আবূ মুয়াবিয়া লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
ইতিহাস রচয়িতাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা
ঐতিহাসিক ঘটনা লিপিবদ্ধকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন ধরণের হয়। কেউ কট্টর শিয়া, কেউবা খারেজী। একইভাবে বর্ণনাকারীদের মানসিকতার মাঝে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য।
ঘটনা বর্ণনাকারীর বর্ণনার ধরণের কারণে ঘটনা বিকৃত হয়ে যায়। কারণ ঘটনা বর্ণনায় বর্ণনাকারীর ব্যবহৃত শব্দাবলীর উপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। যেহেতু ইতিহাস বিষয়ে হাদীসের মত শব্দ হিফাযতের দিক এতোটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তাই এখানে প্রচুর পরিমাণ অর্থগত বা সমঝ অনুপাতে শব্দ জুড়ে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই বর্ণনাকারীরা তার নিজস্ব মানসিকতা ও বোধ-বুদ্ধি অনুপাতে ঘটনা বর্ণনা করেন। এক ঘটনা শুধু বর্ণনার বিকৃতির কারণে পুরাই পাল্টে যেতে পারে। যার ফলে একটি সুন্দর ও শালীন বিষয়টাও অশালীন ও অভিযোগের কাঠগড়ায় পতিত হয়ে যায়।
মোটকথা, ইতিহাস বর্ণনাকারীদের নিজস্ব মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ এর জীবন ও শাসনামল সম্পর্কে। তাই এত বেশি অভিযোগ ও অপবাদ তার জীবন ও শাসনকালকে ঘিরে ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়।
সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কিত ইতিহাস পাঠের মূলনীতি
অভিযোগ ও অভিযোগের জবাব বিষয়ে মূলনীতি হল, যদি কোন অভিযোগের ভিত্তি এমন বর্ণনার উপর হয়, যা বর্ণনা হিসেবে গ্রহণযোগ্য তাহলে সেই অভিযোগের জবাব দেয়া হবে। আর যদি বর্ণনাটি ‘রেওয়াত গ্রহণ বর্জন নীতিমালা’ হিসেবে গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে এমন অভিযোগের দিকে ভ্রুক্ষেপই করা হবে না। জবাব দেয়ারও কোন প্রয়োজন নেই।
উলামায়ে কেরাম লিখেছেনঃ
فترد كم من روايات التاريخ ما يعود منها على شين وعيب فى بعض اصحاب الرسول صلى الله عليه وسلم (احكام القرآن لمفتى محمد شفيع-4/274، بحث خاتمة الكلام فى مشاجرات الصحابة
ঐতিহাসিক সেই বর্ণনা, যাতে কতিপয় সাহাবায়ে কেরামের দোষত্রুটি প্রকাশ করে, সেই সমস্ত বর্ণনাগুলো বর্জনীয়। [আহকামুল কুরআন, মুফতী শফীকৃত-৪/২৭৪]
আল্লামা সাখাবী রহঃ লিখেনঃ
وكل حديث رأيته يخالفه العقول او يناقص الأصول فاعلم أنه موضوع، فلا يتكلف اعتباره اى لا تعتبر رواته ولا تنظر فى جرههم او يكون مما يدفعه الحس والمشاهدة او مباينا لنص الكتاب او السنة المتواترة او الاجماع القطعى حيث لا يقبل شيء من ذالك التاويل (فتح المغيث شرح الفية الحديث-249-250)
প্রত্যেক এ হাদীস যা স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনার বিপরীত হয় এবং শরয়ী মূলনীতির খেলাফ হয় সে বর্ণনার ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে জেনে রাখুন এটি ভিত্তিহীন। সুতরাং এমন বর্ণনা গণনায় ধরা হবে না। অর্থাৎ বর্ণনাটির রাবীদের কোন হিসেবে ধরা হবে না। তার গ্রহণবর্জন বিষয়ক আলোচনারও প্রয়োজন নেই।
