প্রশ্ন
আসসালামুআলাইকুম।
ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা না পড়লে কি মুক্তাদীর নামায হবে না? এর আলোকে বক্তব্যটি লেখাটি পড়ে আমার খুব ভালো লাগছে।
কিন্তু লা মাযহাবীরা যে বলে সূরা ফাতিহা কেরাত নয়। এটি হচ্ছে কুরআনের বাহিরে। এবং এটি কুরআনের মেরদন্ড। তাহলে কি হবে?
ধন্যবাদ
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
লা মাযহাবী বন্ধুদের সূরা ফাতিহা বিষয়ক মানসিকতা বড়ই আশ্চর্য প্রকৃতির।
এ মাসআলায় তাদের বক্তব্য ও আচরণ পুরোটাই বিপরীতমুখী ও হাস্যকর।
কয়েকটি পয়েন্ট তুলে ধরছিঃ
সূরা ফাতিহা বিষয়ে লা মাযহাবীদের অদ্ভুত হালত
১
একদিকে বলছে যে, সূরা ফাতিহা এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা সকল মুসল্লিদের পড়তেই হবে। যদি কোন মুসল্লি ইমামের পিছনেও তা না পড়ে তাহলে তার নামাযই হবে না।
অপরদিকে সেই সূরা ফাতিহাকে কুরআনের অংশ হওয়া অস্বিকার করছে।
এ যেন, বিবিকে ভালোবাসার কথা বলে তিন তালাক দিয়ে বের করে দেয়ার মতই।
২
আরো আশ্চর্যের বিষয় হল, একদিকে বলছে যে, সূরা ফাতিহা কুরআনের অংশ নয়, আবার বলে সূরা ফাতিহা কুরআনের মেরুদণ্ড।
এ বোকাদের কে বুঝাবে যে, মেরুদণ্ড শরীর থেকে আলাদা হলে সেটি আবার পূর্ণাঙ্গ শরীর কিভাবে হয়?
তেমনি সূরা ফাতিহা যদি কুরআনের মেরুদণ্ড হয়, তাহলে সূরা ফাতিহা ছাড়া কুরআন কিভাবে পূর্ণতা পায়?
৩
একদিকে বলে যে, সূরা ফাতিহা ইমামের পিছনে মুসল্লিরা না পড়লে মুসল্লিদের নামায হবে না, আবার ওদেরই একদল বলে যে, ইমামকে রুকুতে পেলে মুসল্লি সূরা ফাতিহা পড়তে না পারলেও তার নামায হয়ে যাবে।
কি আশ্চর্য। যদি সূরা ফাতিহা মুসল্লি না পড়লে নামায না’ই হয়, তাহলে রুকু পেলে উক্ত রাকাত গণ্য হয় কিভাবে?
৪
একবার বলছে যে, সূরা ফাতিহা কুরআনের মা। আবার বলছে যে, সূরা ফাতিহা কিরাত নয়।
যদি সূরা ফাতিহা কিরাত না হয়, তাহলে পৃথিবীর সমস্ত কুরআনে সূরা ফাতিহা কেন রাখা হয়? আর কেনইবা কুরআন হিসেবে তা তিলাওয়াত করা হয়?
তাহলে লা মাযহাবী বন্ধুরা কি বলতে চান যে, কোন ব্যক্তি যদি সূরা ফাতিহা কিরাত হিসেবে পড়ে,তাহলে কুরআন কিরাত পড়ার কোন সওয়াব পাবে না?
সূরা ফাতিহা কিরাত নয়?
তাদের এ গুঁজামিল ও বিদঘুটে অবস্থান বুঝার পর এবার দালিলীকভাবে আমাদের বুঝতে হবে যে, লা মাযহাবী বন্ধুরা মুখে মুখে হাদীস মানার দাবী করলেও মূলত ওরা মুনকিরীনে হাদীস। কারণ, সূরা ফাতিহা কিরাত হবার প্রমাণ পরিস্কার শব্দে হাদীসে আসছে।
যেমন-
(১) হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يستفتح الصلاة بالتكبير والقراءةَ بالحمد لله رب العالمين.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকবীরের মাধ্যমে নামায শুরু করতেন এবং ‘আল-হামদু লিল্লাহি রাবিবল আলামীন’-এর মাধ্যমে কিরাত শুরু করতেন।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৯৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৭৭৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৫০৭; মুসনাদে আহমদ ৬/৩১
এই হাদীসে সুস্পষ্টভাবে সূরা ফাতিহাকে ‘কিরাত’ বলা হল।
(২) হযরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন-
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا نهض من الركعة الثانية استفتح القراءة “بالحمد لله رب العالمين”.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দ্বিতীয় রাকাত থেকে উঠে দাঁড়াতেন তখন ‘আল-হামদু লিল্লাহি রাবিবল আলামীন’-এর মাধ্যমে কিরাত শুরু করতেন।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৯৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৮১৪; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ১৯৬৩
এ হাদীসেও সূরা ফাতিহাকে ‘কিরাত’ বলা হল।
(৩) হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم وأبو بكر وعمر يستفتحون القراءة “بالحمد الله رب العالمين”.
