানে ইবনে মাজাহ, সুনানে আবূ দাউদ, সুনানে তিরমিজী এবং সুনানে নাসায়ীতেও ইবরাহীম বিন মুহাজির থেকে অনেক হাদীস আনা হয়েছে।
সুতরাং ইবরাহীম বিন মুহাজিরকে অকাট্যভাবে জঈফ বলার কোন সুযোগ নেই।
এছাড়া ইমাম তাহাবী রহঃ তার কিতাব “শরহু মাআনিল আছার” এ উক্ত বর্ণনাটি ভিন্ন আরেকটি সূত্রে এনেছেন। যাতে ইবরাহীম বিন মুহাজির নেই। [তাহাবী শরীফ-১/৪৯৩]
সুতরাং ইবনে আব্বাস রাঃ এর ফাতওয়াটি বিশুদ্ধ। এতে আর সন্দেহ বাকি থাকে না।
ইবনে আব্বাস রাঃ এর মত একই ফাতওয়া প্রদান করতেন জাবের বিন জায়েদ, সাঈদ বিন যুবায়ের এবং ইবরাহীম নাখয়ী। [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-৩/৩৪৫, বর্ণনা নং-১৪৯৫৩, ১৪৯৫৫, ১৪৯৫৮, ১৪৯৫৭]
বুখারীর হাদীসের জবাব কী?
বুখারীতে বর্ণিত “আগপর করার পরও নবীজীর উত্তর ‘কোন সমস্যা নেই’ দ্বারা উদ্দেশ্য কী?
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, না জানার কারণে, বা ভুলে আগপর করে ফেলার দ্বারা কোন গোনাহ হবে না। কিন্তু দম মাফ হবার কথা উক্ত বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়নি।
সুতরাং দম আবশ্যক থাকবে। যদিও ভুল বা না জানার কারণে আগপিছ করায় গোনাহ হবে না।
যেহেতু ইসলামের প্রথম হজ্জ্ব ছিল সেটা। তাই সাহাবায়ে কেরাম সকলে হজ্জ্বে আরকানসমূহ ও তারতীবসমূহ ভালোভাবে তখনো জানতেন না। তাই ভুল করায় নবীজী এ সুযোগ দিয়েছেন। এর মানে না জেনে করার কারণে “সমস্যা নেই” মানে হল, গোনাহ হবে না। কিন্তু দম মাফ করা হয়নি।
যেহেতু বর্তমানে হজ্জ্বের সকল আরকান পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। সুতরাং কেউ যদি ইচ্ছেকৃত এমন করে থাকে, তাহলে গোনাহও হবে আবার দমও আবশ্যক হবে। [তাহাবী শরীফ-১/৪৯২]
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউন এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
ইমেইল– [email protected]