দ্বিতীয়ত যে বর্ণনাগুলো স্বাভাবিক জ্ঞান বিবেচনার এবং বাহ্য-সত্যের বিপরীত পাওয়া যাবে, এবং কুরআন ও হাদীসের মুতাওয়াতির বর্ণনার উল্টো হবে এবং অকাট্য ইজমার বিরোধী হবে এমন সুরতেও উক্ত বর্ণনা গ্রহণীয় হবে না। [ফাতহুল মুগীছ শরহে আলফিয়াতিল হাদীস, ইমাম সাখাকীকৃত-২৪৯-২৫০]
এছাড়া আকাবীরে উলামাগণ হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ এর নাম নিয়েও অনেকে মূলনীতি বয়ান করেছেন যে, হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর দোষত্রুটি বিষয়ক হাদীসগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট। এসবের কোন মূল্য নেই। [আলমানারুল মুনীফ ফিসসহীহি ওয়াজ জঈফ, ইবনুল কাইয়্যিমকৃত-১১৭]
ইবনুল কাইয়্যিম রহঃ লিখেছেনঃ
ومن ذالك الاحاديث فى ذم معاوية رضى الله عنه….. وكل حديث فى ذمه فهو كذب (المنار المنيف فى الصحيح والضعيف-117
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথাই প্রমাণিত যে, উলামায়ে কেরামের মতে হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ সম্পর্কিত দোষত্রুটি ও সমালোচনা নির্ভর বর্ণনাগুলো অগ্রহণীয়। সেই সাথে ভ্রুক্ষেপযোগ্য গুরুত্ব রাখে না।
উলামায়ে কেরাম একথা পরিস্কার লিখেছেন যে, আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহি সালাম সকলে মাসূম তথা নিষ্পাপ। এটি কেবল তাদেরই বৈশিষ্ট্য। এছাড়া সাহাবায়ে কেরাম ও উম্মতের অন্যান্য বুযুর্গগণ এ বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত নন। তাদের থেকে ভুলত্রুটি হতে পারে। [আর রফউ ওয়াত তাকমীল, আব্দুল হাই লৌক্ষ্ণবী -১৭১]
فان العصمة عن الخطاء مطلقا من خواص الانبياء ولا توجد فى الصحابة فضلا عن الاولياء (الرفع والتكميل لعبد الحيئ لكهنووى-171
কিন্তু উলামায়ে কেরাম একথাও লিখেছেন যে, যদি সাহাবায়ে কেরাম থেকে কোন ভুলত্রুটি সংগঠিত হয়, তাহলে সেটির মাঝে কোন প্রকার সুন্দর ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়, তাহলে সে ব্যাখ্যা করতে হবে। আর যদি সুন্দর ব্যাখ্যা করা সম্ভব না হয়, তাহলে বর্ণনাটিকে বর্জন করতে হবে। এ বিষয়ে মুখ খোলা থেকে বিরত থাকবে। তাদের ব্যাপারে সমালোচনা করা থেকে নিজেকে অবশ্যই বিরত রাখবে। কেননা, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সমস্ত সাহাবাগণকে ক্ষমা এবং জান্নাতী হবার ঘোষণা দিয়েছেন। [আননাহিয়াহ আন তা’নি মুয়াবিয়া-৩৩]
وان صدر عن احد من الصحابة ما لا يليق فلا يبعد عن الامكان ولما تشاجروا وقع بينهم التساب والتحارب وامور يتوحش المتامل فيها الا ان مذهبنا اهل السنة والجماعة هو بذل الجهد فى تاويلها واذا لم يمكن التاويل وجب رد الرواية ووجب السكوت وترك الطعن للقطع بان الحق سبحانه وعدهم المغفرة والحسنى (الناهية عن طعن معاوية-33