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বকর এবং উমর রা. ‘আলহামদুলিল্লাহি রাবিবল আলামীন’-এর মাধ্যমে কিরাত শুরু করতেন।’ -ইমাম বুখারী, জুযউল কিরাআত খালফাল ইমাম, হাদীস ৭৭৮; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ৯০২; ইবনে মাজাহ, হাদীস ৫০৮; মুসনাদে আহমাদ ৩/১০১
(৪) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-
صليت خلف النبي صلى الله عليه وسلم وأبي بكر وعمر وعثمان رضي الله عنهم يستفتحون القراءة “بالحمد لله رب العالمين”
আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বকর, উমর ও উসমান রা.-এর পিছনে নামায আদায় করেছি। তাঁরা প্রত্যেকেই ‘আল-হামদু লিল্লাহি রাবিবল আলামীন’-এর মাধ্যমে কিরাত শুরু করতেন।’ -ইমাম বুখারী, জুযউল কিরাআত খালফাল ইমাম, হাদীস ১৩০
তো এতগুলো সহীহ হাদীসে সূরা ফাতিহা পড়াকে কিরাত বলা হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীন থেকে প্রমাণিত হল যে, সূরা ফাতিহা পড়াও কিরাত। এরপরও কি আমাদের ঐ বন্ধুরা বলবেন- সূরা ফাতিহা পড়া কিরাত নয়?
সূরা ফাতিহা কুরআন নয়?
লা মাযহাবী বন্ধুরা সূরা ফাতিহাকে কুরআন থেকে বের দেবার কুফরী মানসিকতাকে প্রমাণ করার জন্য অদ্ভুত এক যুক্তির অবতারণা করে থাকে। সেটি হল,
وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعًا مِّنَ الْمَثَانِي وَالْقُرْآنَ الْعَظِيمَ [١٥:٨٧
আমি আপনাকে সাতটি বারবার পঠিতব্য আয়াত এবং মহান কুরআন দিয়েছি। {সূরা হিজর- ৮৭}
সূরা হিজরের উপরোক্ত আয়াতে প্রথমে সূরা ফাতিহার কথা বলা হয়েছে, তারপর এবং বলে কুরআনের কথা বলা হয়েছে।
লা মাযহাবী মুযাফফর বিন মুহসিন তার বিতর্কিত বই ‘জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লামের ছালাত’ নামক বইয়ের মাঝে লিখেছেন যে, যদি সূরা ফাতিহা কুরআনই হতো, তাহলে সূরা ফাতিহা আলাদাভাবে কেন উল্লেখ করা হল? আলাদা উল্লেখ করাই প্রমাণ করে যে, সূরা ফাতিহা কুরআন থেকে আলাদা
ইন্নালিল্লাহ। এই যদি এসব শায়েখদের জ্ঞানের অবস্থা। তাহলে ওদের হাতে দ্বীন কতোটা নিরাপদ তা ভাবা দরকার।
‘এবং’ বলে আলাদা উল্লেখ করার কারণে যদি সূরা ফাতিহা কুরআন থেকে আলাদা হয়ে যায় তাহলে একই যুক্তিতে কুরআনের বাকি কিছু আয়াতও যাচাই করা দরকার। যেমন-
تَعْرُجُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ (4
ফেরেশতাগণ এবং রূহ আল্লাহ তা’আলার দিকে উর্ধ্বগামী হয় এমন একদিনে, যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর। {সূরা মাআরিজ-৪}
এ আয়াতে প্রথমে বলা হয়েছে ফেরেস্তার কথা তারপর ‘এবং’ বলে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে রূহ তথা জিবরাঈল আঃ এর কথা।
ফেরেশতার কথা বলার পর আবার আলাদা করে ‘এবং’ বলে জিবরাঈলের কথা কেন বলা হল? এর মানে কি জিবরাঈল ফেরেশতা নয়?
একজন সাধারণ ইলমওয়ালাও বুঝবে যে, আলাদাভাবে উল্লেখ করার কারণ হল জিবরাঈলে শ্রেষ্ঠত্ব বুঝানো। ফেরেস্তা থেকে বাদ দেয়া উদ্দেশ্য নয়।
আরেকটি আয়াত দেখা যেতে পারে-
فِيهِمَا فَاكِهَةٌ وَنَخْلٌ وَرُمَّانٌ (68
তথায় [জান্নাতে] আছে ফল-মূল, খর্জুর ও আনার। {সূরা আররাহমান-৬৮}
সূরা আররহামানের উক্ত আয়াতে প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে ফলমুল তারপর ‘এবং’ বলে আলাদাভাবে পরপর খেজুর ও আনারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সূরা ফাতিহা বিষয়ক লা মাযহাবী বন্ধুদের অদ্ভুত যুক্তি অনুপাতে এখানেওতো বলা দরকার যে, ফলমূল বলার যেহেতু ‘এবং’ বলে আলাদাভাবে খেজুর ও আনারের কথা বলা হয়েছে, সুতরাং খেজুর ও আনার কোন ফল নয়?
এমন আহমকী মানসিকতা যারা রাখেন, তাদের আর যা’ই কিছু বলা হোক সুস্থ্য মস্তিস্কের মানুষ বলার সুযোগ নেই।
আশা করি পরিস্কার হয়ে গেছে যে, সূরা ফাতিহাকে সূরা হিজরে মূলত আলাদাভাবে উল্লেখের কারণ হল, কুরআনের সূরার মাঝে সূরা ফাতিহার শ্রেষ্ঠত্ব তোলে ধরা। কুরআন থেকে এ সূরাটিকে বাদ দেয়া নয়। যেমন সুরা মাআরিজ ও সূরা রহমানের আয়াত দ্বারাও বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেল।
সূরা ফাতিহা শুধু কুরআনই নয় বরং, কুরআনের প্রধানতম সূরা। যা বিশুদ্ধ হাদীসের আলোকে প্রমাণিত। যেমন-
একটি দীর্ঘ হাদীসে হযরত আবু সাঈদ ইবনুল মু’আল্লা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন-
ألا أعلمك أعظم سورة في القرآن قبل أن أخرج من المسجد، فذهب النبي صلى الله عليه وسلم يخرج من المسجد، فذكرته فقال : الحمد لله رب العالمين هي السبع المثاني والقرآن العظيم الذي أوتيته.
অর্থ : মসজিদ থেকে বের হওয়ার আগেই কি কুরআনের সবচে মর্যাদাপূর্ণ সূরা আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব না? অতপর যখন তিনি মসজিদ থেকে বের হতে উদ্যত হলেন, আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলাম। তিনি বললেন, তা হল, ‘আলহামদু লিল্লাহি রাবিবল আলামীন…।’ এটাই হল ‘সাবআ মাছানী’ তথা বারবার পঠিত সাত আয়াত এবং মর্যাদাপূর্ণ কুরআন যা আমাকে দান করা হয়েছে।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭০৩, ৪৪৭৪
এই হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা ফাতিহাকে শুধু কুরআনের অংশ বলেই ক্ষান্ত হননি; বরং কুরআনের সবচে মর্যদাপূর্ণ সূরা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আর এ-ও বলে দিয়েছেন যে, আয়াতে ‘আল কুরআনুল আযীম’ দ্বারা সূরা ফাতিহা উদ্দেশ্য। কুরআনের অতি গুরুত্বপূর্ণ সূরা হওয়ার কারণে একে القرآن العظيم বলা হয়েছে।
উপরোক্ত দীর্ঘ আলোচনার আলোকে আশা করি পরিস্কার হয়ে গেছে যে, লা মাযহাবী বন্ধুদের সূরা ফাতিহাকে কুরআন থেকে বের করে দেয়া এবং কিরাত হবার বিষয়টি অস্বিকার করা কুরআন ও হাদীস অস্বিকার করার নামান্তর।
আল্লাহ তাআলা আমাদের লামাযহাবীদের ফিতনা থেকে উম্মতকে হিফাযত করুন। আমীন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক ও প্রধান মুফতী-তা’লীমুল ইসলাম ইনস্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
ইমেইল– [email protected]
অনেক ভালো তাফসীর