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উপরোক্ত মূলনীতির আলোকে আমরা সাহাবায়ে কেরামের জীবনেতিহাস এবং ইসলামের ইতিহাস পড়লে ও পর্যালোচনা করলে আমাদের কাছে অনেক বিষয়ই পরিস্কার হয়ে যাবে। সেই সাথে কোন একজন সাহাবী রাঃ এর প্রতি আমাদের কোন প্রকার খারাপ ধারণা আসবে না। এ মূলনীতির আলোকে সাহাবায়ে কেরাম রাঃ এর ব্যাপারে মন্দ কথা ও সমালোচনা করে নিজের আখেরাত বরবাদ করার ভয়ানক অবস্থা থেকে আমরা হিফাযত থাকতে পারি।
মুয়াবিয়া রাঃ বিরোধীদের শ্রেণী বিন্যাস
আমীরুল মু’মিনীন হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ এর বিরোধীতাকারীরা কয়েক প্রকারের। যেমন-
১
একদল হল শিয়া রাফেজী। এটি অনেক পুরানো দল। যাদের পুরো জিন্দেগী এবং ধর্মীয় আলোচনা বলতে হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ এর বিরোধীতা অন্যতম প্রধান বিষয়। এক্ষেত্রে মৃত্যু, কবর, হাশর এমন কি জান্নাত জাহান্নামকেও তারা কোন পরোয়া করে না। পুরো জিন্দেগীই এ মহান সাহাবীর উপর অভিশম্পাত করে থাকে।
২
একদল আবার প্রধানতম সাহাবীগণকে মোহাব্বতও করেন। তাদের শ্রেষ্ঠত্বও স্বীকার করেন। কিন্তু হযরত আলী রাঃ ও আহলে বাইতের প্রতি অধিক মোহাব্বত রাখেন। আর হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এর বিরোধীতা ও সমালোচনা করাকে আলী রাঃ ও আহলে বাইত রাঃ এর প্রতি অধিক মোহাব্বতের পূর্ণতা মনে করেন।
যদিও তাদের এ মানসিকতা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ন্যায়নিষ্ঠ ভারসম্যপূর্ণ মতাদর্শ ও মূলনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। এর দ্বারা আহলে সুন্নাতের ক্ষতি সাধিত হয় এবং শিয়া ফিরক্বার সহযোগিতা হয়ে থাকে। তাই এ মানসিকতা সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য।
৩
আরেকদল মোটাবুদ্ধি সম্পন্ন। যারা আহলে সুন্নাতের মৌলিক নীতিমালা ও ঐতিহাসিক ঘটনা পর্যালোচনার যথার্থ যোগ্যতা রাখে না। বরং এ সংক্রান্ত বর্ণনাগুলোর বাহ্যিক অবস্থা দেখে মুয়াবিয়া রাঃ এর প্রতি বিদ্বেষী ও বিরোধী হয়ে যায়।
এরা জ্ঞানের স্বল্পতার দরূন ভুল বুঝাবুঝির স্বীকার।
৪
সবচে’ ভয়ানক একদল হল, যারা নিজেকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারী দাবী করে, কিন্তু তার প্রাণপণ মেহনত ও প্রচেষ্টা হল, হযরত আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ কে উম্মতের সামনে সমালোচিত ও বিতর্কিত হিসেবে পেশ করা। গবেষণার নামে, ইতিহাস চর্চার নামে তারা এ গোমরাহী ছড়িয়ে থাকে।
এ দলটি নিজেকে আহলে সুন্নত দাবী করলেও মূলত আহলে সুন্নত নয়। বরং শিয়া রাফেজীদের দোসর। এরা মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টিকারী। ভ্রষ্টতা বিস্তারকারী।
এদের থেকে সতর্ক থাকা সকল মুসলমানদের জন্য জরুরী। তাদের লেখা পড়া, বক্তৃতা শোনা থেকে বিরত থাকা, সহজ কথায় এদেরকে বয়কট করা ঈমান ও আমল হিফাযতের জন্য সকলের জন্য আবশ্যক।